“হৃদয়  ঘিরেছে কত জানা- অজানা,

পেরিয়ে  এসেছি তার সব ঠিকানা।

নতুন নতুন কত মানুষ দেখে,

ভুলেছি কিছু, কিছু তার রেখেছি এঁকে।…”

সকাল  বেলা থেকেই শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি পুরনো গান আপন মনেই গুন গুন করছিলাম।সত্যিই বিচিত্র এই পৃথিবী এবং ততোধিক বিচিত্র এই মানব জীবন। পৃথিবীর অনেকটা পথই পার হয়ে এসেছি, অনেক মানুষের সঙ্গেই জানাশোনা হয়েছে, ভাব আদান প্রদান হয়েছে, অনেক ঘটনাই জীবনে ঘটেছে।পথ চলতে চলতে আজ যদি পিছন ফিরে তাকাই তাহলে সব ঘটনাই যে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে তাও নয়।সব মানুষকে পরিস্কারভাবে মনে আছে এমন দাবি ও করতে পারিনা। আবার কিছু কিছু ঘটনা , কিছু মানুষ এমন আছে যাদের হাজার চেষ্টা করেও বোধহয় ভোলা যাবেনা। আসলে কিছু কিছু মানুষ, ঘটনা মনের গভীরে এমন দাগ কেটে যায় যে শত চেষ্টাতেও তার বোধহয় ভোলা বা মুছে ফেলা যাবে না। কিছু কিছু মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কিছু কিছু ঘটনার বৈচিত্র্য মনের গভীরে এমন ছাপ রেখে যায় তা বিস্মৃত হওয়া সম্ভব নয়। এমনি কিছু কিছু মানুষ, ঘটনার কথা এখানে বলব যাদের চেহারা, ঘটনা চোখ বুজলেই এখনো আমি দেখতে পাই।

এমনিই  এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী  আমার বন্ধু প্রশান্ত ।জীবনে চলার পথে নানা লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে কখনও বা তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মনকে আকৃষ্ট করেছে আবার কখনও বা তাদের চমকপ্রদ কীর্তি কলাপ মনকে বিস্ময়ে ভরে তুলেছে। এমনি এক অদম্য ‌সাহসী চরিত্রের অধিকারী ছিল আমার বন্ধু প্রশান্ত ।

বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের ১৯৬৮ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রের মধ্যে আমরা তিনজন – আমি, প্রশান্ত ও মলয় এসেছিলাম ধানবাদ থেকে, তার মধ্যে আমি ও প্রশান্ত ছিলাম মেথমেটিক্স অনার্সের এবং মলয় ছিল ফিজিক্সের।

কিছু মানুষের চেহারা এমন থাকে যা দেখে তার সম্বন্ধে আন্দাজ করা খুব মুশকিল। প্রশান্তর চেহারা দেখে সবাই তাকে শান্ত , গোবেচারা বলেই মনে করা স্বাভাবিক, কিন্তু সে যে কিরকম দূরন্ত , বিচ্ছু  ছেলে ছিল তা  লোকে কল্পনাও করতে পারতো না । আমরা যখন তাকে সেই কথা বলতাম তখন সে হাসত এবং বলতো, এই চেহারাটাই তো আমার এসেট। 

হঠাৎ একদিন হাওড়ার ৫৪ নং বাসে আসতে আসতে প্রশান্ত আমাকে বলল  চল দীঘা ঘুরে আসি। আমি বললাম দীঘা যাবি কিরে , কিভাবে যেতে হয়, কত টাকা লাগে, কোথায় থাকব কিছুই তো ঠিক হয়নি । প্রশান্ত বলল মেড্রাস মেলে খড়গপুর পর্যন্ত যাওয়া যায়, তারপর কোন বাস ধরে নেব, দীঘা তে গভর্নমেন্টের চীপ কোয়ার্টার এ থাকব। প্রশান্তই আরো দুজন বন্ধুকে যোগাড় করে নিল – একজন স্বপন ও অন্য জন উদয়ন। 

চারজনে মিলে ট্রেন এ তো চড়ে বসলাম কিন্তু কেউই তখনো জানতাম না ট্রেন ক’টা য় খড়গপুর পৌঁছাবে এবং আমরা কি করেই বা দীঘা পৌঁছাব। ট্রেন চলতে শুরু করার পর প্রথম যে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তাহল খড়্গপুর ক’টায় পৌঁছাব এবং দীঘায়  পৌঁছে থাকবার জায়গা পাব কিনা । প্রশান্ত কে একবার বলবার চেষ্টা করতেই ও সব চিন্তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না । ট্রেন খড়্গপুর পৌছাল বিকাল পাঁচটায়, সেখান থেকে বাসে দীঘা প্রায পাঁচ-ছঘন্টার পথ, অর্থাৎ দীঘা পৌছাতে প্রায় রাত দশটা বেজে যাবে, তারপর থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা কে জানে?

বাসের ঝাঁকুনি তে শরীরে যন্ত্রণা ধরিয়ে রাত দশটায় যখন আমরা দীঘায় পৌছালাম তখন সবাইর একটাই প্রার্থনা ছিল যে থাকার জায়গা যেন পেয়ে যাই। ভগবান বোধহয় প্রার্থনা শুনেছিলেন কারণ একটাই রুম বাকি ছিল যেটা আমরা পেয়ে গেলাম। রুম পাওয়া গেল, পথশ্রমের কারনে তাড়াতাড়ি খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও মশার কামড়ের চোটে ঘুম আমার সহজে এলো না , ভোরবেলায় অল্প একটু ঘুমিয়ে নিলাম।

সকালে সবাই মিলে হুটোপুটি করে সমুদ্র স্নান, সমুদ্র সৈকতে বালির উপর খালি পায়ে ঘুরে বেড়ানো, কোন কিছু না কিনেও দোকানে ঘুরে বেড়ানো।কোথায় দিয়ে দুটো দিন যে পার হয়ে গেল আমরা কেউই টের পেলাম না। খড়্গপুর স্টেশনের বেন্চে বসে পকেটে কত বাকি আছে হিসাব করতে গিয়ে খেয়াল হল কলেজ হোস্টেল পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার টাকাটুকূই খালি বাকি আছে।

এরপর প্রশান্তর এক দুঃসাহসিক কীর্তি কলাপের কথা বলব ।

আমরা তখন যারা বেলুড় বিদ্যামন্দির কলেজের আবাসিক ছাত্র ছিলাম তাদের বেশ কিছু কঠিন অনুশাসন মেনে চলতে হোত – ধুতি-পাঞ্জাবি কিম্বা ধুতি -শার্ট পরতে হোত, পায়জামা কিম্বা লুন্গি পরা চলতো না, সকালে ভোর পাঁচটা তে প্রার্থনা সন্গীত গাইতে হোত সবার সঙ্গে প্লেয়ার হলে, ভোর বেলা মুখ হাত ধুয়ে খোলা জায়গায় শীত- গ্রীষ্ম- বরষা বালতির জল ঢ়েলে স্নান করতে হতো , রাত এগারোটাতে ঘুমিয়ে পরতে হতো, হোস্টেল এর রুমে কোন সিলিং ফ্যান ছিল না । এগুলো বর্তমানে বাড়াবাড়ি বলে হ্য়তো মনে হবে যেটা তখন আমাদের ও মনে হয়েছে, কিন্তু এতদিন পরে সেগুলোকে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় না বরং সে সব দিনগুলো খুব মিস করি।

যাকগে যেটা বলছিলাম, অন্য গুলো অভ্যাস হয়ে গেলে ও পরীক্ষার সময় এগারো টায় ঘুমিয়ে পড়ার ব্যপারে অনেকেরই আপত্তি ছিলো। কিন্তু আমাদের সাহস ছিল না অনুশাসন অমান্য করার। কিছু দিন পর হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম রাত এগারোটায় আলো নিভে যাওয়ার মিনিট পনেরো পরে আবার জ্বলে উঠলো, অবাক হলেও আমরা মহানন্দে উঠে পড়তে শুরু করে দিলাম। 

পরের দিন প্রশান্তকে জিগ্গেস করাতে ও কিছু না বলে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। পরে জানলাম, আলো নিভে যাওয়ার মিনিট পনেরো পরে ও মেইন সুইচ অন করে আলো জ্বালায়।বোধহয় কোনভাবে মেইন সুইচ বক্সের ডুপ্লিকেট চাবি বানানো করেছিল।

এই ভাবে কিছু দিন চলার পরে বোধহয় আমাদের বিদ্যাভবন হোস্টেল এর ওয়ার্ডেন সনৎ মহারাজ জানতে পেরেছিলেন । কে প্রতিদিন আলো  জ্বালায় তাকে ধরবার জন্য প্ল্যান করলেন সিকিউরিটি গার্ড বাহাদুর এর সঙ্গে। ঠিক হলো আলো জ্বলার পরে বাহাদুর হুইসেল বাজাবে এবং মহারাজ তিনতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলাতে নেমে আসবেন, কারন দোতলায় সিঁড়ির পাশেই মেইন সুইচ বোর্ড ছিল।

প্রশান্ত  কিন্তু মহারাজ এর প্ল্যানের  বিষয়ে কিছুই জানতোনা । প্রতিদিন এর মতো প্রশান্ত মেইন সুইচ অন করে আলো জ্বালানোর পরেই বাহাদুর হুইসেল বাজিয়েছে আর মহারাজ ও সিঁড়ি বেয়ে দুড়দাড় করে নেমে এসেছিলেন। শীতকাল ছিল বলে প্রশান্তর গায়ে একটা সবুজ শাল ছিল যেটা পরে প্রশান্ত তখন মেইন সুইচের ঢ়াকা বন্ধ করতে ব্যস্ত ছিল । মহারাজ হঠাৎ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসাতে প্রশান্ত অনন্যোপায় হয়ে সিঁড়ির উল্টো দিকে ছুটে গেল। মহারাজ ও চোর ধরার আনন্দে প্রশান্তর পিছনে ছুটে গেলেন।

কিছু দূর যাওয়ার পরে মহারাজ আর সবুজ শাল  পরা প্রশান্ত কে দেখতে পেলেন না । মহারাজ বাহাদুর কে ভালো করে সব জায়গা খুঁজে দেখতে বললেন। বাহাদুর সব জায়গা ভালো করে খূজে দেখবার পরেও কিছুই পেলোনা। প্রশান্ত যেদিকে ছুটে গিয়েছিল তার কিছু দূর যাওয়ার পরে করিডোর শেষ , অর্থাৎ তার পরেও যেতে হলে প্রশান্তকে কার্নিশে নেমে পড়তে হতো। কার্নিশের চওড়া মাত্র ছয় ইঞ্চি ছিল। তার উপর দিয়ে কেউ ছুটতে গিয়ে নিচে পড়ে গেলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল।

এবারে শীতের রাতেও মহারাজের কপালে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠল, কারন প্রশান্তর কিছু হলে তার দায় মহারাজের উপরেই বর্তাতো। উপরে নিচে অনেক খূজেও কাকেও না পাওয়াতে মহারাজ বুঝতে পেরেছিলেন চোরের কিছুই হয়নি এবং বোধহয় মনে মনে হাঁফ ছেড়ে ও বেঁচেছিলেন।

চোরের গায়ে সবুজ শাল ছিল এটুকুই খালি দেখেছিলেন, মুখ দেখতে পাননি, সেইজন্য মহারাজ সকালে একটু বেলা বাড়ার পর মহাউৎসাহ ভরে সবুজ শাল ওয়ালা চোরকে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কোথাথেকে প্রশান্তকে দেখলাম একটা নীল সোয়েটার গায়ে মহারাজের পাশে দাঁড়িয়ে বুদ্ধি জোগাচ্ছিল কিভাবে সবুজ শাল গায়ে চোর কে ধরা যায়। মহারাজ দেখলাম প্রশান্তর পরামর্শে প্রত্যেক ঘরে সবুজ শাল খোঁজ করার জন্য বাহাদুরকে বললেন । সুযোগ পেয়েই প্রশান্ত কে বললাম তুই যে সবুজ শাল খোঁজ করার কথা মহারাজকে বললি, যদি তোর শালটা ধরা পরে যায়? প্রশান্ত একগাল হেসে বলল, সে শাল সকাল সকাল আমি লন্ড্রিতে দিয়ে এসেছি।

এই ছিল  প্রশান্ত – দুরন্ত , অদম্য ও দুঃসাহসী । সন্গীতপ্রেমী ছিল বলে স্থানীয় এক গানের শিক্ষকের কাছে গান শেখাও শুরু করল ।  কিছু দিন গান শেখার পর ভালো গান ও গাইতে শুরু করল , কিন্তু একদিন দুম করে গান শেখা বন্ধ করে দিল, বলল ঠিক যেভাবে গাইতে চাই সেভাবে গাইতে পারছিনা ।প্রশান্ত বলতো টেকো হওয়া থেকে চূল পেকে যাওয়া অনেক ভালো । তাহলে অন্তত মাথায় ঠান্ডা লাগবে না । এমনি অদ্ভুত যুক্তি ছিল প্রশান্তর ।

শেষ যেবার দেখা  হলো বলল শিবপুর ইন্জিনিয়ারিং কলেজে মেথমেটিক্স পড়াই। জিগ্গেস করলাম আই এস আইয়ে ঢ়ুকলি না কেন? বলল ওখানে গেলে এত ছুটি পেতাম না । অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ নেই, কোথায় আছে তাও জানি না । বেশ কয়েক বছর পর বেলুড় বিদ্যামন্দিরের রিইউনিয়ন এর আমন্ত্রণ পেলাম। খুশিই হলাম, ভাবলাম, এই সুযোগে প্রশান্তর সঙ্গেও দেখা হবে। দেখা না হলেও অন্তত খবরটা পাওয়া যাবে।

বিদ্যামন্দিরের রিইউনিয়নে বেশ কিছু পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। বয়সের চাকা ঘোরার সঙ্গে শরীরের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা এত বেশি পরিবর্তন হয়েছিল যে কিছু পুরনো বন্ধুকে চেনা মুস্কিল হয়ে পড়েছিল।তাতে অসুবিধা অবশ্য কিছুই হয়নি কারন দেখতে পেয়ে তারাই দেখলাম এসে জড়িয়ে ধরল।তাদের মুখেই জানলাম যে আমার শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়া ছাড়া চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। প্রশান্তর দেখা পেলাম না। উশখুশ করছিলাম, সামনে আমাদের পুরানো ম্যাথমেটিক্স অনার্সের সহপাঠী অলককে দেখে প্রশান্তর কথা জিজ্ঞেস করতেই হতাশভাবে মাথা নাড়ল। বিদ্যামন্দিরের রিইউনিয়ন এর এক সপ্তাহ আগেই নাকি তার শ্যামবাজারের বাড়িতে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছে। হঠাৎ প্রশান্তর এই খবর পেয়ে দুঃখ- কষ্টে বোবা হয়ে গেলাম। অলক তখনো প্রশান্তর কথা আরও বলে যাচ্ছিল, আমার কানে ঢুকছিল না। আমার অন্তরাত্মা তখন প্রশান্তর বিয়োগব্যাথার অব্যক্ত বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।

কলমে মুকুট রায়, আসানসোল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here