(এক)

দীপেন হিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করে, তুমি বিশ্বাস কর হিয়া, আমি ইচ্ছে করে এটা করিনি। ঘটনা পরম্পরায় পাকেচক্রে পড়ে শুভ্রাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। একদিন সব কথা আমি তোমায় খুলে বলব। আজ এটুকুই বলছি যে তোমার প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস ও ভালবাসা আছে। আমাকে তুমি তিনটা মাস সময় দাও লক্ষ্মীটী।
তিনমাস পরে কি হবে? হিয়া বলে, আমার পেটের সন্তান আরো বড় হবে আর আমি পেট ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেরাবো। তাই তো?
না সোনা, তা নয়, দীপেন আকুল হয়ে বলে, এই তিন মাসের মধ্যে একটা কিছু ঘটে যাবে, তুমি দেখ।
কি দেখব? হিয়া মুখ ঘুরিয়ে বলে।
শুভ্রা আমার আর তোমার জীবনে অন্তরায় হয়ে থাকবেনা, দীপেন বলে। তখন শুধু তুমি আর আমি আর আমাদের আগত সন্তান।
বাহ বাহ! বেশ সিরিয়েলের স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করে এসেছ মনে হচ্ছে, বিদ্রূপের ভঙ্গীতে হিয়া বলে, তুমি শুভ্রাকে ডাইভোর্স করবে?
না, দীপেন বলে, সেটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তোমাকে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে না। একটু থেমে দীপেন বলে, তোমাকে আমি বলেছি যে শুভ্রা সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। ওর হার্টে একটা প্রব্লেম আছে। ডাক্তার পই পই করে বলে দিয়েছেন যে হঠাৎ কোন উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় , সেটা ভয়ের হোক, দুঃখের হোক কিম্বা আনন্দেরই হোক, তার হৃৎযন্ত্র বিকল হয়ে তার মৃত্যু ঘটতে পারে।
তুমি কি সেই উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার জন্য অপেক্ষা করছ নাকি, তখনো হিয়ার কণ্ঠে বিদ্রূপের স্বর। যাক গে, তোমার ঐসব বাজে কথা শোনার ধৈর্য বা অবকাশ কোনটাই আমার নেই।

দীপেন হিয়ার হাত দুটো ধরতে গেলে হিয়া হাত সরিয়ে নেয়। দীপেন বলে, তুমি দেখে নিও তিন মাসের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি মিনতি করছি, তুমি আমাকে তিন মাস সময় দাও।
হিয়া ভুরু কুঁচকে বলে, তুমি কি শুভ্রাকে খুন করবে?
দীপেন দুহাতে তার কপালের রগ টিপে ধরে বলে, আমি জানিনা আমি কি করব হিয়া, আমি জানি না, তবে এটা স্থির নিশ্চয় যে তিন মাস পর শুভ্রা ইহজগতে থাকবে না।
হিয়া চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, শোন, আমার সন্তানের পিতাকে আমি খুনি বলে পরিচয় দিতে চাই না। তুমি আমায় ভুলে যাও আর আমার গর্ভের সন্তানের কথাও ভুলে যাও। এই আমার শেষ কথা, হিয়া চলে যাওয়ার উদ্যোগ করে।
দীপেন ও উঠে দাঁড়ায়, বলে, এখনো শেষ কথা বলার সময় হয় নি হিয়া। সময় শেষ কথা বলবে, তুমি দেখে নিও।
বেশিদিন একসঙ্গে থাকার ফলে পরস্পরের প্রতি অনুরাগের সৃষ্টি ও হতে পারে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কাজেই দেরি করা চলবে না, আর দেরি হয়ে গেলে হিয়ার মন ও ভেঙ্গে যেতে পারে, সে কলঙ্ক এড়াতে কিছু একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে ও পারে।
দীপেনের বিয়ে হয়েছে একমাসের কিছু বেশি হল। এর মধ্যে শুভ্রাকে যথেষ্ট সুস্থ মনে হচ্ছে। না, আর দেরি নয়, আজকেই সে যা করবার করবে, অন্ততঃ চেষ্টা করবে। অফিস থেকে ফেরার পথে দীপেন যা ভেবেছিল সেভাবে ক’টা জিনিষ কিনে নিয়ে এল।
সে আইনসঙ্গতভাবে বিবাহিত, তাই স্ত্রীর সঙ্গে এক শয্যায় শয়ন করতে হয়। কিন্তু দীপেন খুব সতর্ক থাকে। সে পূর্ণবয়স্ক যুবক এক সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী যুবতীর পাশে শয্যাগ্রহন করে যে কোন মুহূর্তে তার সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে পড়তে পারে, আর ফলে যদি শুভ্রার গর্ভসঞ্চার হয়ে যায় তাহলে আর কিছু করার থাকে না। দীপেন রাতে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় স্ত্রীর পাশে শোয়।
সেদিন অন্যান্যদিনের মতই দীপেন রাতে খাওয়ার পর নিজের ঘরে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। কিছুক্ষন পর শুভ্রা এসে বিছানার চাদর ঠিকঠাক করে একপাশে শুয়ে পড়ে। সে জানে যে দীপেন তাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেনি, করতে বাধ্য হয়েছে। তার নারীসুলভ ইন্দ্রিয় দিয়ে সে আন্দাজ করেছে যে তার স্বামীর অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। স্বামীর সঙ্গে তার কথাবার্তা খুব কম হয়। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
দীপেন যখন দেখল যে শুভ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে, সে কিভাবে তার পরিকল্পনাটা সফল করবে,চিন্তা করতে করতে আলগোছে স্ত্রীর স্পর্শ বাঁচিয়ে একপাশে সন্তর্পণে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। এক সময় সে তন্দ্রায় ঢুলে পড়ে।
কতক্ষন তন্দ্রাভাবটা ছিল দীপেন জানেনা, হঠাৎ তন্দ্রা ভেঙ্গে যায় একটা কোমল হাতের স্পর্শে। সে জেগে উঠে দেখে ঘুমন্ত শুভ্রার বাঁ হাতটা তার বুকের উপর। দীপেন মুখ ফিরিয়ে দেখে শুভ্রাকে। তার গায়ের রঙটা বেশ ফর্সা। এতদিন সে দেখেনি, আজ লক্ষ্য করে দেখল মুখশ্রী ও বেশ সুন্দর। ঠোঁটের কোনে একটা স্নিগ্ধ হাসি। গালে সামান্য টোল পড়ে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। দীপেনের দৃষ্টি চলে আসে শুভ্রার বক্ষদেশের উপর। শাড়ির আঁচল লুটিয়ে পড়েছে, ব্লাউজের ওপরের দুটো বোতাম খুলে গিয়ে তার পুরুষ্টু স্তনযুগলের সন্ধিস্থল দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে। দীপেন বেশিক্ষন তাকাতে পারে না, মুখ সরিয়ে নেয়। মনে হচ্ছে তার সংযম ভেঙ্গে যাবে। সে আস্তে করে শুভ্রার হাতটা সরিয়ে দেয়।
সে উঠে গিয়ে চাবি দিয়ে ওয়ার্ড্রোব খুলে খুব সন্তর্পনে কিনে আনা প্যাকেটটা খোলে। একটা ভয়ঙ্কর দর্শন মুখোশ আর যাত্রাদলের সাজ বিক্রির দোকান থেকে কেনা লম্বা লম্বা নখ বের করে। ঐ মুখোশ পড়ে লম্বা হাতের নখ দিয়ে সে শুভ্রাকে স্পর্শ করে জাগিয়ে দেবে। সে জেগে এই অদ্ভুত মুর্তি দেখলে, যদি ডাক্তারবাবু সঠিক বলে থাকেন, তবে নির্ঘাত শুভ্রা মূর্ছা যাবে এবং হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার ও সমূহ সম্ভাবনা। মুখোশ আর নখগুলো কাল সকালে রাস্তার পারের খালে ফেলে দিলে আবর্জনার সঙ্গে মিশে হারিয়ে যাবে, কেউ কিছু জানতে পারবে না।
চমকে ওঠে দীপেন হঠাৎ শুভ্রার গলা শুনে , ও, তুমি? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম চোর টোর ঢুকল নাকি। কি খুজছ তুমি?
দীপেন আমতা আমতা করে বলে, না , সিগারেটের একটা প্যাকেট রেখেছিলাম। পাচ্ছি না।
সেটাতো আমি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছি।
দীপেন জিনিষগুলো তাড়াতাড়ি প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেট বের করে চেয়ারে বসে একটা ধরায়। তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। তার মানে শুভ্রা ওয়ার্ড্রোব খুলেছিল। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, শুভ্রা বলে, ভেতরটা বড্ড অগোছালো হয়ে আছে দেখে গোছাতে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা দেখতে পাই।
একটু থেমে শুভ্রা বলে, ভেতরে একটা প্যাকেটে মুখোশ জাতীয় আর কিসব দেখতে পেলাম। বাচ্চাদের কোন নাটক করাচ্ছ নাকি।
দীপেনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা, গলায় সিগারেটের ধুঁয়া আটকে দম বন্ধ হয়ে যায় আর কি। শুভ্রা তাড়াতাড়ি উঠে এক গ্লাস জল এনে তার হাতে দেয়। দীপেন জলটা খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বলে, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? শুয়ে পড়।
শুভ্রা নিঃশব্দে গিয়ে তার জায়গায় শুয়ে পড়ে। দীপেন দ্রুত চিন্তা করতে থাকে এবার সে কি করবে? এই সরল নিষ্পাপ নিরীহ মেয়েটাকে সে খুন করতে পারবে?

 

(দুই)

এবার আমি কি করব? গল্পটা এই পর্যন্ত লিখে আমি ধন্ধে পড়ে গেলাম। তখন রাত একটা বেজে গেছে। ভাবলাম আজ থাক, কাল ভাবা যাবে। আলো নিবিয়ে বিছানায় শুতে যাই। আমার স্ত্রী সেবন্তী তখন গভীর নিদ্রামগ্ন। কিন্তু ঘুম আসছে কই? ধন্ধের কারণটা হল গোড়াতে ভেবেছিলাম, দীপেনের পরিকল্পনা সফল হবে এবং অদ্ভুত দৃশ্য দেখে শুভ্রা হার্ট ফেল করে মারা যাবে। তারপর যদি দীপেন আর হিয়ার মিলন ঘটে তবে গল্পটা বড্ড সাদামাটা হয়ে যায়। সেই জন্য গল্পটাতে একটা মোচড় আনতে ঠিক করেছিলাম যে দীপেন যখন হিয়ার কাছে গিয়ে শুভ্রার মৃত্যুসংবাদ দেবে তখন হিয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করবে এই বলে যে সে খুনিকে বিয়ে করবে না এবং তার সন্তানের পিতৃপরিচয় একজন খুনির সন্তান হতে দেবে না। তার চেয়ে সে একক মাতৃত্বের পরিচয়ে বাঁচবে। সে দীপেনকে ভুলে যেতে চায়।
কিন্তু লিখতে গিয়ে কলম আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল আর আমি শুভ্রাকে মারতে পারলাম না। তাকে বাঁচিয়ে রেখেই আমি ধন্ধে পড়ে গেলাম, এখন দীপেন কি করবে? এই সব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা মৃদু শব্দে। ঘরের আবছা আলোতে তাকিয়ে দেখি আমার টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে কি দেখছে এক নারীমূর্তি। ঘুমের ঘোরে ভুল দেখছি না তো? আমি জিজ্ঞেস করি, কে? কে ওখানে?
মূর্তিটি মুখ তুলে বলে, শেষ পর্যন্ত আপনার সুমতি হয়েছে দেখছি, আপনি আমাকে মারেন নি। এবার হিয়ার কি হবে?
আমি আবার জিজ্ঞেস করি, কে তুমি?
চিনতে পারছেন না? আমি শুভ্রা।
শুভ্রা? তুমি কি করে এলে? আমি যে ভাবতেও পারছি না শুভ্রা তুমি আমার কাছে।
একটা ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার চেঁচামেচিতে সেবন্তীর ঘুম ভেঙ্গে যেতে সে আমাকে ঠেলে তুলে জিজ্ঞেস করে, কি বকবক করছ ঘুমের মধ্যে? আমি উঠে বসি, আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
সেবন্তী ও উঠে বসে বলে, কি বলছিলে শুভ্রা? শুভ্রা কে শুনি যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার স্বপ্ন দেখছ। বল শুভ্রা কে?
আমি কি বলব? জানি আমার কোন কথা সেবন্তী বিশ্বাস করবে না। আমি বলি, ও কিছু না, শুয়ে পড়।
সেবন্তী বলে, সকাল হোক না, মজা দেখাচ্ছি। আমি বের করবই শুভ্রাকে। ঐ শুভ্রার চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসব। তারপর তোমাকে মজা দেখাব। গজগজ করতে করতে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
বিপদ বুঝতে পেরে আমি ও উল্টোদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি। আমার ধন্ধ তো কাটলই না উপরন্তু চিন্তা বেড়ে গেল, কাল সেবন্তীকে কি বোঝাব। সারাটারাত আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটল।

 

 

কলমে সুব্রত নন্দী মজুমদার, শান্তিনিকেতন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here