হিন্দি_হ্যায়_হাম

0
1560
hindihainhum.in

“ওগা মে ঘুসা মিল্গা?”
পাঞ্জাবি ড্রাইভাররের মনে হলো হেঁচকি উঠলো।
চলেছি অমৃত্সর থেকে ওয়াগা বর্ডার, বসেছি ড্রাইভারের পাশে। শুনেছি পাঁচটায় শুরু হয়, মানে ওই বিটিং রিট্রিট আরকি। এখনই প্রায় পাঁচটা, খুব টেনশন হচ্ছে সময় পৌঁছতে পারবো কিনা? তাই এই উৎকণ্ঠা। ভাষাটা বোঝা গেল না তো? ওই হলো আআমাআর হিন্দি। নাঃ, এটা ভ্রমণ কাহিনী নয়, আমার হিন্দি কাহিনী। অবশ্য আমি হিন্দি বললে আশপাশ থেকে আমারই সঙ্গীদের কেউ না কেউ শ্রোতাকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কারন আমার হিন্দি শ্রোতাদের কোনো কারণে অজ্ঞান যদি নাও করে খেপিয়ে যে দেবে সে ব্যাপারে গ্যারান্টি। তাই রাজ্যের বাইরে বেড়াতে গেলে আমি পারতপক্ষ্যে সঙ্গীরা ছাড়া অন্য কারো কাছে মুখ খুলিনা।
হিন্দির একটা ব্যাপার আমার অসহ্য লাগে, কোথায় এককে উচ্চারণ করবে এ্যাক্, তা নয় বলে এ-ক্। আমার নামটা অন্নপূর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়, সেটাকে আন্নাপূরণা গাঙ্গিয়োপাধ‍্যিয়ায়, বলবে কেন? কেন বলবে? শুনতে কেমন বিচ্ছিরি লাগেনা বলুন? তার ওপর এমনিতেই লম্বা নাম, তা আরো লম্বা করলে ভালো লাগে বলুন?
বিয়ের পর থেকেই প্রায় সবাই হিন্দি জানে এমন শশুর বাড়িতে আমার হিন্দি নিয়ে প্রথম প্রথম বেশ হাসা হাসি হত, কিন্তু ক্রমে তা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। একমাত্র আমার সহায় আমার শ্বাশুড়ি, তাঁর কাছেও আমার মত হিন্দি প্রায় ল্যাটিনের সমতুল্য। বাকি স্বামী, শ্বশুর, ননদ, কন্যা সবাই যে কিকরে অত ভালো হিন্দি শিখলো কে জানে।
ওয়াঘা তে যাবার পথে অবশ্য বড় উইঙ্গার গাড়ির একদম পেছন থেকে আমার পতিদেব প্রায় চেঁচিয়ে ড্রাইভারের ভিরমি খাওয়া আটকায়, নয়তো বোধহয় সে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি বাধাত। পতিদেব চেঁচিয়ে বলেছিলো, “সারদার্জি, ঘাবড়াইয়ে মৎ, ও পুঁছ রহি হ্যায়,- ওয়াঘা মে টাইমকে বাদ পঁহোছনেসে, ঘুসনে, মৎলব আনদার জানে দেগা কি নেহি?” সে তখন বলে কি! সে নাকি ভেবেছে আমি ঘুসি মারার ব্যাপারে কিছু বলছি। এই দেখুন! কি সুন্দর লিখে ফেললাম। ওই আমার আরেক সমস্যা, কেউ বলে দিলে ঠিক আছে, নিজে থেকে বলতে গেলেই কেমন যেন গুলিয়ে ফেলি।
ওয়াঘার অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, সবাই ফটোসেশন করছে, আমি তো এক্কেরে সেলফি পাগলী। দাঁড়িয়ে গেলাম এক পূর্ণ ইউনিফর্ম পড়া বিশাল লম্বা জাওয়ানের কাছে, সে তখন দাঁড়িয়ে একটা উঁচু বেদির ওপর, তার সাথে ছবি তোলার খুব ইচ্ছে, কিন্তু সমান সমান না হলে কি করি? অত্যুৎসাহে নিজের হিন্দি জ্ঞানের কথা ভুলে গেলাম, তার পাশে গিয়ে আবেদন করলাম, “তুম নামগা, হাম উঠগা, ছাবি তুলগা” সে বেচারা অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে রইলো, মনে হলো তার বড় খাঁড়া গোঁফটা যেন একটু ঝুলে পড়লো। তারপর তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন,”যা বলতে চাইছেন বাঙলাতেই বলুন, আমি আশা করি বুঝবো।” তৎক্ষণাৎ সীতার পাতাল প্রবেশের আগের মুহূর্তে সীতার জায়গায় আমি পৌঁছে গেলাম।
একবার, গয়া ঘুরতে গিয়ে এক দেহাতি দোকানদারকে রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “দেতা, দেতা, নেহি দেতা, নেহি দেতা, বেশি টাকা কেন নেতা?” লোকটা কেন জানি আমার দিকে হাঁ করে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো তারপর কি বুঝলো কে জানে? মুখ ফিরিয়ে অন্য খদ্দেরদের দিকে মন দিলো। তারাও অবশ্য অবাক হয়ে আমাকেই দেখছিল। মানে মানে কেটে পড়লাম, কি জানি কি মানে করেছি!
কাট টু….চলে আসি আমার বাংলায়। পুজোর সময় সবাই মিলে গাড়িতে গাদাগাদি করে বেড়িয়েছি। এক পুজোর কাছে গাড়ির সামনে একটা ছেলে মোটর সাইকেল নিয়ে টাল খেয়ে গেল। আরেকটু হলেই আমাদের গাড়ির সাথে হয়েছিল আরকি। আমি যথারীতি সামনে, আসলে একটু চেহারাটা এক্কেবারে দুর্ভিক্ষ পীড়িত নয় বলে গাড়িতে সবাই আমায় সামনের সিটেই ঠেলে দেয়, আমারও অবশ্য ভালোই লাগে। তা আসল কথায় আসি, ছেলেটি কোনো মতে উঠে দাঁড়িয়ে, ড্রাইভারকে রেগে গিয়ে হিন্দিতে কিছু বললো, আমার এসব একদম পছন্দ নয়, এটা আমার জায়গা, আমার ভাড়া করা গাড়ী, তার ড্রাইভার, যা বলার আমি বলবো, অন্য কেউ বলবে কেন? ড্রাইভার কিছু বলার আগেই জানলা দিয়ে মুখ বার করেই ঝেড়ে দিলূম,”কেয়া চালাতা, গাড়ি মারতা।” ব্যাটা কি বুঝলো কে জানে? প্রায় তেড়ে মারতে আসে আরকি। ভাগ্য ভালো খুবই পরিচিত ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেছিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বললো, “আরে দিদি, ওটা দুচাকা, এটা চার চাকা, যাই হোক না কেন দোষ আমার, এটাই সিস্টেম। কিন্তু দিদি আপনি ওটা কি বললেন?” ধুর্ ছাই! আমি কি ছাতা জানি নাকি কি বললাম! রেগে গেলে আপামর বাঙালির মত আমিও হিন্দি বলি, তাতে আবার মানে টানে বুঝতে গেলে তো চিত্তির।
এরপর আরেকদিন বাড়িতে এক কার্পেট ওয়ালা এলো, আমি একা, খুব শখ কার্পেট কেনার, কিন্তু হাতে তেমন টাকা নেই, কি করি, সে জানালো, যদি তার খাতায় লিখে দি, তবে সে একটা কার্পেট রেখে যাবে। অগত্যা, জিজ্ঞেস করলাম, “কি লিখবো?” সে বলল, “লিখ্ দিজিয়ে, এক কার্পেট লিয়া।” আমিও লিখে দিলাম। কিন্তু বাড়ির কারোরই প্রায় কার্পেটটা পছন্দ হলো না, দিন সাতেক পড়ে সেই ফেরিওয়ালা আবার এলো, সেদিন সবাই আছে, আমি কার্পেটটা ফেরৎ দিতে গেলাম, লোকটি ফেরৎ নিয়ে খাতা এগিয়ে দিয়ে আবার বললো,
“লিখ দিজিয়ে এক কার্পেট দে দিয়া।” আমিও লিখে দিলাম। এবার পতিদেব কি লিখছি দেখতে এগিয়ে এলেন, দেখেই হো হো করে এমন হাসলেন যে আমি তো চমকালামই, বাড়ির সবাইও দৌড়ে এলো। তিনি খাতাটি তুলে দেখালেন, আমি একদম বাংলা হরফে আগেরদিনের হিন্দিতে লেখা তারিখের নীচে লিখেছি, “এক কার্পেট লে লিয়া।” আর আজ লিখেছি, “এক কার্পেট দে দিয়া।” সেই বাংলা হরফেই। অনুবাদ করতে গেলে যদি আবার কিছু গোলমাল হয়!
সিমলা বেড়াতে যাচ্ছি, ছোট ট্রেনে পতিদেব জুতো খুলেই বসে আছেন, তার পায়ে ব্যথা বলে তার অভ্যেস মত সব স্টেশনে নামছেননা। খুব খিদে পেয়েছে, ধরমপুর স্টেশনে আমি নেমে একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম একটি তারের ঝুড়িতে অনেক ফ্রেঞ্চ টোস্ট ঝুলিয়ে রাখা আছে, দোকানদার কে দাম জিজ্ঞেস করলাম, কি একটা বললো, আমিও উত্তর দিলাম। সে দেখি ক্ষেপে গিয়ে তেঁড়ে এলো প্রায়। ভয় তাড়াতাড়ি পতিদেবের কাছে দৌড়ে গেলাম, তাকে ভয় ভয় জানলা দিয়ে ডাকলাম, তিনি বিরক্ত মুখে বাধ্য হয়ে জুতো পড়ে নেমে এলেন। নিয়ে গেলাম তাকে দোকানে, আমাকে দেখে দোকানদার কটমট করে আমার দিকে তাকালো, আমি সেদিকে নজর না দিয়ে ঝুড়িটা দেখিয়ে পতিদেবকে দাম জানতে বললাম। সেও নির্দ্বিধায় দাম জিজ্ঞেস করলো, দোকানদার বললো, “ঢাই।” পতিদেব আমার দিকে ফিরে খুব বিরক্তি ভরে জানালো, “ওই তো বললো আড়াই টাকা।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “কই বললো? ওই তো ওই দ্যাখ, কি যেন ঢাই ঢাই বলছে। বোধহয় তাড়িয়ে দিচ্ছে।” উনি হেসে বলেন,”উফফ্ তোমাকে নিয়ে আর পারিনা, হিন্দিটা না জানো এইটুকু তো বুঝবে, হিন্দিতে আড়াই কে ঢাই উচ্চারণ করে।” উনি ফ্রেঞ্চ টোস্ট কিনলে, আমরা ট্রেনে এসে বসলাম। ট্রেন ছাড়তে উনি জিজ্ঞেস করলেন,”কি গো তুমি ওই দোকানদারকে ভয় পাচ্ছিলে কেন? আর সেই বা তোমার দিকে অমন রেগে মেগে তাকাচ্ছিল কেন?” চোখ নামিয়ে বললাম, “আমিও বাংলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তরে ওই ‘ঢাই’ না কি যেন বললো। দু তিনবার জিজ্ঞেস করতে দু তিনবারই বললো ‘ঢাই’, আমি ভাবলাম বোধহয় গালি দিচ্ছে। আমিও তাই পাল্টা বললাম ‘ঢুই’! ব্যাস, লোকটাও রেগে গেল। আমি কি করবো? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি, শুধু ভেঙিয়েছি।”
পতিদেব আর সঙ্গীদের দমকে দমকে হাসি এখনো আমি স্বপ্নে দেখি।
তবে, কথা বলে সবচেয়ে শান্তি পেয়েছি কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, তামিল নাডু বা কেরল গিয়ে। আমি এসব জায়গায় নির্ভেজাল বাংলা বলি, ওরা কিন্তু সুন্দর বোঝে। হাত মুখ নেড়ে যা বলি, দুতিনবারের বেশি বলতে হয়না।চেন্নাইতে হোটেলের লিফ্ট থেকে নামা ওঠা করার সময় কি একটা “অলাকাম বলাকম” বলছিল। আমি কিন্তু ঠিক বুঝে গেলাম দরজা বন্ধ করতে বলছে।
কাশ্মীরে গিয়ে এক কাশ্মীরি মা আর তার ছোট্ট পুতুলের মত বাচ্চা মেয়েটার সাথে বাংলায় কত্ত গল্প করলাম, আমি বাংলায় যা বললাম ওরা দেখলাম ভালোই বুঝছে, আর আমিও বুঝলাম, মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর, ওর বাবা টুরিস্ট গাড়ি চালায়, ওদের বাড়ি অনন্তনাগে যাকে ওরা বলে ইন্ডিয়ান ইসলামাবাদ, কিন্তু ওরা এই শ্রীনগড়েই থাকে। বৌটা শ্রীনগরেই পড়েছে, টুরিসমে এম এ পাস, কিন্তু কাছাকাছি কাজও পাচ্ছেনা, বাচ্চা হয়ে গেছে বলে বাড়ির লোকও দূরে যেতে অনুমতি দিচ্ছে না। এ তো আমারই মতন। এই কথা বুঝতে আবার ভাষা লাগে নাকি?
তবে, হিন্দি না জানলেও যেখানে বলার সেখানে কিন্তু আমি ঠিকই বলি,
“জয় হিন্দ।”

 

Writer Amitava Banerjee

— লেখক অমিতাভ ব্যানার্জী Durgapur Steel Plant এর SAIL এ কর্মরত একজন অফিসার। ছোটবেলায় দুর্গাপুরের কল্লোল থিয়েটার গ্রূপের সাথে যুক্ত ছিলেন ।একজন Voracious reader।সিনেমা পাগল মানুষ। জন্ম 1971এর 28 February মানে 47টা শীত পার হয়ে গেছে ।লেখালেখির বয়স খুব বেশি হলে এক বছর।

 

 

 

লেখকের আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন 
 " মুক্তি_যুদ্ধ "  "গোপালকৃষ্ণ বাবুর পেন " " স্বাধীনতার ভোজ "

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here