অঙ্কন: শ্রেয়াঙ্কা পাল
“উফ একটু পড়তে বসল কি,না বসল অমনি মা,মাগো কি খিদে পেয়েছে বলে চিৎকার আর সাড়া না পেলেই সোজা রান্না ঘর।”এভাবে দৌড়ে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরা ছেলে সুবলের নিত্য কাজ ।”আচ্ছা লোভী ছেলে তো তুই সুবল, রান্না শেষ হলে তো তোকে ডাকবো নাকি, এখন তো ছাড় আমায়”- প্রশয়ের ছলে সবিতা।
পাঁচ পাঁচটা মেয়ের হওয়ায় সংসারে কতই না মন কষাকষি, খটামটি শুরু।অবশেষে এই ছেলের জন্ম যেন ভগবান মুখ তুলে চেয়েছিল সবিতার জীবনে।ছোট মেয়ে ও ছোট ছেলের মধ্যে বযসেরও প্রায় সাড়ে আট বছরের ফারাক। বলা যায় এত গুলো বছর পর সুবল এসে যেন বাড়ির মধ্যে একটা হাসিখুশির হিন্দোল এনেছে। স্কুলে ভর্তি হতে যখন গেলো ভাগ্নারা কেউ ফাইব কেউ সেভেন।তাতে কি! পুঁচকে মামা বলে কথা সকলের নয়নের মনি।ছোট দিদির বিয়ে হয়ে গেলে মা বাবা আর ক্লাস সিক্সে পড়া সুবল কে নিয়ে ছোট সংসার ভালোই কাটছিল।”মা, চিন্তা করোনা আমি পড়াশোনা করে মস্ত বড় হবো দেখো”-সুবলের আশ্বাস বাণী মনের ঘরে সুখ বুনলে কি হবে এত কি সুখ সয় সবিতার! সুখী সংসারের আকাশে কালো মেঘ তুমুল বর্ষণে ছন্ন ছাড়া করে তুললো যেন, অকালে মাতৃহারা হলো সুবল।
সবিতার তিলে তিলে গড়া সংসারে হঠাৎ যে মরক লাগবে কে বুঝেছিলো! উঠোন জুড়ে মায়ের হাতে লাগানো কতো গাছ, স্মৃতি তাজা করে বাঁচিয়ে রাখতো সুবল ও তার বাবা।মন দিয়ে পড়াশোনা করে মায়ের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার আর মা যেন গাছের আড়ালে মিষ্টি ফলের সুঘ্রাণে সুবলকে পাহারা দিতো।মায়ের নিজের হাতে লাগানো ওই কলতলার দিকের গাছটায় অজস্র মুকুল এসেছে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সুবলের ওখানে যাওয়া চাই, যেন গাছ নয় ওটাই মায়ের পরশ। মা বলতো,”সুবল গাছ লাগাস বাবা গাছই মানুষের একমাত্র পরম বন্ধু।” বছর বছর এই আমগাছটায় যখন পাকা পাকা আম ধরতো সুবলের চোখে জল আসতো। কষ্টের নয় যেন এ আনন্দাশ্রু, মা ডালি সাজিয়ে পাঠিয়েছে আম তার কোলের সন্তানের জন্য।বাবা সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকতো আর সুবল উঠোন জুড়ে মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে।
দুদিন ধরে রেডিও-টিভিতে সতর্কতা কি যেন ঝড় আছড়ে পড়বে।গতবছর এমনই এক ঝড়ের তীব্রতা টের পেয়েছিল সুবলরা।সকাল থেকে সুবলের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে সব গাছের গোড়াগুলোতে ভাল করে মাটি দিয়ে পোক্ত করা যেন ঝড় ঝাপ্টা টলাতে না পারে তার প্রিয় গাছেদের। সারারাত ঝড়ের দাপটে অশনি সংকেত দেখছে গ্রামের মানুষজন। ১৪০কিমি বেগে বয়ে যাওয়া ঝড় ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে এ তল্লাটের বিদ্যুতের খুঁটি ,বড় বড় গাছ । উঠোনজুড়ে একের পর এক ভেঙে পড়েছে সুবলের প্রাণের গাছ।ইস একি হতশ্রী দশা হয়েছে তার প্রিয় আম গাছের-চোখ দিয়ে হড়হড় করে জল নেমে এলো সুবলের। গোড়া থেকে শিকড় শুদ্ধু উপড়ে যাওয়া মায়ের স্মৃতি চিন্হ মাখা আম গাছের ভগ্ন দশায় যেন লুকিয়ে তার পাঁজর ভাঙ্গার কষ্ট ।
রাতে মায়ের স্বপ্ন এলো,বোকা ছেলে কাঁদতে নেই তুই তো খুব সুন্দর হাতের কাজ করতিস, পারবি না ওই গাছ দিয়ে আমার একটা মূর্তি বানিয়ে রাখতে? ঘুমটা ভেঙে গেল, আরে তাই তো, মায়ের আদেশ আমায় পারতেই হবে।মাটির তৈরি তার পুতুল গুলো যেন ভরসা যোগালো সুবলকে।ঝড় থেমে একটু স্থিতু হতেই মনপ্রাণ দিয়ে সুবল লেগে পড়লো আমকাঠ কে ছেনি হাতুড়ি দিয়ে মায়ের মূর্তির আদল দিতে।টানা বারো দিনের মাথায় সুবল সফল হলো।পাড়া প্রতিবেশীরা মুগ্ধ ছেলের মাতৃভক্তি দেখে।সাবাস সুবল সাবাস বেঁচে থাকুক মায়েরা এভাবে স্মৃতি তাজা করে সন্তানদের মধ্যে।

কলমে রাণা চ্যাটার্জী, পোস্ট-শ্রীপল্লি, বর্ধমান পূর্ব

Warning: Attempt to read property "roles" on bool in /home3/weavesdi/public_html/www.monomousumi.com/bengali/wp-content/themes/morenews/inc/template-functions.php on line 941