নন্দিতা
খুব জোরে ছুটে আসছিলো নন্দিতা । অফিস এর বাস টা আজ কোনো ভাবেই মিস করলে চলবে না তার । প্রতিদিন দেরিতে যেতে যেতে এমন এক দুরাবস্থা যে অফিস এ তাড়াতাড়ি গেলে সবাই মজা করতে শুরু করে দেয় ।এরকম ভাবে বেশিদিন চললে মনে হয়না আর চাকরিটা থাকবে বলে । আসলে তাতুন কে কাজের লোক এর হাতে ছেড়ে আসতে এক দম ইচ্ছা করে না নন্দিতার । তাই যতটা পারে সব কাজ সম্পূর্ণ করে , তাতুন কে ঘুম পাড়িয়ে তারপর সে অফিস পাড়ি দেয় ।অথচ আজ থেকে মাত্র ২ বছর আগে ও দিনগুলি এমন ছিল না । যাই হোক এসব হাবিজাবি ভাবার সময় এখন নন্দিতার হাতে নেই , তার এখন প্রধান উদ্দেশ্য যেমন ভাবেই হোক এই বাস টাকে মিস না করা । এমনিতে অফিস খুব এক টা দূরে নয় নন্দিতার , ফ্লাট থেকে খুব বেশি হলে ২০ মিনিট এর দূরত্ব । বিদেশী কিছু ক্লাইন্ট সামলাতে হয় বলে, এরকম অদ্ভুত সময় এ অফিস করতে পারে সে । এই প্রজেক্ট এ ঢোকার জন্য বস এর ভালোই সাহায্য পেয়েছিলো নন্দিতা । যাই হোক বাস টা এসে গেছে , আর এটা স্টার্টিং স্টপেজ , তাই জায়গা পেতে সে রকম অসুবিধা হয়না । বাসে উঠে ভালো করে বসার পর ঢোক ঢোক করে কিছু টা জল খেয়ে নিলো নন্দিতা । জল খেতে খেতে হঠাৎ দেখলো একটা লাল মতো কি যেন বোতলে এ লেগে আছে , ভালো করে দেখতে দেখলো তার লাল টিপ্ টা আর মাথায় নেই বোতল এ অবস্থান করছে । খুব হাসি পেয়ে গেলো নন্দিতার , এটা নিশ্চয় তাতুন র কাজ , ঘুম এর আগে কখন এই কাজ করেছে নন্দিতা বুঝতে ও পারেনি । বড্ড দুষটু হয়েছে ছেলে টা । এখন একটু একটু জেদি ও হচ্ছে । যতক্ষণ নন্দিতা থাকে ততক্ষন তাকে ছাড়তেই চাইনা । এমন একটা ভাব করে যেন ছাড়লেই মা কে সে হারিয়ে ফেলবে । আর কাজের মাসির কাছেই তো এক দম যেতে চাই না , অনেক বার ভেবেছে নন্দিতা কিছু একটা ব্যবস্থা করবে , কিন্তু কিছুই ভেবে উঠতে পারে না । অথচ আজ থেকে ঠিক ২ বছর আগে অবস্থা এরকম ছিল না । যতদিন সন্দীপ এখানে ছিল । হঠাৎ সন্দীপ র কথা মনে পড়তে মন টা কেমন যেন রাগে জলে উঠলো নন্দিতার , কিছুতেই যেন ভুলতে পারেনা সে সেই দিন টাকে , যে দিন সব ছেড়ে তাতুন এর হাত ধরে সে বেরিয়ে এসেছিলো, আর সন্দীপ এক বার ও তাকে আটকানোর কোনো চেষ্টা টুকু ও করেনি । এসব ভাবতে লাগলেই কেমন যেন মনের মধ্যে এক অদ্ভুত জোর অনুভব করে নন্দিতা । মনে হয় শুধু সে পারবে তাকে যে পারতেই হবে । এসব হাবি জাবি ভাবতে ভাবতে কখন যেন অফিস এর গন্তব্যস্থল চলে এলো নন্দিতার । সব চিন্তা কে অফিস এর সিট এ রেখে নিজের একটু ছোট্ট মেকআপ করে, মোবাইল এক বার পরখ করে নিলো সে নিজেকে । লাগতে হবে তাকে কোম্পানী এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর র মতো , নিজের সাজে এমন এক পার্সোনালিটি রাখে নন্দিতা যে কারোর সাহস নেই তার সামনে এসে কিছু বলার , যে কেন তুমি রোজ লেট করছো । এমন কি নন্দিতা র বস ও নন্দিতা কে একটু সমঝে এ চলে । যাই হোক অফিস এ ঢুকেই দু চারটে হ্যালো বলার পর এ পুরোপুরি কাজে মন দিলো নন্দিতা । এই মুহূর্তের জন্য উড়িয়ে দিলো মন থেকে তাতুন আর তার দুঃখের সব কাহিনী । এমন জীবন এই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে ।
সন্দীপ
আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোবার প্ল্যান করেছে সন্দীপ । কাজ গুলো তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গোটানোর চেষ্টা করছে । কাল লন্ডন যেতে হবে তাকে , মাত্রা ৬ মাস হয়েছে সে জাপান থেকে ফিরেছে , এই মুহূর্তে বাইরে যাবার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না সন্দীপ এর , কিন্তু সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি টাই এরকম , এখানে না খুব একটা কথা শোনা হয় না । তবে টুর তা খুব ই ছোট ম্যাক্সিমাম ১০ দিন , তাই রাজি হয়ে গেছে , এই ১০ দিন এর মধ্যেই আবার তাতুন এর জন্মদিন পরে গেছে , তাই ওকে আজ একটু বুঝিয়ে আস্তে হবে । শেষ ২ বছর জন্মদিন এর দিন লুকিয়ে লুকিয়ে ওর সাথে দেখা করে ওর প্রিয় গেম গুলো গেম জোনে নিয়ে গিয়ে খেলিয়েছিলাম ।খুব খুশি হয়েছিল তাতুন, বলেছিলো ‘এটাই আমার জন্মদিন এর সব থেকে বড় গিফট বাবা’ । মন টা আনন্দে ভরে উঠেছিল সন্দীপ এর । কত ছোট্ট জিনিস এ তাতুন খুশি হয়ে যাই সত্যি এ ভাবা যাই না , তবে মা এর মতো জেদি ও আছে ছেলে , কিছু দিন দেখা না করলে বেশ রেগে যাই । নন্দিতার কড়া হুকুম থাকা সত্ত্বেও ও কিন্তু সন্দীপ এর সাথে ঠিক দেখা করে নেই , ছোট্ট একটা ফোন করে হুকুম করে দেয় বাবু , মা কে কিছুটি জানতে দেয় না । জানিনা ও আমার আর নন্দিতা সম্পর্ক নিয়ে কি বোঝে , কিন্তু ২ জন এর সাথে যে সমান ভাবে মেশে সেটা বেশ ভালো বুঝতে পারি । নন্দিতা যে দিন চলে গেছিলো শুনেছিলাম তাতুন নাকি খুব কেঁদেছিলো , ৬ টা মাস আমাদের দেখা ই হয় নি । মাঝে মাঝে ওর স্কুল এ যেতাম , নন্দিতার অফিস এ ও , কিন্তু ২ জন এর কারোর সামনে যাবার সাহস করে উঠতে পারিনি । সে দিন রাগ করে যখন নন্দিতা চলে গেলো , তখন সত্যি ই ভাবিনি ও আর ফিরবে না । এখন নন্দিতা র কথা মনে করলে সেই কলেজ জীবন এর কথাই ফিরে যেতে ইচ্ছা করে । সেই দিন গুলো যখন কলেজ এর মাঠে দু জন এ হাতে হাত রাখলেই কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম , সব কথা বন্ধ করে সেই তাকিয়ে থাকা নন্দিতা র দিকে । আজ ও ভাবলে শিহরণ লাগে । আমি কখনোই কলেজ এর খুব আকর্ষিত কোনো ছেলে ছিলাম না , কিন্তু নন্দিতা ছিল ভীষণ জনপ্রিয় , সব ছেলে রাই প্রায় ওর জন্য পাগল ছিল । আমি ও ছিলাম , রাতুল , অরিত্র , গুরুং সবাই ছিল ওর জন্য পাগল । পরে জেনেছিলাম রাতুল নাকি প্রপোস ও করেছিল ওকে । আমার সাথে ওর প্রথম দেখা হয় কলেজ এর মাঠের শেষে একটা গাছ তলায় , ওদিকে সাধারণত কেউ যাই না ওর পরেই গার্লস হোস্টেল বলে । আমি সেদিন গেছিলাম জয়িতা ম্যাম কে একটা বই ফেরত দিতে , আসার পথে দেখি নন্দিতা দাঁড়িয়ে আছে , একটু সংকোচ নিয়ে এ জিজ্ঞেস করলাম অন্ধকার এ কে দাঁড়িয়ে আছো নন্দিতা কি ? ও যখন আমার দিকে তাকালো চোখ পুরো জল এ ভেসে যাচ্ছে আর হাতে একটা ফোন, আমি কোনো কিছু না ভেবেই ওর ফোন টা নিয়ে নিলাম , ওদিক থেকে কোনো মহিলার গলা ছিল , সে জানালো নন্দিতার বাবা কাল বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে , তুমি ওকে যেমন করে হোক হাসপাতাল এ নিয়ে এস । বুঝতে পারলাম ওর মায়ের গলা । বললাম এখানে তো আন্টি গার্ডিয়ান ছাড়া কোনো মেয়ে কে ছাড়ে না , তাতে উনি বললেন বাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ওকে আনতে যাওয়া । কোন হাসপাতাল এ আছে জেনে নিয়ে আমি বললাম আমি দেখছি । নন্দিতা কে বললাম দুঃখ করো না আমার সাথে এস । নন্দিতা বললো ও হোস্টেল এ যেতে চাই না , এখন থেকেই পালিয়ে যাবে , হোস্টেল এ গেলে ওকে যেতে দেবে না । আমি কিছুক্ষন ভেবে জয়িতা ম্যাম কে বললাম একটু আসার জন্য , ম্যাম কে সব কিছু খুলে বললাম , ম্যাম বললো নন্দিতা আমি তোমার সাথে যাবো , সন্দীপ তুমি গাড়ির ব্যাবস্থা করো আর তুমি ও চলো আমাদের সাথে । লোকাল ছেলে বলে ফোন করে গাড়ির ব্যাবস্থা করতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি সে দিন । নন্দিতা কে হাসপাতাল এ ঘুরিয়ে হোস্টেল এ ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল সে দিন । কেন জানিনা সে দিন এর পর থেকেই নন্দিতা আমাকে খুব কাছের বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিল । তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই সময় টা চলে এসেছিলো , কে আগে বলবে , যে আমি তোমাকে ভালোবাসি আর বিয়ে করতে চাই । এই ভাবনার জগৎ থেকে আমাকে ‘ভাবনা’ ই বার করে আনলো , ভাবনা আমার অফিস ফ্রেন্ড , ভালো নাম ভবতেশ , কিন্তু কাজ করতে গিয়ে এতো ভাবে ও তাই ওকে সবাই আমরা মজা করে ভাবনা বলে ডাকি । ভাবনা বললো কিরে যাবিনা আজ ছেলের কাছে ? শুনেই মনে পরে গেলো তাতুন এর সেই হাসি হাসি মুখ টা, সব ভুলে আবার কাজ শেষ করার দিকে মন দিলো সন্দীপ ।
অনির্বান
আজ অনেক দিন এর ছুটি কাটিয়ে নিজের ক্লিনিক এ বসতে চলেছে অনির্বান । এতো বড় দিন এর জন্য ছুটি সাধারণত নেই না সে । কিন্তু মন খারাপ এমন জিনিস নিজের প্রফেশনাল সব ধর্ম কেই কেমন যেন ভুলিয়ে দেয় । তোর্সার সাথে ছাড়া ছাড়ির পর নিজের পরিচয় ছেড়ে কোথাও চলে যাবার ইচ্ছা ভীষণ ভাবে পেয়ে বসেছিল অনির্বান কে । তাই চলে গেছিলো বেনারস , নিজের এই ডাক্তারি বেশ ছেড়ে মহাদেব ভক্ত হিসাবে নিজেকে তার সাধনাতেই ডুবিয়ে দিয়েছিলো । কিন্তু ৪ থেকে ৫ দিন এই ভাবে যেতেই মন থেকে যেন বার বার একটাই কথা বলছিলো , ফিরে আস্তে , রুগীর সেবায় নিজেকে নিমজ্জিত করাটাই যেন তার একান্ত কর্তব্য । এক দিন একটা বাজে স্বপ্ন ও দেখে ফেললাম , কোনো একটি বাচ্ছা ছেলের অপারেশন টেবিল এই ডেথ হয়েছে শুধু আমি যেতে পারিনি বলে । আর দেরি করিনি , ফোন করলাম আমার ক্লিনিক এ, সব পেশেন্ট দের এপয়েন্টমেন্ট সামনের সপ্তাহেই ফিক্স করতে বলে কলকাতায় ফিরে এলাম। জানিনা তোর্সা খবর টা পেয়েছে কিনা । তোর্সা আমার থেকে ৩ বছরের ছোট , ভীষণ চুপ চাপ , শান্ত মিষ্টি স্বভাব এর মেয়ে টিকে যে দিন প্রথম দেখলাম নার্সিং স্টাফ দের মধ্যে আমার বেশ ভালো লেগে গেলো । এর পর ফোন নম্বর জোগাড় করা আর অল্প সল্প কথা বার্তার মধ্যে কখন যে ভালো লাগা টা ভালো বাসা হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি । যদিও তখন ও আমার ততটা নাম জোশ হয়নি , সবে ডাক্তার হিসাবে হাত পাকাচ্ছিলাম । এর পর ধীরে ধীরে নাম যশ বাড়তে থাকলো আমার । তুলনায় তোর্সা ভালো কাজ করলে ও কম কথা বলার জন্য সব কৃতিত্ব ওর সিনিওর রাই নিয়ে চলে যেত । আমি পুশ করে ওকে আমাদের সার্জারি ডিপার্টমেন্ট এ নিয়ে এলাম । অল্প দিনেই মেয়ে টা কিন্তু সব ডাক্তার দের ফেভারিটে চলে এলো । ব্যাপার টাই আমি বেশ খুশি ছিলাম । কিন্তু ছন্দ পতন হলো আগের সপ্তাহেই , আমার এসসিটেন্স হিসাবে সবসময় ওর নাম থাকে , এটাই স্বাভাবিক । সে দিন ম্যাডাম আমার কাছে এসে রিকোয়েস্ট করছে , কিছু দিন ও ডাক্তার আবির এর সাথে কাজ করতে চাই , কার কাছ থেকে নাকি শুনেছে উনি একটু অন্য রকম ভাবে কাজ করেন , লন্ডন রিটার্ন , তাই ওনাকে এসিস্ট করে ও নলেজ গেইন করতে চাই । আমি প্রথম এ ব্যাপার টাকে গুরুত্ব দিই নি, তারপর ঠিক আমার অপারেশন আগে যখন ওর টেক্সট পেলাম ‘কিছু মনে করো না প্লিজ , তুমি ই তো বলো প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ এক করো না , আমার অনেক কিছু শেখার আছে ডাক্তার আবির র কাছে , উনি অনেক সিনিওর , তোমার কাছে আমি ফিরবো কিছু দিন ওনার সাথে থাকি প্লিজ । আজকের এলাম না , নিজের ডিউটি চেঞ্জ করানোর জন্য , প্লিজ রাগ করো না ।’ সব টা পড়ে রাগ পুরো সপ্তমে উঠে গেলো অনুপম এর । যা হোক করে অপারেশন টা কমপ্লিট করে , ইচ্ছা করেই রুগী দেখার নাম করে বসে রইলাম । উদ্দেশ্য ২ টো , ডাক্তার আবির কে দেখা, র তোর্সার সাথে দেখা করা । কিন্তু ডাক্তার আবির আসার অনেক আগেই তোর্সার সাথে দেখা হয়ে গেলো, আমার কেবিন এ এলে ওকে খুব শান্ত গলায় বললাম এসব কি শুরু করেছো তুমি ? এটা করার কি কোনো দরকার ছিল । বললো ছাড়ো না রাগ করোনা , একটা টিফিন বাক্স এগিয়ে দিয়ে বললো তোমার জন্য মাংস করেছিলাম , ছোট করে খেয়ে বলো কেমন হয়েছে । ওর এই নিরলস , ভীষণ অগ্র্রাজ্য করার এই অদ্ভুত স্বভাব কে কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না আমি । রাগে ফেটে পড়লাম ওর উপর , সেই মুহূর্তে যা মনে এসেছে সব এ ওকে বলে দিয়েছি । শেষে যখন বলছি আমি চলে যাবো তোমার জীবন থেকে, আমার কোনো ইম্পর্টেন্স নেই তো তোমার কাছে, তখন ও মেয়েটার কি ভীষণ নির্লিপ্ত উত্তর এলো যদি চলে যেতে চাও আমি তো তোমাকে আটকাতে পারবো না, যাবে, এখন আমাকে কি করতে হবে বোলো । অবাক হয়ে গেলাম উত্তর শুনে , এই মেয়ে কেই এতো ভালো বেসেছিলাম আমি , ছি , তখন ই ওকে বললাম তুমি তোমার এই মাংস নিয়ে গিয়ে তোমার পেয়ার এর লোক দের খাওয়াও আর আমাকে মুক্তি দাও । চলে যাও এখান থেকে , এখানে এ থাকার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার । বেশ এই শেষ কথা হয়েছিল তোর্সার সাথে । সে দিন রাতেই রওনা দেয় বেনারস এর উদ্দেশ্যে । ফোন ও সুইচ অফ করে দেয় যাতে কেউ ডিসটার্ব না করতে পারে । আজ এতো দিন পরে আবার রুগী দেখবো একটু টেনশন যে হছে না তা নয় । তবে ২–৩ জন রুগী দেখার পর , এই জড়তা টা অটোমেটিক কেটে যাই । অন্তত লাস্ট ৫ বছর এ ডাক্তার এক্সপেরিয়েন্স তো তাই এ বলে । ‘call the patient ’ বলে নিজের সিট এ গিয়ে বসলো অনির্বান , ফিরে পেলো যেন কয়েক দিন এর হারিয়ে যাওয়া সেই ডাক্তারি সত্তা কে ।
তোর্সা
সবে হাসপাতাল থেকে ফিরে মা কে ফোন করছিলো তোর্সা । হাসপাতাল কি হলো সব কিছু আপডেট দিয়ে সবে ফোন রাখতে যাবে , মা এর সেই বিধিসম্মত কিন্তু সব থেকে কঠিন প্রশ্নর মুখে পড়লো সে
, খাওয়াদাওয়া করেছিস ? এর উত্তর দিতে বেশ বেগ পেতে হয় তোর্সা কে , কারণ সকাল এর ডিউটি থাকলে ম্যাক্সিমাম দিন ই খাবার রেডি থাকে না হোস্টেল । আগে অনির্বান দা যতদিন সাথে থাকতো সকাল এর খাবার ক্যান্টিন এ হয়ে যেত । জোর করে নিয়ে যেত সে , তাই অভ্যাস হয়ে গেছিলো তোর্সার । অনির্বান দার জন্য মাঝে মাঝেই মন টা খুব খারাপ লাগে তোর্সার । আর যাই হোক তোর্সার অনেক উপকার করেছে সে । তোর্সা নিজেই এখনো বুঝতে পারেনা সত্যিই সে অনির্বান দা কে ভালো বাসে কিনা । তবে পছন্দ যে করতো ভীষণ সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই । মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয় , মনে হয় ছুটে চলে যাই অনির্বান দার কাছে , কিন্তু কিছুতেই তোর্সা বুঝতে পারে না , কি অধিকারে সে যাবে তার কাছে । অনির্বান দা নিজেই তাকে কেবিন থেকে বার করে দিয়েছে , বলেছে আর কোনোদিন সে আমার মুখ দেখতে চাই না । তাহলে কোন অধিকার এ সে যাবে ? শুধুমাত্র অনির্বান দা কোনো এক দিন ইমোশনাল হয়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়ে ছিল বলে ? তোর্সা সময় চেয়েছিলো , কারণ এখনো সে নিজের নার্সিং ক্যারিয়ার কে তৈরি তেই ব্যস্ত । তোর্সা ভাবতেই পারিনি ডাক্তার আবির এর সাথে কাজ করতে চাওয়ার জন্য অনির্বান দা এতো টা রাগ করবে । অনির্বান দা র এই রূপ তোর্সা আগে দেখেনি , খুব ভয় পেয়ে গেছিলো সে । প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন , খুব কষ্ট পেয়েছিলো । সমস্ত ভালো লাগা যেন হঠাৎ চলে গেছিলো , মন টা বিষাদ হয়ে গেছিলো তার । বরাবর তোর্সা একটু কম কথা বলে , তাই নিজের মনের কথা কাউকে বলার বিশেষ সুযোগ হয়না তার । বন্ধু ও সেরকম কেউ নেই যার সাথে এসব কথা বলবে , আর বাড়িতে মা কে তো এসব কথা বলা যাই না । অয়ন্তিকা ও ডিউটি করে ফিরেছে মনে হলো পাশের ঘরে । হোস্টেল এ থাকলেও ওদের নিজের রান্না নিজেকেই করে নিতে হয় । তোর্সা দেখলো ক্ষিদে আর ঘুম ২ টি এক সাথে ভালোই বেগ দিছে তাকে । তাই উঠে পড়লো তোর্সা , ফ্রেশ হয়ে এসে একটু ম্যাগি বানিয়ে খেয়ে নেবে , তারপর শোবে । আগে হলে তোর্সা শুয়ে এ পড়তো , কিন্তু এখন শুতে গেলে বড্ড অনির্বান র কথা মনে পরে , ছেলে টা সে দিন এর পর কোথায় গেছে কি করছে কিছুই জানেনা তোর্সা । এমন কি অনির্বান দার বাড়ির কোনো নম্বর ও তার কাছে নেই । তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি নেই । তবে তোর্সা ঠিক করেছে আর অনির্বান দার সাথে বেশি কথা বলবে না , যেটুকু প্রফেশনাল লাইফ এ দরকার তার বাইরে কোনো কথা সে বলবে না । শুধু মন খারাপ লাগছে ছেলে টার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না বোলে । সে চাই না তার জন্য অনির্বান দার খারাপ কিছু হয়ে যাক । যতই হোক এই হাসপাতাল এ আসার পর অনির্বান দা এ ছিল তার বেস্ট ফ্রেন্ড । এই সব ভাবতে ভাবতেই ম্যাগি রেডি হয়ে গেলো তোর্সার । খেতে খেতে কাজ এর একটি অপারেশন র ভিডিও দেখতে দেখতে অনির্বান র সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো সে ।
নন্দিতা
আজ কাজের চাপ টা যেন অনেক টাই বেশি । রাত হয়ে যাবে অনেক টা । মা কে ফোন করে জানিয়ে দিলো সে , কাজের দিদি কে ও এক ফোন করে নিলো , সে যতক্ষণ না ফেরে তাতুন কে ছেড়ে যেন যাই না সে । আসলে নন্দিতা র ভাগ্য টাই খারাপ , বিয়ের পরে পরেই বাবা কে হারালো সে , আর বাবা মারা যাবার পর যেন কোনো কারণ এই হোক মা হঠাৎ হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো । ২ টো মিলিয়ে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল নন্দিতা । সে সময় সন্দীপ কে সব দিক থেকে পাশে না পেলে খুব বিপদে পড়তো সে । অল্প দিনের মধ্যেই তার শশুর বাড়ির কাছাকাছি একটা ফ্লাট কিনে মা কে নিয়ে আসে সে । সন্দীপ এর খুব আপত্তি ছিল এতে । সে চেয়ে ছিল নন্দিতার মা তাদের বাড়িতেই থাকুক । কিন্তু সন্দীপ এর বাবা মা কে নন্দিতার কোনো দিন এ খুব সুবিধার মনে হতো না , তাই কাছাকাছি ফ্লাট এই থাকবে সব সময় একটা লোক রেখে দিলেই হবে , এসব বলে ম্যানেজ করে নেই সে । সে দিন এর সেই সিদ্ধান্ত যে কত টা সঠিক ছিল তা আজ ভালোই করেই বুঝতে পারছে নন্দিতা । এখন মা এর সেই ছোট ফ্লাট ই তার আর তাতুন কাছে আসল বাড়ি হয়ে গেছে । আর সেই সন্দীপ যার উপর এতো ডিপেন্ড করতো সে আজ কের তার জীবন এ নেই । এসব ভাবনা দ্রুত ঝেড়ে ফেললো নন্দিতা , মন দিলো কাজে । এখুনি একটা ক্লায়েন্ট কল আছে । একবার ছোট চ্যাট করলো সে , ওদিক থেকে কোনো রিপ্লায় আসছে না দেখে একটু সময় পেলো রিলাক্স করার । এটা একটা বড় মুশকিল এর ব্যাপার হয়েছে , যে দিন নন্দিতা মনে করে আজ পুরোনো কথা ভাববে না, সেদিন এ সে সব থেকে বেশি ভাবতে শুরু করে । যেমন আজ কের , একটু টাইম পেয়েছে কোথায় রিলাক্স করবে তা নয় , বার বার মনে চলে আসে সেই দুঃসহ দিনের কথাটা । ২ বছর হয়ে গেছে তাও যেন ওই দিন টাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না সে । সে দিন এরকম এ কোনো এক কাজে আটকে পড়েছিল নন্দিতা , ফিরতে পারে নি সে আগে থেকে বলে দেয়া সময় এ । তাতে তাতুন কে একটু বেশি সময় দেখতে হয়ে ছিল সন্দীপ এর বাবা মা কে , কোনো এক অজানা কারণ এ সন্দীপ ও সেদিন আসতে দেরি করেছিল । অবশ্য অজানা কারণ নয় ওর কোনো এক বন্ধুর ফেয়ারওয়েল পার্টি ছিল ওই দিন । অফিস থেকে ফেরার পর আবহাওয়া যে ঠিক ঠাক নয় তা বেশ বুঝতে পারছিলো নন্দিতা । গিয়েই তাতুন কে কোলে নেবার পর থেকেই চুপি চুপি গোলা বর্ষণ শুরু হয়ে যাই । সন্দীপ ঘরে ফিরতেই হঠাৎ সরাসরি আক্রমণ শানাল । সরাসরি বলে দিলো নন্দিতা কে চাকরি ছাড়তে হবে , না হলেই এ বাড়িতে থাকা তার চলবে না । অন্য টাইম এ হলে সন্দীপ ও এর প্রতিবাদ করে কোনো এক অজানা কারণ এ সে করলো না । ওর মা বাবা বলে চললো ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে এ ভাবে , আমাদের বয়স হয়েছে , কত দিন আছি তার ঠিক নেই , তারপর কি হবে । আমাদের ছেলের জীবন শেষ হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি । এই সময় নন্দিতা সরাসারি জানিয়ে দেয় সে চাকরি ছাড়তে পারবে না , এটা তার একটা নিজস্ব আইডেন্টিফিকেশন , সেটা সে কোনো দিন ও ছাড়তে পারবে না । এতে আরো তেল এ জল পড়ার মতো হলো । হঠাৎ করেই সন্দীপ র বাবা মা নন্দিতার বাড়ি নিয়ে খারাপ কথা বলতে লাগলো , যেটা মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না নন্দিতার পক্ষে , ফেটে পড়লো সে , সে ও কিছু কথা বলে ফেললো সন্দীপ এর মা এর বাড়ি নিয়ে । সেই গন্ডগোল র থামানো গেলো না । সন্দীপ কে দেখলাম অদ্ভুত ভাবে শুধু থামানোর চেষ্টা করতে থাকলো , মা এর কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না । বরং বার বার নন্দিতা কে বলতে লাগলো থামার জন্য , যা একে বারেই মেনে নিতে পারলো না নন্দিতা । ডাইরেক্টলি জিজ্ঞেস করলো সন্দীপ কে তুমি কি চাও আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই ? সেটাই তোমার ভালো লাগবে । সন্দিপ নিশ্চুপ থাকলো অনেকক্ষণ , নন্দিতা বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলো সন্দীপ কে, একটু পসিটিউভে উত্তর খুঁজছিলো সে সন্দীপ র কাছ থেকে , বার বার চাইছিলো অন্তত এক টা তো কারণ থাকে এ বাড়িতে থাকার , সন্দীপ তো তাকে সাপোর্ট করুক । কিন্তু হা কপাল,নন্দিতা সেদিন সাপোর্ট পেলো না সন্দীপ এর , বরং উত্তর এলো তোমার যেটা ভালো মনে হয় তুমি করো, আমি বাঁধা দেব না । বেশ আর ফিরে তাকানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না নন্দিতার , সে দিন ই ডিসিশন নিয়ে নেই সে এই বাড়ি ছাড়বে । পরের দিন সকালে অফিস ছুটি নিয়ে , তাতুন কে নিয়ে সে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করলো মা এর এই ছোট ফ্লাট এ । ভেবেছিলো সন্দীপ নিশ্চয় এক বার বলবে থেকে যাও , কিন্তু সে পুরোপুরি নীরবতা পালন করলো । শুধু বেরোবার সময় তাতুন কে খুব জড়িয়ে ধরেছিলো , কাঁদছিলো কিনা কিছুই বুঝতে পারলাম না , এসব মানুষ দের নেকামোর আবার শেষ থাকে না । হঠাৎ চ্যাট টা একটিভ হয়ে উঠলো , আর ১৫ মিনিট এর মধ্যে মিটিং স্টার্ট হবে জানালো হলো সেই সুদূর জার্মানি থেকে । একটা কফি খেতে সিট থেকে উঠে এলো নন্দিতা । মাথা টা ভালোই ধরেছে , কাল আবার তাতুন এর জন্মদিন , আজ যে ভাবেই হোক কাল একটা ছুটি ম্যানেজ করতেই হবে , তাতুন এর সাথে সারাটা দিন কাটানো টা খুব জরুরি । এক বার সন্দীপ দের বাড়িতে ও নিয়ে যাই নন্দিতা , সে চাই না তাদের ভুল বোঝাবুঝি র জন্য তাতুন গুরুজন দের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হোক । বাইরে থেকে কাজের লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেয় , নন্দিতা ভেতরে ঢোকে না । এক কাপ কফি খেয়ে মাথা ব্যাথা টা একটু কমলো নন্দিতার । এই কফি র কাপ টা নিজেই এনে রেখেছে নন্দিতা , নিজের কফি নিজেই বানিয়ে নেই , অফিস থেকে যে কফি দেয় খাওয়া টা ভীষণ শক্ত হয়ে যাই তার কাছে । সিট এ ফিরেই মিটিং এর নম্বর ডায়াল করা শুরু করলো নন্দিতা , টার্গেট ২ টো , কল টা তাড়াতাড়ি শেষ করা আর কাল অফিস আসতে পারবে না ইটা এটা জানিয়ে দেয়া ।
সন্দীপ
তাতুন এর সাথে দেখা হলে মন যেন একেবারে ভোরে যাই সন্দীপ এর । ওর হাঁটা চলা , আদো আদো কথা বলা , বা আনন্দ করা সব ই যেন ভীষণ ভাবে অসামান্য । তাতুন র জন্য ওর ভীষণ ফেভারিট চকলেট আইসক্রিম নিয়ে এসেছিলো সে । অনেকক্ষণ ছেলের সাথে ভুল ভাল বক বক করে , প্রচুর খেলার পর , যখন সন্দীপ জানালো যে কাল তাতুন এর জন্মদিন এ সে দেখা করতে পারবে না , বাবা কে একটু বাইরে যেতে হবে, শুনে বাবুর রাগ দেখে কে । এই রাগ টাকে ও ভীষণ এনজয় করে সন্দীপ, কারণ এর সাথে সে পুরোনো সেই নন্দিতা কে খুঁজে পাই সে । এক বার ভিক্টোরিয়া যাবে বলে সব ঠিক , শেষ মুহূর্তে বাড়ির কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ এসে যাওয়ায় সে যেতে পারিনি , তাতে নন্দিতা এত রেগে গেছিলো ৭দিন তার সাথে কোথায় বলেনি । পরে অনেক অনুরোধে , হাতে পায়ে ধরে কথা বলাতে হয় । কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল , যদি আগে কোনো কিছুর সে নন্দিতা কে কথা দিয়ে থাকে সেটা করতেই হবে , অন্য কোনো পরে আসা রেসপনসিবিলিটি সে নিতে পারবে না । এই কথা দেয়া কে আজ কাল ভীষণ ভয় পাই সন্দীপ , এরকম এক কথা দেবার জন্য ই সে চাইলে ও নন্দিতা কে ফিরে আসতে অনুরোধ করতে পারবে না । কারণ সে কথা দিয়েছিলো নন্দিতা কে, নন্দিতা যদি নিজে থেকে তার জীবন থেকে চলে যেতে চাই সে বাধা হবে না । তাতুন বেশিক্ষন বাবা কে অমনোযোগী হিসাবে নিতে পারে না , জোর করে বাবার মুখ টা ধরে ঘুরিয়ে নিলো সে , বললো তুমি যদি না আসো আমি খুব কষ্ট পাবো বাবা । বললাম বাবা আমি ঠিক ২ দিন পরেই আসবো , তুমি শুধু বলো জন্মদিন এ কি চাই তোমার সেটাই নিয়ে আসবো আমি । শুনে তাতুন খুব খুশি হলো , যদিও আবদার খুব একটা বড় নয় , একটা সাইকেল চাই তার । বললাম হাজির হয়ে যাবে চিন্তা করোনা । এরকম হাবিজাবি আরো অনেক কিছু বক বক করার পর , তাতুন কে যখন ওর দিদার কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে আসছি , মন টা খুব খারাপ লাগছিলো সন্দীপ এর , মনে হলো নন্দিতা কে এক বার ফোন করবে সে , কিন্তু না নিজের প্রতিজ্ঞা কিছুতেই ভঙ্গ করবে না সে । নন্দিতা র সাথে যে ফোন এ কথা হয়নি তার সেটা ঠিক নয় , হয়েছে বেশ কয়েক বার , কিন্তু ভীষণ সীমাবদ্ধ সেই কথা, নিজেদের আপাত দৈনন্দিন কিছু আপডেট এর কথাই তারা আলোচনা করেছে , কোনো ভাবেই ফিরে আসার সামান্য তম ইঙ্গিত ও কখনো দেয় নি নন্দিতা । সন্দীপ র বার বার মনে হয় এক বার বলুক , কিন্তু কিছুই পসিটিভ পাই না সে । আজ সত্যি এই জীবন টার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে । বাবা , মা আজ কেমন যেন চাই নন্দিতা র তাতুন ফিরে আসুক , কিছু স্পষ্ট করে কিছু বলে না । তারা মনে করে তাদের জন্য আমার জীবন টা শেষ হয়ে গেলো । জানিনা নন্দিনী র মনে কি চলে , কিন্তু সন্দীপ র মনে এখনো কোথাও যেন নন্দিনী কে ফিরে পাবার ইচ্ছা ভীষণ ভাবে জাগ্রত । বাড়ি এসে গেছে সন্দীপ এর , এই রাস্তা দিয়ে হেঁটেই ফেরে সন্দীপ, নিজের গাড়ি নেই না । একটু শরীর চর্চা ও হয়ে যাই এতে । নন্দিতা শরীর চর্চা নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস ছিল । এখন তো শুনি খুব রোগা হয়ে গেছে সে , হয়তো কাজের চাপ , তাতুন র চাপ সব মিলিয়ে আর হয়তো শরীর র দিকে অত নজর দেয়া হয় না তার । এসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ঠুকে এলো সে, আজ রাতে খেলা আছে রোনাল্ডো র । নন্দিতা চলে যাবার পর এই খেলা দেখা টা ঠিক ঠাক ভাবে করতে পারে সন্দীপ , তবে নন্দিতার সেই না দেখতে দেবার জেদ টা কে ও সে মিস করে । তাই এই ফ্রীলি খেলা দেখতে পারার ব্যাপার টা তার আসলে ভালো লাগে না মন খারাপ আরো বাড়িয়ে দেয় , তা সে জানে না । তবে রোনাল্ডো র খেলার জাদু দেখতে দেখতে এসব কিছুই মন থেকে কোথায় হারিয়ে যাই , অন্তত ৯০ মিনিট এর জন্য ।
অনির্বান
আজ ক্লিনিক এ ভালো ভিড় হয়েছে । প্রায় ১৫ জন রুগী কে দেখলো অনির্বান । তার মধ্যে মোটামুটি ৫ জন এর তো অপারেট করতেই হবে । তাদের কে কাল কের ভর্তি হয়ে যেতে বললো অনির্বান , তার প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেলে সে রকম কোনো অসুবিধা হবে না জানিয়ে দিলো তাদের । মনের মধ্যে আজ দারুন এক প্রশান্তি কাজ করছে অনির্বান র মধ্যে । এতগুলো রুগী যে এতো দিন পর ফিরে সে সামাল দিতে পারবে ভাবতেই পারিনি । তার সাথে নতুন ভাবে পড়াশোনা করা, অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করিয়ে রাখা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভে গুলো কে সময় দেয়া । তাদের নতুন আসা মেডিসিন গুলোর কম্বিনেশন ভালো করে বুঝে নেয়া । সব কিছু মিলিয়ে বেশ খুশি করে দিয়েছিলো অনির্বান কে । মন থেকে তোর্সা কে মুছে ফেলে নতুন উদ্দম এ কাজ করা শুরু করলো সে । এক বার হাসপাতাল এ ফোন করলো সে । তার ২ অপারেশন সে পিছোতে বলে গেছিলো বা ডাক্তার গৌরব কে ট্রান্সফার করতে বলেছিলো , তাদের স্টেটাস নেয়া টা খুব জরুরি ছিল । ওদিকে যে রিপ্রেসেন্টেটিভে ছিল সে জানালো , রুগী ২ জন ই নাকি বলেছে যদি ডাক্তার অনির্বান করে তবেই করবেন না হলে অন্য কথাও থেকে করবেন । আমার ফোন সুইচ অফ থাকায় তারা এটা জানাতে পারেনি । এখুনি তাদের কে ফোন করে আপডেট জানাবে বলে ফোন তা রেখে দিলো সেই রিপ্রেসেন্টেটিভে । নতুন এসেছে বোধহয় , অনির্বান এর চেনা গলা নয় । যাই হোক কিছুক্ষন এর মধ্যেই আবার ফোন করলো সে । খুশির খবর হলো , তাদের মধ্যে এক জন এর অপারেশন এখনো হয়নি , অন্য ডাক্তার দের ফিস নাকি অনেক বেশি তাই করাতে পারেনি । অনির্বান আর দেরি করলো না , তাড়াতাড়ি কাল অপারেশন বুক করে দিতে বলে ফোন টা রেখে দিলো । কাল ২ তো ব্যাপার হতে চলেছে , অনেক দিন পর অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবে অনির্বান , আর তোর্সা কে ছাড়া সে অপারেশন কমপ্লিট করবে । ফোন টা রাখার পর অন্য এক চিন্তায় বয়ে গেলো অনির্বান । আজ কাল ডাক্তার দের অবস্থান নিয়ে , সবাই নিজেদের ফিস বা অন্যান্য খরচ এমন বাড়িয়ে দেয় , সাধারণ মানুষ গুলোর কাছে নিজেকে দুর্মূল্য করে দেয় অযথাই । অনেক ডাক্তার দের মিটিং এ এটা অনেক বার বলেছিলো অনির্বান , কিন্তু কেউ এসব শোনার লোক এ নয় । সবাই ভাবে ডাক্তার এর ফিস যত বেশি হবে সে ততটাই ভালো ডাক্তার । কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয় । এই নিয়ে একটা আর্টিকেল ও লিখেছিলো অনির্বান , খবর এর কাগজ এ এসেছিলো ও টা , কিন্তু এই পর্যন্তই , না সরকারি কোনো উদ্যোগ আছে , না কোনো ডাক্তার এর । সবাই যেন একটু নাম কেনার অপেক্ষাতেই থাকে , তারপর বের করে আনে সেই প্রাচীন ইচ্ছা আরো ক্ষমতাশালী হবার । যা বেশিরভাগ মানুষ এর ই মানুষত্ব শেষ করে দেয় । তাই একজন ভালো হয়ে যাওয়া রুগী কে আরো ১০ টা টেস্ট করতে দেয় , যা আবার তাদের ই ঠিক করে দেয়া কোনো প্যাথলজি থেকেই করতে হবে , না হলে গ্রহণ যোগ্য নয় , বা একেবারেই ঠিক হয়ে যাওয়া রুগী কে হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট এর কথায় বেশ কিছু দিন হসপিটাল এ আটকে রাখা । অনির্বান এর এসব একেবারেই ভালো লাগে না , এই নিয়ে তার ম্যানেজমেন্ট এর সাথে অনেক বার ঝামেলা হয়েছে , ভীষণ অখুশি থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র তার সুনাম এর জন্য ম্যানেজমেন্ট কিছুই করে উঠতে পারেনি । অনির্বান ই উদ্দ্যোগ নিয়ে একটা ছোট টীম বানিয়েছিলো ২ জন ডাক্তার আর ৩ জন নার্স কে নিয়ে , নাম দিয়ে ছিল ‘কুইক সল্যুশন’। অবশ্যই সেই ৩ জন নার্স এর ১ জন ছিল তোর্সা । এই একটা জায়গায় তাকে তোর্সা সাথে কাজ করতেই হবে , কারণ এটা অনির্বান এর একটা ড্রিম প্রজেক্ট , র এখানে তোর্সার মতো ডেডিকেটেড মেয়ে সত্যি ই দরকার পরবে বার বার । অনির্বান র তোর্সা কে ভালো লাগার আসল কারণ ই তার কাজের কোয়ালিটি । সেটা তোর্সা ও খুব ভালো করেই বুঝতো । তাই হাসপাতাল এ যতই লোকে উল্টোপাল্টা ভাবুক , তাদের সামনে তাদের নিয়ে কোনো কথা বলতো না । কারণ এই ‘কুইক সল্যুশন ’ ডিপার্টমেন্ট টা খুব অল্পদিন এর মধ্যেই পপুলার হয়ে গেছিলো । তা পুরোপুরি হয়েছে অনির্বান র তোর্সা র পরিশ্রমের ফলেই । আবার তোর্সা র কথা মনে পড়তে শুরু করলো অনির্বান এর , মেয়ে টার সব ভালো , শুধু কেন যে সে ওই দিন ওরকম একটা কথা বলতে গেলো , যা অনির্বান কে সব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করলো । এখন তো আর কিছু করার নেই । বেরিয়ে পড়লো ক্লিনিক থেকে অনির্বান , আজ ড্রাইভার কে ডাকা হয়নি তাই নিজেই ড্রাইভ করছিলো সে , একটু অন্যমনস্ক ছিল সে । মন টা ও যে তার আজ বড়ই টালমাটাল , ভালো খারাপ মিশিয়ে এক অদ্ভুত ফুলিঙ্গ হছে মনের মধ্যে । কি করা উচিত বুঝতে না পেরে , বাড়ি ফেরার ব্রিজ এর কাছে গাড়ি টা দাঁড় করলো অনির্বান । বাইরে বেরিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো হোস্টেল র ঘর গুলোর দিকে , যেখানে থাকে তার তোর্সা , এক বার কি দেখা ও যাই না তাকে , এরকম ভাবে চলে যাবে সে, আর অনির্বান কিছুই করতে পারবে না । এক জন সিনিয়র ডাক্তার হয়ে অনির্বান কখনো ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে পারে না এক জন জুনিয়র নার্স এর কাছে । ছাদের উপর যে মেয়ে টি দাঁড়িয়ে আছে সেটা কি তোর্সা নাকি , কে জানে , ফিরে এলো সে গাড়ির কাছে , স্টার্ট দিলো গাড়ি, আস্তে করে পুশ করলো গাড়ির গতি বাড়ানোর এই অদ্ভুত যন্ত্র টাকে । চলতে থাকলো সে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে । মনে মনে বেনারস র বাবা র কাছে একটাই প্রার্থনা করলো ফিরিয়ে দাও তোর্সা কে ।
তোর্সা
আজ ঘুম আসতে বেশ দেরি হলো তোর্সার । কিছুই সে ভাবে ভালো লাগছে না তার । অনেকক্ষণ ধরে আবির স্যার কাল কের কেস টা কে নিয়ে স্টাডি করছিলো সে , যাতে সব কিছু ভুলে থাকা যাই । কিন্তু মনে মনে খুব টেনশন হচ্ছিলো তোর্সার , অনির্বান দার খবর জানতে খুব ইচ্ছা করছিলো তার । হাসপাতাল এ বেশি খোঁজ করতে তার কেমন জড়তা লাগে , যতদিন ২ জন এ এক সাথে ছিল কারোর কিছু বলার ছিল না , কিন্তু এখন অনির্বান দার অনুপস্থিতে অনেক এই এটা মুখরোচক খবর বানাতে চাইছে , যা বেশ ভালো করেই কানে এসেছে তোর্সার । সে নিজের পার্সোনালিটি দিয়ে সেটা কে পাত্তা না দিয়ে এ বেরিয়ে গেছে , কিন্তু খুব চিন্তা হছে তোর্সার । কি হলো অনির্বান দার , সে কোনো দিন অনির্বান দার বাড়ির কারোর নম্বর নেই নি , কোনো দিন ভাবেই নি এসব এর দরকার আছে বলে । আজ যখন হাসপাতাল এ একটা খুব ই ছোট ব্যাপার এ গন্ডগোল এ জড়িয়ে পড়লো সে , তখন বারবার মনে হচ্ছিলো অনির্বান দার কথা । এই সব মুহূর্ত গুলো দারুন ভাবে সামলে দিতো সে । মন খারাপ ভালোই লাগছিলো তোর্সার , আর বার বার মনে হচ্ছিলো কেন সে দিন এরকম ভাবতে গেলো , অনির্বান দার সাথে তো ভালোই কাজ করছিলো সে । আসলে আবির স্যার র তাকে নিজের টিম এ নেয়া কে সে ভীষণ বড় একটা সাকসেস ভেবে ফেলেছিলো , তাই দিক বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে সে চলে গেছিলো অনির্বান দার কাছে । কিন্তু এক বার ও ভাবে নি অনির্বান দার এটা ভীষণ খারাপ লাগতে পারে । কিন্তু কোনোমতেই সে অনির্বান এ কাছে ফিরে যেতে পারবে না , অনির্বান নিজেই তো বলে দিয়েছে ওর সাথে কোনো কন্টাক্ট না রাখতে । মন একটু ভালো করার জন্য ছাদে চলে এলো তোর্সা , হোয়াটস আপ এর ভুল ভাল কিছু মেসেজ দেখে হাসার বৃথা একটা চেষ্টা করলো সে । সামনে দিয়ে হয়ে চলেছে কলকাতা মেট্রো র এক্সটেনশন এর কাজ । শুনেছি আমাদের হাসপাতাল এর সামনেই হবে একটা মেট্রো স্টেশন । তার পর দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্রীজ , যে খানে কত দিন গাড়ি দাঁড় করিয়ে গল্প করেছে অনির্বান দা তার সাথে , তার পর হোস্টেল লুকিয়ে ফিরেছে সে । অনির্বান দা ডাক্তার ছিল বলে কেউ কিছু বলতো না । যে কোনো হাসপাতাল এর কাছে ডাক্তার তো ভগবান , তার পর সে যদি অনির্বান দার মতো পপুলার ডাক্তার হয় । ভালো কাজ করে বলেই অনির্বান দার নাম এ কম কমপ্লেইন জমা করেনি অন্যান্য ডাক্তার রা , কিন্তু ওরা কিছু করতে পারেনি শুধু মাত্র তার পপুলারিটি র জন্য । তোর্সা সত্যি খুব গর্বিত অনুভব করে এরকম একটা লোকের তৈরি করা ‘কুইক সল্যুশন ’ এ এক জন পার্টনার হতে পেরে । কত লোক এর উপকার করেছে এই উদ্যোগ । লোক টা এখন কোথায় আছে কি করছে কে জানে । খুব কষ্ট লাগলো তোর্সার , হয়তো চোখ টা ও একটু ভিজে এল , দূরে ওই ব্রিজ টার কাছে সত্যি যেন মনে হলো কোনো গাড়ি এসে দাঁড়ালো । তাদের সেই অকৃতিম জায়গা তে কেউ এক জন দাঁড়িয়ে যেন এই হোস্টেল কেই পর্যবেক্ষণ করছে মনে হলো তোর্সার । সে অজান্তেই যেন এক বার হাত নেড়ে ফেললো , যদি কোনো ভাবে ওটা অনির্বান দা হয় । অনির্বান দা র নম্বর এ আর এক বার ট্রাই করবে কি তোর্সা , না করা ঠিক হবেনা , তাকে যে অনির্বান দা কন্টাক্ট করতেই মানা করেছে । মনের মধ্যের এই কষ্ট কে জমিয়ে রেখেই নিচে নেমে এলো তোর্সা । তার রুম পার্টনার আজ বাড়িতে গেছে , তাই একাই শুতে হবে তাকে । মোবাইল এ একটা হাসির মুভি চালিয়ে দিয়ে দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো সে । মনের মধ্যে জেগে থাকলো শুধু একটাই আওয়াজ ফিরে এস তুমি ।
নন্দিতা
আজ তাতুন এর জন্মদিন । প্রতিদিন এর মতো সকাল হতেই একটা সুন্দর মিষ্টি হাসি দিতে অভ্যস্ত তাতুন । আজ কের সেই হাসি তেই যেন অনেক কিছু খুঁজে পাই নন্দিতা , মনের সব দুঃখ কে মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে ফেলে সে । সকাল উঠতেই তাতুন কে খুব ভালো করে ওয়েলকাম করলো নন্দিতা , ওর ফেভারিট বেশ কয়েকটা ডিশ সে নিজের হাতেই বানিয়েছে আজ । তাতুন আজ স্কুল যাচ্ছে না , কিন্তু দুঃখের খবর হলো নন্দিতা কে অফিস যেতেই হবে , ক্লায়েন্ট ভিসিট আছে , তাকে অন্তত তার পুরো টীম টার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আস্তে হবে , খুব বেশি হলে ২ ঘণ্টা লাগবে । তাতুন কে কাল রাতে অনেক করে বুঝিয়েছি , ছেলে টা বুঝলো কি না বুঝলো কে জানে , কিন্তু চুপ তো করে গেলো । নন্দিতা আজ কাল র তাতুন কে বুঝতে পারে না , ও মনের কোনো কষ্টে আছে কি নেই, সেটা ও ভালো করে বুঝতে পারে না সে । সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারে না , আবার সে যতক্ষণ তাতুন এর সাথে থাকে ও দারুন এনজয় করে , খুব জ্বালাতন ও করে । হয়তো মনেএর কোনো কোণে সে বাবা কে ও মিস করে । সন্দীপ ও খুব ভালো বাসত তাতুন কে , তাতুন কে কখনো বকতে দেখিনি তাকে , যতদিন ওর কাছে ছিল । মা এর মুখে শুনছিলাম সন্দীপ নাকি মাঝে মাঝে তাতুন র সাথে দেখা করতে আসে । তাতুন কে জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাই , এই মিথ্যে বলার স্বভাব টা ঠিক বাবার থেকেই শিখেছে । মিথ্যা বোলাতে সন্দীপ এর একটা আলাদা আর্ট আছে । সন্দীপ দেখা করে শুনে প্রথম দিন খুব রাগ হয়েছিল নন্দিতার , মনে হয়েছিল সরাসরি তার কাছে এসেই তাতুন এর সাথে দেখা করতে পারতো , এভাবে লুকিয়ে করার কি আছে । তারপর মনে হয়েছিল তাতুন তো এতে খুশি হয় , যা পারছে করুক । তাতুন কে ঘুম থেকে তুলে , ফেভারিট ডিশ গুলো সামনে সাজিয়ে দিয়ে তার মিষ্টি হাসি দেখে নিয়ে স্নান করতে দৌড়োলো নন্দিতা । স্নান করে এসে রেডি হয়ে নিয়ে তাতুন কে অনেক গুলো হামি খেয়ে ২ ঘন্টার প্রমিসে দিয়ে সে যখন বেরোতে পারলো ঘড়িতে ১০ টা বাজে । বাস উঠে অফিস নামতেই শুনলো ক্লায়েন্ট এসে গেছে , একটু হালকার উপর দৌড় লাগলো নন্দিতা । ক্লায়েন্ট দের একটা মিষ্টি হাসিতে ভরিয়ে দিয়ে অভ্যথর্না জানালো নন্দিতা । নিজের পুরো টীম এর সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে , ১৫ মিনিট এর একটা ছোট প্রেসেন্টেশন দিলো সে । ছোট্ট একটা কফি খেতে বাইরে এসেছে , দেখলো বাড়ি থেকে অনেক গুলো ফোন এসেছে তার মোবাইল এ । বোধহয় তাতুন টা বায়না করছে আবার , এমনি তে নন্দিতা র কাজ হয়ে গেছে , এবার সে বেরিয়ে ই যাবে । তাতুন কে দেয়া কথা সে রাখতে পারবে । এসব ভাবতে ভাবতে আবার ফোন এসে গেলো বাড়ি থেকে । ফোন নিয়ে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে ভীষণ উত্তেজিত মা এর গলা শুনতে পেলো নন্দিতা । মা সাধারণত এতো উত্তেজিত হয় না । বেশ ভয় পেয়ে গেলো নন্দিতা । এর পর ফোন এ যা শুনলো , তা শুনে মাথা ঘুরে পরেই যাচ্ছিলো সে, যা হোক করে নিজেকে কন্ট্রোল করে দৌড় লাগালো বাড়ির দিকে । একটা গাড়ি বুক করে গাড়িতে উঠে বসে ভীষণ ঘাম হচ্ছিলো নন্দিতার । তাতুন আজ লিফ্ট এ খেলতে গিয়ে হাত গলিয়ে ফেলেছে , আর হাত বার করতে পাচ্ছে না সে । হাত কাটে রক্ত বেরোছে তাতুন এর । কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না । গাড়ি নিয়ে যখন নন্দিতা পৌঁছলো তখন তাতুন এর হাত বার করা গেছে , কিন্তু হাত টা কনুই থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেছে কেটে, এতো রক্ত বেরিয়েছে তাতুন এর কোনো জ্ঞান নেই , কিছু না ভেবে তাতুন কে নিয়ে হাসপাতাল এ ছুটলো নন্দিতা , সন্দীপ র একটা বন্ধু ডাক্তার ছিল , কি যেন নাম অনির্বান চক্রবর্তী । খুব ভালো অর্থোপেডিক ডাক্তার । সব গ্লানি ঝেড়ে ফেলে শুধু মাত্র তাতুন এর জন্য ফোন লাগলো সে সন্দীপ কে । কিন্তু দরকার এর সময় যথারীতি সন্দীপ এর ফোন লাগলো না । নন্দিতা ভাবতে লাগলো কি করা যাই , হঠাৎ মনে পড়লো সন্দিপ এর অফিস এর বন্ধু ভবতোষ এর কথা, তাদের যখন গণ্ডকল হয় এই লোক টি এসেছিলো সন্দীপ র হয়ে কিছু বলতে । ভালো কথায় কাটিয়ে দিয়েছিলো সেই সময় নন্দিতা । ফোন লাগলো ভবতোষ কেই । ফোন টা লাগতেই ওদিক দিয়ে বৌদি সম্বোধন শুনে ভালো লাগলো নন্দিতার , অনেক দিন এই ডাক টা শুনেনি বা শুনতে চাইনি । যদি ও এখন এসব ভাবার কোনো সময় নেই । সে দ্রুত সব কথা বলে সন্দীপ কে কন্টাক্ট করতে চাইলো । ভবতোষ বললো সন্দীপ এখন লন্ডন, সে এখুনি জানানর চেষ্টা করছে । ৫ টা মিনিট চেয়ে নিলো সে । ৫ মিনিট নন্দিতার কাছে এখন ৫ দিনের সমান । সে সন্দীপ এর কথা ভুলে গিয়ে যে হাসপাতাল এ অনির্বান চক্রবর্তী বসেন সেখানে এই যেতে বললো গাড়িটাকে । ৫ মিনিট লাগলো না ৩ মিনিট এই ফোন বাজে উঠলো নন্দিতার , বিদেশী নম্বর মানে সন্দীপ র এ ফোন । সব শুনে সন্দীপ বললো মাথা ঠান্ডা রাখো , তোমাকেই সব কিছু করতে হবে , কাজেই তুমি টেনশন করো না , কিছু হবে না তাতুন এর, আমি অনির্বান কে কল করে তোমাকে আপডেট করছি । কিছু ক্ষণ এর মধ্যে আবার কল এলো সন্দীপ এর অনির্বান কে বলে দিয়েছি , তুমি শুধু ওকে নিয়ে এখুনি হাসপাতাল এ যাও । একটা কথা প্রায় মুখের কাছে চলে এসে ও ঢোক গিলে নিলো নন্দিতা , কথা টা খুব সাধারণ কিন্তু তার অন্তর্নিহিত অর্থ প্রচুর , ‘তুমি এস , আমি একা আর পারছি না ।’, সন্দীপ, যে কোনোদিন নন্দিতার কোনো ফিলিংস ই বুঝতে পারিনি , কেমন করে যেন মনের সেই কথাটা শুনতে পেলো , র ফোন ছাড়ার আগে একটাই কথা বললো, ‘চিন্তা করোনা আমি আসছি ’।
সন্দীপ
নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হছে সন্দীপ এর । তাতুন এর কোনো কষ্ট যে সে নিতেই পারে না , সেটা যেন আরো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিলো তার মনের মধ্যে বার বার । আজ নন্দিতা ফোন করেছে নিজে থেকে , এই আনন্দ টাকে আর ও প্রশয় দেবে না কি করবে কিছুক্ষন সে বুঝতেই পারছিলো না । তাতুন র জ্ঞান ফেরেনি এখনো , ভাবতেই পারছে না সন্দীপ । কেন এটা ঘটেছে , সেটা জানার থেকে যেমন করে হোক তাতুন কে সুস্থ করতেই হবে । যতটা পেরেছে সে স্বাভাবিক থেকেছে নন্দিতার কাছে , অনির্বান কে ফোন ও করে দিয়েছে , র অনির্বান ভীষণ ভালো ডাক্তার । ও সামলে নেবে , কিন্তু তাও কিছুতেই সে নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না । যেমন করেই হোক তাকে আজ ফিরতেই হবে । নিকুচি করেছে ক্লায়েন্ট আর প্রজেক্ট , তার কাছে সবার আগে তাতুন । ফোন লাগলো সে বস কে , সব কিছু গুছিয়ে বলে ফিরতে চাইলো সে তখুনি । বস ক্লায়েন্ট এর সাথে কথা বলে জানছে বললো । এখন যদি সে কোনো ফ্লাইট পেয়ে যাই , তাহলে কাল সকাল এ পৌঁছে যেতে পারবে আশা করছে । ফ্লাইট একটা পেয়ে গেল সন্দীপ, দেরি না করে , বস এর কনফার্মেশন র অপেক্ষা না করে বুক করে ফেললো সে । অলমোস্ট ৮০০০০ পড়লো । এসব ভেবে এখন র লাভ নেই , তাড়াতাড়ি যেতে হবে তাতুন র কাছে , নন্দিতা একা সব সামাল দিতে পারবে না কোনোমতেই । এর পর বস এর ফোন এলো , মিটিং টা আবার কদিন পরে নতুন করে করা হবে , ক্লায়েন্ট বুঝতে পেরেছে সন্দীপ র সমস্যা টা । র বললো টিকেট র খরচ পরে কোম্পানি দিয়ে দেবে । এতো কিছু শোনার মতো অবস্থায় ছিল না সন্দীপ। আর মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যেই ফ্লাইট , এয়ারপোর্ট হোটেল এর খুব কাছেই , কাজেই যাবার টাইম বিশেষ লাগবে না । নিজের জিনিস গুলো গুছিয়ে নিয়ে ট্যাক্সি ধরে এয়ারপোর্ট চলে এলো সন্দীপ । এক বার ফোন করলো নন্দিতা কে, ও জানালো তাতুন কে ইমার্জেন্সি তে নিয়ে নিয়েছে । তারপর থেকে কিছু জানাই নি । অনির্বান দা আছে , সে এ সব দেখছে । ফোন লাগলো অনির্বান কে , বললো ভাই আমি দেখছি , কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে , দেখছি কি করা যাই । একটু দেখ ভাই আমি কাল ই আসছি । অনির্বান জানালো সে দেখছে কি করা যাই , সব থেকে বেস্ট ট্রিটমেন্ট যাতে তাতুন পাই সেটা সে দেখবে । সন্দীপ খুব ভালো করে চেনে অনির্বান কে , খুব ভালো ছেলে , কিন্তু বাড়াবাড়ি বলতে কি বলতে চাইলো অনির্বান । হাত কেটে বাদ দেবার কথা বললো না তো ? সন্দীপ যে সাইকেল অর্ডার করেছে সেটা তো তাহলে কোনো দিন ই চড়তে পারবে না তাতুন । না সেটা কখনোই হতে পারে না । র এক বার নন্দিতা কে ফোন করে অনির্বান কি বলেছে জানালাম , শুধু বাড়াবাড়ি কথাটা ছাড়া । র জানালাম যে আমি ফ্লাইট এ উঠছি । চেক ইন করে ফ্লাইট এ উঠে ফোন সুইচ অফ করে দিতে হলো সন্দীপ কে । ১২–১৫ ঘন্টার এই অদ্ভুত টেনশন র নিষ্পত্রী যে কি হতে চলেছে জানেনা সন্দীপ । তবে একটা কথা সন্দীপ ছোট বেলা থেকে মা এর মুখে খুব শুনতো , ‘ভগবান যা করে মঙ্গল এর জন্য ’, জানিনা সন্দীপ এর জীবন এ যা যা হয়েছে তাতে কার মঙ্গল হয়েছে , তবে সন্দীপ এর যে হয়নি সেটা তে সে নিশ্চিত । আজ সেই মত কে মেনে নিয়ে , প্রণাম করলো নিজের সিদ্ধ কোনো ভগবান কে, জানালো শুধু একটাই অনুরোধ , প্রমান করো ‘ভগবান যা করে ভালোই করে ’, এটা শুধু প্রবাদ বাক্য নয় সত্যি কথা । কেন জানেনা হঠাৎ এ চোখে অনেক জল চলে এলো সন্দীপ এর । ভাবতে লাগলো নন্দিতা , তাতুন আর তাদের অনেক স্বপ্নের কথা ।
অনির্বান
সকাল সকাল এসে তোর্সা কে ছাড়াই সাকসেসফুল অপারেশন করে বেশ খুশি মনেই ছিল অনির্বান । বাইরে এসে সবে একটা কফি হাতে নিয়েছে , হঠাৎ তার ফোন টা বেজে উঠলো , দেখলো একটা অজানা নম্বর, র ইন্ডিয়ান নম্বর ও নয় । ফোন টা রিসিভ করতেই ওদিক দিয়ে ভেসে এলো সন্দীপ র গলা , সন্দীপ আমার বাল্য বন্ধু । বললো ওর ছেলে কে নিয়ে নাকি হাসপাতাল এ আসছে ওর বউ । ও এখন লন্ডন একটু দেখে নিতে, ও কাল কের সকালেই ফিরে আসছে । সন্দীপ কে আসস্ত করে ইমার্জেন্সি দিকে গেলো অনির্বান । জানিয়ে দিলো তাতুন নামে কোনো রুগী এলে তাকে খবর দিতে । কিন্তু তাতুন যখন এসে পৌঁছলো , বেশ ভয় পেয়ে গেছিলো অনির্বান । শুনলো লিফ্ট র মধ্যে হাত ঢুকে গিয়ে এই অবস্থা । হাত টা কনুই র উপর থেকেই শুধু ঝুলেই আছে বলা যাই । সাথে সাথে ড্রেসিং করিয়ে নিয়ে ব্লাড বন্ধ করলো । আর ব্লাড দেবার ব্যবস্থা করলো তাড়াতাড়ি । কিন্তু এবার কি করবে অপারেশন করতেই হবে । কিন্তু এতক্ষন এ ভাবে কেটে যাওয়া কোনো কিছু জোড়ার কাজ কখনো করেনি অনির্বান , এই হাসপাতাল এ এসব কাজে এক্সপার্ট এক মাত্র ডাক্তার আবির । কিন্তু ডাক্তার আবির র কাছে যেতে বেশ খারাপ লাগছিলো অনির্বান এর । কিন্তু সন্দীপ এর ছেলে বলে কথা , সে ফোন লাগলো ডাক্তার আবির কে , কিন্তু পেলো না তাকে । আসলে বড় ডাক্তার রা এখন পার্সোনাল নম্বর হাসপাতাল কে দেয় না , যে নম্বর টা দেয় সেটা নিজের মনের মতো টাইম এ অন রাখে, না হলে কোনো সেক্রেটারি কাছে রেখে দেয় । তখন হঠাৎ এ মনে হলো তোর্সা তো ওনার সাথে কাজ করে , তাহলে অব্যশই ওর কাছে পার্সোনাল নম্বর থাকতে পারে । কিন্তু তোর্সা কে ফোন করবে সে , তবে ছেলে টার মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হলো অনির্বান এর, কল করলো সে তোর্সা কে , তাকে সব কিছু গুছিয়ে বললো । সব শুনে তোর্সা চলে এলো হাসপাতাল এ সাথে সাথেই , কল করলো ডাক্তার আবির র পার্সোনাল নম্বর এ । ডাক্তার আবির কে আগে ভালো করে চিনতো না অনির্বান । ১ ঘন্টার মধ্যে চলে এলেন তিনি । তাতুন কে ভালো করে দেখে বললেন কি মনে হছে ডাক্তার অনির্বান । স্যার বুঝতে পারছি না কি টাইপ এর অপারেশন করা উচিৎ , আপনি একটু হেল্প করলে ভালো হয় । উনি বললেন প্রথমেই চেষ্টা করো হাত টা জোড়া লাগাবার , যদি কিছু না যাই , তারপর নয় অন্য কিছু ভাবা যাবে । আমি বললাম স্যার আপনার হেল্প হলে ভালো হয় । বললেন না অনির্বান তুমি ই পারবে , আমি অনেক শুনেছি তোমার কথা , তুমি অবশই পারবে, আর তাছাড়া আমার টীম র সব থেকে বেস্ট স্টাফ কে আমি তোমার সাথে দিলাম , তোর্সা , ও থাকবে আজ তোমার অপারেশন এ । দু জন এ মিলে এই অপারেশন কে নিশ্চই সাকসেস করবে । খুব অবাক হলো অনির্বান , সেই সাথে হঠাৎ করে তোর্সা কে পেয়ে গিয়ে আরো যেন মনের জোর বেড়ে গেলো তার । ডাক্তার আবির কে থ্যাংক ইউ বলে অপারেশন র তোড়জোড় শুরু করলো সে । কম টাইম র নয় মিনিমাম ২–৩ ঘন্টার অপারেশন । সন্দীপ কে ফোন এ ধরতে পারলো না অনির্বান , মনে হয় ফ্লাইট এ আছে , তোর্সা কে বললো বাইরে নন্দিতা নাম এ এক জন আছে যে এই বাচ্ছা টির মা । কনসেন্ট নিয়ে এস তার কাছ থেকে । এটা বলে নিজে ঠুকে গেলো মানসিক ভাবে রেডি হবার জন্য । মনে মনে প্রণাম করে নিলো সেই ভোলানাথ কে , যার আশীর্বাদেই সে আজ আবার তোর্সার সাথে কাজ করার সুযোগ পাছে , র হয়তো তার আশীর্বাদেই সে সাকসেসফুল হবেই । এসব ভাবতে ভাবতেই ফোন টা লাগিয়ে দিলো অপারেশন থিয়েটার বুক করার জন্য । সন্ধে ৬টার সময় খালি পেলো সে । তোর্সা কে ফোন করে এই সময় তাকে ফ্রি থাকতে বললো । গুগল খুলে নিজে একটু পড়াশোনা শুরু করে দিলো এই অপারেশন নিয়ে ।
তোর্সা
সকাল বেলায় অনির্বান দার ফোন পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছিলো তোর্সা । ভাবতেই পারেনি এতো তাড়াতাড়ি সে অনির্বান দার ফোন পেয়ে যাবে । ফোন এর বিষয়বস্তূ শুনে ও তার ভীষণ ইন্টারেষ্টিং একটা কেস ই মনে হয় । সাথে সাথে চলে আসে সে , একটা আসল কারণ যেমন অবশ্যই এতো দিন পর ভীষণ ইচ্ছা করছিলো অনির্বান দা কে সামনে থেকে দেখতে , কিন্তু তার সাথে ভীষণ ভাবে চাইছিলো এই কেস টিতে ইনভল্ভ হতে আর ওই বাচ্ছা টিকে দেখতে । অপারেশন এর আগে কনসার্ন নেবার জন্য যখন বাচ্ছা টির মা এর কাছে গিয়েছিলো তোর্সা , খুব কষ্ট লেগেছিলো তার , মনে হয়েছিল এতো মিষ্টি এক জন মহিলা কেমন যেন ভিতর ভিতর শেষ হয়ে যাচ্ছে । ভাবতে খারাপ লাগলে ও এরকম অনেক কেস দেখেছে তোর্সা তার শেষ ৩–৪ বছর ডিউটি তে । তাদের কারোর সব কিছু ঠিক করে পাঠানো গেছে , কারোর ঠিক করা যাই নি । চোখের জলেই বিদায় নিয়েছে তারা । যাই হোক এই প্রফেশন এ নিজেকে আরো বেশি করে শক্ত রাখা জরুরি । না হলে সামলানো মুশকিল হয় । এই সময় নন্দিতা মানে ছেলে টির মা হঠাৎ প্রশ্ন করলো , আমার ছেলে টি বাঁচবে তো সিস্টার ? সিস্টার কথা টা শুনে বেশ ভালো লাগলো তোর্সার । সবাই সাধারণত দিদি বা ম্যাডাম বলে ডাকে , আজকাল সিস্টার কেউ ই বলে না । হাসি মুখেই জবাব দিলো তোর্সা , অনির্বান স্যার দেখছেন , তিনি নিজেই অপারেশন করবেন , আপনি কিছু চিন্তা করবেন না । আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে । তাতুন এর মা এর কাছ থেকে ফিরে এসে তোর্সা সোজা চলে গেলো অনির্বান দার ঘরে । খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছিলো অনির্বান দা । অনির্বান দার এটা একটা সমস্যা , যখন কোনো রকম এর চ্যালেঞ্জিং কাজ পাই, ভুলে যাই তার পার্সোনাল জীবন এর কথা । এই যেমন এখন নোটিশ ই করছে না তোর্সা তার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে । আবার হতে পারে আগের রাগ এখনো ও যায়নি । তবে এক বার ফোন তো করে তাকে ডেকে এনেছে , এটাই আপাতত তোর্সার কাছে বিশাল বড় পাওনা অন্তত অনির্বান দার কেবিন এ আসার জন্য । তোর্সা জিজ্ঞেস করলো কিছু খেয়েছো অনির্বান দা ? অনির্বান দা বললো ও তোর্সা , আমি এখন ভারী কিছু খাবো না একটু কফি এনে দেবে প্লিজ । প্লিজ কেন অবশ্যই দিচ্ছি । কফি এনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো তোর্সা , ছেলে টাকে এক বার দেখা দরকার , যন্ত্রণা কমানোর ইনজেকশন দেয়া হয়েছে , কিন্তু কি অবস্থায় আছে দেখা দরকার এক বার । তুতান কে এখনো ঘুমোতে দেখে , একটু বাইরে চলে এলো তোর্সা । নিজে ও একটা কফি নিয়ে নিলো । অনেক দিন পর মন টা খুব ভালো লাগছে তোর্সার , অনির্বান দার সাথে ঝামেলা টা মিটে যাওয়াতে । কিন্তু তোর্সা বেশ ভালো বুঝতে পারছে অনির্বান দা আবার একটা খুব বড় রিস্ক নিয়েছে । কোনো ভাবে যদি এই অপারেশন এ সে ফেল করে তাহলে অনেক জায়গায় তার সমালোচনা হবে । শুধু তাই নয় এতো ক্রিটিকাল পেশেন্ট কে নিজের হাতে রেখে দেবার জন্য যথেষ্ট সম্যসায় পড়তে হতে পারে তাকে । প্রায় বিনা কারণ এ তাকে শোকস বা সাসপেন্ড ও করতে পারে ডিপার্টমেন্ট । সবাই তো চাই ই যে অনির্বান কোনো কেস খাক । এই যেমন কত হালকা ভাবে ডাক্তার আবির পেশেন্ট টিকে এড়িয়ে গেলো । অনির্বান দা কে আসলে সে বলে গেলো অন্য কোনো বড় হাসপাতাল ছেলে টিকে ট্রান্সফার করতে । কিন্তু অনির্বান দা এসব এর কিছুই বুঝলো না , রীতিমতো সিরিয়াস হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলে টিকে ঠিক করাতে । তোর্সা ভালো করেই জানে এখন ও কিছুই বলতে গেলে অনির্বান দা শুনবে না , পরে যখন সে বলবে উত্তর আসবে বুঝি সব ই কি করা যাবে বলো । রিস্ক নেয়া টাই তো আমাদের প্রফেশন এর আসল কথা । তারপর চাড্ডি জ্ঞান ভরা কথা শুনিয়ে দেবে । যথা সময় অপারেশন এর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো । অনির্বান দা তার ২ জন জুনিয়র , টেকনিশান, আর তোর্সা কে নিয়ে অপারেশন হবার কথা । আশা করি এই কমফোর্টেবলে টীম এর বাইরে অনির্বান দা যাবে না । তোর্সা রা আগে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে রাখে , তারপর পেশেন্ট আসে, র সব শেষে আসে ডাক্তার । আজ ও তার ব্যাতীক্রম হলো না । যথারীতি এনাস্থেসিয়া কমপ্লিট হলে অনির্বান দা এলো অপারেশন রুম এ । শুরু হলো ২ ঘন্টার একটা অদ্ভুত লড়াই । ক্রিটিকাল কোনো অপারেশন দেখলেই তোর্সার মনে হয় যেন ভগবান র সাথে কি ভীষণ লড়াই করে ডাক্তার যে কোনো রুগী কে ফিরিয়ে আনছে বারবার । এসব সময় এ সব রকম চিন্তার বাইরে অবস্থান করে তোর্সা । দারুন থ্রিলিং লাগে নিজেকে । অনির্বান দা র কোন সময় এ কি দরকার সেটা বুঝতে পারার ক্ষমতা তোর্সার এতো টাই বেশি যে , কাজ করা ভীষণ সুবি হয়ে যাই । সাধারণত অনির্বান দার কোন ইন্সটুমেন্ট পরে কোন টা লাগবে , তা সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে । পুরো ২ ঘন্টা লাগলো না অনির্বান দার এই ক্রিটিকাল অপারেশন টা শেষ করতে , অপারেশন অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে শেষ করলে ও , ভালোই টেনশন এ ছিল অনির্বান দা । যাবার সময় তোর্সা কে বার বার বলে গেলো ছেলে টির দিকে নজর রাখতে , র যতক্ষণ না জ্ঞান ফেরে , তোর্সা যেন সব সময় তার কাছে থাকে । তোর্সা জানে অনির্বান দা কেন এরকম বলে , পেশেন্ট পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে আসা না অবধি সে মনে করে তার কাজ অপূর্ণ ই আছে । অনির্বান দার এই অভ্যাস টা দারুন লাগে তোর্সার । কিন্তু আজ তোর্সার সত্যি ভীষণ টেনশন হচ্ছে, হয়তো অনির্বান দার ও হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না । এই অপারেশন এ সাকসেস এর উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে অনির্বান দার , তোর্সা ভেতর থেকে খবর পেয়েছে এটা নিয়ে হাসপাতাল এর অনেক বড় লেভেল থেকেই কথাবার্তা চলছে । সবার মতেই অনির্বান অনেক বড়ই রিস্ক নিয়ে ফেলেছে , অনির্বান দা ও জানে নিশ্চই সব কিছু , তাই তোর্সা কে বলে গেছে অপারেশন এর কোনো আপডেট কাউকে না দিতে । বাচ্ছাটার মুখের দিকে তাকিয়ে বড় কষ্ট হলো তোর্সার । ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ছেলে টা । তোর্সার খুব ইচ্ছা করছিলো তার মা এর কাছে গিয়ে জানিয়ে আসে অপারেশন ঠিকঠাক ভাবেই শেষ হয়েছে । কিন্তু কিছু করার নেই , অনির্বান দার বারুন আছে । অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখ লেগে গেছিলো তোর্সার , হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখলো চারদিক টা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে । ঘড়িতে দেখলো প্রায় রাত ১০ টা । এক বার অনির্বান দার ঘরে যাবে বলে সবে উঠতে যাবে , মনে হলো যেন পা টা নড়ে উঠলো তুতান এর । কিছুক্ষন ভালো করে দেখে বুঝতে পারলো তোর্সা জ্ঞান ফিরতে চলেছে তাতুন এর । তাড়াতাড়ি করে ডাকতে চলে গেলো সে অনির্বান কে । জ্ঞান ফেরার পর যদি কোনো ক্রিটিক্যালিটি হয় অনির্বান দার সেই সময় এ থাকা টা ভীষণ জরুরি ।
সমাপতন
ফ্লাইট ভীষণ লেট করাই বেশ দেরি করেই হাসপাতাল এ এলো সন্দীপ । নন্দিনী কে এর মাঝে অনেক বার ফোন করেছে সে । অনির্বান ফোন বন্ধ করে রেখেছে , কিছুই খবর পাইনি তুতান এর । মন এর মধ্যে একটা বিশাল চাপ নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হাসপাতাল এ এলো সন্দীপ । পাগল এর মতো খুঁজতে লাগলো নন্দিনী কে । নন্দিনী ও যেন বসেই ছিল কখন সন্দীপ আসবে , আর চাপ নিতে সত্যিই পারছিলো না সে । তাই এতো দিন পর সন্দীপ কে দেখে সে ঝগড়া বা ভালোবাসা কোনটা দেখাবে বুঝতে না পেরে মাথা টা আসতে করে সন্দীপ বুকের উপর রাখলো , মনে মনে শুধু একটাই কথা বললো আর পারছি না । সন্দীপ নন্দিনী কে শান্ত হতে বলে অনির্বান কে আবার ফোন লাগলো । ঠিক সেই মুহূর্তেই ফোন টা বেজে উঠলো অনির্বান এর । ওদিক দিয়ে ফোন রিসিভ করলো অনির্বান । সন্দীপ কে বললো দাঁড়াতে , সে আসছে । বাইরে বেরিয়ে এলো অনির্বান , অনেক দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা হলো , কোথায় আনন্দ করার কথা, সেখানে ২ জন এর এ চোখে জল চলে এলো । জড়িয়ে ধরলো দু জন কে । অনির্বান সবে অপারেশন আপডেট দিতে যাবে , হঠাৎ তোর্সা ছুটে এলো ভিতর থেকে , আর অনির্বান কে জানালো তাতুন এর জ্ঞান ফিরছে । এক মুহূর্ত ও নষ্ট করলো না অনির্বান , সাথে সাথে ভিতর এ যেতে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়ালো সে । সন্দীপ আর নন্দিনী কে ও ডেকে নিলো সে । ৪ জন এ মিলে গিয়ে দাঁড়ালো তুতান এর পাশে । এতো দিন ধরে যে ৪ জন নানা কারণ বশত নিজেদের থেকে অদ্ভুত এক দূরত্ব পালন করছিলো । আজ তুতান যেন তাদের কেই খুব কাছে এনে দিয়েছে । তুতান এর বেড এর পশে দাঁড়িয়ে সন্দীপ মনে মনে বলতে লাগলো ফিরে আই তুতান, আর তোর বাবা মা আলাদা থাকবে না , যাই ই হোক সব কিছুর সাথে মানিয়ে নেবে সন্দীপ । তার পাশেই সন্দীপ এর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নন্দিতা ভাবতে লাগলো , এবার সন্দীপ কে আর কোনোদিন ছেড়ে দেবে না সে । সন্দীপ কে ছাড়া নিজেকে যেন বড় অসহায় লাগছিলো তার । একটু দূরে তাতুন এর পা এর কাছে দাঁড়িয়ে ছিল আরো ২ জন । অনির্বান যে এরকম একটা সময় এ শুধু নিজের কাজের কথা ই ভাবে , সে ও যেন তোর্সার পাশে থাকার অনুভূতিকে কোনো ভাবেই অস্বীকার করতে পারছিলো না । বার বার মনে হচ্ছিলো তোর্সা যেন তার এই ভালোবাসা কে মেনে নেই । আর তোর্সা মনের সব টুকু দিয়ে শুধু জেতাতে চাইছিলো অনির্বান দা কে, কারণ কেন জানে না তার আজ বার বার মনে হচ্ছিলো অনির্বান দার প্রত্যেক টা আনন্দ কে নিজের মধ্যে ভাগ না করে নিতে পারলে তার জীবন টাই বৃথা । এর ই মধ্যে হঠাৎ এ যেন ভগবান নিজের হাতেই জাগিয়ে দিলো তুতান কে । ঠিক যেন মনে হলো ভগবান এসে তার কানে কানে বলে গেলো উঠে পর তাতুন , তোর সামান্য হাসি দেখার জন্য এই জোড়া যুগল যে অপেক্ষা করে আছে । এদের মিলনের পুরো কৃত্তিত্ব নিতে যেন সত্যিই জেগে উঠলো তাতুন । মা বাবা বা সামনের ডাক্তার আঙ্কেল বা সেই মিষ্টি নার্স দিদি কাউকে দেখতে পেলো না সে ভালো করে । কিন্তু কেন জানিনা তার মনে হলো অনেক দিন এর একটা কষ্ট নিমেষে মিলিয়ে গেছে । আজ যেন সে সর্ব সুখ লাভ করেছে । হয়তো সেই অনুভূতি তেই হালকা একটা ‘ছোট্ট হাসি ’ দিলো তুতান । এই একটা ছোট্ট হাসি এ যে সম্পূর্ণ করলো সামনে চাতক পাখির মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই দুই যুগল কে । নন্দিনী হারিয়ে ফেললো সমস্ত কথা , সন্দীপ এর হাত টা জোরে চেপে ধরে যেন মুক্তি পেলো এতো দিন এর সমস্ত যন্ত্রনা থেকে । আর তোর্সা , আনন্দ তে নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে জড়িয়ে ধরলো অনির্বান কে । ভারী এক মিষ্টি ভালোবাসায় হারিয়ে গেলো দু জন এ । যেন সব কিছুর মধ্যে একটা কথা এ সত্যি হয়ে দাঁড়ালো যা সন্দীপ এর সেই ভাবনা কে মিলিয়ে দিলো , ‘ভগবান যা করে তা মঙ্গল এর জন্য ’।
লেখক পরিচিতি : সুতনু সিন্হা , একজন IT সংস্থায় চাকুরীরত লেখক। লেখা আমার একরকমের শখ। যখনই সময় পাই , ছোট গল্প লিখতেই বেশি পছন্দ করি , কখনও তা রহস্য -রোমাঞ্চ কখনো বা জীবনমুখী। যে লেখা মানুষের মনে ছাপ রেখে যায় , সেই ধরণের লেখা লিখতেই আমি বেশি ভালোবাসি।
[…] আলোকবর্ষ ছোট্ট হাসি কে প্রতিবন্ধী!! চোখ-গেলো বেলা শেষে […]