আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চারদিকে শোঁ-শোঁ শব্দে ঠান্ডা বাতাস বইছে। এ বাতাস আমাদের সবারই খুব পরিচিত, বৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তের বাতাস। মোতায়ের আহমেদ অফিস রুমে বসে আছেন। খোলা জানলা দিয়ে বাতাস ডুকে পুরো রুমটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। মোতায়ের আহমেদ চেয়ার থেকে উঠে ফ্যানের সুইচটা বন্ধ করে দিয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গুটি গুটি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির তুলনায় মেঘের গর্জন বেশি।
এলোমেলো বাতাসের সাথে বৃষ্টিও বাড়তে শুরু করল। বাতাসের সাথে অফিসের সামনের বড় আম গাছটি থেকে আম ঝরে পড়ছে।সৈকত সেগুলো কুড়িয়ে এনে টির্চাস রুমের সামনে একটা বালতিতে রাখছে। সৈকত এ স্কুলের অবৈতনিক কর্মচারী। আংশিক ভুল বললাম। সে এখানে সম্পূর্ণ অবৈতনিক কর্মচারী নয়। মাস শেষে স্কুলের সব শিক্ষকের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু পরিমাণ পারিশ্রমিক পায়।সেটা নিয়েই সে খুশি। তার কাজ শুধু ঘন্টা বাজানো।প্রত্যেক ক্লাসের শেষে সে ঘন্টা বাজায়।এর বাইরেও তার একটা কাজ আছে, সেটা হচ্ছে সময়ে -অসময়ে মোতায়ের স্যারের জন্য চা নিয়ে যাওয়া।
মোতায়ের স্যার জানলার ফাঁক দিয়ে সৈকতকে চোখের ইশারায় ডাকলেন। এ ইশারা গত কয়েকবছর আগে থেকেই সে খুব ভালো করে বুঝে নিয়েছে। সে স্যারের জন্য চা নিয়ে এলো, সাথে একটা খামও নিয়ে এলো। খামের উপর দশম শ্রেণির সবার পক্ষ থেকে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর নাম।সৈকতের মুখে চিন্তার ভাব। সে খামটি স্যারের টেবিলে রেখে বের হয়ে গেলো। স্যার খাম থেকে কাগজটা বের করে পড়তে শুরু করলেন।শুরতে তিনি ভ্রু কুচকালেন। কিন্তু পুরোটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজসহ খামটি একটি ফাইলে রেখে দিলেন।
ক্লাসের বাকি তিন মিনিট। তিনি তাই রুম থেকে বের হয়ে ক্লাসের দিকে গেলেন।ক্লাসে মাত্র পাঁচজন ছাত্র এক কোণে বসে গল্প করছে।বাকিরা কোথায় গেলো সেটা খামের ভিতর লেখা আছে। স্যারকে দেখে ক্লাসে থাকা পাঁচজন নিজেদের আলোচনা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। রাকিব,মিনার,দাউদ প্রথম টেবিলে এসে বসলো। ফাহিম, আরমান দুই টেবিল পিছনে বসলো। স্যার কোনো কথা বলছেন না, ছাত্ররাও কোনো কথা বলছে না। মনে হচ্ছে নিরব থাকার প্রতিযোগিতা চলছে। প্রায় আট মিনিটের মাথায় স্যার প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে গেলেন। ছাত্রদের জিগ্যেস করলেন-
—তোমাদের ক্লাসের বাকিরা কোথায় গেছে তোমরা জানো?
রাকিব বলল “জ্বি স্যার”
— তোমরা কেনো যাও নাই ?
সবাই একসাথে বলল” স্যার আমাদের যাওয়ার ইচ্ছে ছিলোনা”
যাওয়ার ইচ্ছে যে তাদের ছিলোনা সেটা পুরোপুরি মিথ্যা। তারাও বাকিদের সাথে স্কুল বয়কট করে প্রতিবাদী মানববন্ধনে অংশ নিতে চেয়েছে। কিন্তু ক্লাস টপার রুবেল এ পাঁচজনকে তাদের সাথে অংশ নিতে দেয়নি।কারণটা অবশ্য খুব যুক্তিসংগত। স্কুলে খারাপ ছেলেদের তালিকায় এ পাঁচজনের নাম শীর্ষে আছে। কিন্তু কেনো যে তারা পাঁচজন সবার চোখে এত খারাপ সেটা তারা বুঝে উঠতে পারেনা। ক্লাস টপার রুবেল এবং ক্লাস ক্যাপ্টেন জাহেদ সবার সামনে ঘোষণা দিয়েছিলো “আমরা অপরাধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি,কাজেই আমাদের সাথে কোনো অপরাধী থাকতে পারেনা”।
স্যার ফাহিমকে কাছে ডেকে বললেন “তোমারও বসে না থেকে নিজেদের মতো চেষ্টা করে কিছু একটা কর”। ফাহিম কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। স্যারের হয়তো আরও অনেক কিছু বলার ছিল,কিন্তু বলতে পারেনি। ক্লাস থেকে বের হয়ে তিনি টিচার্স রুমে গেলেন। কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে,কেউ গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ধর্মের শিক্ষক ফজলুল উদ্দিন স্কুলের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক। গত আটাশ বছর ধরে এ স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তার কষ্টটাই সবার থেকে একটু বেশি,চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে যাচ্ছেন অবিরত।
বাইরে পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন পুলিশ নেমে মোতায়ের স্যারের রুমে ঢুকলো। তার আগে অবশ্য দুজন সাংবাদিকও স্যারের রুমে ঢুকেছে। আলোচনা পর্যালোচনা শেষে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনের জন্য একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।
আন্দোলনরত ছাত্রদের সামনে এসে জেলা প্রশাসক সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন “আমরা ইতোমধ্যে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি,কেউ আইনের হাত থেকে বাঁচতে পারবেনা। তোমরা সবাই নিজের ঘরে ফিরে যাও”। জেলা প্রশাসকের এসব পরিচিত কথায় ছাত্ররা সন্তোষ জানলো না। তারা আন্দোলন আরও কঠোর করার হুমকি দিল।শুরুটা জোরালো ভাবে হলেও শেষ পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলো না। বিকেলের দিকে পুলিশের কয়েকটা রাবার বুলেটের শব্দ শোনার পর আর কোনো আন্দোলনকারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সন্ধ্যার সময় ফাহিম আর আরমান টং দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেমন যেনো একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আরমান ফাহিমের কানের কাছে মুখ এনে বলল ” আমাদের কিছু করতে হবে” ফাহিম তার কথায় সম্মতি জানালো। রাকিব,মিনার, দাউদকে কল করে নিয়ে আসলো। স্কুলের পাশে একটা বহুতল ভবনের কাজ চলছে। তারা পাঁচজন মিলে সে ভবনের ছাদে একটা গোপন মিটিং করলো।মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হলো তার গতকালের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করবে। স্কুলে একটা মাত্র সিসি ক্যামেরা,সেটা অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে লাগনো। কে অফিসে ঢুকলো কে বের হলো শুধু সেটা দেখা যায়। এটা দিয়ে পুরো সত্য জানা যাবেনা, কিন্তু মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে। গতকালের ঘটনায় কে কে জড়িত সেটা জানা যাবে।
আদিবার মায়ের বর্ণনা মতে বিকাল চারটা ত্রিশ মিনিটে তার মোবাইলে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। আদিবার মা পরিচয় জানতে চাইলে লোকটি বলে “আমি আদিবার স্কুলের অফিস থেকে বলছি,আদিবাকে শীঘ্রই স্কুলে আসতে হবে। তার এসএসসির প্রবেশপত্রে কিছুটা ভুল হয়েছ”। এ কথা বলে লোকটা ফোন রেখে দিল।আদিবার মা তাকে বিষয়টি জানালে সে কয়েকমিনিট পরই স্কুলের দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। তার বাসা থেকে স্কুলে আসতে বারো-তেরো মিনিট সময় লাগে। সে হিসেবে বিকাল পাঁচটার কাছাকাছি সময়ে সে স্কুলে পৌঁছানোর কথা।
সন্ধ্যায় আদিবাদের পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। অন্যদের পাশাপাশি ফহিম,রাকিব,আরমান, মিনার, দাউদও আদিবার লাশ দাফন করে ফিরতেছে।তাদের চোখে জল, মুখে ঘৃণার আগুন।পাঁচজন মিলে ঠিক করলো তারা আদিবার ধর্ষককে খুঁজে চিহ্নিত করে নিজেরাই শাস্তি দিবে। তাদের ধারণা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ শুরু হতে হতে অন্য কোনো মেয়ে এ ধর্ষকের শিকারে পরিণত হবে।
রাত এগারোটার দিকে তারা স্কুলের দেয়াল টপকে স্কুলে ডুকলো। টিমলিডার ফাহিম তাদের পরিকল্পনা শেষবারের জন্য সবাই বলে নিচ্ছে, ” প্রথমে আমরা অফিসের পিছনের দিক দিয়ে একতলার ছাদে উঠবো। সেখান থেকে দ্বিতীয় তলার ছাদে। তারপর অফিস রুমে ডুকে সিসিটিভি ফুটেজ বের করবো”। অফিস বিল্ডিংটা একপাশে একতলা অন্যপাশে দুইতলা। পরিকল্পনা মতো সবাই খুব সহজেই জানলার সেল ধরে প্রথমে সেলে এবং সেখান থেকে ছাদে উঠলো। সেখান থেকে দ্বিতীয়তলার ছাদে উঠতে তাদের কষ্ট করতে হলোনা। ছাদে থাকা মই দিয়ে তারা উপরে উঠে গেলো।দুতলার ছাদের দরজাটা সামান্য একটু ভাঙা তাই বন্ধ করা যায়না। দরজা ঠেলে তারা চারজন ভিতরে ডুকলো। একজন ছাদে রইলো নজরদারির জন্য। বাকি চারজন পা টিপে টিপে অফিস রুমে ডুকলো। কিন্তু ভিতরে কিছুই নেই। সিসিটিভির সব জিনিস উধাও। ফাহিম জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, ক্যামেরা টাও নেই। ক্যামেরাটা গতরাত থেকেই নেই।সেটা অবশ্য তারা খেয়াল করেনি। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার একটা অংশ হিসেবে সেটা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। মনে হচ্ছে ঘটনার সাথে স্কুলের ক্ষমতাধর কারও যোগসূত্র আছে। হতাশ হয়ে তারা অফিস থেকে বের হয়ে ছাদে চলে এলো। একতলা থেকে জানলার সেল, সেখান থেকে মাটিতে লাফ। দাউদ সবার প্রথমে লাফ দিলো। তার পা মাটিতে না পড়ে একটা লাশের উপর পড়লো। তার উচিৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করা। কিন্তু সে সাহস আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো। সে আস্তে আস্তে শব্দ করে টিম মেম্বারদের ডাকলো। সবাই নিচে নেমে এসেছে। লাশটা উল্টে আছে। সবাই মিলে সোজা করলো। সর্বনাস! সৈকতের লাশ, লাশের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তারা লাশটা সেখানেই রেখে চলে এলো। আসার পথে একটা রক্তমাখা কলম ফেলো।স্কুলের নাম খচিত বিশেষ কলম। সাধারণত এ কলমগুলো স্কুলের স্যার এবং পুরস্কার সূচক ক্লাস টপারদের কাছে থাকে। সম্ভবত এ কলম দিয়েই সৈকতের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে।
স্কুলের রাতের পাহারাদার পলাশ। কোনোমতে লাশটা তার চোখে পড়ে। ভীতু পলাশ তখন চিৎকার দিয়ে মোতায়ের স্যারের বাসার দিকে ছুটে যায়।স্যারের বাসা স্কুল ক্যাম্পাসেই। পলাশ লাশের ব্যাপারে স্যারকে জানালে তিনি স্কুল ক্যাম্পাসে থাকা আরও দুজন স্যারকে ডেকে নিয়ে আসেন।চারজন মিলে লাশের সামনে হাজির হলেন।সবার মুখে চিন্তার ভাব।কি করবে কেউই বুঝতেছে না।চারজন মিলে লাশটা স্কুলের অফিসের সামনে নিয়ে রাখলো। লাশ পাহারার দায়িত্ব পড়লো পলাশের উপর।
মোতায়ের স্যার বাকি দুজন স্যারকে নিয়ে তার বাসায় গেলেন।কিভাবে কি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। গতরাতে একটা ধর্ষণ আর আজকে রাতে একটা খুন। স্কুল তো বন্ধ হয়ে যাবে। এমন কিছু করতে হবে যেনো দুটো ঘটনা একসাথে চাপা পড়ে যায়।দুই ঘন্টার আলোচনা পর্যালোচনা শেষে স্যাররা সিদ্ধান্ত নিলেন সৈকতের লাশটাকে ধর্ষকের লাশ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দুটো ঘটনা একসাথে চাপা দিবেন।
সিদ্ধান্ত মতো কাজ হলো। পরদিন খুব ভোরেই মোতায়ের স্যার একটা বিবৃতি দিলেন, বললেন “গতকাল রাতে কোনো একদল আগন্তুক এসে আদিবার ধর্ষকে হত্যা করে গেছে “। মুহূর্তেই সংবাদটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সংবাদ মাধ্যমেও প্রচারিত হলো। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেলো। ছাত্ররা স্কুলে ফিরে এলো।
একটা খুনের নাটক দিয়ে ধর্ষনের ঘটনা চাপা দেওয়া হলো।ধর্ষক বেঁচে রইলো।নতুন শিকার খুঁজতে লাগলো। সত্য আবৃত থেকে গেলো।।
কলমে শাহরিয়ার হোসেন ভুবন, মজলিসপুর, ফেনী