ভাষা , যা মনের ভাব প্রকাশ করার এক এবং একক মাধ্যম। সে ভাষা অনেক রকমের। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন দেশ ভিন্ন প্রজাতির ভিন্ন ভাষা। তবে মনের ভাষা শুধু মাত্র একটিই, তা হলো মাতৃভাষা , যে ভাষায় আপনি প্রথম কথা বলতে শিখেছেন, মা কে ডাকতে শিখেছেন। ভারতের মতো অনেক দেশেই আজ ইংলিশ ভাষাকে সরকারি ভাবে প্রাধ্যান্য দিলেও , নিজের মাতৃভাষার তুলনা হয়না। ভারতকে ছেড়ে দিয়ে যদি অন্য দেশের কথা বলি , এরকম অজস্র দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে , যেখানে কেউ ইংলিশ এ কথা বলে না ,পড়াশোনা থেকে অফিস -সব রকম কাজ কর্ম চলে তাদের মাতৃভাষা অনুযায়ী। এসব দেশ গুলোর মধ্যে জাপান, ডেনমার্ক , আরো কত দেশই না আছে। যেখানে লোকে শখে ইংলিশ বলে , সেটা কোনো বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু আমাদের দেশে , মানে ভারতে যদি আপনি ভালো করে ইংলিশ না বলে উঠতে পারেন ,তার মানেই আপনার শিক্ষার মাপকাঠিটা এখনো শিখর ছুঁইনি। যাক সে কথা , অনেক চেষ্টা করলেও এদেশে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা প্রায় অসম্ভব।
প্রায় অসম্ভব এই কারণেই বললাম , কারণ আশার আলো বুকে জেগে না থাকলে , বাঁচবেন কি ভাবে !!
আমাদের দেশে ২২ টি প্রধান ভাষা রয়েছে, যা ১৩ টি ভিন্ন স্ক্রিপ্টে লেখা হয়ে থাকে এবং ৭২০ টির বেশি ডায়ালেক্ট রয়েছে। সরকারী ভারতীয় ভাষা হিন্দি (আনুমানিক ৪২০ মিলিয়ন স্পিকার) এবং ইংরেজি, যা ব্যাপকভাবে কথ্য। মাতৃভাষা , আমাদের দেশে , এতো গুলো মাতৃভাষার জন্যই হয়তো , সব গুলিয়ে একটা সরকারি ভাষা নির্ধারিত করা হয়েছে। তা বলে , মাতৃভাষা ভুলে গেলে কি করে চলবে ! সরকারি -আন্তর্জাতিক ভাষার সাথে সাথে নিজের মনের ভাষা কে যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ,জিয়িয়ে রাখতে হবে , আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য, যে প্রজন্ম এখন চোখ খুলেই আন্তর্জাতিক ভাষায় পৃথিবীকে দেখতে শিখছে , আর বলতে শিখছে (খুব গর্বের সহিত ) ” আমি তো মাতৃভাষা জানিনা “, যা আদৌ গর্বের নয়। প্রতিটা মাতৃভাষায় লেখা আছে অজস্র সাহিত্য -অজস্ৰ ইতিহাস , জানি তা ইংলিশ এ পড়ে নেওয়া সম্ভব , কিন্তু সত্যি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা কবিতাকে কেউ ইংলিশ এ ঠিক সে ভাবে অনুভব করবে !! বিতর্কে যাওয়া এই লেখার বিষয়বস্তু নয়।
তাই আসল প্রসঙ্গে আসা যাক।
২১শে ফেব্রুয়ারী , ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে (আইএমএলডি) বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ,ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এবং বহুভাষাবাদকে উন্নীত করার বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হওয়া এক বার্ষিক উদযাপন।এই উৎযাপন , বাংলাদেশ এর প্রথম উদ্যোগ।
ইতিহাস :
১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল, তখন তার দুটি পৃথক অংশ ছিল: পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমানে পাকিস্তান হিসাবে পরিচিত)। সংস্কৃতি, ভাষা, ইত্যাদি অর্থে দুটি অংশ একে অপরের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার তখন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় ভাষা বলে ঘোষণা করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মাতৃভাষা ছিল বাংলা। শুরু হয় প্রতিবাদ -আন্দোলন। তারা উর্দু ছাড়াও কমপক্ষে আরো একটি জাতীয় ভাষাগুলির একটিতে বাংলা -কে দাবি করে।
” Mr. Jinnah made a statement in the Constituent Assembly on 25th February, 1948 that Pakistan being a Muslim state URDU would be its state language. Quaid-E-Azam Md. Ali Jinnah was to visit DU during his stay in East Bengal (Bangladesh) in 1948. The students asked Khwaja Nazimuddin (chief minister of East Bengal at that time) to put forward their demand for Bengali to be accepted as one of the state languages of Pakistan. But apparently he didn’t convey that to Mr. Jinnah. The founder of the nation told them during his speech on 19th March, 1948 that URDU alone will be the lingua franca of Pakistan “
[by Lt. Gen. (retd) Kamal Matinuddin; Tragedy of Errors, East Pakistan Crisis 1968-1971]
প্রতিবাদ ধ্বংস করার জন্য, পাকিস্তান সরকার জনসভা- সভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল।তা সত্বেও , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাধারণ জনগণের সমর্থনে ব্যাপক সমাবেশ ও বৈঠক আয়োজন করেছিল । ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে পুলিশ সমাবেশে আগুন ধরিয়ে দেয়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ শতাধিক তরুণ আহত হয়েছিলেন এই দিনে । এটি ইতিহাসের একটি খুব বিরল ঘটনা, যেখানে মানুষকে তাদের মাতৃভাষার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল।
কিন্তু শহীদদের বলি বৃথা যায়নি । বহু বছর ধরে চলমান বিক্ষোভ, বড় সমাবেশ, ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশিরা (তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানীরা) বড় বড় উৎসর্গের পর , সরকার বাংলা ভাষা কে তার যথাযত পদমর্যাদা দিতে বাধ্য হয়।
তখন থেকে বাংলাদেশীরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের দিন হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারী কে উদযাপন করে। শহীদ মিনারে শহীদদের সম্মানে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের উদ্যেশে গভীর দুঃখ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় ।
পটভূমি
ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙালি সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচয়ের দাবির জন্য একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। এই আন্দোলনটি পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ও বিভাগীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে আরও তীব্রতর করে তুলেছিল । এই আন্দোলনটি ৬-বিন্দু আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের (মুক্তিযুদ্ধ) সহ পশ্চিম পাকিস্তান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছিল।
সেই ২১ শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে, শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এসেছিলেন। তার সাথে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভায় সদস্য, ঢাকায় কূটনৈতিক মিশনের কর্মী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইত্যাদি তাকে অনুসরণ করেন এবং শহীদ মিনারে আসেন । সারা দিন ধরে, সকল বয়সের মানুষ শহীদ মিনারে যান, যারা বাংলার জন্য জীবন দিয়েছেন তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাতে । ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে কাঁদতে কাঁদতে উচারটিতো হইয়াছিল অগ্নি বাণী ,
‘অমর ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি ‘ .
এই দিনের স্মরণে, বাংলা একাডেমি এক মাস দীর্ঘ বই মেলা রাখে এবং সারা মাসে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
বাংলাদেশে, ২১ শে ফেব্রুয়ারী প্রতিবছর ভাষা আন্দোলন দিবস হিসাবে স্মরণ করা হয়।
২১শে- র প্রতিফলন
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলাদেশে একটি জাতীয় ছুটির দিন। এই প্রস্তাবটি রফিকুল ইসলাম, কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের বাসিন্দা ,দ্বারা প্রস্তাবিত হয়েছিল। তিনি ৯ জানুয়ারী ১৯৯৮ তারিখে কোফি অ্যানানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যে তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে বিশ্বের ভাষাগুলি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নেবেন। ঢাকার ভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৫২ সালের হত্যাকাণ্ডের স্মরণে রফিক ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখের প্রস্তাব দেন। সেই থেকে “২১ শে ফেব্রুয়ারি – আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”।
কত দ্রুত সময় চলে যায় ! মনে হচ্ছে রক্তের বিস্ফোরক ঘটনা ২১শে ফেব্রুয়ারী, কয়েক দশক আগে যেন ঘটেছিল। সে সময় কেউ ভাবতেন না যে এই দিনের কার্যকলাপটি অর্ধ শতাব্দীর অধিক সময় পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে আকৃষ্ট করবে।
একুশেয়ের সম্ভবত সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যটি ছিল যে এটি একটি আন্দোলন, যেখানে ভাষা ধর্মের উপর অগ্রাধিকার লাভ করেছিল।
ভাষাগুলি আমাদের বাস্তব এবং অনুভূতিহীন ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র। মাতৃভাষা প্রচারের সকল পদক্ষেপ শুধুমাত্র ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষী শিক্ষাকে উত্সাহিত করতে নয় বরং সারা বিশ্ব জুড়ে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পূর্ণ সচেতনতা বিকাশ এবং বোঝার, সহনশীলতা এবং সংলাপের ভিত্তিতে সংহতি উৎসাহিত করবে।
বাংলা দেশের তথা বাংলা -ভাষী অঞ্চলে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের মধ্যেই বাঙ্গালীর সেই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের স্মৃতি স্মরণ করা যাক।
“বাংলা ভাষার জয় হোক!”
কলমে মৌসুমী কুন্ডু