বকুল ফুল

0
361

       “ ফুল নেবে গো বকুল ফুল !”

      “ বকুল ফুল !”

     “ হু বকুল ফুল । তুমি তো আমাকে ডেকেই চলেছ মা  বকুল ফুল  বকুল ফুল বলে তাই  ত আমি না এসে থাকতে পারলাম না । দেখ তোমার জন্য আমি কত ফুল নিয়ে এসেছি ।“ 

      “ এইটা বকুল ফুল মা বলেছে তুমি এনেছ  আমাকে দেও ।‘’

      “ দেব তো  মা তোমার জন্যই ত নিয়ে এলাম । “

      “ দাও আমাকে !”

       “ এই নাও । তোমার জন্য নিয়ে এনেছি  তোমার যা ইচ্ছে কর !  “

      আঁখি  ফুলগুলো  নিয়ে ওর বিছানায় ,ঘরে  ছড়াতে  থাকে । ওর থাকার  ঘরটা বেশ বড় , সামনে  বড় বারান্দা রয়েছে । বারান্দার লাগোয়া   একটা বকুল ফুলের গাছ বারান্দায় এসে পড়ে বকুল ফুল আঁখি সকাল থেকেই ওসব কুঁড়াতে থাকে ওর  একটা ব্যাগ রয়েছে ওটাতে ভরে । রাখী খুশী হয়ে বলে ,”  ওমা আঁখি কত বকুল ফুল কুড়িয়েছিস মা । ভালো হয়েছে এই বাড়ীতে এসে বড় ঘর, বারান্দা সামনে কত বকুল ফুলের গাছ তাতে পাখী এসে বসবে তুই তাদের সঙ্গে কথা বলবি , ফড়িং , রঙ্গিন  প্রজাপতি কত কিছু  আসবে । এদের সঙ্গে জোরে  জোরে কথা বললেও কেউ বিরক্ত হবে না । এমন একটা খোলা মেলা জায়গাই তো চেয়েছিলাম তোকে নিয়ে থাকার জন্য । তুই বকুল ফুল আর পাখীদের নিয়ে থাক আমিও নিশ্চিন্তে নিজের কাজটা শুরু করতে পারব ।“

  “ কি কাজ ?”

   “ ওসব তুই বুঝবি না !” 

   রাখী কয়েকবার বকুল ফুল , বকুল ফুল বলায় আঁখি এরপর সারাক্ষণ জপতে থাকে বকুল ফুল ,বকুল ফুল , বকুল ফুল !   

       শেষ পর্যন্ত বারুইপুরে   একটা নিরিবিলি বাড়ি খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রামেন্দু আর রাখী । নিরিবিলি হলেও বাড়ীটা কোন নির্জন জায়গায় নয় বারুইপুর শহরের কাছেই  বড় রাস্তার পাশে  বেশ বড় একটা বাড়ি । আশেপাশে আরও বাড়ি  রয়েছে । চারপাশটা জমজমাট জনবহুল  এলাকা শুধু বাড়িটা খালি পড়ে ছিল ।   

      বাড়ীটার নাম বকুলতলা ।  বাড়িতে  বেশ কয়েকটা বড় বড়  ঘর রয়েছে যদিও ঘরগুলো পুরানো আমলের অনেকটা জমিদার বাড়ীর আদলে তৈরি । বাড়ীর পিছন দিকে বেশ বড় বাগান ওখানে নানা রকম ফুল ফলের সঙ্গে  বকুল ফুলের বেশ কয়েকটা গাছ রয়েছে খুব সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এটা থেকেই হয়ত কোন ফুলের  শৌখিন মানুষ বাড়িটার নাম  রেখেছিলেন বকুলতলা । তবে নামকরণের সঠিক কারণ কেউ জানে না । 

      বকুলতলা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা । আগে একজন কেয়ারটেকার থাকত কিন্তু বছর খানেক হল সে মারা গেছে । এরপর আরেকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে কিন্তু সে এখানে থাকে না বস্তিতে  থাকে । সপ্তাহে একদিন এসে  ঘরদোর , বাগান বাড়ির চারপাশ  পরিষ্কার করে যায় সেই কারণে বকুলতলা সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে । 

     রামেন্দু , রাখির সেনগুপ্তের  সমস্যা  ওদের চোদ্দ বছরের মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে আঁখিকে নিয়ে । রামেন্দুর পুলিশের চাকরী কিছুদিন পর পর বদলী হয় কিন্তু আগে যেখানে যেখানে থেকেছে  বেশীর ভাগ মফস্বল ছিল ওসব জায়গায়  কোয়াটার থাকত না কোথাও ভাড়া থাকতে হত । কিন্তু আঁখির কারণে ঘন ঘন বাড়ি বদল করতে হয়েছে । 

      চোদ্দ বছরের আঁখি একজন মানসিক প্রতিবন্ধী । দেখতে খুব সুন্দর মুখটা একেবারে মূর্তির মতো । চোখ দুটো ভাসা ভাসা , গায়ের রং টুকটুকে ফর্সা , চুল  কোমর অবধি আঁখি চুল কাটতে চায় না ।   বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা চওড়া ওকে দেখলে ষোল সতেরো বছরের মনে হয় । কিন্ত যে মেয়ের শরীরে কোন খুঁত  নেই সেই মেয়েটার খুঁত রয়েছে মনে,  মাথায় । আঁখির জমজ আরেকটা ভাই রয়েছে অঙ্কন । সে পুরোপুরি সুস্থ ক্লাস এইটে  পড়ছে কলকাতায় মামার বাড়িতে থাকে ।   

    জন্মের প্রায়  তিনবছর মতো বুঝা যায়নি আঁখির সমস্যার কথা । ভাইবোন দুজনে বড় হচ্ছিল একসঙ্গে অঙ্কন ছোট থেকেই  যতটা শান্ত আঁখি ছিল ততটা দুরন্ত । যতক্ষণ জেগে থাকত ছুটে বেড়াত আর জিনিষপ্ত্র ছুঁড়ে ফেলত আর ভাঙ্গত । অঙ্কন কথা বলত পরিষ্কার কিন্তু আঁখি গুছিয়ে কথা বলতে পারত না । মানে আড়াই তিন বছর বয়সে আঁখি কথা বলেছে কিন্তু তখনও বেশী কথা বলত না দু চারটে শব্দ ছাড়া । মা ভাত ,বাবা চকলেট ,দুজ্ঞা দুজ্ঞা  ,দাদু বিকুট দে , ঠাম  জল এরকম  টুকরো টুকরো কথা বলত ।  ওর মতের বাইরে কিছু করলেই খুব রেগে যেত । অঙ্কন তখন স্পষ্ট কথা বলে  মুখে মুখে পড়াশোনাও শুরু করে দিয়েছে । অল্প অল্প  লিখতেও পারে । কিন্তু আঁখির ওসবের নাম গন্ধ নেই। তবে  বইপত্র ওর চাই শুধু ছবির বই  আর দেখার পর  সেটা  ছিঁড়ে ফেলে দেবে । কথা মোটামুটি বলতে শুরু করেছে চার সাড়ে চার বয়সে কিন্তু স্পষ্ট নয় অনেকটা অগুছালো । আস্তে আস্তে  অস্বাভাবিকতা  ধরা পড়তে থাকে । বাচ্চাদের নিয়ে প্রথম প্রথম রাখী  কৃষ্ণনগরে শ্বশুর বাড়ীতে থাকত দুটো জমজ বাচ্চাকে সামলানো কি সাধারণ ব্যাপার !

     দুটো বাচ্চা জমজ দেখতে প্রায় এক রকম কিন্তু স্বভাব চরিত্র একেবারে আলাদা । আঁখির  সমস্যা প্রথম প্রথম কেউ বুঝেনি সবাই ওকে বেয়াদব ভাবত । বাবা বাড়ীতে থাকে না  লোকজন রাখীকে বলত ,  “তুমি কেমন মা গো ছেলেটাকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিচ্ছ আর মেয়েটার দিকে একেবারে নজর দিচ্ছ না । শেষে ওই মেয়েকে  নিয়ে কি করবে । বাবা বাড়ীতে নেই সবাই তো তোমাকেই  দোষ দেবে ।“ 

   “ কি করব বলুন মেয়েটা তো কারোর কথা শুনে না । ভালো করে কথাও বলে না ।“

  “ ওকে ডাক্তার কবিরাজ দেখাও বাপু মনে হচ্ছে তোমার মেয়ের অন্য সমস্যা আছে ।“

     রাখী একান্নবর্তী পরিবারে থাকত ওর বর সঙ্গে নেই পরিবারের লোকজন শুধু রাখীকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করত না । তবে আশেপাশের লোকজন আর শ্বশুর শাশুড়ির কথায় পাঁচ  বছর বয়সে  ঝাড় ফোঁক ,কবচ তাবিজ  দিয়ে  শুরু হয় আঁখির চিকিৎসা । কোন লাভ হয়নি ওর পাগলামি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে দিন দিন ওর অগুছালো  কথা আর খুব জোরে জোরে কথা বলত এসব বেড়েই চলেছে । এরপর রামেন্দু  ওর এক  বন্ধুর পরামর্শে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় ওখানে ধরা পড়ে চারমাস বয়সের সময় আঁখি বিছানা থেকে পড়ে গেছিল তখন ওর ব্রেনে খুব চোট পায় সঙ্গে সঙ্গে ভালো চিকিৎসা হলে হয়তো  ঠিক হত কিন্তু কেউ তা খেয়াল করেনি ,  এখন  হয়ত কিছুটা ঠিক হলেও হতে পারে আবার নাও হতে পারে ।

     খবরটা শুনে  রামেন্দু  , রাখী দুজনেই খুব ভেঙ্গে পড়ে । এর  মধ্যে কিছুদিনের ব্যবধানে রামেন্দুর  বাবা , মা দুজনেই চলে গেলেন । ভাইদের সঙ্গে  রামেন্দু  আর স্ত্রী ছেলে মেয়েকে রাখতে চাইল না । নিজের  সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু রাখী ভয় পাচ্ছিল দুটো বাচ্চাকে নিয়ে কি করবে সে তার উপর আঁখি মানসিক প্রতিবন্ধী । শেষে  রাখীর বাবা ,মা অঙ্কনকে ওদের কাছে নিয়ে গেলেন আর আঁখিকে নিয়ে বেশ কষ্টেই চলছে তাদের জীবন । ওর চিৎকার , জোরে জোরে কথা বলা ভাঙ্গচুরের জন্য বেশীদিন  এক থাকতে  জায়গায় পারে না  ঘন ঘন বাসা বদলাতে হয় । লেখাপড়া করতে পারে না তবে মনে রাখতে পারে অনেক পুরানো কথা , মানুষকেও । দেখে দেখে অনেক কিছু বলতে পারে লেখাপড়া না জানলেও টিঁভি দেখে , ছবি দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারে । মাঝে  মাঝে আবার বেশ গুছিয়ে কথা বলে আবার একটু পরেই শুরু হয়ে যায় অগুছালো  কথা আর জেদ । কয়েকবার  ব্যাঙ্গালুরে গেছে ওকে নিয়ে ওরাও পরীক্ষা করে এক কথা বলেছে । ঔষধ চলছে সামান্য পরিবর্তন হলেও আঁখি কোনদিন পুরোপুরি সুস্থ হবে না এটা জানিয়ে দিয়েছেন ডাক্তাররা !  

দুই 

      এরপর মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়  রামেন্দু , রাখীর আরেক জীবন । মেয়েটাকে নিয়ে খুব চিন্তা দুজনের । বারুইপুরে প্রমোশন হয়ে এসেছে পুলিশ কোয়াটার  রয়েছে তার জন্য কিন্তু আঁখিকে নিয়ে ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকতে তাদের কষ্ট হবে তাই দুজনে একটু নিরিবিলি  জায়গা খুঁজছিল রামেন্দু   । শেষে ওর কলিগ  রামানুজ বাড়িটার সন্ধান দেয় । বাড়িটা রামানুজের কাকা রজতাভ  লাহিড়ীর বাড়ি । রজতাভ বাবু অনেকদিন হল মারা গেছেন । উনার দুই ছেলে মাকে নিয়ে আমেরিকায় থাকে । দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার । তারা চারবছর পর পর আসে কিন্তু পূর্ব পুরুষের তৈরি করা বাড়ি তারা বেচতে চান না  । রজতাভ বাবুর দাদু নাকি বাড়িটা তৈরি করেছিলেন । বাড়িটা দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার রাখা ছিল সে মারা যারার পর একজন ঠিকে লোক রয়েছে সেই বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে । এতদিন কেউ এই বাড়ীতে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেনি কিন্তু রামেন্দুর  সমস্যা শোনার পর রামানুজ  নিজেই প্রস্তাব দিল এই বাড়ীতে থাকার । কাকাতো ভাইদের সঙ্গে  কথা বলায় তারা খুশী মনেই একজন পুলিশ অফিসারকে বাড়ীতে থাকার অনুমতি দেয় ।

    রাখী এই বাড়ীতে সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে সংসার । কিছুটা  অংশ দোতলা ওখানে একটা বড় ঘর , সামনে একটা বড় বারান্দা , পিছনে বাগান ওই ঘরেই আঁখিকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ছে । ডাক্তার আঁখিকে নিয়ে খোলামেলা জায়গায় থাকতে বলে দিয়েছে আগে ঘরে বন্ধ করে রাখত এখন আর ওসব করতে হয় না । আঁখি নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ায় ওখানে । আর এই বাড়ীতে আসায় রাখীও তার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছে । নীচতলায় তার স্বপ্নের বুটিক  খুলেছে বেশ কজন এসে যোগ দিয়েছে তার বুটিকে । এই বাড়ীতে আসায় রামেন্দু  একটু চিন্তা মুক্ত হয়েছে । বুটিকের নাম রেখেছে  ‘ আঁখি বুটিক’। 

    আঁখি ফুলগুলো ছড়িয়ে ফেলছে দেখে বকুল ফুল বলল ,” ছড়িয়ে ফেলছিস কেন মা দে আমি  সুন্দর করে সাজিয়ে দিই বকুল ফুল দিয়ে।“   

      আঁখি এতক্ষণ বকুল ফুলকে খেয়াল করেনি । সে তো এমনই আপন  খেয়ালে চলে । দেখল অপূর্ব সুন্দর এক নারী বকুল ফুল খুব সুন্দর  শাড়ি পড়ে রয়েছে আটপৌড়ে করে  , কোমর অবধি চুল , কাঁচা হ্লুদের মতো  গায়ের রং  । শরীরে বেশ গয়না রয়েছে কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা , সিঁথিতে সিঁদুর , হাতে শাখাও রয়েছে ।  আঁখি মানসিক প্রতিবন্ধি হলেও সুন্দর ব্যাপারটা বেশ বুঝে । আর এতদিন ধরে ব্যাঙ্গালুরের  ডাক্তারের ঔষধ খাচ্ছে জোরে জোরে কথা এলোমেলো কথা বললেও মাঝে মাঝে বেশ সুন্দর করে কথাও বলে। রাখি  ঘরে  ম্যাগাজিন আনে পড়ার জন্য তার সব কটা ম্যাগাজিন দেখা চাই আর দেখবে সুন্দরী মেয়েদের শাড়ি , গয়নার বিঞ্জাপন । রাখি এসব দেখে বলে ‘  যদি সুস্থ থাকতিস রে মা তাহলে তুইও ওদের মতো সাজগোজ করতে পারতি । কিন্তু কি আর করা যাবে তোর ,আমাদের সবার কপাল মন্দ ।  এবার বকুল ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল , “ সুন্দর ছবির মতো !“ 

    “ আমি সুন্দর ছবির মতো তুমিও খুব সুন্দর মা । তোর বয়সে আমি তোর মতো দেখতে ছিলাম । আমি তোর চুলে ফুল লাগিয়ে দিই ।“ 

    “ দেও !” 

    বকুল ফুল আঁখির পাশে গিয়ে বসল । ওর খোলা চুলে সুন্দর করে লাগাতে থাকে ফুলগুলো । ঘরের ভিতরে বড় একটা আয়না আঁখি সেদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে আর বকুল ফুলকে । এভাবে ওকে কেউ কক্ষনো সাজিয়ে দেয়নি । চারপাশটা গন্ধে ভরে গেছে বকুল ফুল  সাজাতে সাজাতে বলল ,”  তুই আমার চুলে ফুল লাগিয়ে  দিবি মা! আমি তোকে তুই করে বলি কিছু মনে করিস না !”

   আঁখি মুখে কিছু বলল না কি বুঝল কে জানে উঠল কিছু বকুল ফুল দুহাতে  জড়ো করে এনে বকুল ফুলের মাথায়  ঢেলে দিল । বকুল ফুল হেসে বলল ,” এই তো আমার মা কি সুন্দর করে সাজাতে পারে । তুই আমাকে যেভাবে ডাকলি ‘ বকুল ফুল ‘ ‘বকুল  ফুল ‘ বলে আমি তো আর না এসে থাকতে পারলাম না । আর এসে যখন পড়েছি তোকে আমি ভালো করে তুলব । আমার মেয়েটা জন্মালে  এতদিনে হয়ত বুড়ো হয়ে যেত । তারও নাতি পুতি হয়ে যেত । “ 

    আঁখি  এক দৃষ্টিতে  তাকিয়ে শুনছিল বকুল ফুলের কথা । বকুল ফুল বলল ,” এখন আমি আসি মা তোর মা তোর  জন্য খাবার নিয়ে আসবে তুই  খেয়ে নিস দুষ্টুমি করবি  না আমি পরে আবার আসব । “

     জুন  মাসের দুপুরবেলা রোদের তেজ প্রখর তবে একটা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে ।  বকুল ফুল আস্তে আস্তে বাগানের দিকে চলে যায় । আঁখি তাকিয়ে থাকে সেদিকে ।   

    বকুল ফুল আসলে কে সে কি কোন রক্ত মাংসের মানুষ নাকি অন্য কিছু ! মানসিক প্রতিবন্ধী আঁখি তা কি করে বুঝবে !

     তখন ভারত পরাধীন ছিল  রজতাভ বাবুর বাবা ছিলেন প্রফেসার  অমিতাভ লাহিড়ী । কলকাতার কলেজে পড়ার সময় তিনি প্রেমে পড়েন  তাদের কলেজের প্রফেসার নিলাদ্রি সেনের কন্যা বকুল্প্রিয়া সেনের । অসাধারণ সুন্দরী বকুল তাদের কলেজেই পড়ত  অমিতাভ বাবুর জুনিয়র ছিল বকুল । ভালোবাসত  লিটারেচার  অমিতাভ বাবুর ছিল ইংরেজিতে অনার্স আর বকুলের ছিল বাংলায় । নিলাদ্রি বাবু ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন উনার সাথে পড়তে যেতেন অমিতাভ বাবু এভাবেই  বকুলের সঙ্গে আলাপ পরে বকুল কলেজে পড়তে আসে । আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব তারপর তা ভালোবাসায় পরিণত হয় ।  নিলাদ্রি বাবুর পরিবার মুক্ত মনের ছিলেন ওদের মেলামেশায়  তেমন কোন বাধা ছিল না । বেশ কয়েকবছর দুজনের ভালোবাসা চলে  অমিতাভ বাবু ইংরেজির অধ্যাপক হন এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়েটা হয় । বকুল তখনকার সময় বি,এ  পাশ ছিল ভালো ভালো চাকরির অফার আসে তার কাছে কিন্তু অমিতাভ বাবুর বাবা চাইতেন না তার বউমা চাকরি করুক তাই বকুল চাকরি করতে পারেনি । বকুলের কবিতা লেখার শখ ছিল তাই শুরু হয় তবে বাড়ীতে বসে যাতে বকুল যাতে লেখাপড়া করতে পারে সেজন্য ছোট একটা লাইব্রেরী বাড়ীতে তৈরি করেছিলেন অমিতাভ বাবু । 

    বারুইপুর কলেজে  পোস্টিং হয় অমিতাভ বাবুর বেশ ভালোই চলছিল দুজনের জীবন । তবে পরপর দুবার বাচ্চা নষ্ট হয়েছে বকুলের ওর শরীর প্রায় অসুস্থ থাকত তবে তার চিকিৎসা যত্নের কোন ত্রুটি করতেন না অমিতাভ বাবু । কিন্তু  হয়তো তাদের সংসারে কারো কোপ পড়েছিল । আস্তে আস্তে বকুলের শরীরে বাসা বাঁধে ভয়ানক রোগ সেটা হল কুষ্ঠ । ওর পায়ে হাতে শরীরে পচন ধরে । অমিতাভ বাবুর পরিবার  ক্ষেপে উঠেন বকুলকে কিছুতেই বাড়ীতে রাখা যাবে না । নিতান্ত অনিচ্ছা স্বত্বেও অমিতাভ বাবু বকুলকে পাঠান মিশনারি হাসপাতালে তখন নিলাদ্রি বাবু বেঁচে নেই । কিন্তু স্ত্রীকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছিল অমিতাভ বাবুর । তাই কিছুদিন চিকিৎসার পর সবার কথা অমান্য করে বকুলকে বাড়িতে নিয়ে আসেন বকুল তখন অন্তস্বত্বা  ছিল । কিন্তু ঘরে ঠাই হল না বকুলের বাগানে একটা ঘর বানিয়ে ওখানে বকুলকে রাখেন । বকুলের জন্য খাবার ঔষধ তিনি নিয়ে যেতেন । কিন্তু বকুল বেশীদিন বাঁচেনি  একসময়ের প্রাণোচ্ছল মেয়েটা  একা থাকতে থাকতে শারীরিক ও মানসিক কষ্টে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় । বাচ্চাটাও মারা যায় । বকুলকে অমিতাভ বাবু ‘ বকুল ফুল ‘  বলে ডাকতেন ।  তার প্রেয়সী বকুল ফুলের স্মৃতিতে তিনি বাগানে  বেশ কয়েকটা বকুল ফুলের গাছ লাগান আর  বাড়ীটা যখন উনার নামে আসে তখন বাড়ীটার নাম রাখেন বকুলতলা । তিনি পরে আবার অবশ্য বিয়ে করেন পরিবারের চাপে ।  তাদের ছেলেই রজতাভ বাবু । বকুলের আত্মা এত বছর ধরে বাগানে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কেউ তাকে অনুভব করেনি একা একা ঘুরে বেড়ায় বকুলের আত্মা। কখনও কারো ক্ষতি করেনি ।   তাকে ‘বকুল ফুল’  বলে অমিতাভ বাবুও কক্ষনো ডাকেননি । কিন্তু আজ যখন আঁখি ‘ বকুল ফুল ‘’ বকুল ফুল ‘ বলে ডাকছিল এত বছর কেউ বকুলকে ডাকছে তাই ছুটে আসে বকুল ফুল । রাখী মেয়েকে যখন  খাওয়াতে আসে দেখে আঁখির সারা শরীরে বকুল ফুলের গন্ধ পুরো ঘরময়  বকুল ফুল । ওর ভালো লাগে  বলে ,“যাক এতদিনে মেয়েটা খেলার জন্য ভালো কিছু পেয়েছে । বকুল ফুলের গন্ধে ওর শরীর মন দুটোই ভালো থাকবে ! “ 

তিন 

    আঁখিকে সারা দুপুর এদিকে একা থাকতে হয় রাখীর এতদিনের স্বপ্নের বুটিক বেশ জমে উঠেছে । অনেকেই আসছে তার বুটিকে আস্তে আস্তে বাইরেও যাচ্ছে তার বুটিকের  তৈরি জিনিষপ্ত্র । রামেন্দু  নিজের দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে  সংসারের দিকে তাকানোর সময় পায় না । 

      আঁখি এই জায়গাতে এসে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছে এখানে ওকে বকাঝকা করার কেউ নেই  দোষ ধরার কেউ নেউ । তার উপর বকুল ফুলের মতো একজন বন্ধু জুটেছে তার ।

    আঁখি যখন  ‘ বকুল ফুল ‘  বলে ডাকে  বকুল ফুল এসে হাজির হয় । দুজনে পাশাপাশি বসে ,”  আয় মা  তোকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিই ।“

   “ সাজব আমি !”

   “ হু সাজবি তো আমার  মা দেখতে কত সুন্দর একেবারে রাজকুমারীর মতো এমন মেয়েকে এলোমেলো সাজে কি মানায় !”

    বকুল ফুল সুন্দর করে সাজাতে থাকে আঁখিকে । কোন আধুনিক প্রসাধন দিয়ে সাজাচ্ছে না শুধু ফুল দিয়ে ওর চুল সাজিয়ে দেয় , কপালে ছোট টিপ পরিয়ে দেয় । আঁখিকে এভাবে কেউ কক্ষনো সাজিয়ে দেয়নি ওর উশৃঙ্খলতা সামলাতে সামলাতে সব সময়  চলে যেত  রাখীর । কিন্তু এখন কি শান্ত হয়ে বসে রয়েছে । ওকে সাজাতে সাজাতে বকুল ফুল বলে ,” আঁখি মা তুই এত বড় হলি  লেখাপড়া  শিখলি না করবি লেখাপড়া আমার কাছে ! “

    আঁখি ওর দিকে তাকিয়ে বলল ,” আমি লেখাপড়া করব বকুল ফুল ।“

   বকুল ফুল বলে ,” আমি তোকে লেখাপড়া শিখাব মা । জানিস একসময় আমার ইচ্ছে ছিল স্কুলের দিদিমণি হব । কিন্তু শ্বশুর মশাই হতে দিলেন না । এখন যখন তোর মতো একজন ছাত্রী  পেয়েছি তাহলে তোর দিদিমণি হলাম ।“

   “ বকুল ফুল দিদিমণি !”

   “ হু বকুল ফুল দিদিমণি ।“

      আঁখির ঘরে ছবির বই ছাড়া আর কিছু নেই । তবে ঘরের একটা আলমারিতে কিছু পুরানো খাতা রাখা ছিল । বকুল ফুল সেগুলো বের করে আনে । নিজের হাতে ধরে আঁখিকে হাতে খড়ি দেয় । বাঃ বেশ সুন্দর করে লিখতে শিখে গেছে আঁখি । বকুল ফুল প্রতিদিন ওকে কিছু পড়া শিখিয়ে দিয়ে বলে ,” আঁখি মা আজ ওগুলো শিখিয়ে দিয়ে গেলাম তুমি ভালো করে লিখে রাখবে । “ 

   “ আচ্ছা বকুল ফুল ।“

      আঁখি বকুল ফুলের শেখানো লেখাগুলো লিখতে থাকে রাখী নিজের কাজে  এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সারাদিন মেয়ের খোঁজ  নেওয়ার সময় পায় না । এই বাড়ীতে এসে সে নিশ্চিন্ত আঁখি নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াতে পারবে  যাই করুক না কেন তাকে নিয়ে কেউ  কমপ্লেন করবে না । 

   কিন্তু সবার অজান্তেই বকুল ফুলের সঙ্গে গড়ে উঠেছে আঁখির আরেক জগত । সারাটা  দুপুর দুজনে এক সঙ্গে কাটায় বকুল ফুল মন দিয়ে পড়াতে থাকে আঁখিকে  নিজের হাত দিয়ে ধরে ধরে ওকে অক্ষর , সংখ্যা শিখায় ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে পড়তে শেখায় । বর্ণ পরিচয় বকুল ফুল নিয়ে এসেছে ,” এই দেখ আঁখি মা এটা অ এটা আ এটা A এটা  B ,” আঁখি বকুল ফুলের কাছে শিখতে থাকে লেখাপড়া ধীরে ধীরে আঁখি স্বাভাবিক হচ্ছে । বকুল ফুল যখন ওকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় আঁখি বলে,

“ বকুল ফুল তুমিও তো খুব সুন্দর আমি তোমাকে সাজিয়ে দেব !”

 “ সাজিয়ে দিবি মা দে জানিস আমারও না সাজতে খুব ভালো লাগত কিন্তু এমন অবস্থা হল পুরো রূপটাই চলে গেল । “ 

   “ কেন তোমার  রূপ চলে গেল তুমি তো কত সুন্দর ! “

   “ ওসব জেনে তোর কাজ নেই মা তুই দে তো আমাকে সাজিয়ে । সুন্দর করে খোঁপা করে দিস । এই দেখ আমি তোকে সুন্দর করে খোপা বাঁধা শিখিয়ে দিচ্ছি । “

     বকুল ফুল আঁখির মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন এনে দিয়েছে । আঁখি পড়তে ,লিখতে শিখে গেছে ,নিজের কাজ নিজে করতে পারছে অনেকটা , কথাবার্তা  প্রায়  স্বাভাবিক বলছে । বেশ কিছুদিন চলে গেছে রাখী যতটুকু সময় মেয়েকে দেখে তখন তার মনে হয় মেয়ের মধ্যে অনেকটা   পরিবর্তন এসেছে । কিন্তু বিষয়টা কিছুটা  পরিষ্কার হল একদিন দুপুরে রামেন্দু  একটা কাজে বাড়ি আসে । ভাবল মেয়েটা কি করছে একবার দেখে যাই । আঁখির ঘরে এল  দেখল আঁখি স্নান করে সুন্দর করে বসে লিখছে  ।  বকুল ফুল ওর পাশে বসে আছে কিন্তু রামেন্দু  ওকে দেখতে পারছে না । আঁখিকে লিখতে দেখে অবাক হয়ে রামেন্দু  বলল ,

“ মা তুই লিখছিস কে শেখাল তোকে লেখা !” 

 “ বকুল ফুল !”

 “ বকুল ফুল কে ? “ 

     বকুল ফুল ইশারায় কিছু বলতে না করল । আঁখি বলল,” বাবা আমি অক্ষর সংখ্যা  লিখতে শিখে গেছি তুমি আমার জন্য কিছু বই এনে দিও তো ! “

   মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে যাকে এত বছর ধরে সুস্থ  করতে পারেনি তার মুখে এমন কথা শুনে বাক্রুদ্ধ হয়ে যায়  রামেন্দু  । ছুটে যায় রাখীকে টানতে টানতে নিয়ে আসে । “ দেখ দেখ আঁখি কি চমৎকার হয়েছে আঁখি মা নিজে নিজে স্নান করে বসে লেখাপড়া করছে ।“

   রাখীর চোখে জল এসে পড়ে । “ আমিও বুঝেছিলাম জান এই বাড়ীতে এসে আঁখির অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এতটা হবে আশা করিনি।“

   “ সব এই বাড়ীর গুন বল ।“

   “ একদম ডাক্তার ওকে খোলামেলা জায়গায় রাখতে বলেছিল । ভাবছি ওর জন্য একজন টিউটর রেখে দেব ।“

  “ না আমি বকুল ফুল দিদিমণির কাছে পড়ব !”

  “ কে বকুল ফুল ?”

  “ আছে কেউ তুমি চিনবে না বাবা !”

   “ ঠিক আছে ওকে ওর মতো থাকতে দাও কিছুদিন যাক তারপর দেখা যাবে । “

   “ হু সেটাই ঠিক হবে ।“

   রামেন্দু অনেক ধরণের বই এনে দেয় আঁখিকে সবাইকে বলে ওর মেয়ে অনেকটা ভালো হয়ে গেছে । আর পুরো দুপুরে বকুল ফুল আর আঁখির পড়াশোনা গল্প গুজব চলতে থাকে । দুজনের সম্পর্ক মা মেয়ের মতো !  বছর খানেকের মধ্যে আঁখি পুরোপুরি সুস্থ লেখাপড়ায় অনেকটা এগিয়ে গেছে । বকুল ফুল ওকে নিয়ে এখন তার লাইব্রেরীতে বসে । কত  ধরনের বই পড়ছে আঁখি ! 

   মেয়ের সুস্থতায় রামেন্দু ,রাখীর আনন্দের শেষ নেই । কিন্তু বকুল ফুল রহস্য তাদের কাছে চিরকাল অনাবৃত রহস্যই থেকে গেল ! 

কলমে সংঘমিত্রা রায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here