আমি যে বাজারে বাজার করি সেটা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য শাকসব্জি মাছ মাংস ফল মিষ্টির বাজার। গুটি কয়েক মুদিখানাও আছে। দুধ,তেল মশলাপাতি পাওয়া যায়।এককথায় যেমনটি সাধারণ বা ছোটখাটো বাজার হয়। আশেপাশে হিন্দু মধ্যবিত্তর বাস। অর্থাৎ খদ্দেররা প্রায় সবাই হিন্দু।
কিন্তু বাজারটার একটা চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো বিক্রেতারা হিন্দু মুসলমান সমান সংখ্যায় আছে। হয়তো মুসলমান বিক্রেতার সংখ্যা সামান্য বেশীই হবে। পাশাপাশি দোকান লাগিয়ে কেনাবেচা করে। দাড়ি না রাখলে কে হিন্দু কে মুসলমান বোঝাও যায় না। বোঝার দরকারও পড়ে না কেননা খদ্দেররা শিক্ষিত, শহুরে, কম বেশী অসম্প্রদায়িকও।খদ্দেরের সঙ্গে বেচাকেনা নিয়ে ঝগড়া লাগলে পাশাপাশি দোকান লাগানো হিন্দু মুসলমান বিক্রেতারা একজোট হয়ে গলা চড়িয়ে ঝগড়া করে। আমি দেখিনি তবে ওদের কাছেই শুনেছি এক বিক্রেতার বাড়িতে বিয়ে থাওয়া লাগলে উভয় সম্প্রদায়ের দোকানীরা সেখানে আনন্দে মাতে,ভোজ খায়। সবাই দোকানী হিসাবে সবার সহমর্মী বন্ধু।
এই বাজারের এক কোনে বছর তিরিশের সফিকুল ডাব,নারকোল বেচে। কাছেই ভাঙরের দিক থেকে আসে আজ বছর বারো ধরে। আগে দাদার সাথে আসতো। এখন একা। ওর পাশেই বসে পেয়ারা, সবেদা বেচে সমবয়সী অনুকূল। কাছেই জগৎপুর থেকে আসে। দু জনের নামের মিল,সম বয়স, পেশাগত নৈকট্য বা যে কোনো কারণেই হোক খুব বন্ধুত্ব। আমি দুজনেরই নিয়মিত খদ্দের, দুজনেরই ঘনিষ্ঠ।
সফিকুল বংশ পরম্পরায় ভাঙর অঞ্চলের বাঙলী মুসলমান, ভারতবাসী। চেহারা কথা বার্তায় দূস্থ ছাপ থাকলেও বাঙলা উচ্চারণ,হাবভাব সবই এখানকার মতো।
অনুকূলের উচ্চারণ পুরোপুরি বাঙাল। হাবেভাবেও বুঝিয়ে দেয় ওপার থেকে খুব বেশী দিন হলো আসে নি।
এরই মধ্যে দিন তিনেক আগে বাজারে গিয়ে সফিকুলের ডাব, অনুকৃলের পেয়ারা কেনার পরেও হাতে কিছুটা সময় ছিলো।হাফ রাইটার হলেও সব জায়গাতেই গল্পের রসদ খুঁজি। ভাবলাম এই সুযোগে অনুকূল , সফিকুল দুজনকেই একটু বাজিয়ে দেখি কিছু মেলে না কি!
প্রথমে অনুকূলকেই ধরলাম,” তোমার কথাবার্তা আচার আচরণে এখনও পুরো বাঙাল ভাব। তুমি কবে এসেছ ঐ দেশ থেকে?”
অনুকূল বললো,”২০০১ সালে। আমার তহন বয়স সবে বারো বচ্ছর। অহনে পুরা তিরিশ। তা নাই নাই কইরা আঠের বচ্ছর তো হইলো।ওই সোনার দ্যাশ থন আইস্যা পরথম পরথম মনে হইতো পানির মাছরে ডাঙ্গায় আইন্যা হেলাইছে। অহনে তো পুরাই এই দ্যাশেরই হইয়া গেছি আপনাগো মত। তয় রেশন কার্ড ভোটার কার্ড সবৈ হইয়া গ্যাছে,আধারও।”
আমি উষ্মা গোপন করতে না পেরে বললাম,” ওদিকে বলো সোনার দ্যাশ ওদিকে হাজারে হাজারে এই পোড়ার ছাতা দেশে এসে আমাদের জল,মাটি,অন্নতে ভাগ বসাচ্ছো । এখনো উদ্বাস্তু আসার বিরাম নেই। এসেই চলেছে। ”
অনুকূল কাচুমাচু মুখ করে বললো,”অগো কথা তো আমোও বলতে পারবো না কি আসে,কখন চইলা আসে আর ক্যানই বা চইল্যা আসে। তয় খোলাখুলিই বলি। আমরা আসছিলাম মুসলমানগো চাপ সইহ্য করতে না পাইরা। আমগো উপরের জুলুম,অন্যায়ের পিতিকার(প্রতিকার) না মেলায়।”
দেখলাম সফিকুলও শুনছে আর সম্মতি জ্ঞাপক মাথা নাড়ছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা কোরলাম,” সফিকুল একজন মুসলমান। তার সামনে এ ভাবে বলছো!”
অনুকূল ঈষৎ উষ্ণ স্বরে বললো,”তা নিয়া আপনেরে না ভাবলেও চলবে। শুনতে হইলে শোনেন নইলে খালি করেন। খরিদ্দার আইলে আর কমু না। তাছাড়া অখনে গুটাইয়া বাড়ি যাওয়ন ও লাগবে।
সফিকুল আমার সব জানে আমিও অর সবৈ জানি। আমরা দুই একৈ প্যাটের ভাই এর মতো ।”
আমি পুরোটাই বলার জন্যে অনুনয় করতে ও আবার শুরু করলো,” আমগো ছয় বিঘা চরের চাষের জমি আছিলো। সোনা ফলাইত! মাজার, মাদ্রাসা বানানোর ছুতায় দ্যাড় বিঘা জমি বেদখল করলো অরা।
কুথাও কোন বিচার পিতিকার পাইলাম না। মুরুব্বীরা কইলো কোর্টে যাইতে। তয় পয়সা পাম্ কোথায়? বাকী জমির ফসলেরও ভাগ ঠিকমতো বুঝাইয়া দিবো না। একখান ছুটো ডোবা আছিল। তা পাশের বাড়ি থাকতো এক বুড়া মুসলমান। ধর্মপ্রাণ এই এতো বড়ো নুর।
সে সালিশি ডাইক্যা কি সমস্ত হাবিজাবি কাগজ দেখাইয়া অর্ধেকের উপর ডোবা অধিকার করলো। বাড়িতে ছয় ছয়োখান প্যাট। খামু কি?
মনের মধ্যে অনেক দিন থনই ইন্ডিয়া চইল্যা যাওয়ানের মতলব ঘুরে। কিন্তু গিয়া উঠুম কই?করুম কি?খামুই বা কি?
এইদিকে পাশের ভিটার সেই বুড়ার অপকম্মো বাড়তে বাড়তে একদিন চরমে গিয়া ঠ্যাকলো। আমার ছোট বইনের বয়স তখন সাত বচ্ছর। অগো গোয়াল ঘরের সামনে অরে একা পাইয়া ঐ নুরআলা ধার্মিক বুড়া অর পেন্টের ফাঁক দিয়া যুনিতে(যোনি) আঙুল ঢুকাইয়া এমন নাড়াচাড়া করছে যে অক্ত(রক্ত) বাইরাইয়া পেন্ট ভিজাইছে।
আমার বইন কানদতে কানদতে মায়ের কাছে ছুইট্যা আসছে।সারারাত বইন যন্ত্রণায় জাগা।”
এইসময় আমি বাধা দিয়ে বলি কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা তো এই বাঙলা তথা ভারতবর্ষেও প্রায় রোজই শয়ে শয়ে হয়।
অনুকূল উত্তেজিত হয়ে বললো,”কথার মইধ্যে কথা না কইয়া একটু থির(স্থির) হইয়া শুনেন। নিজেই উত্তর পাইয়া যাইবেন।
পরদিন আমার বাবা মা দাদা বইনরে লইয়া গেরামে গিয়া মুড়ল,মুরুব্বী ধইরা বিচার সভা ডাকলো। সেই বিচার সভায় বইন কানদতে কানদতে সবৈ কইলো। বিচারে পাঁচ মুরুব্বী রায় দিল–কেউ তো আর নিজের চউক্ষে দেহে নাই কি ঘটছিলো। শুধু ঐ টুকু মাইয়ার কাইনদা কাইনদা কওয়া কথায় অত ছিনিয়ার(সিনিয়র )ধম্মপরাণ(ধর্মপ্রাণ) একজন মাইনষের শাস্তি বিধান হারাম।”
আমরা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে এই সমস্ত নোংরা কাম কুন শয়তানেও সামনা সামনি সাক্ষী রাইখ্যা করব না। অরা উল্টো কইল যে ‘ঐ বুড়ার লগে আমগো জমির বিবাদ। তাই মাইয়া পোলাপাইনরে দিয়া বানাইয়া বানাইয়া মিছা নালিশ আইন্যা ঐ বুড়া মাইনষের হেনস্থা করার মতলব আটি।’
আমরা থানায়ও গেছিলাম। তয় দারোগা বাবারে আরো নোংরা কথা শুনাইয়া দিলো,’তর মাইয়ার ইয়েতে কে আঙুল ঢুকাইয়া বিলিডিং(ব্লিডিং) করছে তার নালিশ শুননের জন্য সরকার আমগো মায়না দিয়া রাহে নাই।আরে বলদা মালাউনের ব্যাটা ভাউরা তুই না বুঝস্ তর বউ মাগীও কি বুঝে না তর মাইয়ার মেনছ্(মেনস্ট্রুয়েশন )শুরু হইয়া গেছে। এর বেশী বিচার পাইতে হইলে তগো ইন্ডিয়া যাওয়ন লাগবো।ঐ দ্যাশে পুলইশের(পুলিশের) কাম কাইয্য নাই। এইসব মাসিকের মামলারও এজাহার নেয়।’
“এইবার বুঝছেন তো? এইদ্যাশেও এই ঘটনা আখছারৈ হয়। কিন্তু পাবলিক অপরাধীরে ঘৃণা করে।বাজারে পাইলেও গায়ে থুতু ছিটায়।
পুলিশও ডাইরি অন্ততঃ লয়।
যাই হউক এরপর আমাদের মন এক্বারে ভাইঙ্গা গেছিল। ঐ নুরআলা বুড়া ধম্মপেরাণ মিঞাটা চাপও দেতে আছিলো মেলা।বাকী সবটুহুই অর কাছে বিকাইয়া ঐ দ্যাশ ছাইড়া চইল্যা আসি।
যেইটুকু ধানী জমি বাকী আছিলো,বাস্তুভিটা ,আধখান ডোবা মায় ঘটিবাটি সবৈ শ্যাষে জলের দরে ঐ বদমাইশটার কাছেই বিকাইয়া এই দ্যাশে আইয়া পড়লাম।
আমার গল্প তো দুই কাণ ভইরা শুনছেন। অহনে ঐ সফিকুলের গল্প খানও শুইন্যা যান। তয় খুব একটা খারাপ লাগবনা এইটুকুই কইথে পারি ।”
সফিকুল শুরু করলো,” শয়ে শয়ে বছর ধরে এই বাঙলার মাটিতেই আমাদের বাস্তুভিটা। আমাদের জন্মমৃত্যু।মৃত্যুর পর কবরও। আপনারা ওপার থেকে এসেছেন সত্তর বাহাত্তর বছর আগে। তবু আপনাদের হিসাবে এই দেশ এই মাটি শুধু আপনাদেরই ,আমরা পরদেশী। হ্যা এদেশে আমাদের অনুকূলদের মতো জায়গা জমি ভিটা পুকুর বাস্তুতে কেউ হাত দ্যায় না কিন্তু ন্যায্য বিচার আমরাও পাই না। আক্রান্ত হলে আমাদেরও সচরাচর কেউ বাঁচাতে আসে না। নিজেদের রক্ষা নিজেদেরকেই করতে হয়।
এই ঘটনা বছর দশেক আগে।
গ্রামের নিয়মে আমার দিদি খুব ভোর ভোর মাঠ সারতে(প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে) যেতো। কয়েকদিন ধরেই দিদির কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো। কে বা কারা যেন একদম কাছেই গাছের আড়াল থেকে দিদিকে ঐ অবস্থায় দেখে। সন্দেহের কথা বাড়িতে বলতে আমার তিন দাদা আর আমি পরের দিন ঐ সময় পিছন দিক থেকে গিয়ে গয়লা পাড়ার দুই নামকরা বখাটে বদমাইশ ছেলেকে হাতেনাতে ধরে ফেলে বেদম্ মার মারি। ঘটনাচক্রে ছেলে দুজনেই হিন্দু ছিলো।মারের চোটে দুজনেই হসপিটালে ভর্তি হয়। একজনের প্রাণ সংশয়ও হয়ে যায়। পুলিশ আমার আম্মু ছাড়া বুড়ো আব্বা,দাদারা সবাইকেই এমনকি দিদিকেও ‘খুন করার চেষ্টার’ অভিযোগে প্রথমে থানা লক্ আপে পরে জেলে নিয়ে যায়। সৰ্বস্বান্ত হয়ে ঘটিবাটি বিকিয়ে মামলা লড়ে শেষ অবধি প্রমাণের অভাবে আদালত থেকে আমরা বেকসুর খালাস হই।
আরও একটু আছে। ঐ বদমাশ দুটোর মধ্যে যেটা মরণাপন্ন অবস্থায় ভর্তি হয়েছিলো তাকে বড় হসপিটালে মাস ছযেক লাগাতার চিকিৎসার পরে সম্পূর্ণ সূস্থ করে বাড়ি পাঠানো গিয়েছিলো। একজন অনেক আগেই সূস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। একদিন গভীর রাতে বাড়ির সবাই যখন গভীর ঘুমে ওরা লোকজন জড়ো করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়ি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রাণগুলো শুধু পালিয়ে বাঁচে। পুলিশ কোন কেস নেয় নি। বলে ‘তোমাদের কেউ বিড়ি ফুঁকে না নিবিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলো। তার থেকেই আগুন লেগেছে।’ খবরের কাগজ,টিভিতে এই ঘটনা নিয়ে হুলুস্থুলু হওয়ায় সরকার থেকে অবশ্য শেষমেষ “স্বেচ্ছাশ্রম প্রকল্পে” কি কোন্ প্রকল্পে বাড়ি তৈরীর টাকা দেয়।
এই হলো আমার গল্প। দুজনেরটাই তা শুনলেন। এবার কি বলবেন?”
বলার মতো আমার কিছু ছিল না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অনুকূলের ডাকে ফিরে এলাম,”কাকা অনেকক্ষন থন এইখানে খাঁড়ানো।কাকী বাড়িতে ভাবে। গ্যাস জ্বালাইয়া বইয়া আছে।
গপ্পোসপ্পোতে প্যাট ভরবো?কখন কোটনা কুটবো আর কখনই বা পাকশাক করবো? যান পা চালাইয়া বাড়ি যান।”
আমি বাড়ির দিকে পা বাড়াতে শুনতে পেলাম অনুকূল সফিকুলকে বলছে,” দোস্ত্ তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। মনে আছে নি আইজ সন্ধ্যা
ছয়টার শোয়ে ‘আরতি’ হলে ‘বিয়ের ফুলের’ দুইখান টিকিট কাটা আছে। বাড়িতে কইয়া আইস্ রাইতে আমার বাড়িতেই খাবি শুবি। বাড়ি ফিরবি না।”
উপসংহারঃ– এই উপমহাদেশে ছায়া বাড়ে,ছায়া শুধু বাড়ে। অন্ধকার আলোকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়।হিংসা রিরংসার হাত ধরে আসে আরো আরো হিংসা রিরংসা।
ধর্মের বুজরুকির শিকার হয়ে ভাই নানা ছলে ভাইয়ের রক্ত গায়ে হাতে মাখে।
তবুও সবচেয়ে নির্মম ভুক্তভোগী সফিকুল অনুকূলদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার ফল্গুধারা অবিরল বয়ে চলে। ভাগ্যিস এরা মিথ্যা কথা মিথ্যা
ধারণার বেসাতি বড় বড় ধর্মগ্রন্থগুলি পড়ে নি। আর একশো সোয়াশো বছর পর কোনো ধর্মই টিকে থাকবে না।
পাদরি পুরোহিত মৌলবীর আয়ু সীমিত।পৃথিৱী বিখ্যাত চার্চ মসজিদ মন্দির সব হেরিটেজ সাইটস হয়ে যাবে।
মানবতা শুধু বেঁচে থাকবে অনুকূল সফিকুলদের হাতে হাত রেখে।
বিধিবদ্ধ সতর্কতা:–লেখাটির সব চরিত্র যেমন কাল্পনিক ঘটনা গুলিও অবাস্তব কল্পনাপ্ৰসূত। বাস্তবের সাথে কোনো মিল একেবারেই কাকতলীয়।
লেখক পরিচিতি :পৃথ্বী ব্যানার্জী