সক্কাল সক্কাল ল্যাপটপ খুলে মেলটা চেক করতে গিয়েই যেন তমালের মাথা সিলিং ছুঁলো!
ইনবক্সের সবচেয়ে ওপরেই রয়েছে মেলটা। তাতে লেখা, “ইউ আর সিলেক্টেড অ্যাজ অ্যান ইন্টার্ন অ্যাট দা ল্যাবরেটরি অব ড: বিশ্বরূপ বোস।” তার নিচেই একটা ফোন নম্বর আর একটা ঠিকানা দিয়ে তাতে যোগাযোগ করার নির্দেশ।
ছোট একটা বার্তা, নেহাতই ছোট্ট। কিন্তু সেটা দেখেই তমালের মাথা সিলিং ছুঁলো! কথামৃত একাধিকবার পড়া সত্ত্বেও পা দুটো যেন মাটি ছেড়ে ইঞ্চি খানেক উঁচুতে ভাসছে! তবে তাই বলে তমাল কিন্তু ‘আবেগে ভেসে যাওয়া’ প্রকৃতির নয় মোটেই। লঘু সাফল্যে গুরু উদযাপন সে কখনো করেনা। কিন্তু এইটাকে এক্কেবারে ‘লঘু’ সাফল্য বলা যায় কি? বোধহয় না।
ব্যাপারটা হল হপ্তা খানেক আগে তমাল একটা বিশ্বাসযোগ্য, এবং জনপ্রিয়, সাইটে গিয়ে কয়েকটা ইন্টার্নশিপ এর জন্য আবেদন করে। খড়গপুর আই আই টি থেকে মাস্টার্স করেছে তমাল। নেট এক্সামের এখনো মাসখানেক বাকি। এই সময়টা বাড়িতে ল্যাদ না খেয়ে ছোটখাটো একটা কাজ করলে মন্দ হয়না। কিছু এক্সট্রা পকেটমানিও আসবে, হাতে-কলমে একটু কাজও শেখা যাবে। কিন্তু এই ‘ছোটখাটো কাজ’টি যে ড: বোসের সাথে কাজ করবার সুযোগ, এতটা আশা করেনি তমাল। সব লোক না চিনলেও পড়াশোনার সাথে যুক্ত লোকজনের কাছে বিশ্বরূপ বোস অত্যন্ত পরিচিত নাম। যে কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানী ভারত তথা গোটা বিশ্বে বন্দিত, ড: বোসের নাম তাদের তালিকার ওপরের দিকে থাকে। তা এহেন একজনের সাথে কাজ করবার সুযোগ এমন আকস্মিক ভাবে এসে গেলে তমালের মতন অল্পবয়সী ছেলের মনে পুলক জাগাটা বিরাট বড় কোনও দোষের মধ্যে পড়েনা।
জাগলোও পুলক, ড: বোসের বাড়ির সামনে এসে। বাড়িখানা বাইরে থেকে দেখলে ছোটখাটো একটা রাজপ্রাসাদ! তমালের ধারণা ছিল বড় বড় বিজ্ঞানী কিংবা গুণী লোকজনরা তেমন শৌখিন হয়না মোটেই। এইরকম ভাববার কোনো শক্তপোক্ত ভিত্তি নেই বটে। তবুও ধারণাটা ছিল। মানতেই হবে সেই ধারণাটা বেশ ধাক্কা খেয়েছে আজ।
ধাক্কাটা আরও জোর লাগলো ভদ্রলোকের বাড়ির ভেতর এসে। বাড়িতে ড: বোস ছাড়া বোধহয় আর কেউ থাকেনা। থাকলে নিশ্চয়ই ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিটিকে কলিং বেলের শব্দে নীচে দরজা খুলতে আসতে হত না। ভদ্রলোক দরজা খুললেন, তমালকে ওপরে নিয়ে এলেন। পরিচয় পর্যন্ত জানতে চাইলেন না। অ্যাপ্লিকেশনের সময় অবশ্য নিজের ছবি দিতে হয়েছিল। দিন তিনেক আগে, মানে যেদিন মেলটা আসে, সেদিন ফোনও করেছিল তমাল। ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তির যে এখনও বয়স বাড়েনি বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য বয়স না বাড়াটাই স্বাভাবিক। হাজার হোক এত বড় বিজ্ঞানী বলে কথা!
তমাল দেখল ঘরের সব দেওয়াল জুড়েই বড় বড় ছবি টাঙানো। শুধু যে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীর ছবি তাই নয়, সে তো আছেই, তার সাথে সত্যজিৎ, কুরোশাওয়া, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, পিকাসো, এঞ্জেলো সবাই রয়েছে।
“চল তমাল, আমার ল্যাবটা আগে দেখে নেবে চল। ওটাই তোমার কাজের জায়গা যখন…।”
তমালের নামটা পর্যন্ত মনে আছে ভদ্রলোকের! আশ্চর্য!
“ভাবছো এই বিরাট বাড়িতে একাই থাকি কিনা, তাইতো?”, তমালকে নিয়ে ল্যাবে যেতে যেতে ভদ্রলোক বললেন, “একাই থাকি। বিয়ের বয়সে এমন কাজ কাজ খেলা শুরু করলাম যে বয়সটাই পেরিয়ে গেল!”, ভদ্রলোক হাসলেন।
“চাকর বাকর বা দেখাশোনার করবার কেউ…?”
“তাও নেই। কোনো চাকর বাকরও মন থেকে রাখতে পারিনা, জানো। আসলে ওই দাসপ্রথাটা আমি পুরোপুরি মেনে নিতে পারিনা তমাল। হতে পারে ওদের হয়ত শিক্ষা কম, পয়সার দরকার। কিন্তু নিজের বাড়ির নোংরা পরিস্কার করার জন্য কাউকে রাখা আমার দ্বারা হয়ে ওঠেনা।”
ভদ্রলোকের কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছিল তমালের। শুধু বিজ্ঞান নয়, সমস্ত বিষয়েই যে ওঁর সমান আগ্রহ রয়েছে সেটা ওঁর লাইব্রেরির সংগ্রহ দেখেই আন্দাজ করা যায়। তাছাড়া তাঁর আঁকার হাতখানিও বেশ। নিজের আঁকা কয়েকটা ছবি টাঙানো লাইব্রেরির দেওয়ালে। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে সমাজের প্রতি তার দ্বায়বদ্ধতাটা। বিশেষত সমাজের নিচুর তলার মানুষের ওপর হয়ে চলা বিভিন্ন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর কাজ সত্যিই তারিফের যোগ্য। এর জন্য ভদ্রলোক নিজস্ব একটা এন.জি.ও পর্যন্ত খুলেছে, নিজের খরচায়। তবে এইসমস্ত কাজ অবশ্য বর্তমানে অনেকেই করে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ‘সোশ্যাল এক্টিভিস্ট’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। একজন স্বনামধ্য বিজ্ঞানীর এই ব্যাপারে যুক্ত থাকা, এবং বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই যুক্ত থাকাটা বেশ প্রশংসনীয় বৈকি! আর মজার ব্যাপারটা হল ড: বোসের দেওয়াল ভর্তি যে মেডেল, সার্টিফিকেটগুলো রয়েছে তাঁর অর্ধেকটাই তাঁর সোশ্যাল ওয়ার্কের জন্য। এইসমস্ত খবর অবশ্য পেপার কিংবা নিউজ চ্যানেলগুলোয় তেমন স্থান পায়না। অবশ্যি ওদেরও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। যখন যেটা বিকোয় আর কি! তবে তমালের বিশ্বাস ভদ্রলোক যদি এক আধটা সিনেমা সিরিয়ালে অভিনয় করে ফেলতে পারতেন তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম হতে পারত।
তা ড: বোসের ল্যাবের সামনে এসে তো তমাল থ! স্কুলের কথা তো নয় বাদই দেওয়া গেল, মঃস্বলের সরকারি বাংলা মিডিয়ামে পড়ত তমাল, কিন্তু খোদ আইআইটির ল্যাব পর্যন্ত এর সামনে ঘোমটা টানবে। বিরাট এই বাড়িখানার আধ বখরাই বোধহয় দখল করে আছে এই ল্যাবরেটরি। বিরাট একখানা ঘর। দরজা দিয়ে সেই ঘরে ঢুকলে বাকি তিন দিকেই আরও বেশ কয়েকটা দরজা। কোনটার মাথায় লেখা ফিজিক্স, কোনটায় কেমিস্ট্রি, আবার কোনোটায় লেখা ইলেকট্রিক্যাল। সব দরজাগুলোই খোলা, শুধু উল্টোদিকের একটা বাদে।
“এসেই ওই দিকে চোখ?”
তমাল যে ঘরটার দিকেই তাকিয়ে আছে সেটা ভদ্রলোক দেখতে পেয়েছেন।
“ইয়ে, না মানে আসলে ওই ঘরখানা বন্ধ কেন…”
তমালের বাক্যে দাঁড়ি পড়ার আগেই ভদ্রলোক ধরে নিলেন, “সেটাই সরেজমিনে তদন্ত করছিলে। তাই তো?”
“না মানে ঠিক সেরকম ব্যাপার…”
“না, মানে, এত আমতা আমতা করার কি আছে হ্যাঁ? এটা তো আর প্রাইমারি স্কুলের অঙ্ক ক্লাস হচ্ছেনা যে তুমি স্যারকে না বলে জল খেয়ে ফেলেছ আর স্যার তোমায় ধরে ফেলেছে। আরে বাবা এই সামান্য ব্যাপারেই যদি সত্যি বলতে এত ভয় হয় তাহলে আর মিছিমিছি ব্রুনো, গ্যালিলিওর লাইন ধরা কেন বাপু!”
কাজ আর বিশেষ এগোলনা সেদিন। শুধু বললেন, “কাল চলে এসো। তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেব। আর আসার আগে আমি এখন কিসের ওপর কাজ করছি সেটা নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করে আসবে। মানে বর্ণপরিচয়টা পড়া থাকলে একদম সহজপাঠ থেকে শুরু করা যায় আর কি।”, তারপর একটু থেমে, “আর একটা কথা, ওই সারাক্ষণ ‘ড: বোস- ড: বোস-‘ কোরোনা তো। স্যার বলবে, স্যার। ঠিক আছে?”
গুগল করে যা জানা গেল তা বেশ চমকপ্রদ। ভদ্রলোকের কেমব্রিজ থেকে মাস্টার্স, এম.আই.টি থেকে পি.এইচ.ডি, স্ট্যানফোর্ড থেকে পোস্ট ডক। ইউনাইটেড স্টেটসে মোটা মাইনের চাকরি পেলেও মাস দুয়েকের মধ্যে কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে টি.আই.এফ.আর এ যুক্ত হন। একবার, দু’বার নয়, পাক্কা তিন তিনবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ঝুলিতে রয়েছে ভাটনগর, ভারতরত্ন থেকে অ্যাবেল আর ডিরাক মেডেল পর্যন্ত।
“সে সবই তো বুঝলাম তমাল, কিন্তু এখন আমি ঠিক কি নিয়ে কাজ করছি সেটার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে কি?”
“হ্যাঁ, পারলাম বৈকি।”
“পারলে? বাহ্, তা বল দিকি, শুনি।”
“ম্যালকম রোবোস।”
“আচ্ছা। তা সেটা খায় না মাথায় দেয়?”
“কাজে দেয়। অনেক কাজে। একধরনের রোবট। এতদিন যে সমস্ত রোবট আবিষ্কৃত হয়েছে তার চেয়ে কিছুটা উন্নত আর অনেকটা সস্তা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সামনের বছরেই ম্যালকম কোম্পানির এই যন্ত্রটি বাজারে চলে আসবে।”
“ভুলগুলো একটু শুধরে দিই? প্রথমত, যন্ত্র নয়, যন্ত্র-মানব। ম্যালকম রোবোস ইজ আ কাইন্ড অব হিউম্যানয়েড রোবট। এক নজরে আর পাঁচটা মানুষের মতই দেখতে।”, একটু থেমে আবার বললেন, “‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ কথাটা তো খুব চলছে এখন। ব্যাপারটা কি তা জানা আছে নিশ্চয়ই?”
“আজ্ঞে আছে। এই যেমন কম্পিউটারে চেস খেলার সময় যখন সিপিইউ চাল দেয় কিংবা অটোনমাস ভেহিকেলসগুলোয় যে টেকনোলজি ইউজ হয় এই সবই তো আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বা আরও ভালো উদাহরণ হল সিরি কিংবা আলেক্সার মতন পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্টগুলো…”
“সবাই তো এগুলোই বলে। তাহলে তুমি আর নতুনটা কি বললে বাছা?”
“এটাই তো এ.আই স্যার। নতুন কিছু বলি কি করে!”
“না নয়। এটাই এ.আই নয়। এইগুলো কাজ করে বিহেভিরিয়াল অ্যালগরিদম্ আর তাদের স্ট্রং প্রেডিক্টিভ ক্যাপাবিলিটির ওপর ভর করে। কম্পিউটারে চেস খেলার সময় তুমি যদি প্রতি গেমে একই চাল দাও তাহলে সিপিইউও একই চাল দেবে। হেরে যাবে জানলেও দেবে। এটাকে সত্যিই ইন্টেলিজেন্স বলা যায় কি?
আসল এ.আই পুরোনো থেকে শিক্ষা নেবে। যেমন মানুষ নেয়। হেরে যাবে জানলে সেই চাল আর সে দেবে না। সেই দিক থেকে ম্যালকম রোবোসই হতে চলেছে বিশ্বের প্রথম সত্যিকারের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স!”
তমাল চুপ। একটু চুপ থেকে ড: বোস আবার শুরু করলেন, “কিন্তু এসবই তো গেল আমার কাজের কথা। এখন তোমার এখানে কি কাজ সেটার ব্যাপারে আসি। দেখো, ম্যালকম রোবোসের স্ট্রাকচার ডিজাইন আমার রেডি করা আছে। সেটা আজই তোমায় দিয়ে দেবো। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সির ব্যাপারটা আমিই দেখবো। কারণ ওই ব্যাপারে তোমার জ্ঞানের বহর দেখে আমি অভিভূত! আর তোমায় যেগুলো দেখতে হবে সেগুলো হলো…”
তা কাজতো শুরু করা গেল। এর মধ্যেই ম্যালকম কোম্পানির কর্ণধার ড: স্টিভেনসন এর সাথেও কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। তমাল বুঝল এই স্টিভেনসন ভদ্রলোকটি শুধু বড়ো এন্টারপ্রেটারই নন, খুব বড়ো মানুষও। মডার্ন টেকনোলজির ওপর তার অগাধ জ্ঞান। বার্কলে ইউনিভার্সিটি থেকে পি.এইচ.ডি কমপ্লিট করে রিসার্চ ফেলো হিসেবে জয়েন করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। বছর আড়াই সেখানে কাজ করে খুললেন এই ‘ম্যালকম কোম্পানি অব রোবোটিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি’। মাত্র পাঁচ বছরেই সেই কোম্পানি উঠে এল বিশ্বের টপ গ্রসিং কোম্পানির তালিকার আট নম্বরে, আর নিজে উঠে এলেন ধনীদের তালিকার এগারোতে!
একজন গুণী সবসময় অপর আরেকজন গুনীকে চিনতে পারে। আর সেটাই হল তাঁর সবচেয়ে বড়ো গুন। ঠিক যেমন ড: স্টিভেনসন চিনে নিয়েছেন বিশ্বরূপ বোসকে।
“ইওর কান্ট্রি হ্যাজ আ মাচ মাচ হাইয়ার পোটেনশিয়াল দ্যান মোস্ট অব দা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিজ। বাট দা ল্যাকিং ইজ ইন দা ওয়ে অব এক্সিকিউশন।”, ড: স্টিভেনসন বলেন, “বাট আই বিলিভ, আ লিটল্ হেল্প ইজ অল ইউ নিড টু শো দা ওয়ার্ল্ড হোয়াট ইউ আর ক্যাপাবেল অব।”
একদিন যেমন বললেন, “ডু ইউ নো প্রফেসর, হোয়াই আই রেসপেক্ট ইয়োর কান্ট্রি সো মাচ?”
“হোয়াই?”
“বিকজ আই স্পেন্ট থ্রি ইয়ারস অব মাই লাইফ ইন ইন্ডিয়া। আই কমপ্লিটেড মাই গ্ৰ্যাজুয়েশন্ ফ্রম ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট। ফ্রম দ্যাট টাইম আই থট সামডে ইফ আই হ্যাড আ চান্স টু ডু সামথিং ফর দা পিপল অব দিস কান্ট্রি। দিস ইজ দা চান্স, প্রফেসর। দিস ইজ দা চান্স।”
ড: বোসের সাথে কাজ করার মজাটা হল কাজের চাপটা কখনোই ফিল করা যায়না। এই বয়সেও তাঁর ভেতরকার যে প্রচণ্ড এনার্জি আর প্যাশন, সেটা পাশের লোকটার ভেতরেও খুব দক্ষতার সাথে পুড়ে দিতে পারতেন ভদ্রলোক। ঠিক যেমন পুড়ে দিয়েছেন তমালের ভেতরেও।
তমালের দায়িত্ব পড়েছে ভয়েস রিকগনিশন আর স্পীচ ডেভলপমেন্টের। ড: বোস বলেছেন, “আমরা ম্যালকম রোবোসে যে স্পীচ সিন্থেসাইজার টেকনোলজি ইউজ করব তা হবে আগের চেয়ে ঢের উন্নত। কারণ অন্যান্য ভয়েস পাওয়ার্ড মেশিনারিগুলোয় যে ওয়েব সার্ভিস ইউজ হয় তার নেটওয়ার্ক স্পীড ডিপেন্ড করে সেখানকার লোকাল ওয়াই-ফাইয়ের ডেটা স্পীডের ওপর। কিন্তু ম্যালকম রোবোসে সেই ঝামেলা নেই। এর মধ্যেই থাকবে ইন-বিল্ড রাউটার যেটা কাজ করবে ফাস্টেস্ট এইট জি কানেকশনের মাধ্যমে।”
“এইট জি!”
“হ্যাঁ, এইট জি। ভাবো তমাল যেখানে গোটা পৃথিবী এখনো যেখানে ফাইভ জির ব্যবহারই শুরু করতে পারেনি ঠিক করে, সেখানে আমাদের রোবট ইউজ করবে এইট জি টেকনোলজি! তার রেসপন্স হবে অনেক স্মুথ। স্পেশাল স্পীচ সিন্থেসাইজারের জন্য তার গলাও হবে একদম মানুষের মতই। মানে সিরি কিংবা অ্যালেক্সার মতন এক্ষেত্রে রোবটের সাথে কথা বলবার মতন ফিলিংসও হবে না।”
“কিন্তু স্যার এসবের জন্য তো খরচাও অনেকখানি…”
“না তমাল। খরচ এর জন্য মোটেও বাড়বে না। বরং আমার স্পেশালি ডিজাইনড প্রসেসরের জন্য এর দাম হবে এখনকার একটা দামী স্মার্টফোনেরও অর্ধেক! এই প্রসেসর আমি নিজের ল্যাবরেটরিতে বানিয়েছি গত পনেরো বছর ধরে। পৃথিবীতে এমন আর কোনও বিজ্ঞানী নেই যে আমার সাহায্য ছাড়া এই প্রসেসর বানাতে পারে।”
ড: বোস তার ল্যাবের আলমারি খুলে একটা বড় কাগজ বের করে তমালের হাতে দিলেন। রোল করা কাগজটা খুলে তমাল দেখল তাতে স্যারের হাতে আঁকা একটা নকশা। হঠাৎ দেখলে এল ডোরাডোর ম্যাপ বলে ভুল হতে পারে। তবে তমাল বুঝল এটাই ম্যালকম রোবোসের ডিজাইন।
ড: বোস বললেন, “অনেকদিন হল এই ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি’র লেবেলটা গায়ে সেঁটে আছে। এবার অন্তত পৃথিবী জানুক আমরা কি পারি!”
স্যারের সাথে হাত মিলিয়ে আলোর গতিতে এগোচ্ছিল ম্যালকম রোবোসের কাজ। কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যেও তমাল কিছুতেই ভুলতে পারছিল না সেই বন্ধ ঘরটার কথা। এই ক’দিনে তমালের সঙ্গে স্যারের সম্পর্কটা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। কাজের বাইরেও অনেকরকম গল্প করেন স্যার, অনেক ব্যক্তিগত গল্পও। খানিক সেই সাহসেই একদিন জিজ্ঞেস করে বসল তমাল, “ঘরখানা কখনও খোলেন না কেন স্যার?”
“কে বলেছে খুলি না? খুলি তো মাঝে মাঝেই।”
“খোলেন! সত্যি খোলেন! কই, আমি দেখিনি তো কোনওদিন?”
তমালের দিকে কিছুক্ষন স্থির চেয়ে ড: বোস শুধু বললেন, “দেখবার যে এখনও সময় আসেনি।”
সময় এল সাতটা মাস পর। সেদিন তারিখটা ছিল চোদ্দোই নভেম্বর। কাজ প্রায় শেষের দিকেই, আর বড়োজোর হপ্তা দুয়েক। তা সকালবেলা দশটার মধ্যেই স্যারের বাড়ির বেল বাজল তমাল। এরপর স্যার আসবেন, দরজা খুলবেন। একটা কথাও বলবেন না। প্রথম কথাটা হবে একদম ল্যাবে গিয়ে। এই কয়েকমাসে এইটাই যেন রুটিন হয়ে গেছিল তমালের। কিন্তু সেইদিন রুটিনমাফিক চলছিল না কোনোকিছুই। বেলটা দ্বিতীয়বারের জন্য বাজাতে গিয়েই তমাল আবিষ্কার করল দরজাটা বন্ধ নেই মোটেই। হালকা ধাক্কায় দরজাখানা খুলে তমাল ওপরে এল। গোটা বাড়িটাই অদ্ভুত রকমের নিস্তব্দ আজ। বারকয়েক ‘স্যার- স্যার-‘ বলে ডেকেও কোনও ফল পাওয়া গেলনা। তমাল সময় নষ্ট না করে চলে এল ল্যাবের ভেতর। না, ল্যাবেও কোনও লোকের চিহ্ন নেই। কালকে সব জিনিস যেখানে যেমন দেখে গেছিল তমাল আজও সব ঠিক সেখানেই পড়ে আছে। তফাত বলতে শুধু উল্টো দিকের বন্ধ দরজাটা আজ খোলা। যেন তমালের জন্যই কেউ অপেক্ষা করছে ওই ঘরের ভেতরে! তমাল ওই ঘরের দিকে এগোল। ঘরটায় ঢুকতেই তমাল বুঝল এই ঘরটাও ফাঁকা, ঠিক অন্যগুলোর মতই। আশ্চর্য তো, বেমালুম উবে গেলেন নাকি ভদ্রলোক!
এই ঘরখানা বাকি ঘরগুলোর চেয়ে বেশ খানিকটা বড়ো। গোটা ঘরেই ইতিউতি জিনিস ছড়ানো। জিনিস মানে গবেষণার জিনিসপত্র আর কি। বিভিন্ন ছোট বড়ো যন্ত্রপাতি পুরো ঘরটাকেই জুড়ে রেখেছে। তার মধ্যে কয়েকটাকে চিনতে পারল তমাল, বেশিরভাগটাই পারলনা। তবে এই সবকটার মধ্যে কোনার দিকের একটা বেঢপ বস্তুতে চোখ আটকাল তমালের। কাছে যেতেই বুঝল ওটা একটা ছোটখাটো ঘরের মতন! মোটামুটি সাইজের একটা লোক তাতে ঢুকে যেতে পারে অনায়াসে। আর ঠিক সেই যন্ত্রটির পাশেই পড়ে রয়েছে একটা ভাঁজ করা কাগজের টুকরো!
“তমাল,
তোমাকে এই চিঠিটা পড়তে হচ্ছে কারণ আমার মুখ থেকে সব কথা যে শুনতে পাবে এমন আশা আর প্রায় নেইই বলতে পারো। ‘কেন নেই’ সে প্রশ্নের জবাব দেবার আগে বরং কথাগুলো খুলে বলি। সেই প্রথম দিন থেকেই এই বন্ধ ঘরখানা নিয়ে তোমার কৌতুহলটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তবে তখন এই ব্যাপারে কিছু বলিনি কারণ বলাটা সম্ভব ছিল না। আসলে ব্যাপারটা হল বাইরের ওই সতেরোখানা ল্যাবে গাদাখানেক আবিষ্কারের আড়ালে এই বন্ধ ঘরটায় আমি তখন আরেকটা আবিষ্কারের পেছনে ছুটছিলাম। এমন একটা আবিষ্কার যার খবর কোনও তমাল বারুজ্জে, স্টিভেনসন কিংবা বি.সি.সির রিপোর্টে পাওয়া যাবেনা। এমন একটা আবিষ্কার যেটা আমার একদম নিজের, এক্কেবারে ব্যক্তিগত। টানা পনেরো বছর ধরে একটানা গবেষণা করে আমি শুধু ম্যালকম রোবোসের প্রসেসরই বানাইনি তমাল, বানিয়ে ফেলেছি বিশ্বের প্রথম টাইম মেশিন, কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীগুলোর সবচেয়ে ওভার-রেটেড ইনভেনসন!
তুমি হয়তো ভাবছো এমন একটা আবিষ্কার আমি সবার চোখের আড়ালে করলাম কেন। করলাম কারণ জীবনে এই প্রথমবারের জন্য আমি আমার সফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম গবেষণায় সফল হলে তবেই আমার এই আবিষ্কার মানুষের সামনে নিয়ে আসব। অবশেষে কাল আমার সেই আবিষ্কারের কাজ শেষ হল। ‘সফল’ কিনা যাচাই করতে তাই নিজেই ঢুকে বসলাম এর কামরাখানায়। অবাক কান্ড তমাল, সত্যি সত্যি যন্ত্রখানা কাজ করছে যে! ভবিষ্যতের প্রতি লোভ আমার চিরকালের। তাই মেশিনটায় চড়েই পাড়ি দিলাম তিন হাজার সালে! কি অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে এখানে জানো সব! গাছপালা নেই, জল নেই, খোলা মাঠ নেই। খালি বড়ো বড়ো বাড়ি, বিল্ডিং এইসব। ইন্ডিয়া ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি বনে গেছে অনেককাল। জনসংখ্যাও বেড়ে গেছে বিশাল। চারদিকে শুধু গিজগিজ করছে মানুষ। আমি তো ভাবছি গাছপালা, জল এসব ছাড়া এত মানুষ বাঁচছে কি করে! তা অনেক চেষ্টা করার পর অবশেষে বুঝতে পারলাম এই যে চারদিকে এত লোক তাদের মধ্যে নিরানববই শতাংশই মানুষ নয়, রোবট। আর সে কিন্তু যে সে রোবট নয়, স্বয়ং ড: বিশ্বরূপ বোসের নিজের তৈরি ম্যালকম রোবোস! নেহাত আমারই হাতের তৈরি জিনিস। নয়ত মানুষের সঙ্গে এদের তফাত করা অন্যকারোর সাধ্যে কুলোবে না!
এখন এই গ্রহে সব কিছু এই রোবটরাই চালায় জানো। প্রায় সব রোগের ওষুধই বেরিয়ে গেছে এখন। কিন্তু মেডিক্যাল কোম্পানিগুলো সামান্য ওষুধের দামও রেখেছে আকাশছোঁয়া। সাধারণ লোকগুলো তাই মারা যাচ্ছে একটু রোগ হলেই! কয়েকজন মুষ্টিমেয় বিত্তশালী নিজেদের হাতে জমিয়ে রেখে জল, খাদ্য সবকিছুরই কৃত্রিম অভাব তৈরি করে দাম বাড়িয়ে রেখেছে।
সাধারণ মানুষ তাই বেশিরভাগই হয় খেতে না পেয়ে নয়তো রোগে ভুগে মারা গেছে, গুটিকতক ধনকুবের ছাড়া। এতে ওদের অনেক সুবিধে। যেটুকু জল,খাদ্য এখনও বেঁচে রয়েছে তাতে এই ক’জন মানুষের আরও বেশ কয়েক বছর দিব্যি চলে যাবে। নিজেদের সমস্ত কাজই এরা করায় ওই রোবটদের দিয়ে। রোবটদের যে ওষুধ, খাওয়া পরারও দরকার হয়না…।
ভাবো তমাল, যে আমি কিনা সারাটা জীবন গরীব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ভেবে এসেছি, শেষ পর্যন্ত সেই আমারই একটা আবিষ্কারের জন্য কিনা একটা গোটা প্রজাতি ধ্বংসের মুখে! সেই মুহূর্তেই ঠিক করে ফেললাম ম্যালকম রোবোস তৈরি হবেনা। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে নয়। তাই আমার এই ইচ্ছেটা যে তোমাকে পূরণ করতেই হবে তমাল। আমার বানানো ওই প্রসেসরটা তুমি নষ্ট করে দাও, আর সার্কিট ডিজাইনের কাগজটাও পুড়িয়ে ফেল। স্টিভেনসনকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বল। সে ভালো মানুষ। তোমার কথা সে ঠিক বুঝবে। আর সাথে সাথে এই টাইম মেশিনটাও নষ্ট করে দিও। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই টাইম মেশিনটাও।
জীবনের এই প্রথমবারের জন্য আমি গবেষণায় বিফল হয়েছি তমাল। প্রকৃতির নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে এই যন্ত্রটা বানিয়েছিলাম। এতে চেপে ভবিষ্যত তো আমি এসে পড়েছি, কিন্তু আবার হাজার বছর অতীতে গিয়ে পুরোনো সময়ে ফিরতে পারিনি! গ্ৰ্যান্ডফাদার প্যারাডক্স মিথ্যে নয় তমাল। কোনোভাবে ভবিষ্যতে পৌঁছতে পারলেও অতীতে যাওয়া মানুষের পক্ষে কোনওদিনই সম্ভব নয়!
আর মজাটা কি জানো এই তিন হাজার সালেও আমি বেশিদিন থাকতে পারবো না। এখানে আমার আয়ু মাত্র ষাট দিন, আর আমার এই ষাট দিন তোমার কাছে মাত্র বিশ ঘণ্টার সমান! সম্পর্কটা অনেকটা তোমার ওখানকার টাকা আর ডলারের মতন, না? ‘তোমার ওখানকার’ বলছি কারণ এখানে এখন আড়াই ডলার সমান এক টাকা!
তোমার শেষ একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ করি। তুমি ভাবছো এই চিঠিখানা এখানে এল কেমন করে, তাই তো? আসলে আমি এখন তোমার ওখানেই রয়েছি। ঠিক তোমার পাশে। আমি রয়েছি ক্রুশ-বিদ্ধ যীশুর সামনে, রয়েছি দুটো ল্যাপটপের মধ্যে হওয়া বিশ্বযুদ্ধের সামনে! আমাকেই মাঝখানে রেখে ঘুরছে ইলেকট্রন আর বার্নার্ড’স স্টার! আমি দেখতে পাচ্ছি একটা মেটিরয়েডের ধাক্কায় কেমন সূর্যের গা থেকে একটা ছোট টুকরো ছিটকে গিয়ে প্রাণ সৃষ্টি করল, আমি দেখতে পাচ্ছি ওই সূর্যটাই কেমন করে বড়ো হতে হতে নীল গ্রহটাকে গিলে ফেলল…!
আসলে আমি স্পেস টাইমের মাঝখানে আটকে পড়েছি তমাল। ডার্ক ম্যাটারের একটা ছোট কণার মত এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিতে আমিও থেকে গেলাম। এমনটাই তো আমি চেয়ে এসেছি চিরকাল, তাই না তমাল? এমনটাই তো আমি চেয়েছিলাম। তবু কেন যে বুকের বাঁদিকটা এমন চিনচিন করছে!”
লেখক পরিচিতি :দেবোত্তম ঘোষ, ১৯ বছর, হরিদ্রডাঙ্গা, চন্দননগর, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ ।।শ্রীরামপুর কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত অনার্সের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো লাগে আঁকা, লেখা আর সিনেমা। সম্প্রতি নিজের প্রথম শর্ট ফিল্মের কাজও শেষ হয়েছে।