বেশ প্রসন্ন মনে বাড়ি ফিরছে দীপ্ত। ছোটবেলা থেকেই যে স্বপ্নটা সে দেখে আসছে, আজ তা সত্যি।একটি নামী পত্রিকার কবিতা সংকলনে তার লেখা নির্বাচিত হয়েছে; আজ ছিল তার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ও সংবর্ধনা সভা। একটা কোচিং সেন্টারে পড়ানোর পাশাপাশি নিজের লেখালিখি চালিয়ে যাচ্ছে দীপ্ত। বিশ্বসাহিত্য পড়াশোনা ও নিজের লেখালিখি তার প্রাণের সাধনা। জীবনের বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করা, আরও একটি নেশা তার। যাইহোক, আজ দীপ্তর মনটা প্রাপ্তির আনন্দে পরিপূর্ণ; গায়ে তার কেতাদুরস্ত সাজ, ব্যাগে শংসা – স্মারক – সম্মাননা।

   পৌষ – গোধূলির ধোঁয়াটে চাদর ভেদ করে বাসটা মধ্যম লয়ে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার আলোগুলো একে একে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ক’দিন হলো শীতের তীক্ষ্ণতা প্রকটতর। বাসের পিছন দিকে জানালার ধারে একটি সিটে বসেছিল দীপ্ত। জানালার কাচ গুলো লাগানো থাকায় যাত্রীদের আরাম বোধ হচ্ছে। গাড়িতে লোকজনের সংখ্যা কম, এখনো বেশ কিছু সিট ফাঁকা পড়ে আছে। মনের ভিতর একরকম ব্যাকুলতা অনুভব করছে দীপ্ত — কখন সে বাড়ি পৌঁছে, মা – বাবার হাতে তুলে দেবে তার পুরস্কার!  চলন্ত বাসের জানালা থেকে দীপ্তর চোখ পড়ল জনবহুল, যানবহুল, ব্যস্ত শহরটার দিকে – আকাশছোঁয়া ইমারত, বিলাসবহুল হোটেল, রেস্তোরাঁ, শৌখিন দোকানপাট, বড় – বড় ব্যানার, হোর্ডিং, নানারকম মানুষজন, নানারকম সাজ – পোশাক, বাহারি আলোকসজ্জা, নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন মগ্ন রঙিন কলকাতা, সর্বোপরি আধুনিক বিশ্বায়িত পৃথিবীর অত্যাধুনিক নাগরিক পরিবেষ্টিত গোটা সমাজ — এ সবকিছুই দীপ্তর চোখ আর মনকে কেমন যেন ধাঁধিয়ে দিল।

  – বড়দা, ভাড়াটা …

কন্ডাক্টরের ডাকে সংবিৎ ফিরে পেয়ে, দীপ্ত ব্যাগ থেকে টাকা বার করে তাকে দিল। দীপ্ত দেখল, আগের তুলনায় বাসের গতি বেড়েছে এবং বাসে লোকজনও একটু বেশি, তবে বসে থাকা আগের মুখগুলোর বেশিরভাগই এখন আর নেই, বরং সেই জায়গায় নতুন মুখ। সে জানে, কলকাতার মধ্যেকার স্থানীয়রাই এই সময় ওঠা – নামা করে বেশি, দূরের যাত্রী কম থাকে। সায়েন্স – সিটি থেকেই ভিড়টা বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে একটি লোক এসে বসলো দীপ্তর পাশে। লোকটি দীপ্তকে বললো,

  – কদ্দূর যাবেন?

– লাস্ট, জীবনপুর।

– ও…

– আপনি?

– পার্ক সার্কাস।

  দীপ্তর মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইল বার করে সে দেখলো, মা’র ফোন। ফোনটা রিসিভ করতেই ও – প্রান্ত থেকে শোনা গেল,

  – কোথায় আছিস বাবু? কখন ফিরবি?

– মা, আমি বাসে আছি, এখন ছ’টা দশ তো… ঐ… আটটা – সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি ঢুকছি।

– কিছু খেয়ে নিয়েছিস তো?

– হ্যাঁ.. হ্যাঁ… খেয়েছি, তোমরা চিন্তা কোরো না, সময় মতোই আমি ঢুকছি বাড়ি। রাখছি তা’লে এখন।

  ফোনটা রেখে দীপ্ত আবার জানালার দিকে চোখ ঘোরালো। চলন্ত গাড়ি থেকে জীবনের হরেক ছবি — এ হলো দীপ্তর বরাবরের প্রিয় বিষয় আর এভাবেই সে খুঁজে পায় লেখালিখির জন্য বিভিন্নরকম ভাবনার খোরাক।

   দেখতে দেখতে বাস পার্ক সার্কাসে এসে থামলো। একসাথে বেশ কিছু লোক নেমে গেল, উঠলো অল্প কয়েকজন। যাত্রী তোলার জন্য বাসের হেল্পার ও কন্ডাক্টর বিভিন্ন কায়দায় হাঁক পাড়তে লাগলো। আবার চলতে শুরু করলো বাসটা। কিছুদূর গিয়ে আচমকা ব্রেক কষে গাড়িটা পুনরায় এগোতে থাকলো।

  দীপ্ত একটু নড়েচড়ে বসে এবার বাসের যাত্রীদের দিকে মুখ ঘোরালো, বিভিন্নরকম শীতের পোশাকে মানুষগুলো আপাদমস্তক মোড়া। তার চোখদুটো ঘুরতে-ঘুরতে বাসে ওঠার সামনের দরজাটার কাছে যেতেই, একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্যে অবাক হলো দীপ্ত। একটি দশ-এগারো বছরের ছেলে প্রত্যেক যাত্রীর কাছে গিয়ে হাত পেতে ভিক্ষা চাইছে আর অস্ফুট স্বরে  কী যেন বলছে! তার দেহ শীর্ণ, চুল উশকোখুশকো; পরনে ময়লা হাফ-প্যান্ট আর একটা ছেঁড়া-ফাটা ফুলহাতা জামা। দীপ্ত আপনা থেকেই নিজেকে বলে উঠলো – ‘এই প্রচণ্ড ঠান্ডায়…!!’ দীপ্তর চোখ ছেলেটাকে অনুসরণ করতে লাগলো আর অদ্ভুতভাবে দেখতে থাকলো ছেলেটার প্রতি বাসের অধিকাংশ যাত্রীর নির্বিকার অভিব্যক্তি; দীপ্তর মনে হলো, ঠাণ্ডার থেকেও ব্যক্তিস্বার্থের মগ্নতাই লোকগুলোর আড়ষ্টতার প্রধান কারণ। সামনের দিকে কয়েকজন স্যুটেড-বুটেড বাবু গোছের লোক ঘাড় গুঁজে স্মার্টফোনের কারিকুরিতে বুঁদ হয়ে আছেন, তাদের আঙুলগুলো মোবাইলের পর্দার উপর যেন খেলে বেড়াচ্ছে;  এক দম্পতি তাদের দশ-বারো বছরের মেয়েকে নিয়ে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, তাদের কথাবার্তা সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে, তারা স্নেহ- ভালোবাসা মেশা এক খুশির  বৃত্তে যেন অবস্থান করছে;  দু’জন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বেকারত্ব, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নানারকম সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে মৃদু তর্কবিতর্ক চালাচ্ছেন;  একজন মা তাঁর সন্তানকে রীতিমতো মোবাইল- গেমের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন;  আরেকটি লোক তো কানে ইয়ার-ফোন গুঁজে কোনো মশলাদার বাণিজ্যিক সিনেমায় গভীরভাবে মজে আছে — এইরকম নানাবিধ ‘কর্মব্যস্ততার’ মাঝে ছেলেটির কাতর দৃষ্টিপাত যেন কোনো এক ‘অবাঞ্ছিত উপদ্রব’। শুধুমাত্র একজন প্রৌঢ়া ও এক জোয়ান ভদ্রলোক, ছেলেটির নিরাশ রুক্ষতায় কিছুটা প্রাণসঞ্চার করল।

  দীপ্তর বিপরীত পাশের একটি সিট আগে এসে দাঁড়াতেই, ছেলেটিকে হাত ও মাথার একত্র ইশারায় দীপ্ত কাছে ডাকলো।ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ছেলেটি, তার শরীরে-মনে কুঞ্চিত ভাব। 

  – কী নাম তোর?

–  ……

– কিরে… কী নাম?

–  ……

– কোথায় থাকিস?

–  ……

– স্কুলে যাস না?

–  ……

– পড়াশুনো করিস না?

–  ……

– মা-বাবা কী করেন?

–  ……

  এপর্যন্ত দীপ্তর করা কোনো প্রশ্নের জবাব তো ছেলেটি দিলই না, উল্টে সে মাথা নিচু করে মনমরা হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। দীপ্ত বেশ বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললো, ‘ একটা কথাও বলছে না…!’ দীপ্তর মনের কথা শেষ হতে না হতেই, ছেলেটি হঠাৎই মাথা তুলে দীপ্তর দিকে তাকালো,

  – কিচু দাও না…! খুব খিদে পেইচে , সারাদিন খাইনি।

– ……

  স্তব্ধ হয়ে গেল দীপ্ত। এবার সে-ই কিছু বলতে পারলো না আর। মুহূর্তে স্তব্ধতার ঘোর কিছুটা কাটিয়ে দীপ্ত মানিব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে ছেলেটির হাতে দিল আর সাথেসাথেই কালো মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া ঝলমলে সূর্যরশ্মির মতো এক হাসির কণা ছেলেটির ঠোঁটের কোনায় রঙিন হয়ে উঠলো। ছেলেটির হাসি দীপ্তকে ক্ষণিক তৃপ্তি দিলেও কেমন যেন এক ছাইরঙা অস্বস্তি তার মনের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যকে ফ্যাকাশে করে দিলো।

  সায়েন্স-সিটি আসতেই বাসের মধ্যে একটা জনস্রোত আছড়ে পড়লো। ছেলেটি গুটিগুটি পায়ে গাড়ি থেকে নেমে বাইরের অনিশ্চিত আলো – আঁধারিতে মিশে গেল। ব্যস্ত কলরবের মাঝেও দীপ্তর কানে বাজতে লাগলো খিদের করুণ গোঙানি। কিছুক্ষণ থেমে বাসটি সেখান থেকে মফস্বলের রাস্তায় বাঁক নিয়ে এগোতে থাকলো; মনে হলো সেটি কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডল পিছনে ফেলে অজ্ঞাত ছায়াপথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।  

কলমে প্রসেনজিৎ মন্ডল, বসিরহাট

বসিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং টাকি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ। সংগীত – শিল্প – সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী।

SOURCEকলমে প্রসেনজিৎ মন্ডল
Previous articleউড়ান
Next articleস্বপ্ননীড়
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

  1. বেয়াব্রু পড়লাম।খুব ভাল লাগল।
    -সুব্রত মজুমদার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here