সেই অনুভূতিগুলো, খারাপলাগা গুলো আজ সত্যিই আমার থেকে বহুদূরে চলে গেছে। আজকের পাওয়া অনুভূতি, ঐ ছোট ছোট ফুলের মতো মুখ‌গুলোর হাসি, আর ছোট ছোট মুখে বুড়ো বুড়ো সত্যি কথা। যা ভরিয়ে দেয় আমার মুখের হাসি। আবার কারোর আবদার, কারোর মিষ্টি দুষ্টুমি নিয়ে চলছে এখন আমার জীবন। সবার কাছে এদের দুষ্টুমি, আবদার, জেদ বিরক্তিকর হলেও আমার কাছে তা ছিল এক সুন্দর অনুভূতি। কারন ওরা যতটা নয় আমার ছাএছাত্রী, তার থেকে বেশি ওরা আমার ছোট ছোট বন্ধু। হ্যাঁ এরা আমার সত্যিকারের বন্ধু, আমার কাছের আত্মীয়। যাদের কাছে আমার জন্য রয়েছে ওদের ঐ ছোট হৃদয়ে আমার দেওয়া শিক্ষারপ্রতি আগ্রহ আর আমার জন্য ভালোবাসা।যখন একটা সময় জীবনে পাওয়া ডিগ্রির কাছ থেকে কিছু পেলাম না। পরিবারের কাছ থেকে অস্বস্তিকর পরিবেশ, মা বাবার অভিমান এত পড়িয়েও মেয়ে সরকারি চাকরি পাইনি। সমাজ যখন আমার শিক্ষা ও ডিগ্রিকে অপমান করে দেখল শুধু গায়ের রং। তখন বাঁচতে শুরু করি সবকিছু ভুলে নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ঐ বাচ্চাগুলোর হাত ধরে। এখন‌ও মনে পড়ে, আমি সর্বদা ক্লাসে প্রথম দশ জনের একজন ছিলাম। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে কী লড়াই ছিল আমার বন্ধুদের সঙ্গে। আবার কখনো কখনো যদি তাদের থেকে কম নাম্বার পেতাম সে কী কান্না আমার। ভাবতাম পরের পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেতে হবে। সে রাত জেগে কী চেষ্টা। তারপর ভালো ফলাফল করলে শিক্ষকদের ও আত্মীয়দের কাছ থেকে কত প্রশংসা। সত্যিই কথা বলতে মনে মনে খুশি হতাম ও অহংকার‌ও হতো। বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম এই হবো, সেই হবো। কিন্তু তখন কী আর বুঝেছিলাম ক্লাসের 250 জনের মধ্যে লড়াই আর লক্ষ্য লক্ষ্য মেধাবী ছাএছাত্রীদের সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যে লড়াইয়ে অনেক পার্থক্য। কিন্তু তা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম যখন বিএসি পড়া শুরু করি, ও এম‌এসি পড়ি। তখন ধীরে ধীরে সবার কাছ থেকে সেরা হ‌ওয়ার উপাধি ও নিজেকে সেরাভাবা ভাবনাগুলো বদলে যায়। যখন এম‌এসি পড়ার পর বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম কিন্তু কোন কাজ পাচ্ছিলাম না। ও এরপর মেয়ে বড়ো হ‌ওয়ার বাবা, মা যখন আমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু করে তখন নিজের জীবনটা বেশি করে চোখের সামনে ধরা দিয়েছিল ও সমাজকে চিনিয়েছিল।বাবা মনে করেছিল মেয়ে আমাকে এতদূর পড়াশুনা, বিয়ে দেব কোন উচ্চশিক্ষিত ছেলের সঙ্গে, প্রসার বা মাস্টার বা কোন বড়ো অফিসারের সঙ্গে। কিন্তু বাবার এই ভাবনা ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করলো যখন তাদের পছন্দ ছিল, শুধু কলেজে পড়া হলে হবে কিন্তু মেয়ে দেখতে ফরসা সুন্দর চাই। সত্যিই কথা বলতে আমি সুন্দর ছিলাম না। এর থেকে আমার জীবনে বড়ো কোন অপমান হতে পারে না যখন একজন টিচার আমার শিক্ষা না দেখে আমার গায়ের রং দেখে ঘটকের কাছে বলে, “আমি এম‌এসি পড়া মেয়ে চাই না কিন্তু,সুন্দর দেখতে মেয়ে চাই”। এই কথাটা ওদের অজানতে আমি শুনতে পেয়েছিলাম। সেদিন মনে হয়েছিল ডিগ্রির সার্টটিফিকেট গুলোর মূল্য কোথায়, কে মূল্য দেবে, এগুলো ছিঁড়ে ফেলি। খুব কেঁদেছিলাম যখন ঐ টিচার আমাকে দেখতে এসে আমাদের বাড়ির পাশে একজন সুন্দর দেখতে মেয়েকে বিয়ে করেছিল। যার পড়াশুনা ছিল এইচ এস। আমার বাবাকে তখন তার বাবা বলেছিল, “দেখুন আপনার মেয়ে এত পড়াশুনা করেও আজ এই অবস্থা, আপনার আনা ভালো চাকরি করা ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল”। সেদিন বাবার চোখের জল‌ আর সমাজ থেকে পাওয়া অপমান গুলো আমায় খুব কষ্ট দিয়েছিল। ভেঙে দিয়েছিল পড়াশুনা কে নিয়ে আমার অহংকার। একদিকে ভালো হয়েছিল। তখন‌ই মনে করেছিলাম ডিগ্রি নয়, আমি আমার শিক্ষা নিয়ে লড়বে। এরপর শুরু করি ছোট ছোট প্রাইমারী কয়েকটা বাচ্চাকে পড়াতে। ওদের পড়াতে সেইটুকু সময় এতটা ব্যস্ত হয়ে যেতাম সেইসময়ে, ভুলে যেতাম সবকিছু। তারপর শুরুকরি কোচিং ও প্রাইভেট টিউশানি। যা বাবা মা কে নতুন করে আশা দিয়েছিল। সবচেয়ে মূল বিষয় আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম, সঙ্গে আমার শিক্ষার সন্মান আর অনেক অনেক আনন্দ। এইভাবে চলতে থাকে তিন-চার বছর। দুষ্টু বাচ্চাগুলো যারা পড়তেই চাইনা, তাদের আমি পড়ানো শুরু করি।কিন্তু ওদের বন্ধু হয়ে। যা এনে দিতে লাগলো আমায় অনেক অনেক সাফল্য। এরপর আমি গড়ে তুলি বাচ্চাদের এক স্কুল।আর এখন আমি দ্যা হেড ম্যাডাম এই স্কুলের। সত্যি বলতে আজ ঐ অতীতের আর কোন মূল্য নেই আমার কাছে, আমার বাবার কাছে, ঐ অতীত আমাকে ছুতেও পারে না।বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিভাবকরা যখন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটের বাইরে অপেক্ষা করে, তখন মনে হয় আমার ডিগ্রির না মূল্য থাক, আমার শিক্ষার মূল্য রয়েছে। আর আজ আমি এখানে আমার শিক্ষা ও ঐ আমার ছোট বন্ধুদের জন্য, যাদের আমি ছোট্ট মনটা বুঝতে শিখেছিলাম। যা আজ আমার জীবনে খুশির উৎস্য। আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি আমার ছোট বন্ধুরা, ভাবতে বসে অনেকটা সময় চলে গেল। আমি আসছি তোমাদের ক্লাসে।

কলমে অনুশ্রী মাইতি

আমি একটা ছোট গ্রামে থাকি। গল্প ও কবিতা ভাবা ও লেখা হল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু।

SOURCEকলমে অনুশ্রী মাইতি
Previous articleসমুদ্রতট
Next articleদাদাভাই
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here