চন্ডরাজার বলি – উপন্যাস : সংখ্যা ৩

0
1264

<<দ্বিতীয় সংখ্যা   

(৫)

এতোটা শুনে আমি বললাম –তপন একটা সিগ্রেট ছাড় দেখি। তপন অবাক হয়ে বলল –সেকি বললি যে নেশা ছেড়ে দিয়েছিস, তবে কি মত পালটে ফেললি? হেসে বললাম –উহু তা নয় তোর এই গাজাখুরি গপ্পো হজম করতে হলে খানিকটা ধোয়ার সাহায্য বিশেষ প্রয়োজন অন্যথায় পেটে গোলযোগ বাধতে পারে। তপন সিগারেট বের করে আমাকে দিল আর নিজেও একটা ধরিয়ে বলল      –অবশ্য তোর বিশ্বাস না হওয়াটাই স্বাভাবিক, তবে গল্পের পরের অংশটায় আমাদের কাজের বিষয় আছে, আর এবারে প্রমান হাতেনাতে পাবি। কৌতূহলী হয়ে বললাম –সেটা কিরকম? তপন মুচকি হাসল, বলল –একটু ধৈর্য ধরে শোন না কথা দিচ্ছি আর বেশী বোর করব না। তপন আবার ওর গল্প বলতে শুরু করল।

সেদিন বিকেলে মোড়ল এলাহি ভোজের আয়োজন করল। গ্রামের লোকেদের পেটপুরে খাওয়ার ব্যাবস্থা তো রইলই, ত্রিলোচনের জন্য আলাদাভাবে আস্ত একটা ছাগল ঝলসে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেইসঙ্গে আতপ চালের ভাত আর চোলাই করা মদের হাড়ি। ত্রিলোচন স্বাভাবিক ভাবেই খোশ-মেজাজে ছিল। গত রাতের সাফল্যের পর এলাকায় তার প্রভাব প্রতিপত্তি যে অনেকগুন বেড়ে গেছে সে আনন্দে মাত্রাছাড়া মদ্যপান করতে লাগল। একসময় ত্রিলোচন হুঁশ হারিয়ে পুরোপুরি মাতাল হয়ে পড়ল।

সে রাতে নেশার ঘোরে মত্ত ত্রিলোচন তার গোপন কথা আমার কাছে প্রকাশ করে ফেলল। যা শুনলাম তাতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি পাঁচ বছরের শিশুকে কয়েদ করে রাখা হয়েছে। ছেলেটির যখন ছমাস বয়স তখনই নাকি তাকে অপহরণ করা নিয়ে আসা হয়েছিল। ছেলেটি এলেবেলে কেউ নয় একেবারে ওড়িশার একটি বিখ্যাত রাজপরিবারের সন্তান, যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এই আজকের দিনেও যথেষ্ট রয়েছে। নরবলি চণ্ডরাজার অতীব প্রিয় আর সে বলি যদি উচ্চবংশের কারও হয়, তাতে এই দেবতা বিশেষ প্রীত হন। বলির দাতাকে চণ্ডরাজা অলৌকিক শক্তি প্রদান করেন। সে অপরিমিত ধনসম্পদের অধিকারী হয় এছাড়া পৃথিবীর ওপর কর্তিত্ব করার ক্ষমতাও নাকি তার জন্মায়, একশো বছরের ভোগ-বিলাস আর অপর্যাপ্ত ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে সেই ব্যাক্তি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ অর্জন করেন। ত্রিলোচন নিজে অবশ্য বাচ্চা চুরি করেনি করেছে অন্য লোকে। এতবছর ধরে ত্রিলোচন সেই রহস্যময় ব্যাক্তির আদেশ পালন করে চলেছে, আর বছর দেড়েক ব্যাস তারপর শিশুটিকে বলি দিয়ে ত্রিলোচনের রেহাই। মনিব কথা দিয়েছে নিজের সৌভাগ্যের কিছু ভাগ সে সহযোগীকে দেবে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাকি খবরগুলো জেনে নিলাম। ত্রিলোচন দিনে একবার একা গিয়ে ছেলেটিকে খাইয়ে আসে, অন্য কাউকে কখনো ওর সামনে যেতে দেওয়া হয়নি তাই দ্বিতীয় কোন মানুষের মুখ ইতিমধ্যে ছেলেটি দেখেও নি। প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী যজ্ঞেশ্বরের উদ্দেশ্যে নরবলি এভাবেই উৎসর্গ করা হয়। ত্রিলোচন এযাবৎ  ছেলেটির সঙ্গে কখনও বাক্যালাপ করেনি অতএব সে কোন ভাষাও শেখেনি। অন্ধকূপে জন্মবিধি জীবন কাটাবার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেটির বুদ্ধির কিছুমাত্র বিকাশ ঘটে নি। স্বল্প পরিসরে আবদ্ধ থাকার ফলে চলাফেরা করার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলেছে। সাত বছর পুর্ন হলে একে বলি দিয়ে যজ্ঞেশ্বরে কৃপায় ত্রিলোচন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। বলি দেবার কায়দা আর দরকারি মন্ত্রগুলো একটা কাগজে নোট করে নিলাম।এরপর ত্রিলোচন ডমফাই করে তার মনিবের নাম আমার সামনে উল্লেখ করল। নামটা শোনা মাত্র একটা আতঙ্কের স্রোত শরিরের মধ্যে বয়ে গেল। সামনে ভয়ংকর বিপদ! মদের নেশা কেটে যাবার পর ত্রিলোচনের যদি আমাকে বলা কথা সব মনে পড়ে যায়, তাহলে পিতৃদত্ত প্রানটি নিয়ে আর ফিরত যেতে হচ্ছে না। অনেক ভেবে স্থির করলাম বোকা সাজব, ত্রিলোচনের গুপ্ত রহস্য যে জেনে ফেলেছি ঘুণাক্ষরেও তার ইঙ্গিত দেব না।তারপর দেখা যাক কি হয়!

এরপর দুতিনটে দিন কেটে গেল, আজকাল ত্রিলোচন আমাকে দেখলে এড়িয়ে চলে, মৌতাতে মজে সে যে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে সে হুঁশ তার হয়েছে, তবে ঠিক কতোটা? সে এখনো ভালোমতো ঠাহর করে উঠতে পারেনি। ত্রিলোচন কায়দা করে আমার পেট থেকে কথা বের করার চেষ্টা করেছিল, আমি না বোঝার ভান করে গা বাচিয়েছি, তাতে অবশ্য ওর সন্দেহ মেটেনি, আমি বিপদের গন্ধ পেতে শুরু করলাম, ত্রিলোচন ঘোট পাকাচ্ছে! সে যে তার রহস্যের অবাঞ্ছিত অংশীদারকে টিকিয়ে রাখতে চায় না, সেটা বুঝবার মতো বোধবুদ্ধি আমার হয়েছিল। ভগীরথপুর থেকে দু-কিলোমিটার হেটে গেলে বাস রাস্তা, সকাল নটায় সেখান থেকে কেওনঝাড়ের বাস পাওয়া যায়, আমি গ্রামের একটা ছেলেকে দিয়ে ত্রিলোচনের কাছে খবর পাঠালাম, এক আত্মীয়ের অসুস্থ্যতার সংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়েছে, একফাকে বৃন্দাবনকে ডেকে কয়েকটা জরুরি নির্দেশ দিয়ে গেলাম। ভগীরথপুর থেকে কেওনঝাড় বাসে করে পৌঁছন গেল, সেখান থেকে গাড়ি পাল্টিয়ে সোজা ভদ্রক। গলায় একটা সোনার চেন ছিল। ওটা বেঁচে হাতে কিছু নগদ এলো, এবার একটা সস্তার হোটেলে দিন সাতেকের জন্য ঘাপটি মেরে পরে থাকা। ত্রিলোচন যার এজেন্ট তার হাতের নাগাল টপকে এই ভদ্রক শহরেও আমি তিলমাত্র নিরাপদ নই,  তবে ভরসা একটাই ত্রিলোচন ধুরন্ধর লোক, সে যে মৌতাতে মজে মনিবের গুপ্তরহস্য ইয়ার-দোস্তদের কাছে ফলাও করে জাহির করেছে, সেটা আবার বড় মুখ করে বলে নিজের বিপদ ডেকে আনবে, এতোটা মুর্খ ওকে ভাবতে পারছিলাম না।

 আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। পিছনের সাড়ীতে পরে থাকা একটা সংবাদপত্রের ততোধিক নগণ্য অস্থায়ী নিউজ রিপোর্টারের এই চাকরিটা ছাড়া আমার সম্বল আর কিছুই নেই।জীবনে উন্নতির স্বপ্ন নেহাতই দুরাশা। অন্যদিকে, ত্রিলোচনের কথা যদি সত্য হয় আর যদি সেই বাচ্চাটাকে একেবারে কলকাতার মাঝে এনে ফেলা যায় তাহলে কতবড় ব্রেকিং নিউজ তৈরি হবে, সেটা ভাবতেও রোমাঞ্চ হল। রাতারাতি বিখ্যাত হবার এমন সুযোগ জীবনে আর হয়ত পাওয়া যাবে না। বলা বাহুল্য এতে ঝুকিটাও কিছু কম নয়, একেবারে যাকে বলে প্রান হাতে নিয়েই এই অভিযানে নামতে হবে, উচ্চাশার সামনে ভয় বেশীক্ষন দাড়াতে পারল না। ঠিক করলাম বিপদের মোকাবিলা করব, হয় জিতব না হয় তো মরব। পরিকল্পনা মত পুরো দুটো সপ্তাহ অপেক্ষা করলাম, বৃন্দাবনকে বলা ছিল ওদিকে নজর রাখতে আর কোন খবর পেলে যেন আমাকে জানায়, এই দুসপ্তাহে শুধু একদিন বৃন্দাবনের ফোন এসেছে, যা শুনলাম তাতে চিন্তার পরিমান বাড়ল। ত্রিলোচন সাবধান হয়ে গেছে, আগে মাঝে মধ্যে পাহারায় ঢিলেমি দিলেও এখন প্রায় সর্বক্ষন সে কড়া নজর রেখে চলেছে। দারোয়ান দুজন সন্ধ্যের পর চলে গেলে আজকাল ত্রিলোচন নিজেই রাতভর জেগে নজর রাখছে। বুঝলাম আমার কাজ কঠিন থেকে দুরূহ হতে চলেছে। আর সময় কোনভাবেই নষ্ট করা যাবে না, ভদ্রক মফঃস্বল শহর, বেশিদিন এখানে বসে থাকলে এখানকার লোকের সন্দেহ হতে পারে, ঠিক করলাম এযাত্রায় কলকাতায় ফেরত যাব তারপর নাহয় মাসদুয়েক পরে ফের দেখা যাবে। কিন্তু হঠাৎ একটা খবর পেয়ে মত পরিবর্তন করলাম। সেদিন বৃন্দাবনের ফোন এলো, আগের রাতে  ত্রিলোচন গলা অবধি মদ খেয়ে প্রচুর মাতলামি করেছে, সে নিজে দেখেছে, বুঝলাম ত্রিলোচন ঢিলে দিয়েছে, মাতাল কি আর বেশিদিন মদ ছেড়ে থাকতে পারে! যে জিনিস গুলো আমার দরকার সেগুলো সেদিনই যোগার করে নিলাম, একটা বড় সাইজের ট্র্যাভেল লাগেজ্‌, একটা সাত সেলের টর্চ আর প্রচুর পরিমানে টয়লেট প্যাড। ভদ্রকের বেহেরা ট্র্যাভেলস্‌কে বলে একটা টাটা সুমো গাড়ীর ব্যাবস্থা করা গেল। সন্ধ্যের অন্ধকার নামতেই গাড়ীটা নিয়ে ভগিরথপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ভগিরথপুর গ্রামে গাড়ী ঢোকবার মতো রাস্তা নেই, তাই সেটাকে বাস রাস্তার একপাশে রেখে পায়ে হেটে গ্রামে প্রবেশ করলাম। তবে যেদিকে গ্রামের জনবসতি সেদিকটা এড়িয়ে জঙ্গলের প্রান্তে একটা ঝাঁকড়া গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকলাম। রাত আটটা পর্যন্ত এখানে লোক চলাচল করে, চাইছিলাম না তাদের কারো নজরে পরে যাই ওদিকে গাড়ীতে বসে থাকলে ড্রাইভারের মনে সন্দেহ জাগতে পারে তাই দুদিক বাঁচাতে এমন ব্যাবস্থা নিতে হল। রাত নটা অবধি আত্মগোপন করার পরে নিশ্চিত হলাম, গ্রামে আজ রাতে আর কেউ জেগে বসে নেই, এবার সাবধানে বেড়িয়ে পরলাম। নিস্তব্দ নির্জন চেনা গ্রাম্য পথ দিয়ে পা টিপে টিপে বৃন্দাবনের বাড়ির সামনে এলাম। বৃন্দাবন গোয়ালে খাটিয়া পেতে শুয়ে ছিল, আমি শিষ দিতে বাইরে বেড়িয়ে এলো। ওর কাছে খবর পেলাম, কয়েকদিন মদ গাঁজা কিছু না ছুয়ে ত্রিলোচন সজাগ থেকে মন্দির পাহারা দিয়েছে, তবে গতকাল থেকেই সে আবার তার পুরনো অভ্যাসে ফিরত গেছে।  বুঝলাম ভাগ্য আমার সহায়, মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে  মন্দিরের দিকে হাটা দিলাম, এবারে সঙ্গে বৃন্দাবন চলল।

 মন্দিরে পৌঁছে সেরাতে যা দেখলাম আগেও অনেকবার দেখেছি।

ত্রিলোচন আকণ্ঠ মদ গিলে চাতালে এলিয়ে পড়েছে আমি ওর কোমর থেকে সাবধানে চাবির গোছা বের করে মন্দিরের দরজা খুলে সটান ঢুকে পরলাম, নেশার ঘোরে ত্রিলোচন কিছুই খেয়াল করল না। মন্দিরের ভিতরে অবশ্য আলোর কোন ব্যাবস্থাই নেই যাকে বলে একেবারে নিকষ্যি অন্ধকার। টর্চলাইটটা এখানে খুব কাজে এলো,  বেদির ওপর চণ্ডরাজার মুর্তিতে আলো ফেলতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। দেবতার অবয়বটা বড়ই অদ্ভুত? কি হিংস্র লোলুপ চোখের দৃষ্টি, বড় বড় দাঁত বের করে যেন গিলে খেতে চাইছে আর সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় বড় অদ্ভুত রকমের জীবন্ত।মূর্তিটার চোখে চোখ রাখতে অস্বস্তি হচ্ছিল, অন্যদিকে চোখ সরালাম এবারে বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করতে হবে।  টর্চের আলোয় ঘরটা খুটিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম এখানে তেমন কিছু নেই, এবারে মূর্তির পিছনে গিয়ে দেয়াল হাতড়ে একটা বন্ধ দরজা দেখতে পেলাম। সামান্য ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল, ভিতর থেকে মৃদু অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ আসছিল। ছোটখাটো চেহারার একটা ছেলে বেঁকেচুরে শুয়ে ছিল। বৃন্দাবনকে বললাম ওকে কাধে তুলে নিতে। বের হবার সময় কি মনে হল মূর্তির তলাটা ঘেটে দেখলাম, বুনো ফুল দিয়ে ঢাকা একটা ছোট সাইজের গোলাকৃতি পাথরে হাত ঠেকল। অনুমান করলাম এটাই এই দেবতার প্রতিষ্ঠা করা প্রান ভোমরা আর উপরের মূর্তিটা নিছক আবরণ।শিলাখণ্ডটা রুমালে জড়িয়ে পকেটে পুরে নিলাম। সদর দরজা ঠেলে বের হতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে ত্রিলোচনের মুখোমুখি হয়ে পরলাম, নেশার ঘোর কিছুটা কাটার ফলে সে তখন টলতে টলতে এদিকেই এগিয়ে আসছিল, টর্চের জোরালো একটা ঘা মেরে ওকে মাটিতে শুইয়ে আমরা তাড়াতাড়ি বাইরে এলাম। সবার আগে ছেলেটাকে স্যুটকেশে ভরে ফেললাম,  তারপর দেড় কিলোমিটার রাস্তা নির্জন গ্রাম্য পথ  দিয়ে দুজনে মিলে বাক্সটা বয়ে এনে গাড়িতে তুললাম। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলার পর ভোর রাতের দিকে গাড়ি এসে পৌঁছল কসবা নারায়ণগড়ে। মফঃস্বল শহরটা বাংলা ওড়িশা বর্ডারে। আগে থেকেই ব্যাবস্থা করে রেখেছিলাম, আমার পরিচিত একজনের গেস্ট-হাউসে আমরা স্যুটকেশটা নিয়ে উঠলাম। এখান থেকে হলদিয়া হয়ে কলকাতা যেতে মোটে কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, কিন্তু সঙ্গের বাচ্চাটার জন্য বিরতি নেব ঠিক করলাম, এতোটা লং-জার্নির ধকল ছেলেটা নিতে পারবে না। জন্মবিধি চোর কুঠুরিতে বন্দি থাকার ফলে ছেলেটার চোখ কোনরকম আলো সহ্য করতে পারবে না মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, তাই ঘরের সবকটা জানালা পর্দায় ঢেকে দিলাম, কিন্তু তাতেও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় ওর চোখে কালো পট্টি বেঁধে লাগেজের মধ্যেই রেখে দেওয়া স্থির করলাম।

বেলার দিকে প্রভাসদাকে ফোন করলাম।

প্রভাসদা তো একেবারে আকাশ থেকে পরলেন। প্রশ্নে প্রশ্নে একেবারে ব্যাতিব্যাস্ত করে তুললেন। এতদিন কোথায় ছিলাম? সমীরণের ইন্টারভিউয়ের কি হল? কোনরকমে প্রভাসদাকে থামিয়ে বললাম, কাল কলকাতায় ফিরছি, উনি যেন বিরাট একটা খবরের জন্য তৈরি থাকেন। আসল ব্যাপারটা যে কি সেটা আর ভাঙলাম না। কাল যখন ছেলেটাকে প্রকাশ্যে এনে হাজির করব তখন চোখের সামনেই দেখতে পাবে। এবার সমস্যা তৈরি হল ছেলেটিকে নিয়ে, নতুন পরিবেশ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ বের করতে শুরু করল। আপাতত আফিং গোলা জল খাইয়ে ওকে শান্ত করলাম। দিনের বেলায় ওকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা অনুচিত, বাক্স সমেত ধরা পরলে যে ছেলেধরা বিবেচনায় গণধোলাই নিশ্চিত প্রাপ্য সেটা সহজেই অনুমেয়। গাড়ির ব্যাবস্থা করলাম সেদিন মাঝরাতে।

হোটেলের ম্যানেজার সুধীর মণ্ডলের সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ ছিল পেশার সুত্রে, ভদ্রলোক বেশ খাতিরযত্ন করলেন। আগেভাগে জানিয়ে রাখলাম আমাদের কামরায় রুম সার্ভিসের প্রয়োজন নেই, আর আমার অনুমতি বিনা যেন ওঘরে কেউ না ঢোকে। ভদ্রলোক কথায় কথায় বললেন হোটেলের বাগানে তিনি একটি শখের চিড়িয়াখানা গড়েছেন, এবং সেটা আমাকে দেখাতে চান, এইমুহুর্তে ঘর থেকে বেশিক্ষণ বাইরে থাকাটা অনুচিত কাজ তাই একটা অজুহাত দিয়ে আবার ঘরেই ফেরত এলাম।

সে-দিনটা ছেলেটার দিকে নজর রাখতে রাখতেই কেটে গেল। যদিও আফিঙের প্রভাবে ওর হুঁশ প্রায় ছিলই না আহলেও সতর্কতায় ঢিলে দিলাম না, যতক্ষণ না কলকাতায় পৌছতে পারছি, বিপদের আশংকা থাকছেই। গাড়ি আসবে রাত বারোটায়, ছেলেটাকে ফেনা ভাত আর পেঁপে সেদ্দ খাইয়ে, নিজেও ডিনার সেরে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিলাম, বোধহয় তখন রাত    দশটা হবে, হঠাৎ পেটে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। তপন তলপেটের দিকে ইঙ্গিত করে বলল –এখানে ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করলাম। বৃন্দাবন ভয় পেয়ে ম্যানেজারকে ডাকতে যাচ্ছিল আমি বারণ করলাম, এই ঘরে কাউকে আসতে দেওয়া যায় না, আর আমি একমুহুর্তের জন্যেও ওই বাক্সটা ছেড়ে যেতে পারি না। আমার মোবাইলে ডাক্তার রায়ের নম্বরটা সেভ করাই থাকে, ওনাকে ফোন করব বলে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করব বলে হাত দিতেই ছ্যাঁকা খেলাম! কি কারনে বা সুতির কাপড়ে তৈরি পকেট ভীষণ তেঁতে উঠেছে। পকেট ঝেড়ে যা বেরোল সেটা আর কিছু নয়, রুমালে জড়ানো চণ্ডরাজার পাথর যেটা আমি একদিন আগে ভগীরথপুরের মন্দির থেকে চুরি করে এনেছি। পাথরটা থেকে একটা অদ্ভুত নীল আলো ঠিকড়ে বেরোচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি পাথরটা রুমালে জড়িয়ে ড্রয়ারে রেখে দিলাম, এসব জিনিস বৃন্দাবনের চোখে পরে গেলে ওকে আর বশে রাখা যাবে না। আমি বৃন্দাবনকে কাজের আছিলায় বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। এবারে ভালো করে পাথরটা চেক করা দরকার, অদ্ভুত একটা বিষয় নজরে পরল, পাথরটা যতই তেঁতে থাকুক না কেন এর দাহিকা শক্তি কিন্তু একেবারেই নেই, অন্যথায় প্যান্টের কাপড়ে এতক্ষণে আগুন লেগে যেতে বাধ্য ছিল। অথচ শিলাটায় হাত দিলেই ছ্যাঁকা খাচ্ছি, ত্রিলোচনের বলা কয়েকটা কথা হঠাৎ মনে পরল, সপ্তাহে একবার চণ্ডরাজার তেষ্টা পায় আর সে তেষ্টা মেটাতে না পারলে পুজকের সর্বনাশ। চণ্ডরাজার তৃষ্ণা কিসে মিটবে? রক্তে! ব্যাথাটা আর সহ্য করা যাচ্ছিল না, দরজায় খিল এঁটে ব্যাগ থেকে দাড়ি কামাবার ব্লেডটা বের করলাম। ব্লেডটা আড়াআড়ি ভাবে ডান হাতের তর্জনীর ওপর চালিয়ে দিলাম। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার সঙ্গে একটা অগভীর ক্ষতের সৃষ্টি হল, তাজা রক্তের একটা ধারা ক্ষত থেকে বুরবুরি দিয়ে উঠল। আঙুলটা চণ্ডরাজার পাথরের ওপর মেলে ধরলাম। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত শিলাখণ্ডের মাথায় চুইয়ে পড়তে লাগল। নীল আলোটাও অকস্মাৎ স্থিমিত হয়ে এলো। পাথরটা ছুয়ে দেখলাম সেটা খানিক ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। পেটের যন্ত্রণাও খানিক কমল কিন্তু পুরোপুরি সেরে গেলনা। ত্রিলোচনের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম, কিছু কিছু মনে পড়ল, চণ্ডরাজার নৈবিদ্যে রক্তের সাথে প্রাণও অর্ঘ, অন্যথায় সেবা অসম্পূর্ণ। স্থির করলাম তবে প্রাণও উৎসর্গ করব। সেরাত্রে যে কি কষ্ট করে সাধুখাঁর অত সাধের চিড়িয়াখানা থেকে একটা গিনিপিগ চুরি করেছিলাম সে শুধু আমিই জানি।

 তপন সামান্য চুপ করে বলল –আমার কাহিনি এখানেই শেষ, এরপর দেড়টা বছর শুধু  টাফ স্ট্রাগল করে গেছি। বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করা যে কি কষ্টকর সেটা ভুক্তভোগীই জানবে। অচেনা পরিবেশ দেখলেই ছেলেটির নার্ভাস ব্রেকডাউন ঘটে যায়, যখন তখন বিকট চিৎকার করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলতে তুলতে অজ্ঞান হয়ে পরে। দীর্ঘদিন শুয়ে থেকে থেকে ওর চলাফেরার শক্তি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, দৃষ্টিশক্তিও রীতিমতো ক্ষীণ, পরে রক্ত পরীক্ষা করে জানতে পেরেছি এরমধ্যেই ডায়বেটিশ আর কিছু জটিল স্নায়বিক সমস্যা ওকে ধরে নিয়েছে। ত্রিলোচনের কল্যানে আর যাই হোক ছেলেটিকে মানুষের পর্যায়ে ফেলা যায় না। ছেলেটির যে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করব সে সুযোগও পেলাম না কারন বিপদ তখনো আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করেছে, এরপর শুরু হল আমার পলাতক জীবন, কখনও বাংলারকোন গ্রামে, কখনও বা ঝাড়খণ্ডের মফঃস্বল শহরে তো কখনও আসামের কোন অখ্যাত গ্রামে, কোথাও বেশিদিন থিতু হয়ে বসতে পারিনি, যেখানেই গেছি  টের পেয়েছি শত্রুরা আমার পিছু নিয়েছে, একবার তো দেওঘরের বাজারে ক্ষনিকের জন্য একজন অচেনা লোককে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম, দাড়ি গোঁফ ছেঁটে আর শার্ট প্যান্ট পড়লেও ত্রিলোচন সেদিন আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। তবে আশ্চর্যের বিষয়ওরা দূর থেকেই নজর রেখেই এযাবত ক্ষান্ত দিয়েছে, কিন্তু ঠিক কেন সে উত্তর আমার কাছে নেই, তপন একমুহুর্ত চুপ করে বলল –এবারে আশা করি বুঝেছিস জানালা গুলো ওভাবে বন্ধ রাখার দরকার কেন হয়ে পরেছে।

 আমি এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে তপনের অভিজ্ঞতা শুনছিলাম এবার ওকে একপ্রকার থামিয়েই জিগ্যেস করলাম –আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার প্রয়োজনটাই বা কিসের? নিউজ কভার করলেই তো তোর কাজ হয়ে যায়, বাকিটা পুলিসে বুঝবে। তপন গম্ভির ভাবে মাথা নেড়ে বলল –নট ব্যাড্‌, সেক্ষেত্রে নামডাক হয়ত কিছুটা হত, প্রভাসদার শুয়ে পড়া কাগজ একটা ব্রেকিং নিউজও পেত, আর কে বলতে পারে হয়ত বড় কোন সংবাদপত্রের নজরেও পরে যেতে পারতাম। কিন্তু নাঃ সেটা হত বোকামো। বিরাট প্রাপ্তির সম্ভবনাকে পায়ে ঠেলে তুচ্ছ কানাকড়িতে মন ভরানো! তপন আবার একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। ধোয়ায় আচ্ছন্ন তপনের মুখের প্রতিবিম্ব উল্টোদিকের দেয়াল আয়নাটায় পড়েছে, সেদিকে চোখ পরতেই চমকে উঠলাম, কি হিংস্র আর পাশবিক লাগছিল সেই মুখের অভিব্যাক্তি। তপন আমার দিকে স্থির দৃষ্টে চেয়ে রহস্যময় ভাবে হাসল, ওর দৃষ্টিতে কি যেন একটা ছিল, শিকারি বেড়াল যেমন ভাবে ফাঁদে পরা নেংটি ইঁদুরকে জরিপ করে ঠিক যেন তেমনই।

 মোমবাতির আলোয় বদ্ধ ঘরের ভুতুড়ে পরিবেশটা ক্রমশ আরও বেশী করে জমাট হয়ে আসছিল, তপন একটা জীবন্ত মাংসপিন্ড নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে? কি তার উদ্দেশ্য? তবে সেটা আর যাই হোক না কেন নিশ্চয়ই সৎ নয়! ভাবলাম এখান থেকে বেড়িয়ে পরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, মনের ভাব গোপন করার চেষ্টা করে হালকা স্বরে জিগ্যেস করলাম –এসব কথা আমাকে ডেকে এনে শোনালি কেন? আর ছেলেটাই বা কোথায়?

তপনের ঠোঁটের কোনের রহস্যময় হাঁসিটা চওড়া হয়ে উঠল, অদ্ভুত স্বরে বলল – প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল তোর সাহায্য ছাড়া আমার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার নয়এমন কিছু আছে যা শুধু তুই পারবি, সেজন্যই একটু কষ্ট দিলাম। দ্বিতীয়টা হচ্ছে এবাড়ির স্টোর রুম।  -তোর মতলবটা কি বল তো? তপন হঠাৎ অনুনয়ের সুরে বলল –জয়ন্ত প্লিজ আমার কথাগুলো একটু মন দিয়ে শোন। আমাদের এই জানাশোনা জগতের বাইরে একটা প্যারালাল জগত আছে যার বিষয়ে আমাদের কোন ধারণাই নেই। ঢেঙ্কানলের জঙ্গল আর পাহাড়ের প্রবাদ চণ্ডরাজাকে বছরের একটা বিশেষ দিনে, ভাদ্রপদের শুক্লাপক্ষে সাত বছর বয়সী বালকের বলি নিবেদন করলে তিনি বিশেষ পরিতৃপ্ত হন, আর নরকের দরজা খুলে বেড়িয়ে আসেন, যার বলির দানে তিনি দরজা খুলতে পারেন সেই ব্যাক্তিকে সর্বসুখ এবং ক্ষমতা প্রদান করেন, সৌভাগ্যশালী সেই ব্যাক্তি পৃথিবীর সম্রাট হবার অধিকারী হয়, আর এই বিশেষ যোগ শুধু সাতশ বছরে একবার আসে। তবে এখানে একটা নিয়ম আছে ছেলেটিকে কোন রাজ পরিবারের সন্তান হতে হবে। আর এই বলিও তিনি শুধুমাত্র কোন রাজপুরুষের হাত থেকেই গ্রহণ করবেন। এতক্ষনে তপনের অভিসন্ধিটা পরিস্কার হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল, বুঝলাম ও তাহলে আমাকে রাজা ঠাউরেছে!  রুঢ় স্বরে বললাম  –মনে হচ্ছে আমাকে দিয়ে কসাইয়ের কাজ করাতে চাস্‌ তাইত? তপন তক্তপোষ থেকে উঠে এসে আমার হাত চেপে গাঢ় স্বরে বলল –ক্ষুরটা শুধু গলার ওপরে হালকা চেপে ধরবি, সামান্য একটু রক্ত ব্যাস, বাকি যা করার আমি করব। দারুন রাগে শরিরের সব রক্ত যেন মাথায় চড়ে গেল, তপনের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম  –তোর মাথা খারাপ হয়েছে বলে তো আমারও হয়নি। তপন অনুনয় করে বলল –আসল কথাটা বলাই হয়নি, ভেবে দ্যাখ জয়ন্ত জীবনের যা কিছু স্বপ্ন, উচ্চাশা সব তুড়ি মেরে পুরন করে ফেলব আমরা, আমি আর তুই। আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের মতো বাচব, সব কিছু আমাদের হাতের মুঠোয় হবে। হঠাৎ মনে হল তপনের মাথাটা বোধহয় বিগড়েছে! হয়ত সবই ওর বানানো গল্প। ভাবলাম ব্যাপারটা একবার যাচাই করেই দেখা যাক, বললাম   –ঠিক আছে ছেলেটাকে আগে দেখি তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

একচিলতে স্টোর রুমটা সিঁড়ির নিচে। আগেই বলেছি এবাড়িতে ইলেকট্রিক আলোর বালাই নেই মোমের হালকা আলোয় অন্ধকার যতোটা দূর হচ্ছিল তার চেয়ে বেশি পরিমানে যেন চারপাশে থেকে ঘিরে ধরছিল। বৃন্দাবন তালার মধ্যে চাবি ঘুড়িয়ে খুলছিল, অসহ্য লাগছিল, বিরক্ত হয়ে বললাম -এখানে কোন মানুষকে কেউ রাখতে পারে? তপন মৃদুস্বরে বলল -তোকে তো বলেইছি ও আলো সহ্য করতে পারে না, তাছাড়া বাজে সব জিনিস সরিয়ে ঘরটাকে পরিস্কার করে বিছানা পেতে দেওয়া হয়েছে ও ভালোই আছে। দরজা খুলে গেল। মোমের আলোয় কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। তপন বলল -ঘরের কোনে খাট পাতা রয়েছে।

এবারে তাকে দেখতে পেলাম, খাটের ওপর বেকেচুরে শুয়ে থাকা একটা শীর্ন মনুষ্যাকৃতি। আগেভাগে জানা না থাকলে ওকে মানুষ বলে বুঝতে হয়ত অসুবিধে হত। ছেলেটি কেমন যেন অসার মেরে পরে রয়েছিল। তপন মৃদুস্বরে বলল –আফিং গোলা জল খেয়ে বেহুঁশ হয়ে রয়েছে। মেরুদণ্ড দিয়ে বরফের স্রোত বয়ে গেল। তাহলে তপন এতক্ষণ সত্যি কথাই বলে চলেছে। বিপদের মুখে যে শুধু অর্ধমৃত এই মানব সন্তানটিই পরে নেই, আমিও পুরোমাত্রায় আছি সেটা বুঝে এর থেকে বেরোবার উপায় ভাবতে শুরু করলাম। তপন বলল –কাল সকাল সাতটায় অমাবস্যা লাগবে, সূর্যাস্ত পাঁচটা পয়ত্রিশে। তারপরই আমরা ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলব। মনের ভাব গোপন করে বললাম –ভালো কথা বাইরে চল তাহলে। বৃন্দাবন ঘরটায় ফের একবার তালা ঝুলিয়ে দিল। আমরা এবার একতলার বাইরের ঘরটায় চলে এলাম। তপন বলল –তাহলে জয়ন্ত এবারে ওপরে গিয়ে বসা যাক। আমি সুযোগ বুঝে বললাম –তপন মাথাটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে, ভাবছি শোবার আগে একটু তাজা হাওয়া খেয়ে আসব। আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি। তপন সন্দেহজনক দৃষ্টে চেয়ে বলল –কিন্তু আজ রাতে যে আমাদের কারও বাইরে যাওয়া চলবে না। কাল সন্ধ্যেই কাজ মিটে গেলে অবশ্য অন্য কথা। প্রতিবাদ করে বললাম –তার মানে কি আমি তোর বন্দি? তপন মাথা নেড়ে বলল –ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর জয়ন্ত, সমীরণের লোকেরা এই বাড়ির ওপর লুকিয়ে নজর রাখছে, তোকে ঢুকতেও দেখেছে নিশ্চয়ই, এখন তুই রাস্তা ঘাটে ঘুরলে যদি একটা বিপদ ঘটে তাহলে! আমি পাল্টা যুক্তি দিতে যাচ্ছিলাম, তপন কান না দিয়ে বলল –অবশ্য যতক্ষণ তুই এই বাড়ির ভিতর আছিস চিন্তার কিছু নেই, আমার কাছে বিপদের মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র আছে। তপন এবার ওর ফতুয়ার পকেট থেকে একটা রিভলভার বের করল। তপন অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল –দেখে নে জয়ন্ত! বিহারের মুঙ্গের থেকে যোগার করেছি, এটাকে দেশি পিস্তল বলে, লাইসেন্স নেই কিন্তু তাই বলে মানুষ খুন করা যাবে না এমন নয়। তপন সামান্য কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে ধীরেসুস্থে বলল –তাহলে ওপরে গিয়ে বসা যাক।

 অনিচ্ছাসত্ত্বেও তপনের সঙ্গে চললাম। প্রচণ্ড রাগে তখন আমি ফেটে পরতে চাইছি, তপন যেটা করছে সেটা বন্ধুত্বের নামে চরম বিশ্বাসঘাতকতা, কিন্তু এর যথোপযুক্ত শিক্ষা ওকে দিতে হলে আপাতত মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হবে। তপন ঘরে ফিরেই নির্বিকারে  গল্প জুড়ল, গত দেড় বছরে যেসব অসুবিধে ভোগ করে ছেলেটাকে এতদুর নিয়ে এসেছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে লাগল। আমার শোনার মত মন ছিল না। তপন যে ছেলেটাকে হত্যা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে তো পরিস্কার বোঝাই যাচ্ছে, তারপর ওর কাছে কার্তুজ ভরা একটা পিস্তলও রয়েছে, সামনা সামনি বিরোধ করাটা বোকামি হতে পারে। ঘড়ির কাটা বারোটা ছুতেই তপন ব্যাস্ত হয়ে পরল, বলল –চণ্ডের বলির সময় হয়ে এসেছে জয়ন্ত, বাজার থেকে একটা দিশি মুর্গি কিনে এনেছি ওটাকে চণ্ডকে দিয়ে রাতটা বিশ্রাম নিতে হবে। এখন কালকের দিনটা ভালোভাবে কাটলে হয়। তুই বরঞ্চ শুয়ে পর।                              তপন ডাক দিতেই বৃন্দাবন এসে আলো দেখিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে ঢোকামাত্র বৃন্দাবন বাইরে থেকে দরজা এঁটে দিল, তালা মারার শব্দটা কানে অসহ্য লাগল, জীবনে এই প্রথম মোবাইল ফোন ব্যাবহার না করার জন্য সাংঘাতিক পস্তালাম। দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপ্‌দপ্‌ করতে লাগল।

 

 

(৬)

মোমবাতিটা জ্বলতে জ্বলতে একসময় নিঃশেষ হয়ে গেল। রাত যে কত গভীর হয়েছে এই দমবন্ধ করা পরিবেশে তা বোঝা যাচ্ছে না, আমি গভীর চিন্তানিমগ্ন অবস্থায় খাটের ওপর বসে পরিস্থিতি তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। মাঝে মধ্যেই ভারী পায়ের শব্দ ঘুরে ফিরে আসছে। আমাকে শুধু  ঘরে বন্দি করেই তপন ক্ষান্ত হয়নি, রাত জেগে রীতিমতো নজরদারিও চালাচ্ছে। খেলা শেষ হবার আগে ও তাহলে ঢিলে দিতে রাজি নয়! কাল বলি দেবার পর নিশ্চয়ই তপন তার কুকর্মের সাক্ষী রাখবে না, নিজেকে আর ছেলেটাকে বাঁচাবার জন্য ঝুকি আমাকে নিতেই হবে, মনে মনে তৈরি হলাম।

বাথরুমে দু-বালতি জল ধরে রাখা ছিল। সেদুটো এনে দরজার সামনে মেঝেতে ঢেলে দিলাম। চৌকাঠ ডিঙিয়ে জল দরজার বাইরে গড়িয়ে গেল। সামান্য পরে একটা পায়ের শব্দ দ্রুত বারান্দার অন্য প্রান্তে চলে গেল, বুঝলাম বৃন্দাবন তপনকে ডেকে আনতে গেল। একটু পরে জোড়া পায়ের ব্যাস্ত পদশব্দ শোনা গেল, তারপর তপনের রুক্ষ স্বর কানে এলো –জয়ন্ত জল কোথা থেকে আসছে? আমি অ্যালুমুনিয়ামের বালতিটা শক্ত হাতে ধরে দরজার একপাশে দাড়িয়ে রইলাম। তপন আবার জিগ্যেস করল –জয়ন্ত উত্তর দে! আমি সাড়াশব্দ না করে তেমনি দাড়িয়ে রইলাম। এবার টের পেলাম কেউ চাবি ঘুড়িয়ে তালা খুলছে, আমি বালতিটা শক্ত হাতে ধরে তৈরি হলাম। দরজা খুলে গেল। একমুহুর্ত ইতস্তত করে একটা ছায়ামুর্তি ভিতরে প্রবেশ করল। যথাসম্ভব জোরে হাতের বালতিটা দিয়ে ছায়ামুর্তির মাথায় আঘাত করলাম। লোকটি বিকট শব্দ করে মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ল। যদিও ছুটে বের হতে বাধা পেলাম। তপন দরজা আগলে দাড়িয়ে রয়েছে, ওর হাতের উদ্যত পিস্তলটা সোজা আমার দিকে তাগ করা। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে বালতিটাকে বোঁ করে ঘুরিয়ে তপনের মাথায় আঘাত হানলাম। তপন সতর্কই ছিল সরে গিয়ে নিজেকে বাচিয়ে নিল। ঠাণ্ডা গলায় বলল –পাগলামি করিস না জয়ন্ত, ট্রিগারে চাপ পরে গেলে কি হত বলত? আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম –তপন তুই বিশ্বাসঘাতক? বন্দুক দেখিয়ে আমাকে দিয়ে মার্ডার করাতে চাস্‌? এতো নীচ তুই? তপন সামান্য হাসল –ওপরে উঠতে গেলে তো একটু নিচে নামতেই হয়! তবে তোর আক্ষেপ রাখব না, বন্ধুত্বের খাতিরে ফেয়ার ডিল হবে! যদি আমাকে ঘায়েল করে সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে পারিস তাহলে কথা দিচ্ছি তোর পথ কেউ আটকাবে না। তপন পিস্তল পকেটে পুরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তপন ইন্টারস্কুল বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। ওকে পরাস্ত করা মুশকিল। তবে কোনরকমে যদি পিস্তলটা কবজা করতে পারি তাহলে অবশ্য বাজি আমার। একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে মেঝে থেকে বালতিটা তুলে তপনের দিকে ছুড়ে মারলাম। বালতিটা তপনের মুখের ওপর সশব্দে আছড়ে পরল। তপন এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না, মুখ থুবড়ে  সশব্দে বারান্দার ওপর পরল। আমি তপনের উপর ঝাপিয়ে পরলাম। উদ্দেশ্য যে করে হোক ওর পকেট থেকে পিস্তলটা হাতিয়ে নেওয়া, তবে এবারে আর সুবিধা করে উঠতে পারলাম না। তপন সামলে উঠেছে। মুষ্টিযোদ্ধার কায়দায় জোরালো ঘুষি সোজা চালিয়ে দিল আমার থুতনির নিচের অংশটায়। দারুন যাতনায় মনে হল চোয়ালের হাড়টা বুঝি ভাঙল। পরের ঘুষিটা তপন আড়াআড়ি চালাল নাকের ঠিক নিচে, দুই মাড়ির সন্ধিস্থলে, চোখে সর্ষেফুল দেখা কাকে বলে সেদিন বুঝলাম। হুরমুরিয়ে মেঝেতে পরে গেলাম। প্রাণপণ চেষ্টা করে উঠতে যাচ্ছিলাম, তপনকে বলতে শুনলাম –অনেক হয়েছে জয়ন্ত আর দরকার নেই। কষের দুটো দাঁত মাড়ি থেকে ঝুলছিল, জিভের খানিকটা কেটে গেছিল, মুখে তাজা রক্তের বুনো গন্ধ যতটা কষ্ট দিচ্ছিল তার থেকেও বেশী যন্ত্রণা দিচ্ছিল তপনের হাতে ঠ্যাঙানি খাওয়ার লজ্জা। অনেকটা রক্ত পরে গেছিল, মাথা নিচু করে বৃন্দাবনের কাধে ভর দিয়ে সেই পুরনো ঘরে ফিরত এলাম। সামান্য পরে তপন এলো, হাতে একটা সিরিঞ্জ। তপন বলল     –ইনজেকশনটা নিলে রাতে ঘুমোতে পারবি, ব্যাথায় কষ্ট পেতে হবে না। আমি আর কোনরকম প্রতিরোধ করলাম না। তপন সিরিঞ্জটা হাতের শিরায় ফুটিয়ে খালি করে দিল।

কতক্ষণ অজ্ঞ্যান ছিলাম ধারণা নেই জ্ঞ্যান ফিরতে টের পেলাম আমি সেই ঘরে বিছানার ওপরে শুয়ে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। হাত ঠেকিয়ে বুঝলাম নাক আর মুখ থেকে প্রচুর রক্ত গড়িয়ে শার্টের ওপর জমাট হয়ে শুকিয়ে গেছে। তৃষ্ণায় শুকিয়ে গলা যেন কাঠের মতো লাগছিল। এখন বোধহয় দিনের সময়, কারন দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর একটা রেখা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছিল। তেষ্টায় গোলা ফেটে যাচ্ছিল, এখন একটু জলের ভীষণ দরকার। খাট ছেড়ে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শরির অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোনরকমে উঠে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়াতে লাগলাম যদি কোথাও একটা জলের জগ কি কুঁজো পাওয়া যায়। এদিক ওদিক হাতড়াতে হাতড়াতে হাতে কি যেন একটা ঠেকল। ধাতুর কোন জিনিস হাতে লেগে পড়তেই ঠং করে শব্দ উঠল।কাল রাতের বালতিটা। আওয়াজটা বাইরে অপেক্ষমাণ বৃন্দাবনের কানে গেছে, সে দরজা খুলে আমার দিকে চাইল। ওকে ইঙ্গিত করে জল চাইলাম। বৃন্দাবন দরজাটা খোলা রেখেই চলে গেল।ওরা বোধহয় বুঝে গেছে, নিজের পায়ে হেটে আর পালাবার শক্তি আমার নেই। একটু পরে বৃন্দাবন জলের গ্লাস নিয়ে এলো। জলটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিলাম। তেষ্টা মিটল না। আবার জল চাইলাম, বৃন্দাবন কথার উত্তর না দিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে গেল। সামান্য পরে ঘরে তপন এলো সঙ্গে বৃন্দাবন, একটা থালায় ডাল-ভাত টেবিলের ওপর রেখে তপন বলল –খেয়ে নে জয়ন্ত। তপনের দেওয়া খাবার খেতে ঘৃণা হচ্ছিল, যতই খিদে পাক না কেন ওর দেওয়া খাদ্য গ্রহণ করব না। তপন মৃদুস্বরে বলল  –কালকে যা কিছু ঘটল তার জন্য ক্ষমা করে দিস ভাই, যদিও এসবের প্রয়োজন কিছুই ছিল না, তুই আমার দিকটা একটু ভেবে দ্যাখ, কতবড় ঝুকি আমি নিয়েছি, গত দেড় দুবছর ছেলেটাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমার জীবনের সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছে, প্রতিদিন নিজের হাতে ওর মল মূত্র পরিস্কার করে আসছি, আমার সাংবাদিকতার কেরিয়ার চুলোয় গেছে। ব্যাংক ব্যালান্স সামান্য যা ছিল এই দেড় বছরে ডেবিট কার্ড ঘসে ঘসে সব গেছে। এখন শুধু একটাই ভরসা চণ্ডরাজার কৃপায় যা গেছে সব ফেরত পাওয়া।   মুখ ঘুরিয়ে বললাম –যত সব কুসংস্কার। তপন কিছু যেন বলতে গিয়ে সামলে নিল তারপর ধীরে সুস্থে বলল –ঠিক আছে তাই সই, তোর বিশ্বাস তখন হবে যখন নিজের চোখে দেখবি। তুই আর আপত্তি না করে একটু কো-অপারেট করে দে ভাই। আমি ততোক্ষণে কর্তব্য স্থির করে ফেলেছি, বললাম –তপন আমার মনে আর কোন ভয় নেই, তুই চাইলে তোর ওই পিস্তলের একটা গুলি খরচা করতেই পারিস কিন্তু আমি একটা অসহায় বাচ্চার গলায় ছুরি বসাচ্ছি না, নেহাত দরকার থাকলে তুই নিজেই করে নে, আমার বিশ্বাস নামে রাজার থেকে যে ভবিষ্যতে রাজা হতে চলেছে, তোর ওই দেবতাটি তার হাতের কাজেই বেশি খুশি হবে। তপন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল –এখন আড়াইটে বাজে, হাতে আর মোটে তিন ঘন্টা সময় আছে। সরি জয়ন্ত আর বোঝাবার সময় নেই, আমার তাড়া আছে। তুই স্বেচ্ছায় সাহায্য করলে ভালো লাগত, কিন্তু অন্য উপায় যখন নেই। তপন বৃন্দাবনকে ইঙ্গিত করল, দুজনেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। দেয়ালের এক কোনে কাঠের জানালাটা বাইরে থেকে পেরেক দিয়ে এঁটে দেওয়া ছিল। সেখানে এবার উপুরজপরি হাতুড়ির বারি পড়তে লাগল, বারকয়েক ঠোকার পর পাল্লাদুটো আলগা হয়ে খুলে পরল। জানলার বাইরে এবার বৃন্দাবনের মুখ দেখতে পেলাম। ও যেন কিছু এনে জড়ো করছে। পিছন দিয়ে তপনের মুখ দেখা গেল, আমার দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর স্বরে বলল –এবার যেটা হবে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা তোর আছে কিনা পরিক্ষা করে দেখা যাক, আমার কিন্তু কোন দোষ নেই। তপন পকেট থেকে লাইটার বের করে নিচু হয়ে কিছুতে যেন অগ্নিসংযোগ করল, আর বৃন্দাবন একটা কার্ডবোর্ডের টুকরো দিয়ে তীব্র ভাবে বাতাস করতে লাগল, এদের মতলবটা যে কি মাথায় ঢুকছিল না, অবশ্য সবকিছু পরিস্কার হতে বেশি সময় নিল না। মিনিট পাঁচেকের বিরতি তারপর হঠাৎ গলগল করে ধোঁয়া ঘরের মধ্যে ঢুকতে শুরু করল, অসহ্য কটু গন্ধে ঘর কানায় কানায় ভরে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চোখ গলা তীব্র ভাবে জ্বলতে শুরু করল। এটা তপনের আরেকটা শয়তানি বুদ্ধির নমুনা, জানলার বাইরে শুকনো লঙ্কা আর খড় পুড়িয়ে ধোঁয়া তৈরি করছে। বিষাক্ত এই ধোয়ার বৃত্তে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ল। প্রচণ্ড কাঁসির দমকে বুকের ভিতর থেকে দলা দলা কফ আর রক্ত বেরিয়ে এলো আর থিকথিকে কালো একটা পর্দা যেন ক্লান্ত চোখ দুটোকে ঢেকে দিল।

জলের ঝাপটায় জ্ঞ্যান ফিরত এলো। কেউ বালতি ভরে ঠাণ্ডা জল গায়ে মাথায় ঢেলে দিয়েছে। ঝাপসা দৃষ্টি মেলে দেখলাম সৈনিকের পোষাক পরা একজন লোক সামনে দাড়িয়ে। লোকটা আমার দিকে সামান্য চেয়ে হুকুমের সুরে কি যেন বলল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরা আবার কারা? ধীরে ধীরে চেতনা ফেরত এলো। ঘরের ভিতর চোখ চালিয়ে যা দেখলাম তা বেশ অপ্রত্যাশিত। আমাকে এরা আবার একতলার সেই স্টোর রুমটায় নিয়ে এসেছে। ঘরের একটা কোনে তপন চিত হয়ে পরে কাতরাচ্ছে। ওর জামাকাপড় তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তলপেটের কাছটায় গভীর ক্ষত, বোধহয় ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। লোকটি কোমরে দুহাত দিয়ে আমাকে জরিপ করছিল। এবারে কৌতুকপুর্ন কণ্ঠস্বরে বলল –রাজা মশাইয়ের জ্ঞ্যান ফিরেছে দেখছি। অপদার্থ বন্ধুটির কল্যানে ফালতু কষ্ট ভোগ করতে হল। তবে যার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে পস্তাতে তো হবেই। লোকটা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন আমার কতকালের চেনা বন্ধু, অনেকদিন পর হঠাৎ দেখা হয়েছে, জিগ্যেস করলাম –আপনি কে? লোকটি বিনয় দেখিয়ে বলল -আমি সামান্য লোক, জঙ্গলের একজন জংলীও বলতে পারেন, আপনার বন্ধুর কেরামতি আর নিজের গাফিলতিতে এই শহরের পথে পথে ঘুরে বেরাচ্ছি। অধমের নাম সমীরণ মাহাতো। চমকে উঠলাম! একি সেই কুখ্যাত নকশাল নেতা? সমীরণ মুচকি হেসে বলল –মনে হচ্ছে রাজামশাই আমার নাম শুনেছেন।গত চব্বিশ ঘণ্টায় যা কিছু ঘটেছে নতুন করে অবাক হওয়ার ক্ষমতাটাই দেখলাম হাড়িয়ে ফেলেছি, তপন আমাকে খুন করতে চাইছিল এখন বোধহয় এই লোকটাও তাই করবে, আমি চুপ করে পরে রইলাম। সমীরণ মুচকি হেসে বলল –তাহলে রাজামশাই বন্ধুর জন্য যে কাজটা করতে যাচ্ছিলেন সেটা এবার একটু আমাদের জন্য করতে হবে যে।

-যদি না বলি।

সমীরণ হাসল, ক্রূর নির্দয় হাঁসি, বলল –তাহলে সেটাকে হ্যা করতে আমার লাগবে ঠিক সাড়ে চার মিনিট, লোহার প্লাস দিয়ে প্রথমে আপনার হাতের নখগুলো উপড়ে ফেলব তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে আবার ওই প্লাসের টানেই চোখের পাতা দুটো খুবলে ফেলব, এরপরেও যদি আপনি হ্যা বলতে দেরি করেন তাহলে, আমার পকেটে একটা ধারালো ক্ষুর আছে সেটা বের করব, ক্ষুরটা আপনার শরিরের বিশেষ অংশে বুলিয়ে সেটাকে কাটছাঁট করব, আর বিশ্বাস করুন এসব কিছু করতে আমার কিন্তু ওই সাড়ে চার মিনিট সময়ের বেশী লাগবে না। বিশ্বাস করতে অসুবিধে হল না, এই ভয়ংকর লোকটা যা বলল তা নিশ্চয়ই করবে। হতাশায় মনোবল তলানিতে ঠেকল। আর সামান্য কিছু পরে যে আমি ওই ছেলেটা তপন কেউই জ্যান্ত থাকব না সেটা একপ্রকার নিশ্চিত, শুধুশুধু প্রতিরোধ করে জীবনের শেষ মুহুর্তটাকে নৃশংস করে তুলতে মন সায় দিল না। নির্জিবের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সমীরণ করুণার সুরে বলল – সরি রাজামশাই, নিরপরাধ ব্যাক্তির ওপর জুলুমবাজি আমাদের নীতি বিরুদ্ধ কিন্তু এখানে সব দোষ আপনার প্রিয় বন্ধুর, তাছাড়া লাস্ট মোমেন্টে একটা জলজ্যান্ত রাজার ছেলে কোথায় পাই বলুন। সমীরণ তুড়ি মেরে ইঙ্গিত করতেই, আলখাল্লা পরিহিত একজন লোক এসে পাশে দাঁড়াল, লোকটার সঙ্গে সমীরণ অচেনা কোন ভাষায় কথা বলছিল যেটা না বুঝলেও সমীরণ লোকটাকে ত্রিলোচন বলে সম্বোধন করছিল, সেটা বুঝতে পারলাম। এই কি তপনের বর্নিত ত্রিলোচন! হবে হয়ত, তপনের নাটকের সবকটা চরিত্রই বোধহয় আজ এখানে হাজির হয়েছে। হঠাৎ সমীরণের কথায় ছেদ পড়ল, একজন শাগরেদ হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরের মধ্যে এসে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলতে শুরু করল। আমি শেষ মহুর্ত উপস্থিত জেনে শুধু নিজের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিলাম, রাজ বংশের উত্তরাধিকার হিসেবে আমার প্রাপ্য হয়েছে শুধু গোটাকয়েক ভাঙা ইট আর একফালি জমির টুকরো, যার বখরা নিয়ে মামলা টানতে টানতে জীবন বরবাদ হতে চলেছে। কেরানীর চাকরি করি, মাইনে যা পাই ডাল ভাত টুকু জুটে যায়। রাজভোগ কপালে না জুটুক, রাজদ্রোহ দেখা অদৃষ্টে ঘটে গেল। ওদিকে দেখলাম সমীরণ আর তার শাগরেদরা হঠাৎ বেশ চঞ্চল হয়ে পড়েছে। ওদের কথা থেকে বুঝতে পারলাম, পুলিশ বোধহয় কাছাকাছি এসে পড়েছে। সমীরণ ত্রিলোচনকে তাড়া লাগাল –আর কতক্ষণ বাকি? ত্রিলোচন শুকনো মুখে বলল আর দশ মিনিট ব্যাস। একটা গমগমে শব্দ বাড়ির আধখসা ইটগুলোকে যেন কাঁপিয়ে দিল। বাইরে থেকে কেউ মাইকে ঘোষণা করল    –সমীরণ আমরা এই বাড়ি ঘিরে ফেলেছি, পালাবার কোন পথ নেই। যদি আত্মসমর্পন কর তাহলে কথা দিচ্ছি প্রানে মারব না। সমীরণের মুখ দেখে মনে হল না সে বিশেষ ভয় কিছু পেয়েছে। রাইফেল হাতে বন্ধ জানলার সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলল   –আমি সমীরণ মাহাতো বলছি, আমরা আত্মসমর্পন করব, কথা দিচ্ছি গোলাগুলি চলবে না শুধু কুড়ি মিনিট সময় দিন, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাবার জন্য। কথা দিচ্ছি আমরা ধরা দেব। সামান্য বিরতির পর বাইরে থেকে আওয়াজটা ফের শোনা গেল  –দশমিনিট সময় দেওয়া যাবে, কিন্তু কোনরকম চালাকি করলে গুলি করা হবে। এতো কষ্টের মধ্যেও দেখে শ্রদ্ধা হল, সমীরণের মুখে হাঁসি? এই ঘোর সংকটেও! সমীরণের ইঙ্গিতে আমার হাত পায়ের বাধন কেটে ফেলা হল। বিছানার ওপর থেকে ছেলেটাকে দুজন রক্ষি মিলে মেঝেতে একটা চাদরের ওপর শুইয়ে দিল। ছেলেটির ভাবলেশহীন চোখে যেন অসীম ক্লান্তির ছাপ দেখতে পেলাম, ও কিছু বুঝছে কিনা কে জানে? ত্রিলোচন দুর্বোধ্য সব মন্ত্র জপ করতে করতে ছেলেটির কপালে কালো টিপ পরিয়ে দিল, সেই একই টিপের ফোটা আমার আর সমীরণের কপালেও দেগে দিল। এবারে একটা লম্বা শান দেওয়া ছুরি আমার হাতে তুলে দিয়ে ত্রিলোচন ছেলেটির গলায় কোপ দিতে ইঙ্গিত করল। ছুড়িটা ছেলেটির গলায় হালকা ঠেকিয়ে ধরলাম তবে চাপ দিতে পারলাম না, ত্রিলোচন আমার হাতের ওপর নিজের হাত রেখে সামান্য চাপ দিল। ছেলেটি যাতনায় কঁকিয়ে উঠল, মাথা নিচু করে চোখ সরিয়ে নিলাম। রক্তের ধারা ছেলেটির গলার ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়তে লাগল। ত্রিলোচন একটা হলুদ ফুলে রক্তটা ধরে চণ্ডরাজার পাথরের ওপর রেখে সমীরণের দিকে অর্থপুর্ন দৃষ্টে চাইল। দুহাত দিয়ে লম্বা তরোয়াল উচিয়ে সমীরণ এগিয়ে এল, আর ত্রিলোচনও সামনে থেকে সরে গেল। সমীরণ ছেলেটির গলা লক্ষ্য করে তরোয়াল উচিয়ে ধরল। গুড়ুম! কানের পাশ দিয়ে গুলির শব্দ হল আর সমীরণের একজন স্যাঙ্গাৎ ধরমড়িয়ে মেঝে নিল এবার এলোপাথাড়ি গুলি ঘরের সর্বত্র বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল। পুলিশ বাড়ির কোন ফাঁকফোঁকর খুঁজে ঢুকে পড়েছে, সমীরণের হাতে গুলি লেগে তরোয়ালটা পরে গেছে, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে সমীরণ রাইফেলটা তুলতে গেল কিন্তু সুযোগ পেল না, একটা গুলি কপাল ভেদ করে দেয়ালের গায়ে ঝোলানো ফোটো ফ্রেম টাকে চুরমার করে দিল। সর্দারের আকস্মিক পতনে হতবুদ্ধি স্যাঙ্গাতের দলের এলোমেলো  প্রতিরোধ পুলিসের ঝোড়ো আক্রমণের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। একে একে সমীরণের দলের শেষ যোদ্ধাও মাটি নিল।

 

 

<<দ্বিতীয় সংখ্যা                                                                         পরবর্তী সংখ্যা : আগামী সপ্তাহ>>

 

Writer Sanjoy Bhattacharya

লেখক : সঞ্জয় ভট্ট্যাচার্য, পদ্মপুকুর রোড , কলকাতা।

 

SOURCESanjoy Bhattacharya
Previous articleএক বিচিত্র শহর
Next articleসকাল সাতটার শো
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here