দার্জিলিংয়ের ছোট্ট গাঁ। নাম মুকুন্দপুর। পাহাড়ের ঢালের এ সবুজ গাঁ-টি প্রকৃতি যেন আপন হাতের স্নেহ-ছোঁয়া লাগিয়ে পরম মমতা দিয়ে লালন করে আসছে। এখানকার লোকেরা চা-বাগানে ঝুড়িতে করে চা তোলে। মজুরি নেয় এবং তা দিয়ে গরিবয়ানা মতে জীবন যাপন করে। তবে লোকগুলোর মধ্যে সুন্দর এক হৃদ্যতা মাখানো সম্পর্ক আছে। কোনও ঘরের কোনও লোক যদি খেতে না পায় আজও এদের কেউ সে সংবাদ পেলেই দু’মুঠো ভাত নিয়ে গিয়ে তাকে খাইয়ে আসে।

     আহা! এমন গাঁয়ের কথা শুনলে মন তো ভরেই যাবে।

     গাঁয়ের পাশ দিয়ে একটা ক্ষুদ্র নদী বয়ে গেছে। তার ঝরনার জল ঝর ঝর করে সারাদিন কেবল ঝরেই চলেছে। পাহাড়ি বালক-বালিকার দল সেখানে সারাটি দিন ধরে খেলায় মেতে থাকে। পাহাড়ি টিয়ারা এসে ঝরনার জলে গা ধোয়।

     অদূরেই রয়েছে মুনির আশ্রম। নৃপেন মুনি সেখানে থাকে। ওনার এখানে কেউ নেই। কোথা থেকে এসে এখানে আশ্রম করে বসে আছেন কেউ জানে না। তবে নৃপেন মুনি সম্পর্কে এ গাঁয়ে সবার কাছে একটা সুনাম প্রচলিত আছে। নৃপেন কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। বয়স বাহান্ন বছর। সারাদিন ভিক্ষা করে বেড়ান।

     জয়া ওই আশ্রমের মুনির কাছে একদিন এল। জয়ার বাড়ি পাহাড়ের এক কোণে। একমাত্র ছেলে ললিত আর অসুস্থ স্বামী অনন্তকে নিয়ে ওর সংসার। মুনি নৃপেনের কাছে এসে জয়া বলল, ‘বাবাঠাকুর, আমার স্বামীর খুব শরীর খারাপ। আপনি কিছু একটা করুন। মানে চিকিৎসা-টিকিৎসা যদি কিছু করা যায়।‘

     ‘কী হয়েছে তোর স্বামীর?’, প্রশ্ন মুনির।

     ‘আজ একমাস হলো টাইফয়েডে ভুগছে। মাথার চুল সব উঠে গিয়েছে। আর কিচ্ছু বাকি নেই।‘, উদগ্রীব হয়ে বলে জয়া।

     ‘কাল একবার আনিস আমার কাছে। দেখবখন।‘, শান্ত স্বরে বললেন মুনি।

     ‘হ্যাঁ, বাবাঠাকুর একটু দেখবেন। গরিব মানুষ আমি। স্বামী খাটতে-খুটতে পারে না। এই চা বাগানে চা তুলে যা পাই তাই দিয়ে দিন গুজরান করি। বড় ডাক্তার দেখাব, সাধ্য কী?’, আর্ত কন্ঠে বলে জয়া।

     ‘কোনও ডাক্তার দেখিয়েছিস?’, প্রশ্ন করেন মুনি নৃপেন।

     ‘ওই তো একজন মাঝারি গোছের একটা ডাক্তার, কী নাম যেন তার, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, চঞ্চল দাস, তাকেই দেখিয়েছি। উনি বললেন, এ রোগ আর সারবে না। রুগির বাঁচার আশা নেই।‘, দীর্ঘশ্বাস জয়ার।

     পরদিন অনন্তকে দেখে মুনি বললেন, ‘আর আশা নেই। বাঁচবে না। তবে এই শেকড় বাটাখানা খাইয়ে দেখিস। তবে আর একসপ্তাহ টিকবে কি না বলতে পারছি নে রে মা!…’

     এক সপ্তাহ পর অনন্ত এ জগতের মায়া কাটাল। মরে গেল।

     সেই থেকে আজ অবধি জয়া ভিখারিনী। চা বাগানের এক বাবুর কুদৃষ্টি ওর ওপর পড়েছিল। সেদিন হতেই ও চা বাগানের কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর ভিক্ষে করে দিন পার করতে হচ্ছে ওকে।

     ছেলে ললিত এখন চার বছরের ছেলে। ক্লাস ফোরে পড়ে। তবে ওরা আর দার্জিলিংয়ে থাকে না। কলকাতায় চলে এসেছে। এখানে ঘর নেই, দোর নেই, পথের পাশে পড়ে থাকে। শুধু কিছু কাঠপাতা দিয়ে পথের পাশে একটা ঘর মতোন করে নিয়েছে। তাতেই থাকে।

     ওরা দার্জিলিং ছেড়ে আসতে চায়নি। চা বাগানের কিছু লোকের অত্যাচারে ওখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া কলকাতায় যেমন দিন গেলে ভিক্ষে করে আয় হয় ওখানে তার কানাকড়িও হতো না।

     এভাবে চোদ্দো বছর পার হলো। ওরা এখানে একটু স্থিত হয়েছে। এখানে বালিগঞ্জে এক ধনী বাবুর বাড়িতে মায়-বেটা থাকে। বাড়ির সব কাজ দু’জন করে। ওদের থাকা-খাওয়ার সব খরচ ওই বাবুর।

     ললিত লেখাপড়াও শিখছে। যেমন তেমন লেখাপড়া নয়। একেবারে মেডিকেল জয়েন্টের জন্য পড়ছে।

     দু’মাস পর নীট পরীক্ষা। ওই বাবুটি বলতে গেলে ললিতের বাবার ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

     পরীক্ষা হয়ে গেল। আজ ফল বেরনোর দিন। এই ক’দিন জয়া অত্যন্ত অসুস্থ আছে। টাইফয়েড হয়েছে।

     সব্বনাশ! বাবা এই রোগে চলে গেছে। মা’রও আবার! ভেবে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম ললিতের। বাবু বিজয় চ্যাটার্জি বললেন, ‘ললিত, তুই রেজাল্ট দেখতে যা। আমি ডাক্তার আনছি। দেখছি কী করা যায়।‘

     আজ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি অবস্থা ওর মা জয়ার।

     ললিতের একটা মোবাইল ফোন আছে। বিজয়বাবু দিয়েছেন। ওর ফোনে বাবুর নম্বর থেকে কল এল।

     ‘হ্যাঁরে ললিত, তুই এখনও রেজাল্ট দেখলি না!’, বকা দেন বিজয়বাবু।

     বিজয়বাবুর এক মেয়ে। তার বয়স এই কত আর হবে, আঠেরো মতো। স্ত্রী অনেক আগেই গত হয়েছেন। তবে ওনার কাছে জয়ার একটা পবিত্র ও শ্রদ্ধাময় জায়গা আছে।

     ‘কাকু, আমি বসে আছি রাস্তার পাশে। আমি রেজাল্ট দেখতে সাইবার ক্যাফেতে যাইনি। মনটা বড্ড খারাপ।‘, ভগ্ন গলায় বলে ললিত।

     ‘বাড়ি চলে আয়। আমার মেয়ে জয়িতা তোর রেজাল্ট দেখে এসেছে। তুই পঞ্চান্ন র‍্যাঙ্ক করেছিস। আর ডাক্তার জয়াকে দেখেছে। ভালো আছে। ভয়ের কিচ্ছু নেই।‘, শান্ত সুরে বললেন বিজয়বাবু।

     ললিত যেন স্বর্গ হাতে পেয়ে গেল খবরটা শুনে। ও তো ভাবতেই পারছে না, পাঁচ বছর পরে ও একজন এম বি বি এস ডাক্তার হয়ে চেম্বার খুলে বসবে, নাহয় সরকারি কোনও হাসপাতালে চাকরি করবে। ওর মুখে কথা থাকে না।

     ও চুপ করে থাকে।

     ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়। জয়িতা মিষ্টি কিনে এনেছে। খাবি আয়।’, বললেন বিজয়বাবু।

     বিজয়বাবু ধনী লোক। বয়স্ক লোক। মনটা কিন্তু এখনও শিশুদের মতোই।

     এক মাস পর জয়া পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল।

     আর ললিত? সে তো নিয়মিত মেডিকেল কলেজ যাচ্ছে। বিজয়বাবুর কথায় ললিত হবে কয়েক বছর পর ওনার জামাই। আদরের একমাত্র জামাই। এ বিষয়ে জয়া বা ললিতের কারওরই অমত ছিল না।

     ভিখারিনীর ছেলে হয়ে গেল রাজকুমার!…

কলমে মনসুর আলী গাজী, বারুইপুর, দ: ২৪ পরগণা



LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here