নদীর ঘাটটা পার হতেই সন্ধ্যে নেমে এলো।আমার বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় একটা ঘন জঙ্গল পার হতে হয়।জঙ্গলের পরে সাঁওতাল পল্লী, তারপর আমাদের এই ফলকনামা গ্রাম।অনেকদিন গ্রামের বাড়িতে আসা হয়ে ওঠেনি।বৃদ্ধা মা বয়েসের ভারে কোনভাবে বেঁচে আছেন।মা’কে দেখতেই এবারের আসা।
আকাশ ক্রমশ মেঘলা হচ্ছে, বৃষ্টি আসবে বোধহয়। তালগাছ ঘেরা বেহুলা পুকুরটার কাছে গোলাপি কাকিমার সাথে দেখা হয়ে গেল।গোলগাল চেহারায় এখনো ভীষন সুন্দরী।
কাকিমাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো- না রে বাবা,দুপুরের বাসনগুলো মাজামাজিতে একটু দেরী হয়ে গেছে ।এঁটো বাসন তাই আর ফেলে রাখিনি। তা এতদিন বাদে আমাদের কথা মনে পড়লো তাহলে?
আমি বললাম- না কাকিমা, প্রাইভেট চাকরি, ছুটি চাইলে চাকরি খেয়ে নেবার ভয় দেখায়। তবে তুমি আরো সকাল সকাল পুকুরঘাটের কাজ সেরে ফেলবে কেমন? দিনকাল ভালো নয়।
কাকিমা শুধু একগাল হাসলেন।আমি তার হাত থেকে বাসনগুলো নিতে চাইলাম, কিছুতেই আমাকে নিতে দিলেন না।
গতবছর যখন এসেছিলাম তখন কাকিমা বলেছিলেন পরেরবার আসার সময় যেন তার জন্য একটা গন্ধ সাবান নিয়ে আসি।
আমি বেশ কয়েক রকমের গন্ধসাবান কাকিমার জন্য নিয়ে এসেছি।
কাকিমাকে সেকথা বললাম।উত্তরে আমাকে বললেন -বাবা,এই তালটা বাড়ি নিয়ে যেও।এক্ষুনি গাছের নীচে পেলাম।
আমি বললাম- আচ্ছা।
জোড়াসাঁকোর মেয়ে এই গোলাপি কাকিমা।কপালদোষে এখানে আসা।
কাকা কফিহাউসে বয়ের কাজ করতেন, সেই থেকে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, বিয়ে।গ্রামে কিছুতেই কাকি মন বসাতে পারেনি।বাপের বাড়ির সবাই গত হওয়ায় সেখানেও যেতে পারেনি সে।অগত্যা এই গ্রামেই থেকে যেতে হয়েছিল।
চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।গ্রামের দু’একটা বাড়িতে সন্ধ্যাবাতি দেখা যাচ্ছে। আর একটু গেলেই আমাদের বাড়ি। কাকিমা আমাকে বললেন- তুই বাড়ি যা!আমি রেশমার সাথে একটা ছোট্ট কাজ সেরে বাড়ি যাব।
আমাদের বাড়ির ডানদিকের রাস্তা দিয়ে কিছুটা গেলেই  গোলাপি কাকির বাড়ি।
আমি বললাম- আচ্ছা।
আমি যখন বাড়ি ঢুকবো ঢুকবো করছি সে সময় নামলো মুষলধারে বৃষ্টি।
এই একবছরে চালের খড় আর চালে নেই।বাইরের মাটির উনুনে বৃষ্টির জল থৈথৈ করছে। মা বলে ডাক দিতেই আমার ছোটভাইবৌ দীপালি কাঁচ ভাঙ্গা লন্ঠনটা নিয়ে পশ্চিম ঘরের বারান্দায় বেড়িয়ে এলো। হাওয়ায় বাতিটা মাঝে মাঝে নিভে যাওয়ার জোগাড়।
এরপর আসার সময় অন্তত দু’টা হ্যারিকেন আনতেই হবে।হ্যারিকেনগুলোর যা অবস্থা….।
আমার ছোটভাই অমূল্যচরণ খালি গা, ছেঁড়া লুঙ্গিটা গুটাতে গুটাতে বলল- আমি তো নদীর ঘাটে গিয়েছিলাম তোর জন্য।আব্দুলচাচা বললো সে নাকি তোকে আগের ট্রিপেই এপারে দিয়ে গেছে।আমি বাড়ি ফিরে দেখি তুই আসিসনি ভীষন দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। যাক সেসব, মাথা মুছে নিয়ে গুড় মুড়ি খেয়ে নে।
রাতে আমাদের ছোট বৌ চেলা মাছের ঝোল ঝিঙ্গে দিয়ে এত সুন্দর রেঁধেছিল যে কি বলবো।অনেকটা ভাত আমি একাই খেয়ে ফেলেছি।ছোট ভাই অমূল্যচরণ আমি আসবো শুনে নদী থেকে মাছ ধরে রেখেছিল।
মা’র সাথে কুপির আলোতে গল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল।
মায়ের বাতের ব্যথাটা আবার বেড়েছে দিনকয় হলো।মায়ের জন্য আনা একটা বিছানার চাদর আর একটা শাড়ি হাতে দিয়ে বললাম আজ বেহুলা পুকুর পাড়ে গোলাপি কাকির সাথে দেখা হয়েছিল,
চেহারাটা অনেকটা ভেঙ্গে গেছে মা।কাকিমা কিন্তু আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে।একটা তালও আমায় দিয়েছে খাওয়ার জন্য।
মা কথাটা শুনেই ছোট বৌ’মাকে ডেকে বললেন- ও বৌ কচু পাতায় কইরা জল লইয়্যা আয়ছে ত্বরা কইরা!
মা’কে বললাম- কচু পাতার জল খামু ক্যান মা।আইজ খাওয়োন লাগে নাহি।
মা বললেন- তর লগে গুলাপির দেখা হইছে কইলি না? হায় মরন কি সব্বোনাশ হইলো গো!
তর লগে হের দেখা হইবো কি কইরা।
গুলাপি না পরশু রাইতে খুন হইছে।
আমার মাথায় একঝলক বিদ্যুৎ চমকে গেল।তবে আমি কাকে দেখেছি?
সারাটা রাত কাকিমার কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।
দাঁতন গাছের ডাল ভাঙতে গিয়ে একটা সোরগোল শুনতে পেয়ে অমূল্যচরণকে জিজ্ঞেস করলাম।সে আমায় বললো- ঐ যে রে ওপাড়ার রেশমা’কে কে বা কারা কাল রাতে খুন করে গেছে।
-খুন!!!
এক’পা দু’পা করে রেশমাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখলাম মাটির উঠোনে মেয়েটির লাশটা পড়ে আছে। ধস্তাধস্তির চিহ্ন সারাটা শরীরে।ঘাড়ের পিছনে বিশাল ক্ষত।দেখলে মনে হয় কেউ বা কারা যেন পিছনটা চিবিয়ে খেয়েছে। আমার চোখ পড়লো পাশে পড়ে থাকা বাসন গুলোর দিকে।এসব তো কাল সন্ধ্যায় গোলাপি কাকিমার কাছে দেখেছিলাম।কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ফিরে এলাম।তবে কি……কাকিমাই…..
রেশমার সাথে এই হত্যাই কি তবে কাকিমার একটা ছোট্ট কাজ ছিলো?
মা’য়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম কাকিমাকে নাকি রেশমাই খুন করিয়েছিলো।কাকার সাথে একটা অবৈধ প্রেমের জেরেই নাকি রেশমা কাকিমাকে গোপনে খুন  করিয়েছিলো?
বিশ্বাস না হলেও অবিশ্বাসই বা করি কিভাবে।তবে কি এ সবকিছুই বিদেহী আত্মার প্রতিশোধ???
আজও বিশ্বাস করতে পারিনা এমন সত্যি ঘটনা কি সত্যি ঘটে??


কলমে তুহিন কুমার চন্দ, উত্তর দিনাজপুর (প.ব.)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here