দুঃখ, কষ্ট, দরিদ্রতা প্লাবনের মতো ডুবিয়ে রেখেছে ওকে। দারিদ্র্য সর্বদেহে মাছের আঁইশের মতো জড়িয়ে রয়েছে। সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো চাওয়া তার পূর্ণতা পায় না। অভাব আর সংকটে ও মেরুদণ্ড সোজা করতে পারে না। অপ্রাপ্তির ঝর্ণাধারায় জন্মোবধি স্নাত হয়ে আছে ও। হৃদয়ে রক্তক্ষরণের প্রাবল্যের ফলে রক্ত শূন্যতায় কাগজের সাদা পাতার মতো বিবর্ণ চেহারা তার। বিবর্ণ চেহারার মতো বিবর্ণ তার বাস্তব ও আগামি।
আকাশে ক্ষণকালের জন্য হলেও একটিবার অন্তত লালাভ রং চোখে পড়ে। ওর জীবনের আকাশে রঙিন কোনো দিনই আসেনি। অধিকাংশ দিনই অল্প খেয়ে ক্ষুধার রাজ্যে সেরা বুভূক্ষুর পদটি অক্ষুণ্ণ রেখেছে। অদৃষ্ট ভুল করেও তাকে ক্ষমা করে না, যত নির্মম রেশ যেনো তার উপর। শান্তির শ্বেত কপোত হাওয়ায় ভর করে দিগন্তের ঠিকানায় উড়ে গেছে তা আর ফিরে আসেনি। নেগেটিভের মতো বীভৎস অশরীরী ছায়া সামনে, যা তাকে আতঙ্কিত করছে, রক্তাক্ত করছে অথচ তার তিমির যাত্রাপথের গতি রোধ করে প্রাণটিকে কাড়ছে না।
সকালে স্কুলে যাওয়া তার নিয়মিত হতো না, শ্রম বিক্রি করতে চলে যেতো বাবার সাথে। রক্ত ঘাম হয়ে বের হয়ে যেতো, বিনিময়ে পেতো হাতে গোণা কিছু টাকা। তাতে পেট চলতো পাঁচটি জীবের। তাই বলে বইপত্র পড়ে থাকতো না, ও পড়তো। পড়াশোনার প্রতি তার তৃষ্ণা বেশি ছিলো। জীবন নামক রেলগাড়িটির গতিমান প্রতিটি চাকা সামনের দিকে গেছে, তাই তো এই সভ্যতার দীপ্র দুপুরেও যে গ্রামে ছিলো মধ্যযুগীয় অন্ধকার, সেই গ্রাম থেকে প্রথম এসএসসি পাস করলো সে। যে নিজে চেষ্টা করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেনই। ঐশ্বরিক দ্যুতিতে গ্রামটা ভরে গেলো।
কোনো কিছুই যেমন থেমে থাকে না, কোনো কিছুই তেমন বেঁধে থাকে না। কলেজে ভর্তি হলো। মাটির সাথে মিশে যে যাচ্ছিলো দারিদ্র্য নামক সন্ত্রাসীর চোখ গরমে, সে আজ একটা বড় পরিবেশে পড়াশোনা করছে। শুকুণির ডানার তলে ও চাপা পড়তে জানে না, ওর ভাষা সংগ্রামের। ও জয় পাবেই। কোনো দিন কারোর কোনো স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া, মমতা পায়নি, তাই কারো কাছ থেকে হঠাৎ উষ্ণ স্পর্শ পেলে ও মোমের মতো গলে যায়।
কণ্টকময় পথের কণ্টক অমর কণ্টক হয়ে সম্মুখে এলেও কণ্টককে সে মোকাবেলা করেছে। তার জন্য লেগেছে সৎ সাহস আর অধ্যবসায়। দীনতার আগ্রাসী স্পর্শ আর অভাবের ডালপালা অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেও গতির রোধক হতে পারেনি ওর চলার পথে। পা পা করে ও পা রাখলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে। এত দিন দারিদ্র্য তাকে কুপোকাত করতে পারলেও ন্যুব্জ করতে পারেনি। এবার বুঝি সংগ্রামে সে হারলো। বাইরে থেকে পড়াশোনা করার মতো ক্ষমতা তার নেই। পকেটে অক্ষমতা থাকলে মেরুদণ্ড আর সোজা হয় না, মনোবল থাকে না, কত কদম সে অনাহারে হাটতে পারবে? স্বপ্নটা বুঝি আর বাস্তবতার মুখ দেখবে না। নির্বাক চেয়ে থাকে আকাশের দিকে, নির্বাক চোখে তার কান্নার শব্দ।
আপ্রাণ দারিদ্র্যের সাথে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু যোদ্ধা এত দিনে হাল ছাড়লো। পরিচিত এক বড় ভাইকে অনুনয় করে বললো, ভাইয়া, আমার একটা টিউশনি ঠিক করে দেবেন? আব্বা আর খরচ দিয়ে পারছেন না।
বড় ভাই বড় ভাইয়ের মতো উপদেশ দিলেন, শোনো ভাই এহসান, টিউশনি করে আর কত বের হবে, এ করলে সময় অপচয় হবে, শ্রম যাবে, নিজের পড়া ঠিক করতে পারবে না, নিজের রেজাল্ট খারাপ হবে, ভালো চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে পারবে না। ভালো করে পড়ো, সারাজীবন টিউশনি করে যে অর্থ কামাবে দুই মাসের চাকরির বেতন তারচেয়েও বেশি হবে। সাময়িক হাত টানে তোমার তেমন ক্ষতি হবে না। দশ টাকার জন্য দশ হাজার খোয়া যাবে, ভাই।
বড় ভাইয়ের কথাগুলো মস্তিষ্কের বর্মতালুতে যেয়ে শীতলতার পরশ দিলো। উপদেশ তো সত্য, কিন্তু তার এখন অর্থ চায় এটাই বড় সত্য। সম্মুখ যুদ্ধে সে পরাহত সৈনিক। উপদেশ সে গ্রাহ্য করলো না। অন্য পরিচিত এক বড় ভাইকে কথাটি বললো। সে ভাই বললো, দেখো এহসান, টিউশনি তো পাওয়া যাচ্ছে না। বছরের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে সব বুক হয়ে যায়। তুমি যে আমার কাছে টিউশনি খোঁজ করছো, আমার আরো একটি টিউশনি পেলে ভালো হয়।
এহসান আশাহত হলো। বুঝলো নিজেকেই টিউশনি খুঁজতে হবে। অন্যের উপর নির্ভর করা যায় না। বিবর্ণ দীপ্তিহীন আর নিষ্প্রভ হয়ে গেলো ও। ক্যাম্পাস অতিক্রম করে হাঁটতে হাঁটতে সে বেশ লোকালয়ে চলে গেলো।
একটি মহিলা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ-ভূষা দেখে বোঝায় যাচ্ছে অবস্থা সম্পন্ন ঘরের কেউ। বললো, জ্বি, মানে কাকী, এদিকটাতে একটি টিউশনি পাওয়া যাবে?
মহিলাটি বললেন, টিউশনি করবে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কি শিক্ষক হবে? শিক্ষকতা করে কী পেট চলে? সম্মানও তো পাবে না। গ্রামে বিচার হলে তোমাকে কেউ ডাকবে না, কারণ তুমি যে নীতিকথা বলবে।
এহসান বললো, কাকী, টিউশনিটা খুব প্রয়োজন। নিম্ন বিত্ত ঘরের সন্তান, খরচ আর জোগাতে পারছেন না আব্বা।
মহিলাটি বললেন, গরীব ঘরের সন্তান, কেনো তবে এত বড় ঝুঁকি নিয়ে পড়তে আসো? দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুকের মতো টিউশনি খুঁজছো, পড়াশোনা করার জন্য আর কত নিচে নামবে?
এহসান সব বুঝে ফেলেছে। ও আর ওখানে থাকলো না। মহিলাটি গুণগুণ করে তখনো বলছেন, আল্লাহ এদেরই যে কেনো মেধা দেন?
বন্ধু সমাজে আড্ডার সময় নানা কথা তাকে বলতে হয়, নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয়, তাতে কিছু টাকাও যায়। কোনো বন্ধু একদিন তাকে খাওয়ালে অন্যদিন তাকে তো খাওয়াতেই হয়, নতুবা সম্পর্ক থাকে না। পাঁচ সাত বা তারও কম দুই তিন জন যুবক একস্থানে হওয়া মানেই আলোচনার মূল বিষয় প্রেম। এক প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর বললো, একবার যে প্রেম করেছে, তার জীবনে বার বার প্রেম আসে। কারণ মেয়েদের সাথে কথা বলার ক্ষমতা সে প্রথম প্রেম থেকেই শিখে যায়। আর টিউশনিও তাই। যে একটি টিউশনি পেয়েছে সে বার বার টিউশনি পায়।
সিদ্দিক বললো, রসায়নের একটি মেয়েকে আমার ভালো লেগেছে। পিছন পিছন ঘুরছি। পাত্তায় দিচ্ছে না।
তুষার স্লোগান দিয়ে উঠলো, প্রেম করেছে সিদ্দিক ভাই, সুন্দরী তোর রক্ষা নাই।
আতিক বললো, দীর্ঘদিন তোরা তো দেখছিস প্রেম করছি। কিন্তু ও এখনই বিবাহ করবে না, ও কী ফাঁকিই দেয়।
তুষার আবারও স্লোগান দিলো, প্রেম হবে তো বিবাহ হবে না, তা হবে না তা হবে না।
এমন মুহূর্তে ওদের মাঝে একজন ভদ্রলোক এলেন। বললেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট কার? তাকে আমার মেয়ের জন্য টিউটর রাখবো।
ভদ্রলোকের প্রশ্নে বাকিদের রাগ হলেও আতিক রাগের ধার না ধেরে বললো, এহসানের।
ভাগ্যবশত এহসান টিউশনি পেলো। চোখে মুখে আশার ঝিলিক জেগে উঠলো। ও অল্পতে খুশি, কিন্তু আজ তার এ মোটেও অল্প নয়। বুকটা ভরে গেলো। প্রথম দিন টিউশনিতে গেলো। ছাত্রী পড়ার টেবিলে আসছেই না। সাজগোজ করছে। বসে আছে এহসান। এলে পড়াবে তার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। চল্লিশ মিনিট পরে এসে ছাত্রী বললো, ভাইয়া, আজ পড়বো না। মার্কেটে যাবো। কাল আসেন।
ছাত্রীর ইচ্ছার উপর পড়ানো নির্ভর করছে ওর। যদি আজ পড়ে তবে ও পড়াবে। পরের দিন যদিও বা পড়তে এলো, মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত থাকলো। মাথা নিচু করে এহসান তা শুনতে লাগলো। কথা শেষ হলে এহসান বললো, আমি যখন পড়াবো তখন মোবাইল বন্ধ রাখবে।
ছাত্রী মাথা নেড়ে বললো, আর কী নীতি মানতে হবে?
এহসান বললো, সময়বোধ থাকতে হবে। আমাকে বসিয়ে রাখা উচিতও নয়।
ছাত্রী বললো, আপনি আসবেন, বসে থাকবেন, নাস্তা করবেন, চলে যাবেন। মাস শেষে টাকা নেবেন। আপনাকে পড়াতে হবে না।
এহসান আশ্চর্য হয়ে বললো, মানে?
ছাত্রী বললো, কোথাকার ক্ষেত! আপনার কাছে পড়তে আমার বয়ে গেছে। আপনি যান, আর আসবেন না। আমি অন্য ভাই খুঁজে নেবো।
দীপ নেভার মতো মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো এহসানের। দীর্ঘশ্বাস কেটে বের হয়ে এলো। একেই কী বলে জীবন? এতো আলো অথচ আলো তার কেউ নয়? অন্ধকার তার সব?
অনেক দিন টিউশনির নাম সে মুখে আনেনি। মেসে যে খালা রান্না করে দেন, উনার মাধ্যমে এহসান পাশেই একটি টিউশনি পেলো। বাচ্চাটা ছোট ক্লাসে পড়ে। পাঁচ মিনিটের পথ। ও হেঁটে যেয়েই পড়িয়ে আসে। একদিন ঐ বাড়ি এক ভদ্রমহিলা এলেন। জানতে চাইলেন, কে ভাবী ছেলেটা?
বাচ্চার মা বললেন, ছেলের জন্য টিউটর রেখেছি।
ভদ্রমহিলা বললেন, লুঙ্গি পরে পড়াতে এসেছে কেনো? আটকালচারড ছেলে। কী শিখবে আপনার ছেলে এই সব গ্রাম্য ভূতদের কাছ থেকে?
কথাগুলো এহসানের কানে গেছে। কথা তো নয়, বিষ। পিত্তথলিটা জ্বলে গেলো। ঐ সব কথার আঘাতে হৃদয়টা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেলো। এটাকে বাঁচা বলে না। ও টিউশনি ছেড়ে দিলো।
আব্বা ধার দেনা করে এহসানের টাকা দেন। সেই টাকা সে খরচ কিংবা বাজে খরচ করতে ভয় পায়। জ্ঞানপূর্ণ মেধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে। আলোয় আলোকিত হবে। হারিয়ে যাবে বলে আসেনি। কত কিছু দেখার এখানে, কত রঙিন রঙিন মুখ, সবার কী রঙিন জীবন? না, ওর মতো আরো ফ্যাকাশে কিছু মানুষ আছে? লটারির কবুতর সবাই। হাজার দুয়ার খোলা সামনে। নিজের গার্জেন যখন সে নিজে, নিজেকে তো সে বিপথে গমন করাতে পারে। নিজেকে বিকাশ করার জন্য যত উত্তম স্থান এটি, নিজেকে নষ্ট করে দেয়ারও এটি একটি উত্তম স্থান। না, এহসান তো মানুষ হতে এসেছে, উন্নত মানুষ। ও মেধা নিয়ে এসেছে, মেধাশূন্য হয়ে বের হতে চায় না। ও সংগ্রাম করবে, জীবনটাই তো ওর সংগ্রামের।
এক মাস দুই মাস পরপর বাড়ি এলে বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে, কিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িস, প্রেম ট্রেম করলি নাকি?
মনে মনে এহসান বলে, যেই চেহারা ভিক্ষুকও তাকায় না।
উচ্চারণে বললো, প্রেমের বাজারে মেয়েদের দাম বেশি, আর বিবাহের বাজারে ছেলেদের। তাই প্রেমের জন্য অপেক্ষা না করে বিবাহের জন্য অপেক্ষা করছি।
আবার মনে মনে বলে, প্রেম করে আব্বার রক্ত ঘাম করা টাকা হাতিকে খাওয়াবো?
এবার সুখের পায়রার মতো একটি টিউশনি ও পেয়েই গেলো। মেয়েটি বড় ক্লাসে পড়ে। ব্যবহার ভাল। এহসান একদিনেই বুঝে ফেলেছে। ভদ্রও বটে। পরিবার তাকে ভদ্রতার ঐতিহ্য শিখিয়ে দিয়েছে, যা তার আচরণে হীরার মতো ঝিলিক দিচ্ছে। প্রথম দিন এহসান মেয়েটির ব্যক্তিগত কিছু কথা জিজ্ঞাসা করেছিলো। মেয়েটি বলেছিলো, আমার ব্যক্তিগত কথা শুনে আপনি কী করবেন?
শাপলার মতো কোমল স্নিগ্ধ এক ফালি মুখ মেয়েটির। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। এ এমনি মহিমান্বিত রূপ, তুলনা চলে না শিল্পীর আঁকা ছবির সঙ্গে। এহসান চিন্তায় পড়লো, মস্তিষ্কের অসংখ্য কোষে গিজগিজ করছে চিন্তার ঘূণপোকা। ভাবলো, ব্যক্তিগত কথা জানতে চাইলাম, টিউশনিটা কী যায়-ই নাকি?
না, এটি বোধ হয় স্থায়ী হয়েই গেলো। পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক হলো। বাবা বললেন, ওর পড়াশোনার ভালো মন্দ সব তুমিই দেখবে, ভুল হলে সাজা যেমন দেবে, অনুপ্রেরণাও দেবে। গৃহশিক্ষকের হাতে কর্তৃত্ব না দিলে সে পড়াতেও যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, তেমনি যে পড়ে তারও পড়ার প্রতি একনিষ্ঠতা থাকে না।
মেয়েটি পড়তে বসলে এহসানের দিকে কেবলি ভাষাহীন চোখে তাকায় আর ঠোঁটে হাসে। চরম অপ্রস্তুত হয়ে যায় এহসান। ভাবে, আমি কী পড়াতে পারছি না? না, বোঝাতে পারছি না?
দুটো দিন গেলে এহসান জিজ্ঞাসা করলো, রীতা, কী হবে তুমি? ডাক্তার, না ইঞ্জিনিয়ার?
নৈরীতা এহসানের দিকে তাকিয়ে বললো, উন্নত মনের মানুষ।
কিছুদিন পর বাবা এসে বললেন, এহসান, আমরা তো বাসা পরিবর্তন করবো। রীতাকে তোমার কাছে পড়াতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু তা আর হচ্ছে না। রীতার কাছে বেতনটা আছে, নিয়ে নিও। কাল থেকে আর এসো না। আমরা কাল সকালেই চলে যাবো।
বাবা এই বলে চলে গেলেন। নৈরীতার মনটা বেশ খারাপ। আজ ও পড়বে না। একটি ব্যাগ এহসানের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো, প্রত্যেকদিন এক শার্ট পরে আসেন, তাই দুটি শার্ট কিনেছি, নেন। পরবেন কিন্তু।
এহসান হাত দুটো না-সূচক ভঙ্গিমায় নাচালো আর বললো, না, না, দুঃখিত রীতা।
নৈরীতা বললো, উপহার নেবেন না কেনো? উপহারে সম্পর্ক বাড়ে, সম্পর্ক স্থায়ী হয়। আর টাকাগুলো নেন।
এহসান চোখ মোটা মোটা করে বললো, এতো টাকা?
নৈরীতা বললো, আব্বার পকেট চুরি করে করে, মায়ের কাছে বায়না ধরে ধরে, এ টাকা আমি সঞ্চয় করেছি। আমি চাই, এ টাকার সফল ব্যবহার হোক। আপনি এ টাকার সফল ব্যবহার করতে পারবেন। দুটো দিন তো স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন। বিনিময়ে রীতাকে মনে রাখতে হবে বলছি না!
এহসান নিজ স্থানে অটল। বললো, আমি একটি টাকাও বেশি নিতে পারবো না, রীতা!
নৈরীতা এবার রেগে গেলো, আপনাকে কতো দেবো তা বলে তো ঠিক করা হয়নি। পুরো টাকাটাই আপনার শ্রমের দাম, নিন কিন্তু।
এহসান নিরুপায়। লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো শিম পাতার মতো। হাত পেতে নিতে হলো অসম ভারের উপহার আর টাকা।
নৈরীতা বললো, এবার আপনি যান। প্রত্যেকদিন তো আমিই উঠে আগে ঘরে চলে যাই, আজ আপনি আগে যান। পেছনে তাকাবেন না, যতক্ষণ দেখা যায় আমি আপনার প্রস্থান লক্ষ্য করবো।
এহসান চলে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, আমার দরিদ্রতাকে সম্বল করে কেউ কেউ আমাকে আঘাত করে কষ্ট দিয়ে, অপমান করে, আর কেউ ভালোবেসে।
গল্পের পরিণতি এখানেই নয়। জীবন নাটকের তৃতীয় দৃশ্য বলে একটা কথা আছে। আগে দারিদ্র্য নামক শিলাখণ্ডটি তাকে টুকটুক করে আঘাত করতো, এখন সেটি জোরে জোরে আঘাত করতে শুরু করেছে। ঘোড়ার বিপক্ষে দৌঁড়ায়েছিলেন জেসি ওয়েন্স জীবিকার তাগিদে। কিন্তু একটু বেঁচে থাকার তাগিদে বিদ্যুতের বিপক্ষে এহসানকে কেনো দৌঁড়াতে হচ্ছে? সবাই শিক্ষাসফরে রংপুর ‘ভিন্নজগৎ’ দেখতে যাবে। একজনই কেবল টাকা দিতে পারলো না, সে এহসান। শাহেদ বললো, তোর মতো অভাবী আর মনে হয় দুনিয়ায় কেউ নেই? তুই যত অভাবী তারচেয়ে বেশি অভাবীর ভান করিস। পকেটে কেবল তোর অভাব নয়, তোর মনে প্রাণেও অভাব।
এহসানের সফরে যাওয়া হলো না। শীতকাল। একটা শীতের পোশাক নেই তার। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ক্লাসে এলো। স্যার বললেন, তোমার শীত লাগে না, ছেলে?
সামসুল বললো, স্যার, ওর শরীরের রক্ত ব্যাঙের শরীরের রক্তের মতো। তাপমাত্রার সাথে উঠানামা করে। তাই ওর শীতের পোশাকের প্রয়োজন পড়ে না।
জাহাঙ্গীর বললো, এবার শীতার্তদের জন্য গরম কাপড় সংগ্রহ করলে, ওকে একটা দিয়ে দেবো।
এহসান এমনিভাবে অপমানিত হয় বন্ধুদের দ্বারা। চুল এক বিঘাত না হওয়া পর্যন্ত স্যালুনে যায় না। শ্যাম্পুও করতে পারে না। দাড়ি-গোঁফ কাটে মাসান্তে। একদম জংলি লাগে। শরীফ বললো, আমাদের মধ্যে ভূতবন্ধু আছে। ওর গল্প আমি বাসাতে যেয়েও ভাই বোনদের সাথে করি। মা শুনে বলেন, তোমার ঐ বন্ধুটির বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটেছে, নতুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলে এমন ছন্নচ্ছাড়া হবে কেনো? মায়ের কথা শুনে খারাপ লাগে। এই এহসান, মানুষের মতো হয়ে ক্যাম্পাসে আসবি, নতুবা আমাদের সাথে মিশবি না। তুই প্রতি পরীক্ষায় প্রথম হচ্ছিস। তোকে অনেকে অনুসরণ করবে, তুই যদি এমন অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকিস, তবে তোকে বন্ধু বলতেও বাঁধবে।
মাথাটা নিচু করে থাকলো এহসান। অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিলো সে। ঠোঁট নড়লো, বিড়বিড় শব্দ হলো, এত চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে একটি শব্দ বের হলো না। শূন্য দৃষ্টিতেই শুধু তাকিয়ে থাকলো। যেন অশীতিপর ব্যক্তি, বেঁচে থাকায় তার লড়াই।
যে মেসে থাকে সেটি অনেক পুরানো, তাই ভাড়াও কম। দেয়াল থেকে খসে খসে বালি পড়ে। টিনশেড, তাতে অনেক ফুঁটো। সূর্য উঁকি দেয় সেই ফুঁটো দিয়ে। বর্ষাকালে তাকে হয়ত এই মেস ছাড়তেই হবে।
এই যুগে কার হাতে মোবাইল নেই? এহসানের মা মোহনের ফোন দিয়ে রাজ্জাকের মোবাইলে ফোন করেন। রাজ্জাক প্রথম প্রথম এহসানকে ডেকে দিতো। মা ছেলের সংযোগ হতো। এখন রাজ্জাক বলে, কাকী, এহসান তো রুমে নেই। অন্য সময় কল করলে বলে, কাকী, আমি তো রুমে নেই। কখনো বলে, কাকী, আমি একটু ব্যস্ত। এহসান মায়ের সাথে কথা বলতে পারে না, তাও দারিদ্র্যের বদৌলতে।
এটা সত্য ক্যাম্পাসে বোবা, কানা, খোঁড়া, অঙ্গহীন মানুষের অভাব নেই। সবার কাজ মামা সাহায্য দেন। আর ভিক্ষুক তো আছেই, কাজ হাত পাতা। এক ভিক্ষুককে আসা দেখে নূর বললো, এহসান, তোর স্বজাতি আসছে, দেখ…দেখ…
এহসান মূর্ছা যায়। আর কত ছোট হবে ও? ওর বন্ধুরা ওকে আর কত ভাবে ছোট করবে? উপেন নূরকে বললো, ভিক্ষুকের কাছে তো কিছু থাকে, এহসানের কাছে তাও তো দেখি থাকে না। শুধু ওর মুখে টাকা নেই, টাকা নেই কথা। আজ আমার কাছে ধার খুঁজবে, কাল তোর কাছে। তুষার ওর কাছে পাঁচশত টাকা পাবে। শোধ না দিলে ওকে কেউ আর কি ধার দেবে?
সিদ্দিক বললো, শোধ ছাই দেবে। কবে দেখিস বলবে, দোস্ত, টাকাটা মাফ করে দে৷ ওর মুখে তো কিছুই বাঁধে না, এ কথাও ও বলতে পারবে। আর আমরা ধার দেবো না কেন? অসহায়ের মতো করে ধার খুঁজবে। বন্ধু মানুষ, কতবার ফেরানো যায়? তাই দিই।
এহসান উঠে চলে যাচ্ছিলো। আজ সে নৈরীতার দেয়া শার্টটা পরে এসেছিলো। জাহাঙ্গীর বললো, কোথায় যাবি? নতুন জামা পরেছিস বলে সারা ক্যাম্পাস ঘুরবি নাকি?
এহসান বন্ধুদের এমন কটাক্ষাঘাতে বাকশূন্য হয়ে যায়। রাগে দেহের রক্ত টগবগ করতে থাকে। এহসান রাগ নিয়ন্ত্রণ করে চলে গেলো। টুটুল বললো, সেজেগুজে এলে এহসানকে কিন্তু দারুন লাগে!
ওদিন আরো তিন চারজন বন্ধু ওকে টিটকিরি কেটেছে নতুন জামা পরে এসেছে বলে। রুমে ফিরে জামাটি ও ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও ছিঁড়লো না। ওর আর সহ্য হচ্ছে না অন্যের টিপ্পনি।
পরের দিন রৌদ্রে পোড়া আর বৃষ্টিতে ভেজা হলদেটে বিবর্ণ সেই শার্টটি পরে ক্লাসে এলো এহসান। সেগুফতা বললো, এটা পরিস কেন? মাঠের শ্রমিক নাকি তুই?
সেগুফতা চলে গেলে লুবনা এলো। ও বললো, আজ নতুন জামাটা পরে এলি না কেনো?
তিনা তীর্যক চোখে চেয়ে রসালো ঢঙে বললো, প্রত্যেকদিন নতুন জামা পরলে জামা কী নতুন থাকে? দেখিস ও ভাইভার দিন পরে আসবে!
এই বলে তিনা হেসে দিলো। মনে মনে এহসান কেঁদে দিলো। ভাবলো, কী ফাঁদে পড়লাম আমি? কোনোভাবেই কেউ আমায় বুঝতে চায় না কেনো? আমাকে ছোট করে ওরা শান্তি পায়?
শান্ত নিরুদ্বিগ্ন স্ফূটিক জলের কাছে গেলে কার না ইচ্ছা হয় মুখটা একটু দেখার? কিন্তু তা তার আর হয়ে উঠে না৷ মনটা সাজতে চায়, সাধ্যটা কোথায়? কী বিবর্ণ একটি ছেলে! কী দীপ্তিহীন তার জীবন! কী নিষ্প্রভ তার চাল-চলন! সময় নেই পদ্মার পেটে চড়ে চড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবিতা, গল্প লেখার। সময় নেই ঐ পদ্মার পাড়েই অপ্সরী মানবীদের অট্টহাসি আর বেলাল্লাপনা দেখার। সময় নেই ভদ্রা পার্কে যেয়ে জুটিদের নির্লজ্জ আর বেহায়াপনা কাণ্ড দেখার। সময় নেই মেয়েদের হলগুলোর সামনে যেয়ে অজস্র ছেলেদের ধাক্কা সহ্য করার৷ পেটের চিন্তা, সেই কারণে চোখে ও ঘোর অন্ধকার দেখে। কেবল ওর জন্য যেন চাঁদ চোখ বুজলো। ওর পৃথিবী ফ্যাকাশে আর পাণ্ডুর। ওর ইচ্ছা ঘোড়া খোঁড়া, পায় না খুঁজে নতুন দিগন্ত তরুণ তুর্কির মতো। তাকে দেখার কেউ নেই, তাকে বোঝার কেউ নেই, তার কথা শোনার এমন ধৈর্যশীল শ্রোতা একটিও নেই। দীর্ঘশ্বাস তার সম্বল। অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতার বিমোহিত সুর তার কানের কাছে বারবার ঘুরে ফিরে বাজে। আবছায়া দেখে ও সবকিছুর মাঝে। স্বপ্নের স্রোত মস্তিষ্ক থেকে বিদায় নিয়েছে তাই স্বপ্নহীন এক অলীক জীবন যেনো তার। স্বপ্নগুলো ছিনতাই হয়ে গেছে বিবর্ণ বাস্তবতার আঙ্গিকে। পঙ্কিলতার পাকে পড়ে দিগভ্রান্ত হয়ে গেছে। সমস্যা নামক শব্দটি মনের পর্দায় মাখিয়ে দিয়েছে তরল বিষাক্ত কীটনাশকের ছোপ ছোপ কালো দাগ। দারিদ্র্য যেনো বিষাক্ত কোনো প্রাণী ফণা তুলে ছোবল দিতেই উদ্যত সে। মনোবলশূন্য হয়ে গেলো ও। পেটে অন্ন না থাকলে মনে জোর থাকে না। আকাশ ফর্সা হলে রাজ্যের কাক এসে জড়ো হয়, তাদের খাদ্যের অভাব নেই। কিন্তু একটি মাত্র জীব এই জীবধাত্রী ধরিত্রীর বুকে তার অন্নের খোঁজ নেই। জীবন ক্যালেন্ডার থেকে তাই ওর অনেক স্বাধ আহ্লাদ কাটা পড়ে গেছে।
এহসান বেশ কদিন ডিপার্টমেন্টে আসছে না। তাই তুষার ভ্রূ কুঁচকে বললো, ওতো একটা ক্লাসও মিস করে না। পাগলের মতো সব ক্লাস করে, আর ঐ ছেলে ক্লাসে অনুপস্থিত?
সিদ্দিক বললো, ওকে অনেক বেশি অপমান করেছি। সে একজন মানুষ তা জ্ঞান করেছি?
শাহেদ বললো, সত্যই, ওর আর্থিক অনটনকে সম্বল করে ওকে বড় বড় কথা বলে বলে ছোট করেছি। বন্ধু হিসেবে এমনটা করা মোটেও উচিত হয়নি। ওর জন্য কিছু করতে পারলাম না, তবে ওকে নষ্ট করার উঁৎ পেতেছি কেনো?
আতিক বললো, আচ্ছা, আমি ওর জন্য কিছু একটা করতে চাই। স্টেশন বাজারে যে দোকান থেকে আমি নিয়মিত তরকারি কিনি, উনি উনার ছেলের জন্য টিউটর চেয়েছেন। বেশি টাকা দিতে পারবেন না। তবে ওর চলে যাবে।
সামসুল বললো, ওর জন্য তুই যদি কিছু করতে পারিস তো ভালো। যদি ওর জন্য কিছু নাই করতে পারি, তবে ওকে কেউ যেন কটাক্ষ না করি। সবচেয়ে বড় কথা ও আমাদের বন্ধু।
এ কদিন এহসান ডিপার্টমেন্টে যায়নি তার কারণ বন্ধুরা টিটকিরি কাটে তাই কেবল নয়, মেস এলাকায় একজন অবস্থাশালী লোক আছেন। উনার একশোটা রিক্সা আছে। ভাড়া দেন। দিনে একশো টাকা আর যদি দিন রাত রাখে তবে একশো পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিতে হয়। এহসান একটি রিক্সা ভাড়া নিয়েছে। বন্ধুরা বা পরিচিতরা চিনে ফেলবে বলে ও মাথায় গামছা বেঁধেছে। মাফলারটা আছে, ওটা মুখ জুড়ে পেঁচিয়ে নিয়েছে। এভাবে সে রিক্সা টানা ধরেছে। কিন্তু তাতে কী নিজেকে আড়াল করতে পারলো ও? ধরা পড়ে গেছে, তাও নৈরীতার কাছে। নৈরীতা এহসানের রিক্সায় উঠলো। সাহেব বাজার গেলো। সেখান থেকে নিউমার্কেট হয়ে কাজলা অভিমুখে। এহসান বললো, কোথায় যাবে?
নৈরীতা বললো, বিনোদপুর।
বিনোদপুর অভিমুখে রিক্সা চলতে লাগলো। শীতকাল। তবুও শরীরটা ওর ঘেমে গেছে। জামাটি ঘামে ভিজে গেছে। নৈরীতা ওর পিঠে একবার হাত দিতে যেয়েও দিতে পারলো না। নৈরীতার হৃদয়ের সবটুকু আবেগকে স্পর্শ করলো এহসানের এমন কষ্ট। বললো, আপনি আমার স্যার। আমাকে বিদ্যা দিয়েছেন। আপনাকে কোনো শিক্ষণীয় কথা বলা আমার জন্য অকালপক্বতার পরিচায়ক। তবুও বলছি, রিক্সা চালাচ্ছেন ঠেলায় পড়ে। রিক্সাওয়ালাদের জীবন কেমন জানা হলো। যদি অবস্থাশালী হতেন তবে কী করতেন? ক্যাম্পাসে মেয়েদের পিছনেই তো ঘুরতেন। সময়গুলো অপচয় করতেন পড়াশোনার নামে টো টো করে। বাবা মায়ের চোখের আড়ালে বলে আপনারা কী করেন না? প্রেম করেন, প্রেম তো নয়, ছিনালিপনা। খোলা স্থানে ডেটিং করেন সেটা না হয় কাম্য, কিন্তু রুমডেটিং? এটা কোন বিবেকের কাজ? পার্কে যেয়ে ইংলিশ নায়ক-নায়িকাদের মতো বেহায়াপনা কিসের সামিল? আপনি এগুলোর একটিও করতে পারছেন না অর্থাভাবে। নতুবা আপনিও তাকাতেন আমাদের দিকে, আর প্রস্তাব করতেন, উত্যক্ত করতেন, নির্লজ্জ হতেন। কোনো ঘাপটি স্থানে জড়িয়ে বসে হাতের কাজ, মুখের কাজ করতেন, মশার কামড় তখন তুচ্ছ হতো। দারিদ্র্য আপনাকে মহান করেছে, আর কেউ না।
এহসান সব শুনলো। শুধু বললো, বিনোদপুর এসে গেছে।
নৈরীতা বললো, স্টেশন বাজার, তারপর মেহেরচণ্ডী কড়ইতলা বাজার, তারপর সোজা ভদ্রা, সেখান থেকে নিউমার্কেট।
এহসান রিক্সা চালাতে লাগলো। নৈরীতা এবার বললো, তা মুখ ঢেকে চালাচ্ছেন কেনো? ঘামে ভরা মুখটা মানুষ দেখুক, যে কাজ আপনাকে অন্ন দিচ্ছে, সে কাজকে তুচ্ছজ্ঞান করছেন কেনো? জ্ঞানী মানুষ আপনি, কোনো কাজকে ছোট করে দেখা আপনার কাজ নয়। গর্ব সহকারে কাজ করুন, অনেক বড় হতে পারবেন। এতে তো আপনার শক্তি আর সামর্থ্যের পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশে ছাত্র মানে তো ক্লাসে যাওয়া আর আসা, ঘুরে ঘুরে সময় নষ্ট করা আর ঘুমানো। পড়াশোনার পাশাপাশি সব ছাত্রই যদি কাজ করতো, নিজের রোজগার নিজে করতো, তবে দেশের অবস্থা হতো ভিন্ন।
এহসান কেবল শুনলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রিক্সা থামালো। তারপর বললো, খুব কষ্ট হয়ে গেছে। তুমি এখানে নামো। অন্য রিক্সা চড়ে বাসায় চলে যাও। আমি ক্লান্ত।
কথাগুলো শোনার পর নৈরীতার চোখে পানি চলে এসেছে। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, সকালে খেয়েছেন?
এহসান হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালো। নৈরীতা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো, রিক্সা ধরলেন কেনো?
এহসান বললো, সামনের মাসের এক তারিখে চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু। ফিস লাগবে, তাই।
নৈরীতা জানতে চাইলো, ফিস কতো?
এহসান বললো না। দ্বিতীয় বার নৈরীতা জানতেও চাইলো না। ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে বললো, নেন।
এহসান বললো, আমাকে আর লজ্জা দিও না, রীতা। কাজ করে খাবো। হাত পেতে নিতে পারবো না।
নৈরীতা এহসান সম্বন্ধে ভালো জানে। তাই বললো, ধার নেন। যদি আর দেখা না হয় তবে সারাজীবন তো বলতে পারবেন রীতার টাকাটা দেয়া হলো না। এ কারণে হয়ত আপনার মন থেকে আমি ভুলবো না।
এহসান নিরুপায়। কোনো ভাবেই নৈরীতাকে কাটাতে পারলো না। টাকাগুলো নিলো। নৈরীতা এহসানের দিকে চেয়ে বললো, আপনাদের মতো মেধাবী ছেলেরা টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে না পেরে অকালে ঝরে যাচ্ছে। কেউ আপনাদের দিকে তাকায় না। যার আছে তেল, তাকেই সবাই তেল দেয়। কিন্তু তারা জানলো না কোন ফসলে সার দিলে ফসলটা ভালো হবে। দেশের মঙ্গল হবে। আর দেখেন আল্লাহ কাকে টাকা দিয়েছেন, এই ধরুন আমাকেই। ব্যাগে কয়েক হাজার টাকা, অলস টাকা। কোনো কাজে লাগে না। এই টাকা বাড়িতে যেয়ে সব চুল্লিতে দেবো।
এহসান নির্বাক। আকাশের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ পরে বললো, রীতা, তুমি দারুন একটা মেয়ে। কেউ কোনোদিন এতো কাছে আসেনি, এমন করে কথা বলেনি। এতোটা কষ্ট বোঝেনি। আমার জন্য সমবেদনা দেখায়নি। খুব ভালো লেগেছে তোমায়।
নৈরীতা আশ্চর্য হয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে বললো, অনার্স শেষ হলেই তো চাকরির জন্য রাজশাহী ছেড়ে চলে যাবেন, তাই না?
এহসান বললো, হ্যাঁ, মাস্টার্স করা সম্ভব হবে না।
নৈরীতা নির্লিপ্ত নয়নে বললো, চাকরি পেলে নিশ্চয় অন্য আর একটা জীবনের কথা ভাববেন, তাই না?
এহসান বললো, হ্যাঁ, তা তো করতেই হবে। তোমার কথা কোনোদিন ভুলবো না।
নৈরীতা বললো, এবার যদি কোনোদিন দেখা হয় কথা দেন, একটু সময় আমার সাথে হাঁটবেন!
এহসান নৈরীতার মুখের দিকে তাকালো, ঐ চোখে মুখে একটা ভাষা স্পষ্ট, যা এহসানের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। এহসান ভাবলো, বনফুলের প্রতিও অনেকের আকৃষ্টতা আছে!
এহসান মুখে বললো, রীতা, তুমি ঐ রিক্সায় চড়ে চলে যাও।
নৈরীতা অন্য রিক্সায় ওঠার পূর্বে বললো, জীবনে বড় হতে পারলে খবরটা আমাকে জানাবেন। আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না। আমি সেদিনের জন্য অপেক্ষা করবো।
অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে নৈরীতা চলে গেলো। এহসান বোকার মতো একটু হাসলো আর বললো, রীতা, আমি দরিদ্র না হলে তোমার মতো মনে প্রাণে ধনীর দেখা পেতাম না। দারিদ্র্য আমাকে সবচেয়ে বড় যে পুরস্কারটি দিয়েছে সেটি তুমি। তোমার অব্যক্ত অথচ পূর্ণ বিকশিত অসীম ভালোবাসা আমি সযতনে গচ্ছিত রাখবো।

কলমে সৌমেন দেবনাথ, যশোর, বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here