জীবনের গল্প

2
1979
Photo : Time Magazine

বাড়ির বাইরে একটানা কুকুরের ডাক সত্ত্বেও নিঃসঙ্গতার নগ্ন খোলস স্পষ্টভাবেই অনুধাবন করা যাচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। ঘরে চাল নেই, তেল-লবণও অপর্যাপ্ত। মধ্যবিত্ত পরিবারের মাস শেষের এই টানাপোড়েন বুঝতে পারেনা ছেলেটা। বয়স আর কতইবা হবে? সবেমাত্র প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে উঠেছে। স্কুলমাঠে খেলাধুলা করে বাড়িতে ফিরতেই মা বাজার থেকে চাল এনে তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতে বলেছেন।

ক্লান্তি আর বিরক্তি একসাথে জেঁকে বসলেও বাবার কাছ থেকে একটা ব্যাগ, একটা কাগজ আর কিছু টাকা নিয়ে সে গ্রামের বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করে। মাঝপথে যাবার পর তার মনে পড়ে বাংলা খাতার পৃষ্ঠা শেষ হয়ে গেছে, অন্য খাতায় বাংলা লিখলে স্যার বকা দেন। সামনে অগ্রসর হতে হতে সে ভাবে, আগামিকাল আব্বাকে বলতে হবে।

একটা ব্যাগ, একটা কাগজ আর কিছু টাকা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে ছেলেটা। দোকানদার নেই, সম্ভবত চা-পান বা সিগারেট খেতে গেছেন। শেষবিকেলে জমে উঠতে শুরু করেছে দোকানপাট। আব্বার দেয়া কাগজটা বের করে দেখতে থাকে সে। যদিও পড়ার কিছু নেই কারণ চিঠিটা সেই লিখেছে, আব্বা শুধু মুখে বলেছেন। তবুও সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে,কোথাও কোন ভুল আছে কী না!

‘এলাহী ভরসা

বাবুল ভাই,
সালাম নিবেন। আমার ছেলেকে কিছু টাকাসহ পাঠালাম। মাসের শেষ তো, সামনের হাটবারে বাঁকিটা দিও দিবো। পাঁচ কেজি চাল, আধা কেজি ডাল আর এক পোয়া সয়াবিন তেল দিয়ে বাধিত করবেন।
ইতি
জামাল হোসেন
তাং- ১৮/৭/২০০৬’

বাবুল চাচা তখনো আসেন নি। ছেলেটা দূরে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে দুই পাশের দোকান গুনছে, এক সারিতে চারটি অন্য সারিতে তিনটি। পালাক্রমে সে গণনা করছে, একবার এপাশ থেকে ওপাশ, অন্যবার ওপাশ থেকে এপাশ। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে, পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। পাশের দোকান থেকে আগরবাতির সুগন্ধ ভেসে আসতে শুরু করছে।

দূর থেকে বাবুল চাচাকে দেখা যায়। আয়েশ করে বসেন দোকানের মাঝখানের উঁচু জায়গাটিতে। ছেলেটা হাতের কাগজ আর টাকা এগিয়ে দেয় তার দিকে। শুরুতে আগ্রহ থাকলেও চিঠিটা পড়ে মুখটা মলিন হয়ে যায় তার।

চুপচাপ নীরবতা, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।

মুয়াজ্জিনের আযান ভেসে আসছে। আযান শেষে ছেলেটা বলে, চাচা, আব্বা বলেছে পাঁচ কেজি চালের কথা…
নিদারুণ বিরক্তিমাখা কণ্ঠে গত মাসের বাঁকির কথা উল্লেখ করে দোকানদার বলেন, ‘আমারেও তো মহাজনের কাছ থেকি মাল আনতে হয়। আমারও তো মাস শ্যাষ। এভাবে কী বাঁকি দেয়া যায়? কয়জনাক বাঁকি দিবো?’

সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন না তিনি। দুই কেজি চাল আর দুইশ পঞ্চাশ গ্রাম ডাল দিয়ে বিদায় করেন ছেলেটাকে।

সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। ক্লান্ত শরীরে অবসন্ন মন নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে ছেলেটা। ভাবতে থাকে, কোনোভাবে যদি আব্বাকে অপমানিত হওয়া থেকে রক্ষা করা যেত!

 

লেখক মোঃ জুবায়ের ইবনে কামাল

লেখক পরিচিতি : মোঃ জুবায়ের ইবনে কামাল, (স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী,বয়স ২৩ বছর, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি-জীবনের গান গাই), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ।

 

 

 

 

বিঃ দ্রঃ লেখাটি মন_ও_মৌসুমী র #ত্রিমাসিক_লেখা_প্রতিযোগিতার (জানুয়ারি ,২০১৯) এর একটি Entry .
ফলপ্রকাশ জানুয়ারি ,২০১৯ এর দ্বিতীয় সপ্তাহ , পড়তে থাকুন -যোগাযোগ বজায় রাখুন #মন_ও_মৌসুমী র ওয়েবসাইট এর সাথে।

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here