কালীপূজো আসতে আর দু’দিন বাকি। সায়নকে একটা লেখা জমা করতে হবে একটা পত্রিকার জন্য।  অথচ কিছুই মাথায় আসছে না সায়নের, বেডরুমের জানলাটা খুলে ভাবার চেষ্টা করছে কিছু একটা প্লট।

বহুতল বাড়ির বাইশ তলা থেকে সামনের সব ক’টা বাড়ি ছোটই লাগে। সায়নদের বিল্ডিংটাই সবচেয়ে লম্বা। সামনে একটা জলা জমি, তার পেছনে অনেকগুলো বিল্ডিং। কোনোটাই ১৪ তলার বেশি না। 

বেশ লাগছে। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া মুখে চোখে এসে লাগছে। সায়নের মনে মনে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব আসছে যে অনেক কষ্ট করে শেষমেশ বাড়িটা কিনতে পেরেছে । তার জন্য যদি কিছু অজান্তে অন্যায় হয়ে থাকে তার দায়িত্ব সায়নের হতে পারে না। একাই থাকে সায়ন এখন বাড়িটায়। আই টি জব করলেও সায়নের পছন্দের বিষয় হল লেখা লিখি করা। নিজের শখেই এদিক ওদিক নানা রকম পত্রিকায় লেখা দিতে ভালো লাগে তার। কিন্তু এবার একটা পত্রিকায় একটা লেখা দিয়ে হবে যার বিষয় হল ভৌতিক – অলৌকিক।  সায়ন ভৌতিক – অলৌকিক এসব বিষয়ে প্রচুর লেখা লিখে এসেছে। কিন্তু এবারে কিছুতেই কোন প্লট মাথায় আসছে না। সায়ন সাধারণত চেষ্টা করে তার গল্পে কিছুটা হলেও সত্যি ঘটনা তুলে ধরতে। কোন একটা সত্যি ঘটনা কেন্দ্র করে প্লট মাথায় এলে বাকিটা কল্পনায় সাজিয়ে ফেলে সে। তার বেশ কিছু লেখা বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে ।

রাত প্রায় ১১ টা বেজে গেছে। অধিকাংশ বাড়িগুলো থেকে ঝলমলে আলো দেখা যাচ্ছে এখনো। আলোগুলো বোধহয় সারা রাতই জ্বলবে। সবাই আলো দিয়ে সাজিয়েছে নিজের নিজের বাড়ি। ইতিমধ্যে অনেকে ছাদে বাজি ফাটানোও শুরু করে দিয়েছে। নানারকম  আলোর খেলা – কোনোটা জ্বলছে নিভছে, কোনোটা এক ভাবে জ্বলছে কিছুক্ষণ তারপর আলোর রঙ বদলে বদলে যাচ্ছে, কোনোটা আবার স্থির হয়ে জ্বলছে। আচমকা সায়নের চোখ পড়ে একটা বারান্দায়, সেখানে কোন রকম আলোর সাজ নেই। আশে পাশের বাড়ির বারান্দার আলোর প্রতিফলনে একটু একটু আলো আসছে বারান্দাটায়। মনে হচ্ছে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। ভালো করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে সায়ন বোঝার চেষ্টা করে ওটা কি বা কে হতে পারে? বিল্ডিংটা জ্লা জমির ওপারে, কাজেই খুব একটা কাছে নয়। মনে হচ্ছে একজন মেয়ে বা মহিলাই হবে, যে বা যিনি দাঁড়িয়ে। লম্বা চুলটা  খোলা। সকাল হলে দূরবীনটা দিয়ে দেখা যেত। এখন স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না । একসময় মনে হল মানুষটা সিলিং থেকে ঝুলছে, তাই মাথাটা এতটা ওপরে। শরীরের মাঝামাঝি জায়গার নিচে আর বোঝা যাচ্ছে না, বারান্দার রেলিঙের জন্য। এটা নিশ্চয়ই অন্য কিছু হবে, সায়নের চোখের ভুল হবে। এমন আবার হয় নাকি ?

জানলাটা বন্ধ করে শুতে চলে আসে সায়ন। ঠিক করে এই পত্রিকায় লেখাটা আর জমা দেবে না, অতিরিক্ত ভৌতিক ব্যাপার লিখতে লিখতে এবার মনে হয় এসব সে দেখতেও শুরু করেছে। ঘুমিয়ে পড়ে সায়ন।

পরদিন সকালে অফিস, কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সায়ন, তাই ঘটনাটা আর মনে ছিল না।

কালীপূজোর আগের দিন, সন্ধ্যে বেলায় জানলায় প্রদীপ দিতে গিয়ে আবার চোখে পড়ে সেই বারান্দা, সেই মূর্তি। এবার ঘটনাটা ভাবিয়ে তোলে সায়নকে। বার বার চোখের ভুল হতে পারে না । অদ্ভুত ভাবে একটা গল্পের প্লট এসে যায় মাথায় এই ঘটনা অবলম্বন করে। রাত পর্যন্ত লিখে সায়ন শেষ করে ফেলে গল্পটা।   

একটা আত্মহত্যার ঘটনা তুলে ধরে গল্পে, এক মহিলা এমন এক বহুতল বাড়ির বারান্দা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন কালীপূজোর তিন দিন আগে, তার দাদার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে। অবিবাহিত বোনকে  দাদা কিছুতেই নিজের কাছে রাখতে চায় না। মহিলার ওপর অত্যাচার করা, এসব নিয়ে কষ্ট, ব্যথা, মৃত্যু – তারপর অলৌকিক ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়ে যায় এক টান টান ভৌতিক গল্প। সেই মহিলার অতৃপ্ত আত্মাকে বছরের এই সময় দেখা যায় বারান্দায় রেলিঙের ওপর বসে থাকতে। সে ফিরে ফিরে আসে, দাদার ওপর প্রতিশোধ নিতে। অদ্ভুত ভাবে মহিলার দাদার সারা শরীরে হিংস্র আঁচরের দাগ দেখা যায়  পর দিন সকালে।  

এমন একটা গল্প লেখার পর, সৃষ্টির আনন্দে সায়ন ঘুমোতে যায় সেই রাতে।  

পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে সায়ন দেখে অদ্ভুত ভাবে তার নিজের শরীরেই অজস্র হিংস্র আঁচরের দাগ। বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা যা সায়ন মনে করতে চায়না, কোথাও তার প্রমান রেখে দিতে চায়না, নিজের অজান্তেই কেমন করে সায়ন সেই ঘটনাই নিজের গল্প আকারে রচনা করে ফেলে এবং তার পরিণতিও ঘোষণা করে ফেলে।

কলমে শ্রীপর্ণা দাস ব্যানার্জী, ব্যাঙ্গালুরু

উওমেন খ্রিস্টান কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাথে যুক্ত লেখালেখি নিয়ে। কবিতা, ভ্রমন কাহিনী লেখার শুরু ১২ বছর বয়স থেকে। প্রথম প্রকাশিত ম্যাগাজিন কোলাজ, ২০১০ সালে। সেই থেকে শুরু।  তারপর আমেরিকার বাঙালি  ম্যাগাজিন সৃজন – ২০১৫ থেকে বর্তমান। এছাড়া আরও ছোট বড় কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নানা রকম প্রকাশনা।  প্রথম প্রকাশিত ভৌতিক বই;  ওয়াইফাই …কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখা ছাড়া, আঁকা (Acrylic, Oil, Sketch), বই পড়া, সিনেমা দেখা খুব পছন্দের বিষয়। 

9 COMMENTS

  1. বেশ জমেছিলো গল্পটা , আর একটু কিছু হওয়ার দরকার ছিল। তবে ভালো লেগেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here