বিল্টুর বিটলামি

0
886

বিল্টুর আজ সকাল থেকেই মটকা গরম । তার সাথে এটি করতে পারল তিন্নি? প্রতিশোধ নিল কাল রাতে র ঘটনার !! যে বিল্টুকে পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুরা পর্যন্ত সমঝে চলে ,তাকে এভাবে অপদস্থ করা! তিন্নি বিল্টুর ছোট বোন, বিল্টুরা এক ভাই এক বোন। বিল্টু ক্লাস সিক্সে পড়ে আর তিন্নি পড়ে ক্লাস থ্রি তে । ছোট থেকেই বিল্টু খুব দুষ্টু । বিল্টুর দুষ্টুমিটা একটু অন্যরকম, আর পাঁচটা ছেলের থেকে আলাদা, ও মানুষ কে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। স্কুলেও ওর এ ব্যাপারে খুবই দুর্নাম আছে।একবার অঙ্কের টিচার সুধাংশু বাবু ক্লাস নিচ্ছেন, বোর্ডে একটা অঙ্ক বোঝাচ্ছেন ,সবাই খুব মন দিয়ে দেখছে, বিল্টু হঠাৎ ফাস্ট বেঞ্চ থেকে একটু ঝুঁকে পেন্সিল তোলার ভান করে একটা কৌটো থেকে দুটো ব্যাঙ বের করে স্যারের পা এর কাছে ছুড়ে দিয়েছিল,ব্যাঙ লাফাতে লাফাতে স্যার এর পা এর ওপর,তারপর ভয়ানক চিৎকার, হেডমাস্টারমশাই এর আগমন -শাস্তি, ভয়ানক শাস্তি , কিন্তু বিল্টুর কি কিছু পরিবর্তন? কিচ্ছু না, আবার কদিন পরেই সংস্কৃত ক্লাসে সামনের বেঞ্চে অভীকের জামার পিছনের কলার তুলে কৌটো থেকে আরশোলা বের করে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ,আবার ক্লাস পন্ড,গার্জিয়ান কল, পিঠে বেত, বিতিকিচ্ছিরি এক ব্যাপার -এসব তার মাঝে মধ্যেই চলতো।
তবে একবারই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও। সেবার গরমের ছুটি পরেছে সবে। একদিন দুপুর বেলা এক ঘরে মা আর বোন ঘুমাচ্ছে, ঠাম্মা ঘুমাচ্ছে অন্য ঘরে ,বাবা বাইরের ঘরে বসে পরীক্ষার খাতা দেখছে,,বিল্টু কি করবে তার চোখে তো বোনের মতো নিদ্রা দেবী যখন তখন নেমে আসে না, যদিও বাবা দুই একবার অঙ্ক করতে বসতে বলেছিল কিন্তু বিল্টুর পড়াশোনা করতেও ভালো লাগে না।হঠাৎই মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল, আস্তে আস্তে মা এর ঘরের আলনা থেকে বাবার একটা ধুতি পাঞ্জাবী নিয়ে পরে ফেললো, তারপর মা এর পাউডার কেস থেকে কিছু পাউডার নিয়ে মাথার চুলে লাগালো এবার চললো ঠাম্মার ঘরের দিকে, ঠাম্মার ঘরের শোকেস থেকে নিল একটা বাক্সের ভিতরে যত্ন করে রাখা স্বর্গীয় দাদুর ব্যবহার করা চশমা। চশমাটা চোখে পরে নিল, একটু দেখতে অসুবিধা হচ্ছে ,তা থাক– এবার দরজার পিছনে রাখা দাদুর লাঠিটা হাতে নিয়ে একবার আয়না দিয়ে নিজেকে দেখে নিল—না দেখতে তাকে সত্যিই দাদুর মতোই লাগছে, এবার এগিয়ে গেল ঠাম্মার বিছানার কাছে, ঠাম্মার মাথার কাছে দাড়িয়ে দাদুর লাঠি টা দিয়ে ঠকঠক শব্দ করতে লাগল, না ঠাম্মার তো ঘুম ভাঙছে না, কি করা যায়–বেশি সময় তো নষ্ট করা যাবে না, কেউ এসে পরতে পারে, এবার তাই আস্তে আস্তে দাদুর লাঠি টা দিয়ে ঠাম্মার গায়ে কয়েকবার খোঁচা দিল—ঠাম্মা চমকে উঠে বললো কে রে?? তারপর ঘুম চোখে তার দিকে তাকিয়ে একটা জোরে কে এ- এ-এ-এ- আওয়াজ করে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পরে গেল।
বাবা বাইরের ঘর থেকে ছুটে আসলো, বিল্টু কি করবে প্রথমে বুঝতে পারছে না,তারপর বাবার চিৎকারে ছুটে জল নিয়ে এসে ঠাম্মার চোখে মুখে দিতে লাগল কিন্তু ঠাম্মার জ্ঞান তো আসছে না ,ডাক্তার কাকা কে ডাকা হল, উনি দেখে বললেন বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার ।হাসপাতালের বেডে ঠাম্মার মাঝে মাঝে জ্ঞান আসছে আবার কে এ-এ-এ—–বলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, টানা তিন দিন এভাবে থাকার পর ঠাম্মার পুরোপুরি জ্ঞান এসেছিল । তারপর বাড়িতে বাবার হাতে উত্তম মধ্যম ধোলাই খাবার পর ঠিক করেছিল আর এইরকম ভাবে কারোকে ভয় দেখাবে না।
কিন্তু কাল যে আবার মাথায় কি চাপলো কে জানে!! সন্ধ্যাবেলা মায়ের কাছে পড়তে বসেছিল ওরা দুই ভাই বোন । মা দুজনকে পড়া দিয়ে একটু রান্নাঘরে গিয়েছে ,তিন্নি মন দিয়ে পড়ছে কিন্তু বিল্টুর পড়ায় মন নেই ও উঠে গিয়ে আস্তে আস্তে ঠাম্মার ঘরে গিয়ে একটা সাদা কাপড় নিয়ে পিছনের বাগানে চলে গেল তারপর সাদা কাপড় দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে বোন যে ঘরে জানলার সামনে বসে পড়ছে সেই জানলার ওপর কিছুটা উঠে হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ——করে মুখ থেকে আওয়াজ করতে লাগলো , তিন্নি জানলার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে ‘বাবাগো মাগো’ বলে রান্নাঘরের দিকে দৌড়াতে লাগলো—-
পরদিন সকালবেলা তিন্নি র ডাকে ঘুম ভেঙে গেল ‘দাদা ওঠ হরি কাকা এসেছে, আমার আর বাবার হয়ে গেছে । ‘ অনিচ্ছসত্বেও ওর উঠতে হল,,, হরিকাকার পাড়ার মোড়ে একটা ইটালিয়ান সেলুন আছে, একটা গাছের তলায় ইট পেতে বসে চুল দাড়ি কাটে তাই পাড়ার ছেলেরা বলে ইটালিয়ান সেলুন।। মাসে একবার করে এসে বাবার চুল দাড়ি কাটে, তিন্নির আর তার চুল ও ছেটে দেয় ,এব্যাপারে বাবার কড়া নির্দেশ হরিকাকাও সেটা জানে । যাইহোক ঘুম চোখে গিয়েই বসতে হল হরিকাকার সামনে, আজ দেখি তিন্নি ই আগ্রহ করে বাটিতে জল এনে রেখে দিল । হরিকাকা চুল কাটছে বিল্টুর চোখে তখনও ঘুমের আমেজ,হঠাৎ কিছু টা কাটার পর একটা অন্যরকম অনুভূতি—–বিল্টু লাফ দিয়ে উঠে হরিকাকার আয়নাটা টেনে নিল,,ডানদিকের কানের কিছু টা ওপরের অনেকটা চুল চেছে দিয়েছে টাক দেখা যাচ্ছে,আর্তনাদ করে উঠলো বিল্টু,’এটা তুমি কি করলে?’
”কেন তিন্নি বহিন ই তো বললো বাবু নাকি বলেছে তোমাকে আজ ন্যাড়া করে দিতে।” দূরে দাঁড়িয়ে তিন্নি তখন মিটিমিটি হাসছে।বিল্টুর চোখ ফেটে জল আসছে কিন্তু তার নালিশ জানাবার কোন জায়গা নেই তার কথা কেউ শুনবে না। কিন্তু আজ যে তার স্কুলে ভূগোলের ইউনিট টেস্ট, তাকে তো যেতেই হবে স্কুলে, ,,, কি করবে সে —-হঠাৎই মাথায় এল একটা বুদ্ধি — দৌড়ে ঠাম্মার ঘরে গিয়ে একটা সাদা কাপড় ছিড়ে মাথায় ফেট্টি বেঁধে নিল।।
স্কুলে ঢুকতেই বন্ধুরা ঘিরে ধরল , বিল্টু গম্ভীর মুখে জানিয়ে দিল বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে,মুখ দেখে তো মনে হল সবাই ই বিশ্বাস করেছে কিন্তু অভীক!! ওর যেন মুখে একটু মুচকি হাসির রেখা – টিফিনের পরের পিরিয়ডে ভূগোল পরীক্ষা, বিল্টু বই নিয়ে বসে আছে কিন্তু কিছুই পড়ছে না, মন মেজাজ আজ খুবই খারাপ ,তারপর – হঠাৎ অভীকের গলা,,, ‘বন্ধু রা আজ আমি তোমাদের একটা ম্যাজিক দেখাবো’-বলেই বিল্টুর মাথার ফেট্টি টা টেনে খুলে দিল-বিল্টু কে ঘিরে সবার সেই নাচ-”’ন্যাঁড়া ন্যাঁড়া ন্যাঁড়া ,বেঞ্চির ওপর দাঁড়া ” বিল্টুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে, শুধু কানে একটা সুর ভেসে আসছে—–
টিফিন টাইম শেষ, শুরু হল ভূগোল পরীক্ষা- ম্যাপে এসেছে বঙ্গোপসাগর নির্ণয় -বিল্টু র হাতের পেন্সিল ধীরে ধীরে বঙ্গোপসাগরের তীরে এসে দাঁড়াল ,চোখের জলে সাগরে যে আজ ঢেউ উঠেছে—–

লেখিকা পরিচিতি : শুভশ্রী সান্যাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here