—১—
সকাল থেকেই মেঘের ফোনটা আনরিচেবল। অনেক চেষ্টা করেও মেঘের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ শাওনি। আজ মেঘের চাকরির ইন্টারভিউ। গত পাঁচদিন ধরে মেঘ এই ইন্টারভিউর জন্যই শাওনির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি। এদিকে, গতকাল পাত্রপক্ষ শাওনিদের বাড়ি এসে আগামী মাসের শেষদিকের একটা তারিখ দেখে বিয়ের জন্য পাকা কথা দিয়ে গেছে। অতএব হাতে বলতে গেলে আর মাত্র কয়েকটা দিন। সুতরাং ওরা দুজনে মিলে যে এক হওয়ার স্বপ্নটা এতদিন ধরে দেখে আসছিল, আজ যেন সেটা ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে।
মেঘেদের পরিবার শাওনিদের মতো আর্থিক ভাবে তেমন সমৃদ্ধ নয় বলেই হয়ত আজও শাওনি ওর বাবা-মাকে মেঘের বিষয় একটা কথাও বলতে পারেনি। অপেক্ষা করেছে মেঘের একটা ভালো চাকরি পাওয়ার। অবশ্য মেঘ যে চাকরি পায়নি, তেমনটা নয়। আসলে শাওনির পরিবারের সামনে পাত্র রূপে দাঁড়ানোর মতো মেঘের মানিব্যাগের উচ্চতাটা যে এখনো হয়নি। আর তাই মেঘের এই চাকরিটা পাওয়ার উপর এখন সবকিছুই নির্ভর করছে।
শাওনির ঘরের দেওয়ালগুলো সবুজ রঙের হলেও সিলিংটা হলদে। একটু বেমানান। খয়েরি রঙের তিন ব্লেডের পাখাটা ঘুরছে অনবরত। মেঘের চিন্তায় মঘ্ন শাওনি জানালা দিয়ে একভাবে ঠিক কতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, সেটা জানা নেই। তবে, এটুকু মনে আছে সকালে হাতে নেওয়া বইটা সেই যে খুলে বসেছে তারপর আর ওর বন্ধ করা হয়নি। কিছুদিন আগে অবধি শাওনি এই সময়টা মেঘের ফোনের জন্য অপেক্ষায় থাকত কিন্তু এখন চিত্রটা অন্য। আকাশের দিকে তাই তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়া শাওনি, হঠাৎ কেঁপে উঠল একটা ফোনে।
– হ্যালো, শাওনি। আমি মেঘ।
– কীরে, চাকরিটা পেয়ে গেছিস??? (ওপর প্রান্ত থেকে মেঘের গলার স্বর শুনেই বলে উঠল শাওনি)
– সব বলব। তবে, একটু পরে। তুই তাড়াতাড়ি হাইওয়ের রাস্তায় চলে আয়।
কথা শেষ করেই ফোনটা রেখে দিল মেঘ, শাওনিকে কিছু বলার তেমন সুযোগ সে দিল না। ফোনটা রাখার পর, শাওনি মেঘের কথামত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ল এবং এগিয়ে চলল শহরের নানান কোলাহল পিছনে ফেলে নিজের স্বপ্নকে স্পর্শ করার তাগিদে। মনে মনে শাওনি ধরেই নিয়েছে যে চাকরিটা মেঘ পেয়েই গেছে এবং ওদের সম্পর্ক এবার সসম্মানে সবার স্বীকৃতি আদায় করতে পারবে। আর তাই বিগত কিছুদিনের কান্না, হলদে সিলিং এর দিকে এক জোড়া চোখ নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা। এইসব কিছুর যেন আজ ইতি ঘটবে।
এদিকে, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম আর ঘড়ির কাটা অনবরত ঘুরছে দেখে, মাঝ রাস্তাতেই অটোরিকশা থেকে নেমে শাওনি হাঁটতে লাগল। আকাশের দিকে তাকালে মনে হবে না যে সেদিন বৃষ্টি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। সেদিনের ওই নিঃসঙ্গ ভেজা হাইওয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শাওনির চোখের সামনে শুধুই ভেসে উঠছিল ওর আর মেঘের একসঙ্গে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো। কলেজ স্ট্রীট হোক কিংবা গঙ্গার ঘাটে বসে পড়ন্ত বিকেলগুলো গরম লেবু চায়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একসঙ্গে উপভোগ করা। স্মৃতির অ্যালবাম থেকে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসছিল একের পর এক সেই পুরনো দৃশ্যগুলো। হ্যাঁ! কলেজের ফার্স্ট হওয়া শাওনির সাধারণত ক্লাসে বাকিদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগত না আর তাই যখন সে এক কোণে একা বসে থাকত, তখন ছিপছিপে চেহারার এই মেঘ যেত ওকে সঙ্গ দিতে। ওদের প্রেমটা কীভাবে হয়েছে সেটা ওরা কোনোদিনই বোঝেনি। কারণ একে অপরের পাশে থাকতে থাকতে ওরা আসলে একে অপরের অভ্যেস হয়ে উঠেছিল।
—২—
হাঁটা থামিয়ে হাইওয়ের ধারে দাঁড়িয়ে কখন যে শাওনি একভাবে বটগাছের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া জলের ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, তার হুঁশ নেই ওর। কিন্তু হঠাৎ একটা হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করতেই চমকে উঠল শাওনি এবং পিছন ফিরে তাকাল। সেই হাত আর কারোর নয় স্বয়ং মেঘের। হ্যাঁ! মেঘ, যাকে ও নিজের চেয়েও অধিক ভালোবাসে। মেঘ কিছু বলার আগেই আবারও সেই প্রশ্নটা শাওনি ওর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল,
– কীরে, চাকরিটা পেয়েছিস তো? সুখবরটা দিতেই আমাকে এইরকম নির্জন জায়গায় ডাকলি, তাই না?
কিছুক্ষণ একভাবে শাওনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর, মেঘ বলল
– না, রে। ওই চাকরিটা আর আমার পাওয়া হল না, সেইসঙ্গে তোকেও।
কথাটা শোনা মাত্র মাটিতে বসে পড়ল শাওনি, একদম নিথর। ওর মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মেঘের দিকে তাকিয়ে ও আবারও সেই একই প্রশ্ন করল,
– মেঘ, তুই কি বুঝতে পারছিস না ব্যাপাটা কতটা সিরিয়াস? কেন ঠাট্টা করছিস, তুই চাকরিটা পেয়ে গেছিস তাই না?
ঘড়ির কাঁটাটা তখন সন্ধ্যে নামার অপেক্ষায়, বাকি আর পাঁচটা দিনের চেয়ে সেদিনের হাইওয়েটা বড্ড বেশি একলা। এতদিনের সব রঙিন স্বপ্নগুলো যেন মুহূর্তেই বদলে গেল কালো রঙে, ঠিক আকাশের ওই রঙটার মত।
নিজের চোখের জল আর আটকে রাখতে না পেরে শাওনি ফের বলে উঠল,
– আমাদের সম্পর্কটা তাহলে এখানেই শেষ, তাই তো? বাড়িতে বিয়ের তোড় জোড় শুরু হয়ে গেছে। গতকাল সৌম্যদের বাড়ি থেকে এসে বিয়ের পাকা কথা বলে গেছে। এখন কি হবে, মেঘ? কি করব আমি?
– (যন্ত্রণাটা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেই বলল মেঘ) কেন? তোর যা করার সেটাই করবি। আমাদের তো আগেই কথা হয়ে গিয়েছিল, এই চাকরিটা না পেলে আমাদের সম্পর্কটাও বাকি আর পাঁচটা ব্যর্থ সম্পর্কের মতই ব্যর্থ প্রেমের খাতায় আজীবনের জন্য লিপিবদ্ধ হয়ে যাবে।
শহরের বুকে বসন্তের সন্ধ্যেগুলো তুলনামূলকভাবে একটু দেরিতে নামে। ব্যস্ত দিনযাপনের জটগুলো ছাড়াতে ঠিক কতটা সময় লাগে, সেটা বোধহয় সন্ধ্যেগুলোর জানা আছে। সূর্যের পড়ন্ত লাল আলো আর চাঁদের স্নিগ্ধ হলদে আলোয় নিজের প্রিয় মানুষটাকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানতে গিয়ে মেঘের বুকটা তখন ফেটে যাচ্ছে। তবুও বিদায়বেলায় মুখে হাসি রেখে নিজের জামার বুক পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে শাওনির হাতে দিয়ে মেঘ বলল,
– প্রত্যেকবার তোর জন্য চকলেট আনতে ভুলে যেতাম বলে, তোর কাছে কতই না বকা খেয়েছি। কিন্তু এই প্রথমবার হয়ত ভুলিনি। আজ তাই অন্তত এই চকলেটটা নিয়ে যা। আমাকে ফিরিয়ে দিস না, প্লিজ।
চকলেটটা হাতে নিয়ে মেঘকে জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদছিল শাওনি। অপরদিকে, মেঘ নিজেকে এতক্ষণ সামলে রাখতে সক্ষম হলেও, সেই মুহূর্তে আর নিজেকে সে ধরে রাখতে পারল না। শাওনিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সেও ভাসল কান্নায়।
আর এর সঙ্গেই আমাদের এই শহর আবারও একটা সম্পর্ক ভাঙ্গনের সাক্ষী হয়ে থাকল। সেদিন মেঘ চাকরিটা না পেলেও, আগামীদিনে হয়ত মোটা মাইনের একটা চাকরি ও ঠিকই পেয়ে যাবে। কিন্তু তখন এই চাকরি না পাওয়ার কারণে ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা, শাওনিকে, মেঘ আর কখনোই ফিরে পাবে না।
কলমে রণিত ভৌমিক