অপ্রকাশিত

1
1114
দেখো তো কি বৃষ্টিটাই না শুরু হলো! কি করবে নীল দা?- বলল নীলাঞ্জনা। নীল কলেজের সিনিওর, ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর টপার, অসাধারণ গানের গলা, গিটারে; গলার সুরে- কণ্ঠে গোটা কলেজের এক চেনা মুখ; উত্তরে বলল- আর কি করা যাবে, তুমি বরং বসো একটু থামুক বৃষ্টিটা; ততক্ষণ ফোন টোন দেখো; আর কলেজে থেকে তো তোমার বাড়ি বেশি দূর না; আমিও তো ওদিক দিয়েই যাবো ছেড়ে দিয়ে আসবো তোমাকে বাড়িতে। এমন একটা বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যে; এমন একজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে যতটুকুই কাটানো যায়, তাতেই বড্ড প্রশান্তি।
মৃদু হেসে নীলাঞ্জনা বলল- বেশ তাই হবে, একটা গান গাও না শুনি। নীল অতিশয় উপহাসের সাথে বললো আরে শোনো শোনো, এই অধমের গলায় গান শুনে সুন্দর সন্ধ্যেটা স্পয়েল করো না: তার থেকে বরং এই যন্ত্রটায় (ফোন দেখিয়ে) রুপম বা অনুপমের কিছু…… কথা শেষ করতে না দিয়েই নীলাঞ্জনা বেশ অভিমানের সুরেই বলে উঠল – হ্যাঁ আমি কে বলো? আমি কিই বা বুঝবো তোমার গান; বাদ দাও। এগিয়ে এসে নীল বলল আচ্ছা অনেক হয়েছে ম্যাডাম বলুন কি গান শুনবেন? ‘আমারও পরাণ যাহা যায়’ টা গাও; বেশ লাগে তোমার গলায়! এরপর নীল- নীলাঞ্জনা গানের তালে বেশ সুন্দর কিছুটা মুহূর্ত কাটালো। এভাবে নীলাঞ্জনার দাবি মেটানোর দরুণ নীলকে আরো কয়েকটি আধুনিক গানও গাইতে হলো। কলেজের ফাঁকা রিহার্সাল রুমে বসে দুজনে যেনো ভুলেই গেছে বাড়ির রাস্তা। প্রায় এক ঘন্টা পর দারোয়ান শ্যাম দা এসে বলল- বৃষ্টিটা কমে গেছে এখন দেখো চলে যেতে পারবে হয়তো ; এছাড়া কলেজের সবাই প্রায় ফিরে গেছে। এরপর ওরা দুজন কলেজ থেকে বেরোয়; তবে, না বৃষ্টিটা কিন্তু এখনও অল্প অল্প পড়ছে। নীলাঞ্জনা ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধরল কিন্তু সে কি আর নীলের মত লম্বা; হাসতে হাসতে নীল শীঘ্রই হাতে তুলে নিল ছাতাটা; দুজনে হাত ধরে চলল বাড়ির পথে। নীলাঞ্জনা এক কথায় সুন্দরী, লম্বা লম্বা ঢেউ খেলানো চুল ছাড়াই আছে কাঁধের ওপর কাজল পড়া দুটো চোখ; গায়ের রঙও উজ্জ্বল; সে হাতে চুড়ি পড়ে রঙ বেরঙের। এমন একজন সুন্দরী প্রিয়তমার সাথে বর্ষা ভেজা সন্ধ্যেটা কলকাতার ফুটপাথের হলুদ আলোর মধ্যে দিয়ে উপভোগ করছিল নীল; তবে অদৃষ্টতো সময়টার আবার হিসেব রাখেন; তাই হয়তো একটু তাড়াতাড়িই চলে এল নীলাঞ্জনার বাড়ি।
        কলেজের ভালোলাগা গুলো বড্ড সুন্দর হয়; বেশ রঙীন। এমন অনেক সুন্দর মুহূর্ত ওই ক’বছরে ওরা দুজন কাটিয়েছিল। হয়তো বাস্তবটা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাদের অপ্রকাশিত প্রেমটা সম্পূর্ণ পরিণতি পেল না; একদিকে ভালোই হয়েছে প্রেমের গল্পটার ইতি কাউকেই টানতে হয়নি; এই সৌভাগ্য।
          কলেজের দিনগুলো ছিল গল্পের মত; সত্যি হয়েও যেন কেমন স্বপ্নের মত অধরা। নীল- নীলাঞ্জনা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ভীষণভাবে। নীল ইংরেজির অধ্যাপকও হয়েছিল এখবরটা নীলাঞ্জনার কাছে পৌঁছেছিল ঠিকই ; তবে নীলাঞ্জনার কোনো খোঁজই নীল বহুদিন পায়নি। ফোন নম্বরটাতে ডায়েল করলে কেবল এক বিদেশি মহিলা’ সুইচ অফ’ বলে সাড়া দেয়। জীবনের শোরগোল, যানজট, টানাপোড়েন এসব যখন অনেকটা পাগল করে দিয়েছে নীলকে; তখন বোধ হয় নীলের আর নীলাঞ্জনাকে খোঁজার সুযোগটা হয়ে ওঠেনি। এরপর যখন সুযোগ এল তখন বোধহয় অনেকটা দেরী হয়ে গেছিল। এপ্রসঙ্গে তো তবে ঘটনাটা বলতেই হয়- কলেজের বন্ধু আনন্দের বিয়েতে নীল নিমন্ত্রিত ছিল; তখন অবশ্য নীল একজন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রফেসর; সে এক প্রকার আশা নিয়েই গিয়েছিল সেখানে বিবাহিত বা অবিবাহিত কোনো এক নীলাঞ্জনাকে দেখার। একদমই তাই; নীলাঞ্জনা তো এসেছে;সঙ্গে ওর স্বামীও। দুজনকে দেখে বেশ সুখী দম্পতিই মনে হয়। সেদিন নীলকে আলাপ করতে যেতে হয়নি বরং নীলাঞ্জনাই এসে আলাপ করিয়ে দেয় তার সুপুরুষ স্বামীর সঙ্গে তাকে। ওই দিনটায় নীল তার প্রিয়তমাকে সুখী দেখেও নিজে কেনো সুখী হতে পারছিল না কে জানে? আচ্ছা, নীলাঞ্জনার কি সেসব দিনগুলো মনে আছে? কলেজের রিহার্সাল; ফাংশন; কলেজ স্পোর্টস এছাড়াও তাদের একসাথে ফেরার দিনগুলো; সেই সন্ধ্যেগুলো ; হয়তো সে ভুলে গেছে সব!
         না না একদমই অভিমানের বশে নয় বরং বাস্তবের সাথে মানিয়ে নিতেই নীল সাথীকে বিয়ে করেছিল। ঘরোয়া, সুন্দরী, আবেগপ্রবণ মেয়েটি বিয়ের পর কখনোই আর নীলকে তার অতীতের কথা ভাববার সুযোগ করে দেয়নি।
           দীর্ঘ তিরিশ বছর অতিক্রান্ত হল। এখন দিন অনেক বদলেছে। কলকাতা আরো চকচকে উন্নত হয়েছে ; তবে রাস্তাগুলো বদলায়নি। ওদের কলেজের পাশের কৃষ্ণচূঁড়া গাছটা এখনও আছে; বর্ষায় ভেজে এখনও। যানজটের কলকাতা শহর বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেতে এখনও চমৎকার; হাতে টানা রিক্সা; মাটির ভাঁড়ে চা সেই নস্টালজিয়া কিন্তু এখনও অটুট এই শহরে। হাজার হাজার মানুষ রোজ নতুন কিছু শিখছে, নতুন বন্ধু পাচ্ছে নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ছে ভাঙছে, নতুন স্বপ্ন দেখছে; এক কথায় শহর বড্ড ব্যস্ত রেখেছে সবাইকে; সবার মাঝখানে কি কলকাতার রাস্তাগুলো এখনও খোঁজে ওই দুটো মানুষকে; সময়ের ফাঁকে?
          অপরদিকে বাঁকুড়ার ঝিলিমিলির ‘ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ বেশ ভালোই আনন্দে আছে। সেখানে সবাই সবার খুব ভালো বন্ধু। প্রায় দিনই আধমরা মানুষগুলো আসে এখানে তার কিছুদিনের মধ্যেই আবার সতেজও হয়ে ওঠে।কি না নেই এখানে? প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর তৈরি ‘ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ ; এক একজন মানুষের জন্য এক একটি ঘর তাতে খাট, আলমারি কিছু প্রসাধন দ্রব্য রাখবার মত টেবিল, আয়না এসব রয়েছে। এছাড়া অনেক বড়ো ঘাসে ভরা লন, অনেক ফুলগাছও বড়ো হয় সেখানে; এখানকার বাসিন্দারাই অবশ্য বাগান গুলোর যত্ন নেয় । একবাক্যে – স্নিগ্ধ সুন্দর চিন্তামুক্ত প্রাণখোলা বাড়ি; বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের জন্য। বৃদ্ধাশ্রম কথাটা বড্ড বেদনাদায়ক তাই বোধহয় এখানকার সবাই নিজেদের ঠিকানা বলতে এই’ আনন্দ বাড়ি’কেই চেনে; তারাই দিয়েছে নামখানা। গত এক সপ্তাহ আগে একজন পঞ্চাশোর্ধ বিধবা বৃদ্ধা এখানে এসেছেন, আসার পর থেকেই কেবল জানলার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে; ঠিক সময়ে খাবার খান না; কারোর সাথে বিশেষ কথাও বলেন না। বাকিদের নিজেদের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব তবে ইনি কেনো এমন করছেন তা সবাই অবশ্য বুঝতে পারছে তাই আর তাকে বিশেষ জোর করেনা কেউই। সদ্য ছেলে বা মেয়ের থেকে প্রত্যাখ্যাতা হয়ে এটুকু কষ্টতো পেতে হবে বৈকি। একশো জনের বেশিই সদস্য’ শ্রদ্ধাঞ্জলি’তে ; ফলত নীলের নীলাঞ্জনাকে খুঁজে বের করা একটু কষ্টসাধ্যতো অবশ্যই। হ্যাঁ, ঠিকই বললাম; ঐ বৃদ্ধাই নীলাঞ্জনা; তবে নীল কে এখানে? কোথায় সে? সেও কি পরিবারের বাড়তি সদস্য হয়ে পড়েছিল?
       কিছুদিন আনমনে থাকার পর সমাজের সাথে খাপ খাওয়াতেই হয়তো নীলাঞ্জনা আলাপচারিতা সারলেন ওখানকার কয়েকজনের সাথে। এভাবে সেও’ আনন্দ বাড়ির’ একজন সক্রিয় সদস্যা হয়ে উঠলেন। একদিন বাগানের নয়নতারা গাছে জল দিতে দিতে ফুল গুলোকে পরম সুখে আদর করছিল নীলাঞ্জনা; পরনে একটা ছাপা শাড়ি ; কপালে টিপ; কাচাপাকা চুলে তার এখনও বেশ গোছ আছে। ঠিক এমন সময় নীল তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই নীলাঞ্জনা দেখলেন- ধূসর চুল; পাঞ্জাবি পরা; মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে সেই লম্বা চেনা চেহারাটা তার সামনে; তার সামনে নীল; এটা কি সত্যি; না এ কি করে হয়? এত গুলো দিন বাদে কখনো এমন হবে তা তো জানা ছিল না দুপক্ষেরই।
      বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা চলল তাদের; হয়তো কলেজের গল্পটা সেখানে শেষ না হয়ে অনেকটা দূর এগোলে আজকের দিনটা আরো অনেক রঙীন হতো এমন একটা ইঙ্গিত দুপক্ষের কথাতেই রয়েছে । এরপরই হঠাৎ এক সধবা বৃদ্ধা এসে বসেন নীলের পাশে এবং বলেন সেও কি যোগ দিতে পারে কথোপকথনে? এমন সময় নীল সাথীর সঙ্গে নীলাঞ্জনাকে আলাপ করিয়ে দেয়। হ্যাঁ ইনিই নীলের স্ত্রী সাথী। বিদেশে ছেলে থাকে; এখানে দেখাশোনা করার মত কেউ না থাকায় তারা আজ’ শ্রদ্ধাঞ্জলি’র সদস্য; তাদের অবশ্য ছেলের সঙ্গে সুসম্পর্কই আছে। প্রত্যেকটি কথাই নীলাঞ্জনা শুনছে তার উত্তরও দিচ্ছে বটে; কিন্তু তার একটা অদ্ভূত মানসিক টানাপোড়েন চলছে। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটাকে কি এতদিন পর অন্য কারোর সাথে ভাগ করতে পারছে না নীলাঞ্জনা? নাকি সে খুশি ওদের একসঙ্গে দেখে? না তবে খুশিইতো হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে সাথীর সাথে এটুকু আলাপেই সাথী যে খুব ভালো একটা মানুষ তার অনুমান নীলাঞ্জনা করতেই পেরেছে। হঠাৎ দমকা হওয়ার সাথে বৃষ্টি শুরু হল। নীল শিগগির সাথীকে নিয়ে সামনের বারান্দাটায় সাবধানে উঠিয়ে দিয়ে এলো; এছাড়া সাথীর পায়ে কিঞ্চিৎ চোট রয়েছে বলে মনে হয়; তাই হয়তো এই সাবধানতা অবলম্বন। এতক্ষণ নীলাঞ্জনা বেখেয়ালে ভিজেই গেল বৃষ্টিতে; এরপর যখন সে উঠবে চেয়ার থেকে এমন সময় নীল তার হাত ধরে একটা ছাতা মাথার ওপর মেলে তাকে বারান্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই স্পর্শ, সেই চেহারাটা, সেই হাত সত্যিই বদলায়নি কিছুই; না সবই তো বদলেছে! আবারও একটা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার সংস্পর্শে আসলো নীল। হয়তো বাড়তি কিছু চিন্তা সাথীকে দেখার পর আর নীলের মাথায় আসলো না; কিন্তু নীলাঞ্জনা যে আজ বড্ড সুখী; হয়তো কলকাতার ব্যস্ত শহরে না হোক এই শান্ত গ্রামটাতেই আবারো একটা স্মৃতি তৈরি হলো তাদের। হয়তো এমন অনেক নতুন স্মৃতি তৈরি হবে তাদের। শেষতো হয়নি তাদের গল্পের। অকথ্য প্রেমটা বড্ড নিষ্পাপ। সময়ের ঘেরাটোপে সুপ্ত থাকা অনুভূতির হাতছানি হয়তো বা বারবার প্রত্যেক প্রেমিক – প্রেমিকা পাবে; তা রঙীন যৌবনে হোক আর ফ্যাকাসে বার্ধক্যে। তবে বার্ধক্যও হয়তো রঙীন হয় এরূপ অনুভূতিতে। কেবল সময়টা চলে গেলে আর হয়তো সেভাবে কখনোই ফিরে আসে না; কেবল নিজেদের জন্যে- তখন হয়তো কোনো তৃতীয় ব্যক্তিও দাবি রাখে গল্পে।ঐ- অপ্রকাশিত-
দেখো তো কি বৃষ্টিটাই না শুরু হলো! কি করবে নীল দা?- বলল নীলাঞ্জনা। নীল কলেজের সিনিওর, ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর টপার, অসাধারণ গানের গলা, গিটারে; গলার সুরে- কণ্ঠে গোটা কলেজের এক চেনা মুখ; উত্তরে বলল- আর কি করা যাবে, তুমি বরং বসো একটু থামুক বৃষ্টিটা; ততক্ষণ ফোন টোন দেখো; আর কলেজে থেকে তো তোমার বাড়ি বেশি দূর না; আমিও তো ওদিক দিয়েই যাবো ছেড়ে দিয়ে আসবো তোমাকে বাড়িতে। এমন একটা বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যে; এমন একজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে যতটুকুই কাটানো যায়, তাতেই বড্ড প্রশান্তি। মৃদু হেসে নীলাঞ্জনা বলল- বেশ তাই হবে, একটা গান গাও না শুনি। নীল অতিশয় উপহাসের সাথে বললো আরে শোনো শোনো, এই অধমের গলায় গান শুনে সুন্দর সন্ধ্যেটা স্পয়েল করো না: তার থেকে বরং এই যন্ত্রটায় (ফোন দেখিয়ে) রুপম বা অনুপমের কিছু…… কথা শেষ করতে না দিয়েই নীলাঞ্জনা বেশ অভিমানের সুরেই বলে উঠল – হ্যাঁ আমি কে বলো? আমি কিই বা বুঝবো তোমার গান; বাদ দাও। এগিয়ে এসে নীল বলল আচ্ছা অনেক হয়েছে ম্যাডাম বলুন কি গান শুনবেন? ‘আমারও পরাণ যাহা যায়’ টা গাও; বেশ লাগে তোমার গলায়! এরপর নীল- নীলাঞ্জনা গানের তালে বেশ সুন্দর কিছুটা মুহূর্ত কাটালো। এভাবে নীলাঞ্জনার দাবি মেটানোর দরুণ নীলকে আরো কয়েকটি আধুনিক গানও গাইতে হলো। কলেজের ফাঁকা রিহার্সাল রুমে বসে দুজনে যেনো ভুলেই গেছে বাড়ির রাস্তা। প্রায় এক ঘন্টা পর দারোয়ান শ্যাম দা এসে বলল- বৃষ্টিটা কমে গেছে এখন দেখো চলে যেতে পারবে হয়তো ; এছাড়া কলেজের সবাই প্রায় ফিরে গেছে। এরপর ওরা দুজন কলেজ থেকে বেরোয়; তবে, না বৃষ্টিটা কিন্তু এখনও অল্প অল্প পড়ছে। নীলাঞ্জনা ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধরল কিন্তু সে কি আর নীলের মত লম্বা; হাসতে হাসতে নীল শীঘ্রই হাতে তুলে নিল ছাতাটা; দুজনে হাত ধরে চলল বাড়ির পথে। নীলাঞ্জনা এক কথায় সুন্দরী, লম্বা লম্বা ঢেউ খেলানো চুল ছাড়াই আছে কাঁধের ওপর কাজল পড়া দুটো চোখ; গায়ের রঙও উজ্জ্বল; সে হাতে চুড়ি পড়ে রঙ বেরঙের। এমন একজন সুন্দরী প্রিয়তমার সাথে বর্ষা ভেজা সন্ধ্যেটা কলকাতার ফুটপাথের হলুদ আলোর মধ্যে দিয়ে উপভোগ করছিল নীল; তবে অদৃষ্টতো সময়টার আবার হিসেব রাখেন; তাই হয়তো একটু তাড়াতাড়িই চলে এল নীলাঞ্জনার বাড়ি।
        কলেজের ভালোলাগা গুলো বড্ড সুন্দর হয়; বেশ রঙীন। এমন অনেক সুন্দর মুহূর্ত ওই ক’বছরে ওরা দুজন কাটিয়েছিল। হয়তো বাস্তবটা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাদের অপ্রকাশিত প্রেমটা সম্পূর্ণ পরিণতি পেল না; একদিকে ভালোই হয়েছে প্রেমের গল্পটার ইতি কাউকেই টানতে হয়নি ; এই সৌভাগ্য।
          কলেজের দিনগুলো ছিল গল্পের মত; সত্যি হয়েও যেন কেমন স্বপ্নের মত অধরা। নীল- নীলাঞ্জনা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ভীষণভাবে। নীল ইংরেজির অধ্যাপকও হয়েছিল এখবরটা নীলাঞ্জনার কাছে পৌঁছেছিল ঠিকই ; তবে নীলাঞ্জনার কোনো খোঁজই নীল বহুদিন পায়নি। ফোন নম্বরটাতে ডায়েল করলে কেবল এক বিদেশি মহিলা’ সুইচ অফ’ বলে সাড়া দেয়। জীবনের শোরগোল, যানজট, টানাপোড়েন এসব যখন অনেকটা পাগল করে দিয়েছে নীলকে; তখন বোধ হয় নীলের আর নীলাঞ্জনাকে খোঁজার সুযোগটা হয়ে ওঠেনি। এরপর যখন সুযোগ এল তখন বোধহয় অনেকটা দেরী হয়ে গেছিল। এপ্রসঙ্গে তো তবে ঘটনাটা বলতেই হয়- কলেজের বন্ধু আনন্দের বিয়েতে নীল নিমন্ত্রিত ছিল; তখন অবশ্য নীল একজন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রফেসর; সে এক প্রকার আশা নিয়েই গিয়েছিল সেখানে বিবাহিত বা অবিবাহিত কোনো এক নীলাঞ্জনাকে দেখার। একদমই তাই; নীলাঞ্জনা তো এসেছে;সঙ্গে ওর স্বামীও। দুজনকে দেখে বেশ সুখী দম্পতিই মনে হয়। সেদিন নীলকে আলাপ করতে যেতে হয়নি বরং নীলাঞ্জনাই এসে আলাপ করিয়ে দেয় তার সুপুরুষ স্বামীর সঙ্গে তাকে। ওই দিনটায় নীল তার প্রিয়তমাকে সুখী দেখেও নিজে কেনো সুখী হতে পারছিল না কে জানে? আচ্ছা, নীলাঞ্জনার কি সেসব দিনগুলো মনে আছে? কলেজের রিহার্সাল; ফাংশন; কলেজ স্পোর্টস এছাড়াও তাদের একসাথে ফেরার দিনগুলো; সেই সন্ধ্যেগুলো ; হয়তো সে ভুলে গেছে সব!
         না না একদমই অভিমানের বশে নয় বরং বাস্তবের সাথে মানিয়ে নিতেই নীল সাথীকে বিয়ে করেছিল। ঘরোয়া, সুন্দরী, আবেগপ্রবণ মেয়েটি বিয়ের পর কখনোই আর নীলকে তার অতীতের কথা ভাববার সুযোগ করে দেয়নি।
           দীর্ঘ তিরিশ বছর অতিক্রান্ত হল। এখন দিন অনেক বদলেছে। কলকাতা আরো চকচকে উন্নত হয়েছে ; তবে রাস্তাগুলো বদলায়নি। ওদের কলেজের পাশের কৃষ্ণচূঁড়া গাছটা এখনও আছে; বর্ষায় ভেজে এখনও। যানজটের কলকাতা শহর বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেতে এখনও চমৎকার; হাতে টানা রিক্সা; মাটির ভাঁড়ে চা সেই নস্টালজিয়া কিন্তু এখনও অটুট এই শহরে। হাজার হাজার মানুষ রোজ নতুন কিছু শিখছে, নতুন বন্ধু পাচ্ছে নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ছে ভাঙছে, নতুন স্বপ্ন দেখছে; এক কথায় শহর বড্ড ব্যস্ত রেখেছে সবাইকে; সবার মাঝখানে কি কলকাতার রাস্তাগুলো এখনও খোঁজে ওই দুটো মানুষকে; সময়ের ফাঁকে?
          অপরদিকে বাঁকুড়ার ঝিলিমিলির ‘ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ বেশ ভালোই আনন্দে আছে। সেখানে সবাই সবার খুব ভালো বন্ধু। প্রায় দিনই আধমরা মানুষগুলো আসে এখানে তার কিছুদিনের মধ্যেই আবার সতেজও হয়ে ওঠে।কি না নেই এখানে? প্রায় পাঁচ বিঘা জমির ওপর তৈরি ‘ শ্রদ্ধাঞ্জলি’ ; এক একজন মানুষের জন্য এক একটি ঘর তাতে খাট, আলমারি কিছু প্রসাধন দ্রব্য রাখবার মত টেবিল, আয়না এসব রয়েছে। এছাড়া অনেক বড়ো ঘাসে ভরা লন, অনেক ফুলগাছও বড়ো হয় সেখানে; এখানকার বাসিন্দারাই অবশ্য বাগান গুলোর যত্ন নেয় । একবাক্যে – স্নিগ্ধ সুন্দর চিন্তামুক্ত প্রাণখোলা বাড়ি; বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের জন্য। বৃদ্ধাশ্রম কথাটা বড্ড বেদনাদায়ক তাই বোধহয় এখানকার সবাই নিজেদের ঠিকানা বলতে এই’ আনন্দ বাড়ি’কেই চেনে; তারাই দিয়েছে নামখানা। গত এক সপ্তাহ আগে একজন পঞ্চাশোর্ধ বিধবা বৃদ্ধা এখানে এসেছেন, আসার পর থেকেই কেবল জানলার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলে; ঠিক সময়ে খাবার খান না; কারোর সাথে বিশেষ কথাও বলেন না। বাকিদের নিজেদের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব তবে ইনি কেনো এমন করছেন তা সবাই অবশ্য বুঝতে পারছে তাই আর তাকে বিশেষ জোর করেনা কেউই। সদ্য ছেলে বা মেয়ের থেকে প্রত্যাখ্যাতা হয়ে এটুকু কষ্টতো পেতে হবে বৈকি। একশো জনের বেশিই সদস্য’ শ্রদ্ধাঞ্জলি’তে ; ফলত নীলের নীলাঞ্জনাকে খুঁজে বের করা একটু কষ্টসাধ্যতো অবশ্যই। হ্যাঁ, ঠিকই বললাম; ঐ বৃদ্ধাই নীলাঞ্জনা; তবে নীল কে এখানে? কোথায় সে? সেও কি পরিবারের বাড়তি সদস্য হয়ে পড়েছিল?
       কিছুদিন আনমনে থাকার পর সমাজের সাথে খাপ খাওয়াতেই হয়তো নীলাঞ্জনা আলাপচারিতা সারলেন ওখানকার কয়েকজনের সাথে। এভাবে সেও’ আনন্দ বাড়ির’ একজন সক্রিয় সদস্যা হয়ে উঠলেন। একদিন বাগানের নয়নতারা গাছে জল দিতে দিতে ফুল গুলোকে পরম সুখে আদর করছিল নীলাঞ্জনা; পরনে একটা ছাপা শাড়ি ; কপালে টিপ; কাচাপাকা চুলে তার এখনও বেশ গোছ আছে। ঠিক এমন সময় নীল তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই নীলাঞ্জনা দেখলেন- ধূসর চুল; পাঞ্জাবি পরা; মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে সেই লম্বা চেনা চেহারাটা তার সামনে; তার সামনে নীল; এটা কি সত্যি; না এ কি করে হয়? এত গুলো দিন বাদে কখনো এমন হবে তা তো জানা ছিল না দুপক্ষেরই।
      বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা চলল তাদের; হয়তো কলেজের গল্পটা সেখানে শেষ না হয়ে অনেকটা দূর এগোলে আজকের দিনটা আরো অনেক রঙীন হতো এমন একটা ইঙ্গিত দুপক্ষের কথাতেই রয়েছে । এরপরই হঠাৎ এক সধবা বৃদ্ধা এসে বসেন নীলের পাশে এবং বলেন সেও কি যোগ দিতে পারে কথোপকথনে? এমন সময় নীল সাথীর সঙ্গে নীলাঞ্জনাকে আলাপ করিয়ে দেয়। হ্যাঁ ইনিই নীলের স্ত্রী সাথী। বিদেশে ছেলে থাকে; এখানে দেখাশোনা করার মত কেউ না থাকায় তারা আজ’ শ্রদ্ধাঞ্জলি’র সদস্য; তাদের অবশ্য ছেলের সঙ্গে সুসম্পর্কই আছে। প্রত্যেকটি কথাই নীলাঞ্জনা শুনছে তার উত্তরও দিচ্ছে বটে; কিন্তু তার একটা অদ্ভূত মানসিক টানাপোড়েন চলছে। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটাকে কি এতদিন পর অন্য কারোর সাথে ভাগ করতে পারছে না নীলাঞ্জনা? নাকি সে খুশি ওদের একসঙ্গে দেখে? না তবে খুশিইতো হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে সাথীর সাথে এটুকু আলাপেই সাথী যে খুব ভালো একটা মানুষ তার অনুমান নীলাঞ্জনা করতেই পেরেছে। হঠাৎ দমকা হওয়ার সাথে বৃষ্টি শুরু হল। নীল শিগগির সাথীকে নিয়ে সামনের বারান্দাটায় সাবধানে উঠিয়ে দিয়ে এলো; এছাড়া সাথীর পায়ে কিঞ্চিৎ চোট রয়েছে বলে মনে হয়; তাই হয়তো এই সাবধানতা অবলম্বন। এতক্ষণ নীলাঞ্জনা বেখেয়ালে ভিজেই গেল বৃষ্টিতে; এরপর যখন সে উঠবে চেয়ার থেকে এমন সময় নীল তার হাত ধরে একটা ছাতা মাথার ওপর মেলে তাকে বারান্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই স্পর্শ, সেই চেহারাটা, সেই হাত সত্যিই বদলায়নি কিছুই; না সবই তো বদলেছে! আবারও একটা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার সংস্পর্শে আসলো নীল। হয়তো বাড়তি কিছু চিন্তা সাথীকে দেখার পর আর নীলের মাথায় আসলো না; কিন্তু নীলাঞ্জনা যে আজ বড্ড সুখী; হয়তো কলকাতার ব্যস্ত শহরে না হোক এই শান্ত গ্রামটাতেই আবারো একটা স্মৃতি তৈরি হলো তাদের। হয়তো এমন অনেক নতুন স্মৃতি তৈরি হবে তাদের। শেষতো হয়নি তাদের গল্পের। অকথ্য প্রেমটা বড্ড নিষ্পাপ। সময়ের ঘেরাটোপে সুপ্ত থাকা অনুভূতির হাতছানি হয়তো বা বারবার প্রত্যেক প্রেমিক – প্রেমিকা পাবে; তা রঙীন যৌবনে হোক আর ফ্যাকাসে বার্ধক্যে। তবে বার্ধক্যও হয়তো রঙীন হয় এরূপ অনুভূতিতে। কেবল সময়টা চলে গেলে আর হয়তো সেভাবে কখনোই ফিরে আসে না; কেবল নিজেদের জন্যে- তখন হয়তো কোনো তৃতীয় ব্যক্তিও দাবি রাখে গল্পে।
লেখিকা :নেহা সরকার
Previous articleকরোনা ভাইরাস বনাম আমরা
Next articleঅন্য পৃথিবী
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here