“সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে” – শব্দ বন্ধনীটা এই সময়ে অপ্রয়োজনীয়। মুচির ছেলে সে আর রাস্তায় বসে জুতো পালিশ করতে চায় না। তার অভিভাবকরাও চায় না,তাদের মতো অবহেলিত হোক। বারোয়ারি ব্যক্তিরা নিজেদের সুপ্ত বাসনা যেনতেন উপায়ে সন্তানেরা পূরণ করে তার জন্য সদা সচেষ্ট।
বিলোল শ্রীরামপুর জুটমিলে স্টোরকিপারের কাজ করে। বিলোলের সমস্ত ক্ষোভ তার পিতৃদেব নৈবেদ্য চরণ মিশ্রের উপর। বাবা স্থানীয় জুনিয়ার হাইস্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। অনেক খ্যাতি-প্রতিপত্তি ছিল। নৈবেদ্য কখনও কারও সঙ্গে অনায্য ব্যবহার বা বিচার করেননি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান হয়েও বিলোলের ক্ষোভ এইখানেই – একটু সচেষ্ট হলেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে পারতেন, বিনা বেতনেই। কত সরকারী প্রকল্প হল, সামান্য ইশারা করলেই ঠিকাদাররা বাড়িটার পাকা ছাদ করে দিত। কমিশনের টাকায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যেত। কোন কিছুই না করে উনি ‘সৎ’ প্রতীক হয়ে থাকলেন। ফল ভুগতে হচ্ছে বিলোলকে। এই চাকরিটাও বাবার এক ছাত্র ম্যানেজার হয়ে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার মতো, বাবার অজান্তে বিলোলকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিলোল দেখছে তার সমবয়সী বন্ধুরা খুঁটির জোড়ে ফুলে ফেঁপে উঠে গাড়ি-বাড়ি করেছে। ওদের তির্যক এবং অবঞ্জা দৃষ্টির থেকে রেহাই পায়না বিলোল।
বিলোল চায় তার ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করবে সমাজে। সে এবং তার স্ত্রী শান্তা কষ্ট করে নিজেদের সংসার খরচ কমিয়ে পুত্র পরিতোষকে নামজাদা স্কুলের খরচ চালাতে লাগল। বিলোল অচিরেই বুঝতে পারল এভাবে চলবে না। গুদামের সরবরাহ করা মালের হিসেব উল্টপাল্টা করার কাজ ঠিকাদারদের সাহায্যে উপরি আয়ের ব্যবস্থা করল। ছেলেকে – মানুষের মতো মানুষ করবেই।
পরিতোষকে ভাল কলেজে ভর্তি করে দেয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে রাজস্থানের কোটায় আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করে। পরিতোষ বিলোলের মুখ রক্ষা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ আমলা হয়েছে। বিলোল ও শান্তার জীবনযাত্রা অনেকদিল হল পালটে গেছে ওই দুনম্বরী পয়সার দৌলতে।
সেই ট্রাডিশনাল কিছু আপ্তবাক্য কিন্তু এখনও প্রাসঙ্গিক – ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড় ধরা’। সমাজ এখনও টিকে আছে ওই ট্রাডিশনাল বিশ্বাসে -“ধর্মের কল বাতাসে নড়ে”। কোথা থেকে কি যে হল কেউ বুঝতে পারল না।
ম্যানেজার, মালিকের ছেলে এবং পুলিশের লোকেরা, গুদামের মালপত্তরের হিসাব মেলাবে। পুকুর চুরি হয়েছে – ধরা পড়ে গেল বিলোল। জেল হবে। বিলোলের আশা ছেলে নামিদামি উকিল নিয়োগ করবে – যারা দিনকে রাত করে দিতে ওস্তাদ। পরিতোষ আসলো, এসে মেঘলা ভোরের মতো ম্লান হেসে বলল – আমি কখনও বলিনি আমাকে চুরি করা টাকায় প্রতিপালন করতে হবে। যে চোর, চুরি করেছে সেই ফল ভোগ করবে।
কলমে : তপন তরফদার, প্রেমবাজার (আই আই টি), খড়গপুর।