<<জাপান পর্ব :১৮ ৬ জুন থেকে ১৬ জুন
টোকিও থেকে এসে অবধি মেয়ে খুব ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে , পেট খারাপ। সে এক কান্ড বটে। আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকে পেটরোগা। কিন্তু এবারে আর ওর দোষ দিয়ে ঠিক কাজ হবে না। এক তো ৪-৫ দিন বাইরে খাওয়া তার ওপর আবার জাপানীস। আমিও যে একটু দুর্বল হয়ে পড়েনি তা নয়। এসে অবধি একটা ব্যাকুলতা , কিসের কে জানে। হয়তো মেয়ের শরীরের কথা ভেবেই। এখানে তো কাঁচকলা পেঁপে পেয়ে উঠছিনা , যে মেয়ে কে খাইয়ে সুস্থ করবো। দেখতে দেখতে মেয়ের অবস্থা বেশ শোচনীয় হওয়াতে দ্বারস্থ হতে হয় , স্থানীয় এক হাসপাতালে। এ সপ্তাহন্তে আর কোথাও যাওয়া হয়নি , হাসপাতালের পথ ই চিনে যেতে হয়েছে। বেশ অনেকটা দূরে , ঠা ঠা রোদ্দুরে শনিবার সকাল ১০ টাই স্বামী -স্ত্রী সহিত বাচ্চা সাইকেল এর ক্যারিয়ার এ বসিয়ে রওনা হলাম , মোবাইল জিপিএস লাগিয়ে।হাসপাতালের নাম , প্রতিবেশী ও স্কুলের এক সঙ্গী মা এর থেকে নেওয়া। এখানে চাইল্ড কেয়ার আছে। হাসপাতালের নাম The Baptist Hospital, কিয়োটো। কে বলবে হাসপাতাল। চাইল্ড কেয়ার বিভাগ দেখলে মনে হবে কেউ সাজিয়ে গুছিয়ে অপেক্ষায় আছে ছোট ছোটো বাচ্চাদের জন্য। সব বাচ্চারা মন দিয়ে খেলে চলেছে , ভুলেই গেছে যেন কি জন্য তাদের এখানে আনা ।
আমাদের জাপানীস ডাক্তার একটু আধটু ভাঙা ইংলিশ এ ওষুধ দিলেন , আর সাথে ও বললেন ইংলিশ নাকি খুব শক্ত ভাষা। কি ভালো না !!! এখানে ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার হতে ইংলিশ বলতে হয়না ,এরা এদের এক ভাষাতেই পড়াশোনা করেন আর সেবাও।
মেয়ে প্রায় ৭-৮ দিন ভোগার পর একটু ভালোর দিকে। এদিকে তখন মেয়ের স্কুলে চলছে বার্ষিক কোনো অনুষ্ঠান , যেখানে মায়েরা বাচ্ছাদের জন্য কিছু পরিবেশন করবেন। সে যাই হোক , গান বা নাটক বা নাচ। আমাকেও টোকিও যাওয়ার আগে থেকে আইক (আমার জাপানীস বান্ধবী ), অনেকবার বলেছে অনুশীলন এর জন্য স্কুলে উপস্থিত থাকতে। কিন্তু ঘুরতে যাবো বলে আর যেয়ে ওঠা হয়নি। সত্যি বলতে , আমি ভেবেছিলাম কিছু ভাবে এড়িয়ে যাবো। কিন্তু এরা ছাড়ার পাত্রী নয়। আমাকে আইক আবার মনে করিয়ে দিলো , সেই অনুষ্ঠান আর তার অনুশীলনের কথা। এমন কি শরীর ভালো যাচ্ছিলো না বলে , অনুপস্থিত থাকার জন্য , সে আমাকে ভিডিও করে নাচ পাঠিয়ে দিলো। বললো অনুশীলন করতে। আমি একবার ভেবেছিলাম বলি , আমাকে না নিলে কি চলে না !!কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেলাম। ওদের এতো আন্তরিকতা আমাকে পিছুটান দিলো। একদিন গেলাম ও অনুশীলনে। কিছু না বুঝেও যে এতো মজা আর নাচ করা যায় তও আবার রামেন জাপানীস নাচ। ভাবা যায়।
Ramen dance মানে হলো এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় খাবার Ramen বানানোর পদ্ধতি ওই নাচের মধ্যে দিয়ে বাচ্চাদের বোঝানো হবে। তাই সাজলাম রামেন ম্যান এর মতো। গলায় সাদা তোয়ালে , সাদা জামা (ওই দিনের নাচের ইউনিফর্ম ), আর মাথায় রমেন বাক্স (যে গুলোওরা আমার জন্য বানিয়ে এনেছিল ).সেরকম বলতে গেলে আমি কিছুই করিনি , নাচ ছাড়া। সব উপকরণ , সাজানো , সঞ্চালন সব মায়েদের। আমার তাতে কোনো অবদান ছিল না। কিন্তু এই দিনে না গেলে সত্যি কিছু বাদ পরে যেত। কে বলবে ওদের আমি চিনিনা , বা ওরা আমাকে। হেসে খেলে কি ভাবে কেটে গেলো , দিন।
যেদিন অনুষ্ঠান ছিল , সেদিন অন্য ক্লাস এর বাচ্চাদের মায়েরা আগে সম্পাদন করলেন তাদের নাচ-নাটক। আমাদের পালা এলো , আমরা দেখলাম ম্যাজিক আর নাচ। বাচ্চাদের সে কি আনন্দ। সবাই দেখছিলো মায়েদের নাচতে , আনন্দে ওদের চোখ গুলো চিকচিক করছিলো। এর পর ছিল ওদের সিনেমা দেখানোর পালা আর আমাদের মায়েদের প্যারেন্ট-টিচার মিটিং। সাথে ছিল অনেক ছবি তোলা , রেকর্ডিং। সব এর দায়িত্বে ছিল সেইকো কিন্ডারগার্টেন , আমার মেয়ের জাপানীস স্কুল।
এ সপ্তাহে আমার ও হাসপাতালে নিজেকে দেখতে যেতে হলো। তবে Bapist না , পাশে সুগাকুইন স্টেশনের সামনে একটি ছোট হাসপাতালে। ভাইরাল জোর আসছিলো। আর কি। ডাক্তার -হাসপাতালের অভিজ্ঞতায় বা কেন বাদ পরে। এখানে একজন প্রবীণ ডক্টরের সাথে আলাপ হলো , যিনি খুব ভালো ইংলিশ জানেন। অনেক গল্প ও হলো। ওনার ওষুধে কদিনে ঠিক হয়েও উঠলাম। পাঁচ মাসে এই প্রথম শরীর খারাপ। ভাড়াটে থাকলে ৫ দিন অন্তর ভুগি। তাই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো বৈকি।
এই প্রথম সপ্তাহের শনিবারে আমরা সাইকেল নিয়ে পাড়ি দি Demachiyanagi Station চত্বরের দিকে একটু বাজার করতে আর কামো নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতে। এখন এখানে অনেকটা গরম পরে গেছে , সাথে মাঝে মাঝে অল্প বৃষ্টি। আমাদের সুগাকুইন স্টেশন থেকে ৩ তে স্টেশন পরে Demachiyanagi . প্রায় ২০-২৫ মিনিটের বেশি সাইকেল চালিয়ে পথ চিনে যতক্ষনে সেখানে পৌছালাম , সব দোকান প্রায় বন্ধ করছে। একটু সবজি কিনে ফেরার পথে চোখে পড়লো একটা সিডি ক্যাসেট এর দোকান যেখানে আমাদের ভারতের হিন্দি মুভি “dangal” এর পোস্টার।
আসা যাওয়ার পথের দুপাশে সবুজ গাছপালা সাথে কামো নদী আর মরসুমের ফুল। এখন রাস্তার পাশে Hydrangea এর সারি। বিভিন্ন রঙের Hydrangea, বেগুনি ,গোলাপি , সাদা , নীল।
গত সপ্তাহে সেরকম কোথাও যায়নি বলে , এই শনিবার ভেবেছি কিয়োটো র অন্যতম বিখ্যাত জায়গা ফুশিমি ইনারি তাইশা যাবো। কথা মতো শনিবার দুপুরে ৫ নম্বর বাস ধরে আগে কিয়োটো স্টেশন , আবার সেখান থেকে Kyotoekihachijoguchiabantizen বাসস্টপ থেকে , কিয়োটো স্টেশনের লাগোয়া বাসস্টপ , ৮১ নম্বর বাস ধরে Kanjinbashi বাসস্টপ। সেখান থেকে ভিড়ে মানুষ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে হাঁটলেই ১৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন ফুশিমি ইনারি। পথে চোখে পরবে Fushimi Inari স্টেশন। কেউ যদি বাস এ না এসে কিয়োটো স্টেশন থেকে ফুশিমি ইনারি আসতে চান , তাহলে , কিয়োটো স্টেশন থেকে কারাসুম লাইন র এর ট্রেন ধরে এক স্টপ Fushimi Inari স্টেশন। স্টেশন টা অদ্ভুত ভাবে মিল করে বানানো , ফুশিমি ইনারি শ্রাইন এর মতো। একই রং এর সমন্বয় আর সেই টোরি গেটের মতো গঠন।
জাপান আসার আগে যে যে জায়গা গুলো দেখবো বলে ঠিক করি সেটা র মধ্যে এটি একটি। এটি বলতে গেলে কিয়োটোর সবথেকে জনপ্রিয় জায়গা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে। এটি বিখ্যাত হওয়ার অনেক কারণ।
Fushimi Inari শ্রাইন (伏 見 稲 荷 大 社, Fushimi Inari Taisha) দক্ষিণ Kyoto একটি গুরুত্বপূর্ণ Shinto মঠ। এটি তার হাজার হাজার সিন্দূর বা সিঁদুর রঙের টোরি গেটগুলির জন্য বিখ্যাত, যা এর প্রধান ভবনগুলির পিছনে একটি পথ ঘিরে বিস্তৃত। এই টোরি গেট গুলি মাউন্ট ইনারির দিকে চলে গেছে এক বনভূমির দিকে , যা ২33 মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং মঠের স্থানের অন্তর্গত।
ফুশিমি ইনারি এর এই গেট গুলো সিন্টো দেবতা ইনারিকে উৎসর্গীকৃত , যিনি এদের ভাত বা Rice এর দেবতা। শিয়ালকে এই ইনারি দেবতার বার্তাবাহক বলে মনে করা হয়, তাই মঠের মাঠে অনেক শিয়াল মূর্তি স্থাপিত করা হয়েছে ।শ্রাইন এর সামনেই দুদিকে বড় বড় শিয়ালের মূর্তি। এছাড়া শ্রাইন এর পথে ঢুকতে লম্বা বাজারের রাস্তায় , সব দোকানে টোরি গেটের সাথে সাথে বিক্রি হচ্ছে , শিয়াল এর মূর্তি , শিয়ালের আকারের মিষ্টি অন্য খাবার ও। ফুশিমি ইনারি শেরনের প্রাচীন এই উৎসটি 794 খ্রিস্টাব্দে কিয়োটোতে রাজধানী এর পদক্ষেপের পূর্বাভাস দেয়।
শ্রাইন এর সামনে মস্ত ম্যাপ এ দেওয়া আছে আসল মন্দিরের অবস্থান আর টোরি গেটের অবস্থান ও। সেই দেখে দেখে সব পর্যটকরা যে যার মতো পাঠা বেঁচে নিচ্ছিলো। আমরা আগে টোরি গেটের দিকেই গেলাম।এই মঠ বা শ্রাইন এর প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার রোমান গেট , যা 1589 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত নেতা টায়োতোমি হেময়োশি দ্বারা দান করা হয়েছিল। পিছন দিকে মঠের প্রধান হল (হণ্ডেন) রয়েছে , যেখানে পর্যটক বা দর্শনার্থীরা , একটি ছোট দালান দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন ।
টোরি গেটের প্রবেশদ্বার-হাইকিং ট্রিলের প্রবেশপথের পিছনে রয়েছে, যা সেনন তরী (“হাজার হাজার টেরি গেটস”) নামে দুটি দ্বারের সমান্তরাল সারি দিয়ে শুরু হয়। পুরো পথের পাশে যে টোরি গেটগুলি দেখা যায় , তা সব ই ,ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারা দানকরা হয়েছে।সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দানকারীর নাম না দেখা গেলেও পেছন ফায়ার তাকালেই দেখা যাবে টোরি গেটের পেছনে কালো বর্ণে বড় বড় করে লেখা দানকারীর নাম এবং প্রত্যেকটি গেটের পিছনে অনুদানের অনুদান পাবেন। একটি ছোট আকারের গেটের জন্য খরচ প্রায় 400,000 ইয়েন শুরু হয় এবং বৃহত্তর গেটের জন্য এক মিলিয়ন ইয়েন পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়ার পর মাঝ পথে পরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার জায়গা। যা পাশ দিয়ে ওপরে উঠে গেছে , সেখানে রয়েছে রো ছোট ছোট ২-৩ তে শ্রাইন। ওঠা ও নাম মিলিয়ে প্রায় ২-৩ ঘন্টার ব্যাপার , আমরা প্রথম একটি সিনে দেখে নিচে নেমে আসি এবং এগিয়ে যায় সামনের সমতলে টোরি গেটের উদ্যেশে। পথের পাশে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে স্থানীয় থিমযুক্ত থালা-বাসন যেমন ইনারি সুশী এবং কিটসন উডন (“ফক্স ইউনন”), উভয়ই শিম্পাঞ্জি (ফ্রাইড টুফু), যা শিয়ালের প্রিয় খাবার বলে মনে করে, পাওয়া যাচ্ছিল ।
প্রায় 30-45 মিনিটের পর এবং তরোরি গেটের ক্রমবর্ধমান অবনমনের পরে, দর্শকরা Yotsutsuji পর্বত এর কাছে এসে পৌঁছাবে ( প্রায় অর্ধেক পথ ), যেখানে কিয়োটোতে কিছু চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। রাতের এই ফুশিমি ইনারি এক অন্য রূপ নেয় , একদম মায়ার রাজ্য। যদিও আমাদের সেটা দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আমরা সন্ধ্যের আগেই , রওনা দি। পথে চোখে পরে সেদ্ধ করা মিষ্টি ভুট্টা। এখানে এসে প্রথম ভুট্টা খাওয়া। তবে এদের সেই ভুট্টা সেদ্ধ করার পদ্ধতি একেবারেই আলাদা।
কি করে এই প্রসিদ্ধ জায়গায় পৌঁছাবেন তো আগেই বললাম। আর বলি এই শ্রাইন এ ঢোকা যায় বিনামূল্যে , এটি রোজ সব সময় খোলা থাকে।
এ দু সপ্তাহে এটুকুই। আগামীতে আরো কিছু।
<<জাপান পর্ব :১৮ পরবর্তী :ক্রমশ >>
Copyright © জাপান পর্ব ১৯, 2018 by M K Paul, monomousumi.com
[…] << জাপান পর্ব ১৭ জাপান পর্ব ১৯ >> […]