কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় সেই ভয়ঙ্কর আওয়াজ

কলমে ঐশ্বর্য্য কর্মকার

0
636

সময়টা ২০০২ বা ২০০৩ হবে। তখন ইনভার্টারএর প্রচলন হয়নি। কারেন্ট চলে গেলে মোমবাতির আলোতে পড়তে হতো। বাড়িতে হারিকেন ছিল বটে , তবে মা ওটা খুব একটা ব্যবহার করতেন না। সন্ধেবেলা যখনই মা পড়াতে বসতেন তখনি প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে লোডশেডিং হতো। আর আমরা ও ওই সময়টার জন্য অপেক্ষা করতাম।

বাস্ , লোডশেডিং ও শুরু আর আমাদের খেলাও শুরু। তবে এই খেলার সুযোগ খুব কমই আস্ত। কারণ মা তবুও মোমবাতির আলোতে পড়তে বসাতেন। যেদিন ওই ছুটিটা পেতাম , সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতাম আমাদের সামনের বাড়িতে। আমার দুই খেলার বন্ধু থাকতো। কত গল্প করতাম। য় গানের লড়াই থেকে শুরু করে বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিনা চলত | মাঝে মাঝে কিছু মনের কথা আদান প্রদান, ভবিষ্যতের অলীক কল্পনা | কি না থাকত সেখানে | মোটকথা নির্ভেজাল একটা আড্ডা | একইভাবে পাড়ার মোড়ে মোড়ে, বা বাড়ির পুলের সামনে এরকম আড্ডা জমে উঠত লোডশেডিংকে কেন্দ্র করে |

আর গরম হলেই শুরু হতো কালবৈশাখী। আমার জীবনে কালবৈশাখী আর লোডশেডিং -এই যুগলের অনেক স্মৃতি আছে। তারই মধ্যে আজ একটা স্মৃতির কথা কথা বলি। ছোটখাটো সেই স্মৃতিগুলো যখন মনে পড়ে, তখন ভাবতে বেশ ভালোই লাগে।

একদিন বাড়িতে মা নেই। শুধু আমি আর আমার ভাই। সামনের বাড়িতেও আমার বন্ধু রিন্তি আর বিন্তি একা। লোডশেডিং হয়ে গেছে। কিছু ক্ষণ পর শুরু হয়েছে ঝোড়ো হাওয়া। আমরা তিন জন মিলে ঠিক করলাম সামনের মাঠে যে আম গাছ আছে সেখান থেকে আম পাড়তে যাবো। তার আগে অবশ্য বাবাদের কাছে থেকে আমরা শুনে নিয়েছি যে তাঁরা ও ছোটবেলা ঝড়ের মধ্যে আম পাড়তে যেত , বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলতো। সেই সব গল্প থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে ঠিক করলাম ছেলেরা যদি আম পাড়তে পারে , মেয়েরা কেন নয়।

ভাই তখন ছোট , আমরা প্রথমে ওকে বাদ দিয়ে দিলেও এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়ার ভয়ে ওকেও নিলাম। কারণ পরে বকা খেলে ওই বা কেন বাদ যাবে।

একটা চার্জার লাইট নিয়ে ঝড়ের মধ্যে গেলাম মাঠে। গাছে আমরা কেউ উঠতে পারিনা। এখন তাহলে কি করা যাবে ? নিয়ে আসা হলে চেয়ার। সেটা দিয়েও আম গুলো কে বাগে আনা গেলো না। এবার বিন্তি বললো ” যা রান্নাঘর থেকে পিঁড়ি নিয়ে আসা হোক “। ভাই ছোট , তাই আদেশ ওকেই করা হলো। চেয়ারের উপর পিঁড়ি দিয়ে রিন্তি উঠলো। আম গাছের উচ্চতা কম থাকায় ৫ -৬ তা আম হাতের নাগালে পেয়ে গেলাম।

এদিকে হাওয়ার বেগ ক্রমশ বাড়ছে। আম গুলো পকেটের মধ্যে নিয়ে যখন বিন্তি নামলো তক্ষনি পাশ থেকে কে যেন বললো ” এই আমাকে ও নিয়ে চল “। এই আওয়াজ দু তিনবার কানে এলো। আমরা চারিপাশে দেখলাম কেউ নেই। আমাদের মধ্যে রিন্তি একটু সাহসী ছিল। ও এই সবের মধ্যে পিঁড়ি হাতে নিয়েছে , আমাকে বলেছে চেয়ার ধরতে। তখন কি আর কথা কানে যায় …….

হতভম্বের মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর সম্বিৎ ফিরতে আমরা যেই পিছুঁ ফিরেছি , সেই কেমন একটা গলাতে আওয়াজ ” এই তোরা চলে যাচ্ছিস কেন ? নিয়ে যা আমাকে।”

এইসব শুনে দে ছুট। বাড়িতে এসে চারজনে একজায়গায় বসে। কেউ কারোর সাথে কথা বলছে না। কিছু ক্ষণ পর মায়েরা এলো। আমরা কিছুই বললাম না। আম গুলো সেই দৌড়ের সময়ে কোথায় পড়েছিল কে জানে। সারারাত আমাদের ঘুম এলো না। পরের দিন স্কুলে গেলাম। আমাদের কিছু বিজ্ঞ বন্ধুদের এই ঘটনা শোনাতে তারা আরো দশটা ভূতের অভিজ্ঞতা বা গল্প বললো।

সেই শুনে আমাদের আরো তিন রাত ঘুম এলো না। উঠছি বসছি – সব কিছুতেই ওই এক আওয়াজ কানে আসছে।

কিছুদিন পর সেই ভয়টা কেটে গেলো। তবে আমরা ওই মাঠের ধার দিয়ে যাতায়াত করতাম প্রাণ হাতে করে।

দেখতে দেখতে এতো গুলো বছর চলে গেলো। আমাদের ছোটবেলার ওই আম গাছটা এখন নেই। মাঠটাতে এখন সকাল সন্ধ্যা ক্রিকেট টেনিস খেলা হয়। মাঠের যে জায়গায় আমগাছ ছিল , সেখানে বাড়িও হয়েছে একটা। পুরোনো কথা মনে পড়লেই আমাদের এখন মনে হয় নিশ্চয়ই কেউ আড্ডা মেরেছিল। এখন আম চুরির পাঠ প্রায় বিলুপ্ত। লোডশেডিং হলেও বাড়িতে ইনভার্টার আছে। আর কালবৈশাখী হলে এই গরমে বেশ আরাম লাগে। দিনের সাথে সাথে সেই অনুভূতিগুলো ও পাল্টে গেছে।

কিছু কিছু ভালো লাগা ভালো অনুভূতিগুলো প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছে।

কলমে ঐশ্বর্য্য কর্মকার, রানাঘাট, নদীয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here