দিনটা মঙ্গলবার। লাঞ্চ সেরে অভিমন্যু নিউজ খুলে বসেছে। নিউজ চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ পাশের ঘরে ফোনটা বেজে উঠল। “এই যাঃ” বলে লাফিয়ে উঠে ফোনটা ধরতে গেল অভিমন্যু। যা ভেবেছিল ঠিক তাই। ডক্টর উন্মেষ সিকদারের ফোন। উন্মেষ সিকদার অভিমন্যুর সাইকিয়াট্রিক্স, প্রতিদিন দুপুরে আধঘন্টার অ্যাপয়েনমেন্ট থাকে ডাক্তারের চেম্বারে। কাজের চাপে মাঝেমধ্যেই থেরাপিতে যেতে ভুলে যায় অভিমন্যু। ফোনটা ধরে ওপাশ থেকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই অভিমন্যু “আসছি আসছি” বলে জিভ কাটে। ওপাশ থেকে শুধু একটু হাল্কা হাসির শব্দ এল। অভিমন্যুও একটু হেসে ফোনটা কেটে বেরিয়ে পড়ল ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে যেতে যেতে আবার ফোন এল, রিসিভ করল অভিমন্যু ——-
“কি রে কোথায় আছিস?” কিংশুকের গলা।
“আরে আবার ভুলে গেছিলাম। নিউজগুলো জাস্ট দেখতে বসেছিলাম তখনি ডাক্তারের ফোন এল। জানিসই তো ——-“
কথা শেষ করতে না দিয়েই কিংশুক বলে
“ও তুই আবার ভুলে গেছিস! কী যে হল না তোর! ভালো করে ট্রিটমেন্টটা করা। ডাক্তার কিছু বললো কেন হচ্ছে এরকম?”
“আরে চিন্তা করিসনা, উনি খুব ভালো ডাক্তার, ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। তুই তো জানিসই আমার হিস্ট্রি, ওটার কারণেই হতে পারে ডাক্তার বলছে।“
“আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কী ট্রিটমেন্ট হচ্ছে ওটা! গিয়ে তো ওই ১৫-২০ মিনিট ঘুমাস শুধু, ওতে কিছু লাভ হচ্ছে!”
“হবে নিশ্চয়ই, তাছাড়া ওনার MD করা আছে তো, আমি আমার বাকি রোগের ওষুধও লিখিয়ে নিই ওনার কাছে। একসাথে সব কাজ হয়ে যায়।“
“তোর তো ইনসোমনিয়াও আছে, সেটারও ট্রিটমেন্ট করাস নাকি শুধু ওই PTSD আর এইসব ওষুধ?”
“না না, সবই করাই। এই শোন, রাখলাম আমি, পরে কথা হবে।“ বলে ফোনটা কেটে দেয় অভিমন্যু।
অভিমন্যু সিনিয়র পুলিশ অফিসার, CID Crime Branch । কিংশুক অভিমন্যুর সহকারী। একসাথে অনেকগুলো কেস সলভ করেছে, এখন সহকারীর থেকে বন্ধুই বেশি হয়ে গেছে।
এরমধ্যে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে অভিমন্যুর Post Traumatic Stress Disorder (PTSD) আছে। সম্ভবত ওর একটা পুরোনো ঘটনারই প্রভাব এটা। তার সাথে Insomnia, High Blood Pressure আর Gastric Ulcer। বাড়িতে একাই থাকে অভিমন্যু, কিন্তু এত রোগের সাথে থাকতে থাকতে ওর আর নিজেকে একা বলে মনেই হয়না।
পরদিন সকালবেলা উঠে চা টা হাতে নিয়ে খবরের কাগজ খুলল অভিমন্যু। এমন সময়ই থানা থেকে ফোন এল অভিমন্যুর কাছে। কাল রাতে একটা মার্ডার হয়ে গেছে, অভিমন্যুকে দেওয়া হয়েছে কেসটা। কিংশুককে ফোন করে ফটাফট রেডি হয়ে অভিমন্যু বেরিয়ে পড়ল ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশনে। গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেখে লোকাল পুলিশ অলরেডি পৌঁছে গেছে সেখানে। একটা ফ্ল্যাটের মধ্যে হয়েছে খুনটা, তিনতলায়। ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে রক্ত বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সকালে রক্ত দেখতে পেয়েই এক প্রতিবেশী পুলিশে ফোন করে খবর দেয়। অভিমন্যু পৌঁছানোর পাঁচমিনিট আগেই কিংশুক পৌঁছে গেছে সেখানে। তখন এভিডেন্স কালেকশন চলছে, আশেপাশের লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ক্রাইম সিনটা চারিদিকে ব্যারিকেড টেপ দিয়ে ঘিরে দিয়েছে, সবকিছুর ছবি তোলা হচ্ছে।
ব্যারিকেড ডিঙিয়ে অভিমন্যু ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল, যে রুমে খুনটা হয়েছে। অদ্ভূতভাবে করা হয়েছে খুনটা। সিলিঙে ফ্যানের হুকের সাথে পা বেঁধে উলটো হয়ে ঝুলছে বডিটা। ডেডবডির মুখে প্লাস্টিক বাঁধা, প্লাস্টিকটা রক্তে মাখামাখি। প্লাস্টিক বেয়ে চুঁয়ে চুঁয়ে রক্ত মেঝেতে পড়েছে। রুমের দেওয়ালে ধারালো একটা কিছু দিয়ে খোদাই করে লেখা “ADRASTEIA”। প্রাথমিক যাবতীয় কাজ অর্থাৎ সব অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তোলা এসব সেরে বডিটা নামিয়ে এনে পাঠানো হল পোস্টমর্টেমে। ক্রাইম সিনের সমস্ত ছবি তুলে, এভিডেন্স কালেক্ট করে অভিমন্যু সোজা পৌঁছালো CID অফিসে। কিংশুককে বলে গেল জিজ্ঞাসাবাদ সেরে সেখানেই পৌঁছাতে।
বডিটা এসে গেছে পোস্টমর্টেম রুমে। অভিমন্যুও এল সেখানে। পোস্টমর্টেম করবেন ফরেন্সিক ডক্টর ঋতই দাস, লেডিডক্টর। বেশ কয়েকবছর থেকেই আছেন CID তে। ততক্ষনে কিংশুকও পৌঁছে গেছে সেখানে। অভিমন্যু আর কিংশুক সেখান থেকে ওদের রুমে গিয়ে ভিক্টিমের ডিটেলস সার্চ করতে শুরু করে। পোস্টমর্টেম কমপ্লিট হলে ডক্টর দাস ডেকে নেবেন ওদের।
ভিক্টিমের নাম বিকাশ দত্ত। খুবই সাধারণ একজন স্কুল টিচার, কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। দুজনে মিলে এইসব সার্চ করতে করতে বিকেল হয়ে এল। একটা টী ব্রেক নিতে বাইরে বেরোল অভিমন্যু। চা-টা খেয়ে কেবিনে এসে আবার কাজ শুরু করেছে এমন সময় ডক্টর ঋতই দাসের ফোন, পোস্টমর্টেম কমপ্লিট। কিংশুককে নিয়ে বডির কাছে গেল অভিমন্যু, ডাক্তার ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ওরা আসতেই ডক্টর দাস বলতে শুরু করেন——-
“খুনি বুদ্ধি খাটিয়ে খুব নিপুণভাবে করেছে খুনটা। মৃত্যুর কারণ ব্রেন ব্লাস্ট। বেশিক্ষণ উল্টোভাবে ঝোলার কারণে সারা শরীরের রক্ত আর কোথাও যেতে না পেয়ে ব্রেনে গিয়ে জমেছে। স্বাভাবিকভাবেই ব্রেনে প্রেশার বাড়তে থাকে আর এভাবে থাকতে থাকতেই প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর ব্রেন ব্লাস্ট হয়ে মৃত্যু হয় বিকাশবাবুর। বডিতে কোনোরকম আঁচড়ের নিশান নেই অর্থাৎ মৃত্যুর আগে খুনির সাথে কোনোপ্রকার ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়নি। রক্তে নিউরোটক্সিনের নমুনা পাওয়া গেছে। টক্সিন টাও খুব রেয়ার, একপ্রকার মাকড়সার ভেনাম, নাম Black Widow। একমাত্র নর্থ আমেরিকাতেই মেলে এই প্রজাতির মাকড়সা। এই ভেনামের বিশেষত্ব হল এটা একমাত্র রক্তের সংস্পর্শে এলেই বিষক্রিয়া ঘটায় এবং বিষক্রিয়ার ফলে বডি প্যারালাইজড হয়ে যায়। Pectoral Muscle এ একটা আড়াআড়ি কাট আছে যেটা ক্লিনিক্যাল স্ক্যালপেল দিয়ে কাটা হয়েছে। খুনি স্ক্যালপেলে ভেনাম লাগিয়ে সেই স্ক্যালপেল দিয়ে Pectoral Muscle এ আড়াআড়ি কাট টা করেছে। Pectoral Muscle কাটার ফলে হাতের পেশিতে কোন বল থাকেনা, অসাড় হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভিক্টিম আত্মরক্ষার কোন চেষ্টাই করতে পারবেনা। খুনি আরামসে তার কাজ করতে পারবে। অর্থাৎ খুনি খুব দক্ষতার সাথে একটাই অস্ত্র দিয়ে রক্তে ভেনাম মেশানো এবং Pectoral Muscle কাটার কাজ করেছে যার ফলে ভিক্টিম সম্পূর্ণরূপে প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে।
এরপর আসি মাথায় বাঁধা প্লাস্টিকের কথায়। প্লাস্টিকে একটা ছোটো ফুটো করা আছে——–“
ডাক্তারের কথা শেষ হতে না দিয়েই কিংশুক উৎসুক হয়ে বলে ওঠে “প্লাস্টিকে ফুটো! সেটা আবার কীজন্য?”
“হ্যাঁ, প্লাস্টিকে ফুটো, তারও কারণ আছে। প্লাস্টিকে ফুটো না থাকলে ভিক্টিম Cardiac Arrest এ মারা যেতেন, কিন্তু সেটা করা হয়নি। প্লাস্টিকে ছোট ফুটো ছিল যার মাধ্যমে সামান্য হলেও অক্সিজেন ব্রেনে পৌঁছাতে পেরেছে আর কম অক্সিজেন ব্রেনে পৌঁছালে মানুষ পুরোনো বিভিন্ন ট্রমাটিক ঘটনা হ্যালুসিনেট করে। অর্থাৎ বিকাশবাবু মৃত্যুর মুহূর্তে হ্যালুসিনেট করছিলেন। “
“খুনের পদ্ধতি তো জানা গেল, এবার জানতে হবে কে এবং কেন করল খুনটা“ বলতে বলতে অভিমন্যু রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিংশুকও তাকে অনুসরণ করল।
“কিংশুক, তুই কাজ এগিয়ে রাখ। খুব টায়ার্ড লাগছে, আজ আমি আসছি, কাল সকালে দেখা হবে“ বলে অভিমন্যু সেদিনের মত ফিরে গেল।
কিংশুকের মাথায় প্রথম থেকেই ঘুরছিল “ADRASTEIA” শব্দটা। এটা দেওয়ালে লেখার মানে কি! ADRASTEIA শব্দটারই বা কি অর্থ? গুগল খুলে সার্চ করল কিংশুক আর সব রেজাল্ট পড়ে যেটা বুঝল সেটা হচ্ছে এই যে — মাইথোলজি অনুযায়ী Adrasteia হলেন একজন গ্রীক দেবী যাঁর প্রচলিত নাম “Nemesis”। Nemesis এই ধারণায় বিশ্বাসী যে, পাপ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। Adrasteia হলেন জাস্টিসের দেবী এবং তিনি মানুষকে পাপ অনুযায়ী তার পরিমাণমতো কর্মফল দেন। এদিকে বিকাশবাবু তাঁর পুরনো স্মৃতিচারণ করতে করতে মারা গেছেন এবং সেটা খুনের একটা অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য যে কারণে ইচ্ছা করে প্লাস্টিকে একটা ফুটো করে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সবমিলিয়ে যেটা দাঁড়াচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে খুনি নিজেকে নেমেসিস বলে মনে করে আর সে বিকাশবাবুকে তাঁর জীবনের কোনো এক পাপের সাজা দেওয়ার জন্য তাঁকে সেই পাপ মনে করাতে করাতে মেরেছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে বিকাশবাবু জীবনে কী এমন পাপ করেছেন যার জন্য তাঁকে এরকম নির্মমভাবে খুন হতে হল? তাঁর তো কোন ক্রিমিনাল রেকর্ডও নেই, খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। এইসব ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাড়ি ফিরে গেল কিংশুক।
পরদিন সকালে থানা থেকে ফোন আসে অভিমন্যুর, একইরকমভাবে আবার খুন হয়েছেন একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আশুতোষ রায়। কিংশুককে নিয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় অভিমন্যু। ঠিক একইরকমভাবে এই খুনটাও করা হয়েছে। সিলিঙে ফ্যানের হুকে পা বেঁধে উল্টো করে ঝোলানো, মুখে প্লাস্টিক বাঁধা, দেওয়ালে খোদাই করা “ADRASTEIA”।
তাড়াতাড়ি বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানো হল। পোস্টমর্টেমেও সেই একই রিপোর্ট—প্লাস্টিকে ফুটো, ব্রেন ব্লাস্ট করে মৃত্যু, Pectoral Muscle এ আড়াআড়ি কাট, রক্তে Black Widow র ভেনাম। আশুতোষবাবুরও কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড খুঁজে পাওয়া গেলনা।
দুদিন পর হুবহু একইরকমভাবে আরেকটা খুন। এবার ভিক্টিম একজন বিজনেসম্যান শুভ্রতনু ভট্টাচার্য।
“অদ্ভূত ব্যাপার কিংশুক, শুভ্রতনুবাবুরও কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। ভিক্টিম তিনজনই খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন।“ অভিমন্যু খুব বিচলিত হয়ে বলল। কিংশুক তার সাথে আরও যোগ করে “খুনি তাহলে কিসের ভিত্তিতে ভিক্টিম নির্বাচন করছে? আর ক্রিমিনাল রেকর্ড যখন নেই তখন কোন পাপেরই বা শাস্তি দিচ্ছে এদের? মোটিভ কী?“ অনেক প্রশ্ন। রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে কেসটা ওদের।
লাঞ্চ সেরে এসে ফ্রেস মাইন্ডে দুজনে বসল খুনগুলোর মধ্যে লিঙ্ক খুঁজতে। কিছুক্ষন পর ডক্টর সিকদারের ফোন এল অভিমন্যুর কাছে, থেরাপির জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। অভিমন্যু বেরিয়ে গেল কিংশুককে কাজের দায়িত্ব দিয়ে।
যুগ্মকলমে ঋতশ্রী সূত্রধর ও রিজু মোদক (পশ্চিমবঙ্গ)
পরবর্তী পর্ব : ক্রমশ>>
বেশ তো।
অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের।
Darun laglo
Porer part kobe asbe
Suspence ta barche…chalie ja…
[…] << পর্ব ১ […]