“শুভ দা অফিসে বেরোচ্ছ নাকি” ? বাইকটা প্যাসেজ থেকে বের করতে করতে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়
শুভময়। অনিকেত।পাড়ার ছেলে। প্রতিবেশী হলেও অনিকেত কে ভাইয়ের মতোই দেখে শুভময়।
“কিছু বলবি “?
“না তেমন কিছু নয়, আসলে তোমাকে দু দিন অফিস থেকে ফেরবার সময় যেভাবে দেখলাম, আমার
খুব একটা ভাল লাগল না “। অনিকেত গেটটা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।
“কি বলতো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ও তুই সমীরণ বাবুদের বাড়ির সমস্যায় আমার মধ্যস্থতা করতে
যাওয়ার কথা নিয়ে কিছু বলছিস কি “? কিছুটা বিস্ময় শুভময়ের গলায়।
“সে তো তুমি পাঁচজনের ঝামেলায় ছুটে যাও, সমাধান করো, সেটা না, আসলে এই রোগটা তো ভালমানুষ
খারাপ মানুষ বিচার করেনা, দুরত্ব মানছেনা কেউ, মাস্ক নেই অথচ রোগটা প্রতিদিনই চোখ রাঙাচ্ছে “
অনিকেতের গলায় উদ্বিগ্নতার সুর।
“ও তাই বল, ওসব নিয়ে ভাবিস না, আমি মানি বরাবর, অন্যদেরও বোঝাবার চেষ্টা করি.. আজ বুধবার
তুই রবিবার আয়, অনেক কথা আছে”, বেরিয়ে যায়, শুভময়।
২
শুভময় আর ওঁর স্ত্রী শিউলি আজ চারদিন একটা ঘরে নিজেদেরকে বন্দী করে রেখেছে ।
দিন পাঁচেক আগে অফিস থেকে ফিরে আসবার পর শুভময় শরীরের মধ্যে কেমন একটা
অস্বস্তি অনুভব করেন, পরের দিন দুজনেই একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা করে বোঝেন
তাঁরা স্বামী -স্ত্রী দুজনেই ওই ভয়ঙ্কর রোগের শিকার।
আজ তাঁদের পাঁচবছরের মেয়ে আর বৃদ্ধা মায়ের কাছ থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রেখেছে শুভময়।
একটু দূরে মামাতো ভাইয়ের বাড়ি। সেখানে আজ মা আর মেয়ের ঠিকানা।
একটু আগেই গোধুলির লাল আলো লুটোপুটি খাচ্ছিল শুভময়দের খিড়কি পুকুরের জলে। শিউলি ছাদের রেলিং ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আজ কদিন ঠিকমতো খেতে পারছেনা,
মেয়ের কথা ভেবে। শুভময় এগিয়ে এসে শিউলির কাঁধে হাত রাখে,”মন খারাপ করোনা, আর তো কটা দিন
সব ঠিক হয়ে যাবে “।” কি ঠিক হবে, আমাদের রোগ সেরে গেলে, নেগেটিভ রিপোর্ট হলে, আমরা
না হয় মা আর মেয়েকে কাছে পাবো,কিন্তু এই কয়েকদিনের মানসিক যন্ত্রণা, ভুল বোঝার ক্ষত,
এটা কি করে এড়াবো ? প্রতিবেশীর সাথে, কাছের বন্ধুর সাথে, ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, ছেলের সাথে,মেয়ের সাথে মায়ের, বাবার এই যে দুরত্ব এ আমি আর নিতে পারছিনা “। ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে শিউলি।
শুভ কিছুটা বিহ্বল। তাঁর দুটো চোখের পাতা ভিজে যায় । কান্নায় গলা বুজে আসে। তবু এতো
যুদ্ধ, এক বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক সে। ভেঙে পড়লে চলবে না। সেনাবাহিনীর কমান্ডার কাঁদতে জানেনা।
দলা পাকিয়ে আসা কান্নাটা আড়াল করে, শিউলির চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে খুব শান্ত গলায় বলে,
তুমি না ঝান্সীর রানী আর পদ্মিনীর ভূমিকা অভিনয় করেছিলে কলেজে, এত সহজে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে
পালিয়ে যাওয়া, হার মেনে নেওয়া, তোমারও নয় আমারও নয় কারোর শোভা পায়না।
“জানি, তাই তো দাঁতে দাঁত চেপে, লড়াই করছি, মেয়ে যখন মা মা বলে, গ্রিলের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে
ডাকছে, আমি ছুটে বাথরুমে গিয়ে চোখের জল আড়াল করছি, আর সবাইকে বলছি, ওকে নিয়ে যাও
আমার সামনে থেকে “
“জানি শিউলি, আমি শুধু তাকিয়ে আছি কাল সকালের দিকে, যেদিন এই দুরত্ব ঘুচে যাবে, আবার
পুব আকাশটা লাল হয়ে সূর্য উঠবে “, শুভময় শিউলির হাত টা জড়িয়ে ধরে মুষ্টিবদ্ধ করে।
সত্যি বলছো, আসবে! আসবে সে দিন, এমন দিন তো আমরা চাইনি”। শিউলির কান্নাভেজা গলায়
বিষাদ ঝরে পড়ে। “তাই যেন হয় গো”।
“কবি বলেছেন, “আরও বেঁধে বেধে থাক”, দুরত্ব বা ব্যবধান যদি থাকে শারিরীক, মানসিক নৈকট্য
আজ যেন হয় ততটাই গভীর, ব্যবধানহীন”, শিউলির চোখ থেকে নেমে আসা নোনা জলে
বাঁধ দেবার চেষ্টা করে শুভময়।
“হ্যা গো, এই অবিশ্বাস, দুরত্ব, সন্দেহ, ভয় – এসব চলে যাক, তার জন্য, যদি আমাদের প্রত্যেকের
জীবন অনেক আরাম, অনেক অর্থ, অনেক সুখ কমে যায়, যাক, তবু, তবু শান্তি, স্বস্তি,
ভয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস তো কাটবে! রোগ বিদায় নেবে”। শিউলির গলায় এক অন্যরকম সুর।
“কাটবেই, কাটতে হবেই। দানব কে বিদায় নিতেই হবে ! আমরা কিছু মানুষ আজও সত আছি, বিশ্বস্ত আছি
প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে,তাই আঁধার কাটবেই।
শুভময়, শিউলির কাঁধে হাত রাখে, তারপর চোখের দিকে চোখ স্থির রেখে বলে,
আমার এই কথাগুলো হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উঠে এসেছে, শিউলি, এই কথা মিথ্যা হবার নয়।
শুভময়ের চোখের পাতা ভিজে যায়। শিউলির দুচোখ ভাসিয়ে নেমে আসে বাঁধভাঙা বন্যার জল।
কলমে নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা