টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) বা The Sustainable Development Goals , কি এই লক্ষ্য? কেন এই ভাবনা চিন্তা? হঠাৎ ই কি এই চিন্তা নাকি এর পেছনে রয়েছে কিছু কারণ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মানবজাতির ও প্রকৃতির জন্য উন্নততর বৈষম্যহীন ভবিষ্যত অর্জনের একটি প্রয়াস, একমুষ্ঠি লক্ষ্যমাত্রা। সময়ের সাথে বদলাচ্ছে জীবনযাপন, বদলাচ্ছে প্রকৃতির অবস্থান, দেখা দিয়েছে বৈষম্য অর্থনীতিতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব বেশি মাত্রায় প্রয়োজন একটা সমতা বা ভারসাম্য।
এই লক্ষ্য গুলো প্রণয়ন করেছেন জাতিসংঘ ২৫ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সালে, তিন দিনের বিশ্ব সম্মেলনে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এ লক্ষ্যগুলি নির্ধারিত হয়েছে বিশ্বের ১৯৩টি দেশ দ্বারা। এই লক্ষ্যের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের বিশ্বকে ২০৩০ সালের মধ্যে এক নতুন উন্নত – বিশ্বে রূপান্তরিত করা, যেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্রতা , থাকবেন না কোনো অশিক্ষা, থাকবে না অন্যায়-অপচয়, থাকবে এক আধুনিক -উন্নত – দূষণমুক্ত বিশ্ব। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এ রয়েছে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা।
জেনে নি কি সেই ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রা, যা ২০৩০ সালের মধ্যে বদলে দেবে আমাদের পৃথিবীর সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে।
১) দারিদ্র্য নির্মূলীকরণ: দারিদ্র্যতাকে সর্বত্র তার সকল রূপে শেষ করা।
২) খাদ্য নিরাপত্তা : ক্ষুধা নিবারণ, খাদ্য সুরক্ষা এবং উন্নত পুষ্টি অর্জনে সক্ষম হওয়া এবং টেকসই কৃষিকে উন্নীত করে বিশ্বকে খাদ্য নিরাপত্তা দেওয়া।
৩) সু স্বাস্থ্য: টেকসই বিকাশের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন সুনিশ্চিত করা এবং সব বয়সের মানুষের সুস্থতার উন্নতি করা অপরিহার্য।
৪) মানসম্মত শিক্ষা: মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনই টেকসই উন্নয়ন তৈরির ভিত্তি। জীবনের মান উন্নত করার পাশাপাশি, বিশ্বের বৃহত্তম সমস্যার জন্য, বিকাশের জন্য, শিক্ষায় অন্যতম উদ্ভাবনী সমাধান।
৫) লিঙ্গ সমতা: যদিও বিশ্ব, লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের দিকে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও আজকের নারী সুরক্ষিত নয়, তারা বিশ্বের প্রতিটি অংশে বৈষম্য এবং সহিংসতায় ভুগছে। লিঙ্গ সমতা কেবল একটি মৌলিক মানবাধিকার নয়, তবে একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং টেকসই বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় ভিত্তি।
নারীকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শালীনতা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে প্রতিনিধিত্বের সমান অধিকার উৎসাহিত করবে আগামী টেকসই বিকাশের, যার দ্বারা বৃহতরূপে সমাজ ও মানবতাকে উপকৃত করবে।
৬) সবার জন্য জল এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রাপ্যতা: বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি থাকা সত্বেও, কোটি কোটি মানুষের এখনও নিরাপদ জল, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুবিধার অভাব রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী ২০৩ সালের মধ্যে মৌলিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিষেবাতে সর্বজনীন অভিগমন অর্জনের জন্য বর্তমান বার্ষিক অগ্রগতির দ্বিগুণ হওয়া প্রয়োজন।
৭) সকলের জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই এবং আধুনিক শক্তির প্রাপ্তি নিশ্চিত করা – বর্তমানে দরিদ্রতম দেশগুলিতে বিদ্যুতের ব্যবহার ত্বরান্বিত হতে শুরু করেছে, শক্তির উন্নতি অব্যাহত রয়েছে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি বিদ্যুৎ খাতে লাভ অর্জন করছে। এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, প্রায় ৮০০ মিলিয়ন লোক বিদ্যুৎবিহীন এখনো। এছাড়াও, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কিত লক্ষ্যগুলি মেটানো হয়, তবে পরিবহন ও উত্তাপন সহ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বিপুল পরিমানে শক্তিপ্রাপ্তির নিশ্চিন্তিকরন প্রয়োজন।
৮) সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক,অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পূর্ণ ও উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা: বিশ্বব্যাপী শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে এবং বেকারত্ব প্রাক-আর্থিক সঙ্কটের পর্যায়ে ফিরে এসেছে। তবে, বিশ্ব অর্থনীতি ধীর গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে আরও অগ্রগতির প্রয়োজন, সবার জন্য শালীন কাজ তৈরির জন্য, কর্মসংস্থান এবং লিঙ্গ বেতনের ব্যবধান কমাতে, নিরাপদ ও সুরক্ষিত কাজের পরিবেশকে উৎসাহিত করতে হবে .
৯) স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই শিল্পায়ন এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহ প্রদান করা : উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর জন্য অর্থায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোবাইল এ সংযোগ ব্যাবস্থার অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত যে দেশগুলি পিছিয়ে রয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের উৎপাদন শিল্পের অংশ দ্বিগুণ করার ক্ষেত্রে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে. সেই হিসাবে বৈজ্ঞানিকভাবে বিনিয়োগ গবেষণা এবং উদ্ভাবন বা আবিষ্কার বৈশ্বিক গড়ের নীচে থেকে যায়।
১০) বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং নিজের দেশের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা : আয় এবং ক্ষমতার বৈষম্য সংকীর্ণ করেছে অগ্রগতি পথ। বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে এবং একটি দেশের মধ্যে বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হিসাবে অব্যাহত রয়েছে সর্বদা। অনেক দেশের ৪০ শতাংশ জনগণই ইতিবাচক আয় বৃদ্ধির হারের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা সত্বেও বিশ্বের বহু অংশে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে । আয়ের বৈষম্য হ্রাস করার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলিরনজর দেওয়া বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলির রপ্তানির জন্য শূন্য-শুল্কের অভিগমন বাড়াতে এবং স্বল্পোন্নত দেশও ছোট দ্বীপ উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সহায়তা করার জন্য অতিরিক্ত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
১১) শহর এবং মানব বসতিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ করে তোলা :- বর্তমানে বস্তিতে বসবাসকারী নাগরিকে সংখ্যা হ্রাস পেলেও , এই পরিস্থিতিতে ১ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস করে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে পাল্টানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
১২) সঞ্চয় ও ব্যয়ের সামঞ্জস্য বা উৎপাদন ও ব্যবহার এর ব্যাবস্থাকে টেকসই করা: বিশ্বব্যাপী উপাদানের ব্যবহার দ্রুত বেড়ে চলেছে, সেক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ের লক্ষে পৌঁছানো কোনো ভাবেই সম্ভবপর নয়। বর্তমান উপাদান এর প্রয়োজন, সম্পদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা পরিবেশগত সম্পদকে শেষ না করে ফেলে, সেটা যেমন দেখা উচিত, তেমন ২০৩০ এর মধ্যে উন্নয়ের সমস্ত লক্ষ্য অর্জন করতে, অর্থনীতির দক্ষতা উন্নত করে, অর্থব্যবস্থার সমস্ত ক্ষেত্র জুড়ে বর্জ্য এবং মূলধারার টেকসই অভ্যাসকে হ্রাস করতে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
১৩) জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার প্রভাবকে মোকাবেলার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া: গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধির সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত হারে ঘটে চলেছে এবং এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে। যদিও ঋতুপরিবর্তন -জলবায়ু প্রবাহ এর সমস্ত সমস্যাকে খুব ভালো করে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলেছে, তবুও অভিযোজন বিষয়ে আরও বেশি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা এবং ত্বরান্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন। বিশেষত স্বল্পোন্নত দেশ এবং ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য অর্থের এবং শক্তিশালী সক্ষমতা আরও দ্রুত হারে বাড়ানো দরকার।
১৪) টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র এবং সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার: সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, উপকূলীয় ইউট্রোফিকেশনের ক্রমবর্ধমান মাছ ধরা, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রের লবনাক্ত / এসিডিফিকেশন বিরূপ প্রভাব, বিদ্যমান নীতি ও চুক্তিগুলির জন্য সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চলগুলির সম্প্রসারণ অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কোটি কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য এবং খাদ্যের উৎসের জন্য এবং মহাসাগরের আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতির উপর নির্ভর করে, তাই সমস্ত স্তরে সমুদ্রের সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসইভাবে ব্যবহারের জন্য বর্ধিত প্রচেষ্টা এবং হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
১৫) স্থলজগতের বাস্তুতন্ত্রের টেকসই ব্যবহারকে সুরক্ষা, পুনরুদ্ধার এবং অবিচ্ছিন্নভাবে বনসম্পদ রক্ষা, মরুময়তা প্রতিরোধ, এবং স্থবির ও স্থল বিপর্যয় এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়কে থামানো : পার্থিব পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় প্রকৃতি সব সময় সক্ষম, কিন্তু তার একটা মাত্রা রয়েছে। বন ক্ষতি হ্রাস পাচ্ছে, জমির অবক্ষয় অব্যাহত থাকা সত্বেও, জীব বৈচিত্র্য হ্রাস একটি উদ্বেগজনক হারে ঘটে চলেছে, এবং আক্রমণাত্মক প্রজাতি এবং বন্যপ্রাণীগুলির অবৈধ শিকার এবং পাচার অব্যাহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা এবং পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে চলেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অনুযায়ী স্থলজগতের বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা খুব প্রয়োজন।
১৬) টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা। সবার জন্য ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা এবং কার্যকর, জবাবদিহি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান সকল স্তরে গড়ে তোলা : সহিংসতা অবসান, আইনের শাসন প্রচার, প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালীকরণ এবং ন্যায়বিচারে নিশ্চয়তা বৃদ্ধিতে অগ্রগতি অসম কিন্তু সুরক্ষা, অধিকার এবং সুযোগ থেকে লাখ লাখ মানুষকে বঞ্চিত করে, সরকারী সেবা সরবরাহ এবং বিস্তৃত অর্থনৈতিক বিকাশকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নবীন প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।
১৭) টেকসই উন্নয়নের জন্য বাস্তবায়নের মাধ্যমগুলিকে শক্তিশালীকরণ এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্বকে পুনরুজ্জীবিত করা : ODA হ্রাস পাচ্ছে, বেসরকারী বিনিয়োগের প্রবাহ টেকসই উন্নয়নের সাথে সুসংহত নয়, একটি উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল বিভাজন এখনও অব্যাহত রয়েছে। দেশগুলিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ দেওয়ার জন্য বাস্তবায়নের পর্যাপ্ত উপায় বিদ্যমান তা নিশ্চিত করার জন্য উন্নত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।