অসহায়

1
717
আমি তুতাই। আমার মা সেই ভোরবেলা বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত নটা। সারাদিন বাড়ীর হাজার ঝক্কি,  বাবার অফিসের ভাত, মায়ের টিফিন, আমার টিফিন, দাদুর জলখাবার,আমায় রেডী করে স্কুল পাঠানো- সব আম্মা একা হাতে হাসিমুখে সামলাতো। আর দাদু আমাকে স্কুলে আনা নেওয়া,পড়াশুনা দেখিয়ে দেওয়া এসব নিয়েই মেতে থাকতেন। মা লোক রাখার কথা বললে আম্মা বলতো, “লোকের কি দরকার? আমি তো চালিয়ে নিচ্ছি টুকটুক করে!”দাদু ভারী সুন্দর করে ধরে ধরে আমাকে পড়াতেন। মা টিচার রাখার কথা বললে, আমি কেঁদেকেটে বাড়ী মাথায় করতাম। আমি জানতাম, দাদুর মতো করে কেউ আমাকে পড়াতে পারবে না।
             একদিন সকালে আম্মা আর ঘুম থেকে উঠলো না। আর তখনই আমাদের সংসারে নেমে এলো ঘোর অমানিশা! এইবয়সে আম্মার চলে যাওয়াটা ভীষণ রকমের একা করে দিলো দাদুকে! দাদু আমাকে পড়ানো ছেড়ে দিলেন। সারাদিন একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন।
                            আম্মা চলে যাবার পর বাড়ীর কাজগুলোর জন্য লোক রেখে বা আমাকে পড়ানোর জন্য টিচার রেখে সমস্যার সমাধান হলেও আসল সমস্যা শুরু হলো দাদুকে নিয়ে। প্রথম প্রথম আমরা কেউই বুঝিনি সমস্যাটা। পর পর দুসপ্তাহে দাদু দুদিন আমাকে স্কুল থেকে আনতে ভুলে গেলো। আমি যথেষ্ট বড়ো হয়ে গিয়েছিলাম বলে, দারোয়ান কাকুর থেকে পয়সা নিয়ে আমি একাই বাড়ী ফিরেছিলাম। বাড়ী ফিরে প্রথম দিন দাদু কেন আনতে যায়নি জিজ্ঞাসা করাতে, আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিনতো পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে!দাদু আমাকে চিনতেই পারলেন না, সারাদিন কিছু না খেয়ে  মাথা হেঁট করে চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে রইলেন। সে রাতে কিছুতেই দাদুকে খাবার টেবিলে আনা গেলো না।
                    সারাদিন ঘরে-বাইরে সব ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে পোহাতে মা নাজেহাল হয়ে গেলো, তারমধ্যে দাদুর এই সব কিছু ভুলে যাওয়া মাকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিলো! দাদুকে ডাক্তার দেখানো হলে, ডাক্তার বললেন, “দাদুর আ্যলজাইমার হয়েছে, তাই উনি সব ভুলে গেছেন। দাদুর ভালো হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।” কখনো সখনো আমাকে ‘নিজের মা’ ভেবে খাবার চাইতেন। দাদুকে দেখাশোনার জন্য আয়া রাখা হলে,দাদু ওদের কথাও শুনতেন না। ওরাও কয়েকদিন পর পরই কাজ ছেড়ে চলে যেতো।
                        দাদুকে কেন্দ্র করে মা বাবার অশান্তি চরমে উঠলো। রোজ রাতে অশান্তি। একদিন তো বাথরুম থেকে স্নান করে বেরিয়ে, কিছুতেই জামা কাপড় পরবে না দাদু, উলঙ্গ অবস্থায় বসে ছিলো সারাদিন। আমি স্কুল থেকে ফিরে দাদুকে পোষাক পরালাম। সেদিন আয়ার মুখ থেকে সবশুনে মা বাড়ী ফিরে গোঁ ধরলে, কিছুতেই দাদুর সঙ্গে আর এক বাড়ীতে নয়। বাড়ীতে হয় দাদু থাকবে, নয় মা! এমনকি ওই উলঙ্গ বিকৃত পুরুষমানুষের সংস্পর্শে মা আমাকেও থাকতে দিতে নারাজ। সেদিন বাবা হাতের কাছে পড়ে থাকা স্কেলটা তুলে নিয়ে, একলাফে চলে এলো দাদুর ঘরে! স্কেল দিয়ে সেকি এলোপাতাড়ি মার দাদুকে, বাবার মাথায় খুন চেপে গিয়ে ছিলো। পাগলের মতো মারতে মারতে বলছিলো, “মায়ের বদলে তুমি মরলে না কেনো?”
                       আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুকে বুক দিয়ে আগলাতে গিয়ে আমার গিয়েও লেগেছিল ঘা কতক।শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে বাবা সেদিন মেরেছিলো দাদুকে। দাদু কাঁদতে কাঁদতে আমার হাতটা ধরে বলেছিলো, “দেখো না! মা! ওই লোকটা আমাকে মারছে শুধু শুধু। আমি আর দুষ্টুমি করবো না মা। তুমি ওকে বকে দাওনা, মা।”
                    আমি বাবা কে নিরস্ত করে, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বিছানায় চলে গিয়েছিলাম। সে রাতে আমরা কেউই কিছু খাইনি। মাঝরাতে, পা টিপে টিপে দাদুর ঘরে গিয়ে ছিলাম, একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দেবো বলে! লাইটটা জ্বালতেই দাদু আমাকে দেখে, খুব স্বাভাবিকভঙ্গীতে অবিকল আগের দৃষ্টিতে বললেন, “এসো দিদিভাই! আমার হাতটা ধরো তো! আমি নদী পার হবো, একা পারছি না!” আমি এগিয়ে গিয়ে, দাদুর হাতটা ধরতেই, দাদু পরম নির্ভরতার সঙ্গে আমার হাতটা চেপে ধরে চোখটা বুজে-পাড়ি  দিলেন না ফেরার দেশে——!
লেখিকা পরিচিতি: দীপশিখা দত্ত
SOURCEদীপশিখা দত্ত
Previous articleঅঁজিষ্ণু
Next articleসুন্দরবনের পাশে
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here