কম্বোজ রাজার দেশে

0
684

রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানাতে যাবার তাড়া আজ একটু বেশি ঘুমাতে যাবে ঋক বাবু। কখনো জঙ্গল, কখনো মহাকাশ, কখনো বা ইতিহাসএর গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে না জানি কত বার পাড়ি দিয়েছে কত অজানাতে, কত বার পথ হারিয়েছে আমাজনের জঙ্গলে, রাজার সাথে তলোয়ার হাতে যুদ্ধে জিতেছে। আজকের গল্পে ঋক পৌঁছে গেছে কম্বোডিয়া, রসিয়ে রসিয়ে বাবা বলে চলেছে বিশ্বের এক বিস্ময়কর স্থাপত্য প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির আঙ্কোর ওয়াটএর রহস্যময় ইতিহাস, হাজার বছর আগের গল্প,কম্বোজ রাজার দেশ আজকের কম্বোডিয়া, সে দেশে মানুষ বুদ্ধের পূজারী, বিভোর হয়ে শুনছে ঋক, মনে হচ্ছে যদি ওখানে যাওয়া যেত, শুনতে শুনতে হারিয়ে যাচ্ছে কম্বোজ রাজার দেশে, দু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, গল্পটা যেন ছবি হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে, ধীরে ধীরে গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে যাচ্ছে ঋক। 

  চারদিক জঙ্গল, জনমানবের চিহ্ন নেই, সামনে একটা অনেক পুরানো বিশাল মন্দির, ঠিক বাবার গল্পের আঙ্কোর ওয়াট এর মতো, আশেপাশে ঘুরে দেখতে দেখতে জঙ্গল ছেড়ে কখন জানি মন্দিরের ভিতর চলে এসেছে খেয়াল করেনি ঋক,জায়গাটা গা ছমছম করা, কেমন যেন আলোআঁধারি, রহস্য মোড়া,  ঋক মুগ্ধ হয়ে দেখছে ভাস্কর্য, পাথরের দেব মূর্তি, কারুকার্য, আর অবাক হয়ে ভাবছে কি অপূর্ব, কিন্তু বুদ্ধের দেশে বিষ্ণু মন্দির কি করে হলো? প্রশ্নটা ঋকের মুখ ফসকে হটাৎ যেন বেরিয়ে গেলকে বানাল?” মন্দিরের দেওয়ালে ঘুরে ঘুরে অনুরণন হতে লাগল  কেবানা? কেবানা? কেবানা?”

কে বানাল?” চমকে ওঠে ঋক, ঠিক ওর পিছনে, কেমন যেন জাদুকরের মতো পোশাক পরে একজন বয়স্ক মানুষ।

আপনি?” বৃদ্ধ উত্তর না দিয়ে ধমক দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করে, “জানতে চাও কে বানাল?” মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে ঋক

এস তবে

একটা বিশাল কাঠের দরজার গায়ে যুদ্ধের নকশা করা, যুদ্ধগামী সৈন্য দল, হাতি, ঘোড়া, লোকলস্কর, ঋক কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বৃদ্ধ বলে – “ক্ষেমরা চলেছে চাম এর সাথে সম্যক়্ সমরে।

ঝনঝন আওয়াজ করে খুলে গেলো বিশাল দরজা, চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে পা দিতেই মনে হলো শরীরটা যেন হওয়া তে ভেসে যাচ্ছে, পালকের থেকেও হালকা লাগছে নিজেকে, হটাৎ একটা ঝাঁকুনি তে চোখ  খুলে দেখে দিনের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক, অদ্ভুত পোশাক পরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে ঋক কে ঘিরে।

কিন্তু এটা কোন জায়গা, মোটা মোটা পাথরের স্তম্ভ, উঁচু সিঁড়ি, বিশাল বিশাল হাতি, ঘোড়া, সিংহ মূর্তি, ঠিক হিস্ট্রি চ্যানেলে যেমন রাজ্দরবার দেখায় তেমন, কিন্তু কোথায় গেলো সেই জাদুকর?

ওঃ! তো সিংহাসনে, সেই বুঝি রাজা!

আরিব্বাস!  রাজা তো একেবারে হীরকের রাজার মতো দেখতে, জোর হাসি পায় ঋকের কিন্তু চেপে যায়, ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রাজার লোকলস্কর, অস্ত্র হাতে সবাই জয়ধ্বনি করছে মহারাজ জয়বর্মনের এর জয়.

এতক্ষনে ঋক বুঝেছে সে বন্দি রাজা জয়বর্মন এর হাতে, বুঝতে আর বাকি নেই দরজাটা ছিল টাইম মেশিন আর সে এখন দ্বাদশ শতাব্দীতে।

জি!! এই তো চাই, উফফ! কি মজা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ঋকের

অল্প অল্প ভয় হচ্ছে যদিও, এই বুঝি সাধের গর্দানটা বাদ হয়ে গেলো।

ঋক দেখছে শুরু হলো দরবারের রাজকার্য:

মন্ত্রী :     মহারাজ! আঙ্কোর ওয়াট  গভীর রাতে,

             ধরেছি জারে হাতে নাতে,

            বালক বুঝি শত্রু চাম এর লোক,

            বেত্রাঘাত নাকি শিরশ্ছেদ? আদেশ হোক।
রাজা:    বল হে বালক, আমার দেশে,

            এসেছ কি অভিলাষে?

মন্ত্রী:    কানে কি যাই না কথা, কালার হদ্দ?

             না মহারাজ কি বলেন?

ঋক:     হাঁ !! আপনি তো সেই বৃদ্ধ ,

          কি মন্ত্রে রাজা বোনে গেলেন?

রাজা:   চোপরও বেয়াদব,  দেশ আমার,

          ধৃষ্টতার ক্ষমা নেই, জেনে রেখো একবার।

ঋক:    রাজন আমি পর্যটক - বিশ্ব দেখার শখ,

          দেখবো আর লিখবো-মহারাজের কীর্তি

          এতে কার কি ক্ষতি?

          যুগে যুগে লোক জানবে আপনার ইতিহাস

           টুকুই অভিলাষ।

রাজা:  দেখবে আর লিখবে, উত্তম বিচার,

           ঠিক কতদিন দরকার?

ঋক:   বেশি নয়, মাস কয় --

রাজা:  মন্ত্রী- ঠিকমতো হওয়া চাই অতিথি সৎকার।

মন্ত্রী:     জো হুকুম সরকার।

রাজা:   বটে !! তুমি ভবঘুরে - তা থাকা হয় কতদূরে?

ঋক:    বাড়ী মোর বাংলা, ভারতের অংশ,

          মা বাপ্ আছে সেথা, দত্তবংশ।

          মার্ ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যাই সত্বর,

          কত দিনে ছুটি পাবো যদি পাই উত্তর।

রাজা:   আমি  তো বীর কম না, আগে হোক সেই রচনা!

           ছুটি হবে তারপর। কোরোনা কো ছটফট,

           কি জানতে চাও, যদি বলে দাও

           উত্তর দিয়ে দিই চটপট।

ঋক:    মার্জনা, মহারাজ মার্জনা,

           কেবল একটা উত্তর করি প্রার্থনা।

          এত দেবালয়, এত বিগ্রহ

          কে করল নির্মাণ জানবার আগ্রহ!

রাজা:  সকলি আমার কীর্তি!

ঋক:   সাধু!!! বলতে কি আছে আপত্তি?

          কেমন করে বৌদ্ধ দেশে হিন্দু দেবতা

          ভাবতে গেলে গুলিয়ে যাই, চুলকোই মাথা,

          আপনি তো নয় হিন্দু, বুঝিনা এক বিন্দু।

রাজা:  : চোপ!! আমার ধর্ম রাজ্ ধর্ম, ন্যায়  সততা

          অন্য কোনো ধর্মে আমার নেই কোন মাথা ব্যথা।

ঋক:    ধন্য মহারাজা, কি অপূর্ব বিচার, কি দারুন কথা,

           দয়া করে শোনান যদি আপনার বীরগাথা 

রাজা:   সে ছিল বীরত্ব, সততা নাকি মূঢ়তা?

           সে বিচার করবে জনতা,

           চিরদিন মেনেছি সততার জয়,

           প্রাণ যদি যাই যাক, মিথ্যাচার যেন না হয়।

মন্ত্রী:     সৎকার্যে ত্যাগ স্বীকার মহাবীরের কাজ,

            কম্বোজ দেশের গর্ব তুমি ক্ষেমের মহারাজ।

জনগণ: জয় সত্যবাদী, সৎ, মহাবীর, অকুতোভয়,

            মহারাজ শ্রী সপ্তম জয়বর্মনের জয়!!

রাজা:    সে বছর ফসল নাই, শূন্য কোষাগার,

            প্রজাগনে অভুক্ত, রাজ্যে অনাহার,

           এমন দিনে বণিক এলো, মস্ত জাহাজ চেপে,

            ধার নিলাম শস্য যত সের মেপে মেপে,

            কেমন করে মূল্য দেব শূন্য কোষাগার?

            বণিক বলে চিন্তা কিসের, না হয় রইল ধার।

            বছর পরে বণিক এলো, লজ্জায় মরে যাই,

           এত অর্থ শোধ দেবার যোগান কোথা পাই?

ঋক :   সেই তো রাজা, বিপুল অর্থ ! বণিক কি তবে ফিরল ব্যর্থ?

রাজা:    না বালক, এবার ছাড়ান নাই,

             বণিক বলল সুদসহ মূল্য চাই,

             পাই পয়সা হিসাব করে চলে যাবো রাজ্য ছেড়ে,

             আমি বললাম সুদসহ মূল দেব!  অর্থ যে নাই বণিক,

             তুমি নিয়ে যাও আমার যা কিছু ধন, রত্ন,মনি-মানিক।

             বণিক বলে সে সব আমার দেদার আছে, রত্নে লোভ নাই,

             কর্জ তোমার মাফ করব, যদি  রাজ্য পাই।

             শুনে বনিকের সাধ, ক্রোধে অঙ্গ যায় জ্বলে,

             মন্ত্রী বলে, আদেশ হলে, ব্যাটা কে চড়াবো শুলে।

             স্পর্ধা দেখি কম নয় বেনে, উপকার তোমার আছে মনে

             অসময়ে বন্ধু তুমি দিয়েছিলে ধার ,

             রাজ মহল? নাকি অন্ধ কারাগার?

             বল বন্ধু কোথায় করবো তোমার অতিথি সৎকার।

ঋক:      বেনে বুঝি ভয় পেল, জারিজুরি ভুলে গেল?

             কর জোড়ে যাঁচিলো  মুক্তি?

রাজা:     না হে ছোকরা, বেনের ছিল আরো যুক্তি।

ঋক:      যা! এত ধমক এত চমক সব গেল জলে,

রাজা:     আমিও সেদিন হার মানলাম বেনের বুদ্ধি বলে,

              একটি বাক্যে ঘটল আমার মাথায় বজ্রাঘাত,

             এক চালেতেই বেনে রাজা, আমি কিস্তিমাত।

ঋক:      একেবারে কিস্তিমাত, তুমি হলে কুপোকাত,

              বল না রাজা কি সেই চাল?

রাজা:     আমার সততা কে সে করলে ঢাল,

              বললে কর্জ শোধ না করা মহাপাতকের কাজ,

              পরের জন্মে কুকুর হবে তুমি মহারাজ,

             ধন গেছে মান গেছে, গেছে রাজ্ ধর্ম -সততা।

              ঢিঃ ঢিঃ ফেলে রটিয়ে দেব, তোমার সব কু-কথা।

             প্রজারা সব ছিঃ ছিঃ করবে থুতু দেবে গায়,

             চুনকালী পড়বে মুখে? মুখ লুকাবার কি উপায়?

ঋক:      বটে! বেনের বুদ্ধি আছে ঘটে।

রাজা:     অতএব !! অবশেষে, পর হলাম নিজ দেশে,

              আমার রত্ন সিংহাসনে, রাজা হয়ে বসল বেনে।

              রাজার ভারী ধর্মে মতি, বানাল সে সব মন্দির মুরতি।

              কম্বোজ দেশে খেমের পরে, নির্মাণ হলো রাজ্য জুড়ে।

ঋক:       আর খেমর বংশ?

রাজা:       হলো ধ্বংস!!!!        হা হা হা হা। ……..

            হা হা হা হা.. কি ভয়ঙ্কর অট্টহাসি রাজার, হাসির চোটে কাঁপছে রাজপ্রাসাদ, ফেটে পরছে 
           স্তম্ভ, সিংহ মূর্তি, গড়িয়ে পড়ছে বড় বড় পাথর, প্রাণপনে ছুটছে ঋক সেই দরজার দিকে, 
           আর হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, আর একটু, আর একটু, আর-
  • না না। আর একটুও নয়, ওঠ! ওঠ!”

ধড়ফড় করে ওঠে ঋকওঃ! কোথায় অট্টহাসি! কোথায় ভূমিকম্প! মা জোরে জোরে নাড়িয়ে বলছে

স্কুল আছে, আর ঘুমলে স্কুল বাস চলে যাবে এবার, ওঠ।

আর বাস!  একটু হলে কম্বোজ রাজার দেশে প্রাণটাই চলে যেত, কি বাঁচা যে বেঁচে গেছি!  থ্যাংকস গড।

        

 

লেখিকা পরিচিতিশিল্পী দত্ত

SOURCEশিল্পী দত্ত
Previous articleপ্রায়শ্চিত্ত
Next articleমন নিয়ে
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here