পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি গ্রামের নাম জয়রামপুর। সেই গ্রামে বাস করে একটি অত্যন্ত মেধাবী ছেলে। সেই ছেলেটি অত্যন্ত দরিদ্র, তাই সে তার নিজের স্কুলের খরচ জোগাড় করার জন্য দরজায় দরজায় ঘোরে জিনিস বিক্রি করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একদিন তার কোনো জিনিসই বিক্রি হল না। এইভাবে সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলল, এমন সময় সে প্রবল তৃষ্ণা ও ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ল। তখন, সেই ছেলেটি ঠিক করল সে যে গৃহে প্রথম প্রবেশ করবে, সেই গৃহ থেকে কিছু খাদ্য চেয়ে নিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করবে।
তারপর, সে সামনের বাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজায় আওয়াজ করল। একটি ছোট্ট মেয়ে দরজা খুলতেই সেই ছেলেটি একটু ঘাবড়ে গেলো আর খাবার চাওয়ার পরিবর্তে শুধু এক গ্লাস জল চাইলো। কারণ, সে তৃষ্ণার্তও ছিল। কিন্তু, মেয়েটি তাকে দেখে বুঝতে পারলো যে ছেলেটি ক্ষুধার্ত, তাই সেই মেয়েটি ভিতর থেকে বড় এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে দিলো। ছেলেটি বিনা বাক্যালাপে এক গ্লাস দুধ ধীরে ধীরে পান করল।
দুধ পান শেষ করে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, দুধের দাম কত দেবো? তৎক্ষণাৎ মেয়েটি বলল টাকা কিসের জন্য? আমার মা আমাকে শিখিয়েছেন যে, “যদি কাউকে কোনোরকম উপকার বা সাহায্য করো তবে তার থেকে কোনকিছুর প্রত্যাশা করবে না।”
সেই কথা শুনে ছেলেটি বলল; “তাহলে আমি অন্তর থেকে তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি”। এই কথা বলে সে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। দুধ পান করার ফলে সে কেবল শারীরিক বলই পেলো না, বরং তার ভগবান ও মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং ভরসা আরও বেড়ে গেলো।
তারপর সেই মেয়েটি ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগলো, স্কুল পেরিয়ে স্নাতক হয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হল আসানপুর গ্রাম থেকে। কারন, তার বাড়ি ছিল সেই আসানপুর গ্রামের পাশের আর একটি গ্রাম শঙ্করপুরে। এরপর ধীরে ধীর অদিতি সুগায়িকা হিসাবে পরিচিত হল।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ করে তার পিতৃ বিয়োগ হল। পিতা সরকারি কর্মচারী ছিলেন। পিতাকে হারিয়ে মাকে নিয়ে তার জীবনে শুরু হল নতুন লড়াই। গান শিখিয়ে রোজগার করতে শুরু করল অদিতি। অত্যন্ত পরিশ্রমের ফলে ও সময়ে খাওয়াদাওয়া না করার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার মা তাকে গৃহ চিকিৎসককে দেখালেন। চিকিৎসক বললেন জ্বর না কমলে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। এক সপ্তাহ পরে রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল, ডাক্তারবাবু যা সন্দেহ করেছিলেন তাই হয়েছে, অদিতির ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। তখনই ডাক্তারবাবু তার মাকে বললেন এক্ষুনি অদিতিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং রক্ত দিতে হবে। এই কথা শুনে অদিতির মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
পিতার পেনশনের টাকায় কোনোরকমে সংসার চলছিল মা ও মেয়ের। এখন ঈশ্বরই একমাত্র ভরসা। কীভাবে অসুখের খরচ জোগাড় করবে সেটাই একমাত্র তার মায়ের চিন্তা।
হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড: দেবব্রত রায়কে রোগী দেখবার জন্য অনুরোধ করলেন। এরপর ডাক্তার তার আসন ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে মেয়েটির ঘরে ঢুকলেন, তিনি মেয়েটিকে দেখতে গেলেন এবং তার জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা দেখে স্তম্ভিত হলেন এবং যখনই ড: দেবব্রত রায় মেয়েটির গ্রামের নাম শুনলেন, তৎক্ষণাৎ তিনি চমকে উঠলেন।
মেয়েটিকে দেখা মাত্রই চিনতে পারলেন। তিনি তখনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, মরণাপন্ন মেয়েটির প্রাণ তিনি যে কোনো উপায়ে বাঁচাবেন। ড: রায় মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করলেন এবং একটা সময়ে তার পরিশ্রম সার্থক হলো। মেয়েটি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেলো।
ড: রায় হাসপাতালের অফিসে নিজে গিয়ে সমস্ত খরচ মিটিয়ে দিলেন এবং রসিদ নিয়ে তিনি সেই রসিদের একটি কোনে একটি কথা লিখলেন; আর তারপর সেই মেয়েটির কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
মেয়েটি রসিদ দেখে ঘাবড়ে গেলো। কারণ সে জানতো যে, তার মারাত্মক অসুখ থেকে তো সে বেঁচে গেছে, কিন্তু হাসপাতালের খরচ দেওয়া তারপক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। সে ধীরে ধীরে রসিদটা খুললো খরচের হিসেব দেখার জন্য, আচমকা নজর পড়লো কোনের দিকে। যেখানে ড: রায় কিছু কথা লিখেছিলেন। মেয়েটি পড়ল, যেখানে লেখা ছিল – “এক গ্লাস দুধের ঋণ এইভাবে শোধ করলাম”। এটা দেখে মেয়েটির চোখ দিয়ে আনন্দে অশ্রুধারা বইতে লাগলো। সে মাথার উপর হাত তুলে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালো, বলল – “হে ভগবান! তোমায় অনেক অনেক ধন্যবাদ, তোমার আশীর্বাদেই আজ আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হলাম এবং জানলাম সেই ছেলেটিই আজ ড: দেবব্রত রায়”।
তারপর, সে উপলব্ধি করল যে – “অপরকে নি:স্বার্থভাবে উপকার করলে নিজের ভালোই হয়”।
কলমে শুভ্রব্রত রায়, মন্তেশ্বর, পূর্ব বর্ধমান