ছবি: সংগৃহীত।

“ইঁট কাঠ পাথরের পাঁজরে ইতিহাস ফিসফিস কথা কয়।”

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজারও স্থাপত‍্য। কালের ক্ষত চিহ্ন বুকে নিয়েও স্থাপত‍্য গুলি বর্তমানের কাছে অতীত কে তুলে ধরে ইতিহাস পিপাসু মানুষের কৌতূহল পিপাসা মিটিয়ে প্রকৃত বন্ধুর মতো সাহায্য করে। এরকমই একটি শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত‍্য তারাপীঠ মন্দির, যার প্রতিটি গ্রথনে আছে এয়োদশ শতাব্দীর বাংলার নিজস্ব স্থাপত‍্য রীতির বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও পুরাণ । কালের কামড় কে নিজ অঙ্গে ধারণ করে চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে জনপ্রিয়তার সঙ্গে বর্তমানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থেকে ফিসফিস করে অতীতের কথা বলে চলেছে প্রতিনিয়ত।

অবস্থান :- পশ্চিমবঙ্গের বীরাচারী বা তন্ত্র সাধনার মহাপীঠ বীরভূম জেলার রামপুরহাট মহকুমার সদর রামপুরহাট শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে তারাপীঠ থানার অন্তর্গত সাহাপুর গ্রামপঞ্চায়েতের একটি ছোটোগ্রাম তারাপীঠ। মন্দিরের নামানুসারেই এলাকার নাম। মূল মন্দিরের অদূরে মহাশ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যৌবন হারানো দ্বারকা নদী।

● কেন বিখ্যাত:- এটি মূলত বামাক্ষ‍্যাপার সাধন পীঠ ও বীরাচারী সাধনা বা তন্ত্র সাধনার মহাপীঠ হিসেবে খ‍্যাত। তবে আরও যে যে বিশেষত্ব মন্দিরটিকে বিশ্বের দরবারে বাংলার পর্যটন স্থান হিসেবে পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছে সেগুলি হল–
■ এখানে যে মন্দির আছে সেটি শতাব্দী প্রাচীন এবং মন্দিরটি বাংলার স্থাপত‍্য শিল্পের যথার্থ নমুনা।বর্তমান মন্দিরের কাঠামোর সঙ্গে জড়িত বাংলার স্থাপত্যের নিজস্ব শৈলী ও বাংলার নিজস্ব শিল্প–টেরাকোটা শিল্প।শুধু মূল মন্দিরটি নয় চন্দ্রচূড়ের মন্দিরের পাশাপাশি মহাশ্মশানে অবস্থিত সাধক বামাক্ষ‍্যাপার সমাধি মন্দির ও মা তারার পায়ের ছাপ সম্বলিত মন্দির গুলিতেও প্রাচীন বাংলার স্থাপত‍্য শিল্পের ছাপ আছে।
■ অনেকের মতে তারাপীঠ ব্রহ্মার মানস পুত্র বশিষ্ট মুনির সাধন পীঠ। বশিষ্ট মুনির পর মন্দিরটি বিশেষ খ‍্যাতি অর্জন করে  সাধক বামাক্ষ‍্যাপার সাধন পীঠ হিসেবে। বামাক্ষ‍্যাপার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়েও অনেক কথা লোকমুখে প্রচলিত আছে।
■ মন্দিরের পাশাপাশি দেবী মূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অলৌকিকত্ব ও পৌরাণিকতা।
■ মন্দির ও মা তারাকে ঘিরে  নানা অলৌকিক কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত আছে।
■ মন্দির এলাকার মধ‍্যে ‘অমৃতকুণ্ড’ বা জীবিত কুন্ড’ নামে একটি পুকুর আছে।এই পুকুরটির অলৌকিকত্ব নিয়ে লোকমুখে নানা গল্প প্রচলিত আছে।মানুষের ধারণা এই পুকুরে স্নান করলে সমস্ত রোগ সেরে যায়,দেহ নিরোগ হয়।
■ অনেকের মতে এটি সতীর একান্নপীঠের এক মহাপীঠ।এখানে সতীর নয়নের তারা পড়েছে।যদিও এই মত অনেকে অস্বীকার করেন।
■ মন্দিরের মহাশ্মশানে অবস্থিত মা তারার পায়ের ছাপ।
■ অন‍্য স্থাপত‍্যে নির্মাণকারি শ্রমিকদের নাম উল্লেখ থাকে না,কিন্তু এই মন্দিরে শ্রমিকদের নামের ফলক আছে।
■ বর্তমানে মন্দিরটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পার্ক ও মনরোম পরিবেশ যা পর্যটকদের বাড়তি পাওনা।
■সর্বোপরি মন্দিরটি স্থানীয় মানুষদের আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

● মন্দিরের ইতিহাস:- কালের প্রভাবে মন্দিরের পটপরিবর্তন ঘটেছে বারবার। বর্তমান তারাপীঠ মন্দিরটি প্রায় দ্বি-শতাব্দী প্রাচীন। এর আগেও এই স্থানে মা তাঁরার মন্দির ছিল। কিন্তু সেগুলি কালের  গর্ভে পতিত হয়েছে।
তারাপীঠ ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ট মুনির সাধন পিঠ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কোন্ সময়?এবিষয়ে ইতিহাস নিরুত্তর। কোনো প্রামাণ্য নথি এ বিষয়ে পাওয়া যায় না। সে সময়ের তারা মায়ের একটি মন্দির ছিল বলে মনে করা হয়। যা দ্বারকার  বন‍্যায় ভেঙে যায় বলে মনে করা হয়‌।কিন্তু মাতৃমূর্তি অক্ষত থাকে। এরপর তৎকালীন রত্নাগড় (বর্তমান নাম সাঁইথিয়া) এর জমিদার জয়দত্ত বজরা নিয়ে   বাণিজ্য বের হন।তিনি ছিলেন মা তারার বিরোধী। দ্বারকার তীরে সাপের কামড়ে তার ছেলের মৃত‍্যু হয়। লোকমুখে প্রচলিত আছে ছেলেকে হারিয়ে মা তারার ঘোর বিরোধী জয়দত্ত মা তারার শরণাপন্ন হলে মা তারার কৃপায় মৃত ছেলে প্রাণ ফিরে পায়।জয়দত্ত স্বপ্নাদেশ পেয়ে তারাপীঠ মহাশ্মশান থেকে মা তারার শিলামূর্তি উদ্ধার করে সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।কিন্তু মহাকালের রথের চাকায় আবারও দ্বারকার বন‍্যায় সেই মন্দির ভেঙে পড়ে। এরপর মা তারার ভক্ত বীরভূমের মল্লার পুরের বাসিন্দা সোম ঘোষ আবার শ্মশানে মায়ের মন্দির নির্মাণ করে কিন্তু সেটিও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর আবার মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলিখাঁর অধীনস্থ জমিদার উদয়নারায়ণ রায়ের অধীনস্থ মুর্শিদাবাদের এড়োয়াল নিবাসী অধুনা ময়ূরেশ্বরের ঢেকার রাজা রামজীবন চৌধুরী মা তারার মন্দির নির্মাণ করেন কিন্তু তাও ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ বা ১২২৫বঙ্গাব্দে মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায় তারা মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মূল মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । পরে ওই বছরেই ৮ ই এপ্রিল মন্দির প্রাঙ্গণ সর্বসাধারণের জন‍্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।পরে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন নাটোরের রাণী ভবানী। বর্তমান যে মন্দিরটি আছে সেটি তারই কৃতিত্ব।বর্তমান মন্দিরের বয়স ২০০বছরের ও বেশি।তবে এই মূল মন্দিরে একাধিক বার নানা নির্মাণ কার্য ও মেরামতির কাজ হয়েছে।

মন্দিরের গঠন:-খ্রিস্টীয় এয়োদশ শতক অর্থাৎ মুসলিম শাসনে বাংলায় কাঠামো নির্মাণের মূল গঠনভঙ্গি ছিল ইসলামি রীতির অনুসরণ।আর বাইরের কারুকার্য ও কাঁচামাল ব‍্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলার লৌকিক রীতির ছাপ দেখা যায়।
আমাদের আলোচ‍্য তারাপীঠ মন্দিরের গঠনেও আমরা বাংলার প্রাচীন স্থাপত‍্য রীতির নিদর্শন খুঁজে পাব। তৎকালীন সময়ে বাড়ি বা মন্দির ঢালু ধাঁচে তৈরি করা হতো, যাতে বৃষ্টিতে জল দাঁড়াতে না পারে সেই ভাবনায় ,যা ‘বাংলা ‘নির্মাণ পদ্ধতি নামে পরিচিত।তারাপীঠ মন্দিরেও এই ‘বাংলা’ নির্মাণ পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে।
চাল বা চালা ভিত্তিক মন্দির বানানোর রীতি বাংলায় দেখা যায়। চালার সংখ‍্যার উপর নির্ভর করেই মন্দির গুলিকে একচালা,দো-চালা বা আটচালা বলা হতো।ইসলামীয় স্থাপত্যের ধাঁচে চালা গুলির মাথায় মাঝে মধ‍্যেই খিলান,গম্বুজ বানানো হত।বাংলার প্রাচীন ইসলামীয় রীতি অনুসারে তারাপীঠ মন্দিরটি আটচালা বিশিষ্ট।মন্দিরটি উত্তরমুখী।
ইমারতে ইঁটের ব‍্যবহার বাংলার স্থাপত‍্যরীতির একটি বৈশিষ্ট্য।সেইমতো আটচালা বিশিষ্ট তারাপীঠ মন্দিরটিও লাল ইঁট নির্মিত। মন্দিরের শিখর পর্যন্ত একাধিক খিলান উঠে গেছে,সেগুলি ধনুকাকৃতি।খিলানের উপরে চার চালার ওপরে চারকোণে চারটি ছোটো ছোটো চূড়া অবস্থিত। মাঝে একটি চূড়া বিশিষ্ট রত্ন (সাধারণত আয়তক্ষেত্রাকার কাঠামোর উপর একাধিক চূড়া দিয়ে তৈরি মন্দির) আছে। মাঝের  চূড়ায় একটি তামার পতাকা ও ত্রিশূল তিনটি পদ্মভেদ করে উঠেছে। মন্দিরের গায়ে বাংলার নিজস্ব শিল্প– পোড়ামাটির বা টেরাকোটার কাজ করা আছে।
গর্ভগৃহে প্রবেশের ও  বার হবার জন‍্য একটি করে পৃথক দরজা আছে।
মন্দিরের প্রবেশপথের মধ‍্য খিলানের ওপর দুর্গার প্রতিকৃতি আছে।উত্তর দিকে বামপাশের খিলানের ওপর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঘটনার দৃশ‍্য,ভীষ্মের শরশয‍্যা,অশ্বত্থমা হত প্রভৃতি মহাভারতের কাহিনীর দৃশ‍্য ,উত্তর ভিতের পূর্বদিকে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা যেমন– সীতাহরণ,অকাল বোধন, রাম-রাবনের যুদ্ধের দৃশ্য এবং পশ্চিমদিকে কৃষ্ণলীলার নানা চিত্র খোদিত আছে।দেবী মূর্তি ১২ ফুট × ৬ ফুট মাপের মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত।
মহাশ্মশানে অবস্থিত মন্দির গুলিতেও ঢালু ধাঁচ চাল,চূড়া,ইঁটের ব‍্যবহার প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
তারা মন্দিরের পূর্বদিকে অবস্থিত শিবমন্দির।এখানে শিব চন্দ্রচূড় নামে পূজিত হন।এই মন্দিরটি মাঝারি আকারের গম্বুজাকৃতি।পঞ্চমুখী এই মন্দিরেও এয়োদশ শতাব্দীর বাংলার স্থাপত্যের নমুনা আছে।মন্দির চত্বর থেকে তিনফুট উঁচুতে এই মন্দিরটি অবস্থিত।গর্ভগৃহে মাঝারি আকার ও উচ্চতার কালো রঙের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে।

মূর্তির বর্ণনা:-এখানে মা তারার শিলা মূর্তি আছে।শিলা মূর্তিটি যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য শিলা মূর্তিটি একটি ধাতব কালী মূর্তি দিয়ে ঢাকা থাকে।সাধারণত দর্শনার্থীরা এই ধাতব তারা রূপী কালী মূর্তি দর্শন করে থাকে।এই ধাতব মূর্তির অধিকাংশ অংশ রুপো দিয়ে মোড়া।মূর্তিটিতে মা তারার গলায় মুন্ডমালা এবং লোলজিহ্বা।এলোকেশী মায়ের মাথায় রুপোর মুকুট। মূর্তির মাথায় একটি রুপোর ছাতা। মূর্তির পিছনে একটি রুপোর পাত তাতে পদ্ম,সর্প  সহ নানা নকশা আঁকা ও পাশে একটি রুপোর ত্রিশুল। মূর্তিটি বস্ত্র পরিধান করে থাকে এবং জবা,গাঁদা ,নীল অপরাজিতা ফুলের মালায় ঢাকা থাকে। ধাতব মূর্তিটির কপালে লাল বা মেটে রঙের সিঁদুর খুব পুরু করে লাগানো আছে। ধাতব মূর্তির  নীচে গোলাকার বেদীতে দুটো রুপোর পাদপদ্ম আছে।সেই পায়ের উপরে রুপোর তৈরি জবা ফুল আছে।ভক্তরা এই পাদপদ্মে আলতা গঙ্গা জল দুধ নারকেলের জল ঢালে পুন‍্য অর্জনের আশায়।
এই ধাতব মূর্তির ভিতরে আছে তারা মায়ের শিলা মূর্তি। সেই শিলা মূর্তিটি সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমুদ্র মন্থনের পৌরানিক কাহিনী। সমুদ্র মন্থন জাত হলাহল পান কারী মহাদেবে কে জ্বালার হাত থেকে রক্ষা করতে দেবী দুর্গা মাতৃরূপে শিবকে নিজের স্তন‍্যপান করান। সেই পৌরাণিক কাহিনী মতোই বাম ক্রোড়ে পুত্ররূপে শায়িত শিশুশিবকে স্তন‍্যদানরতা শিলা মূর্তিই এখানে পূজিত হয়। শুধু স্নানের সময় ধাতব মূর্তি সরিয়ে এই মূর্তিটি বের করা হয়।এই শিলা মূর্তিটি “তারা ঐ কোমল রূপের একটি নাটকীয় হিন্দু প্রতিমা” বলে অভিহিত করা হয়েছে।

কিংবদন্তীর তারাপীঠ:-এই মন্দির ও মা তারাকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি।সেই কিংবদন্তির কিছু কিছুর পশ্চাতে অবশ‍্য ঐতিহাসিকতা আছে।

◆ বশিষ্ট মুনির কিংবদন্তি:- ব্রহ্মার মানসপুত্র নীলাচলে তারা দেবীর সাধনায় সিদ্ধিলাভে ব‍্যর্থ হয়ে পিতার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলে পিতা উপদেশ দেন কামাখ‍্যা যোনিমণ্ডলে সাধনা করার।পিতার উপদেশ শিরোধার্য করে কামাখ‍্যায় যান কিন্তু সেখানেও ব‍্যর্থ হন। বশিষ্ট ক্রোধে তারাবীজকে অভিসম্পাত করেন।তখন দৈববাণী হয় ,তাতে বশিষ্ট কে মহাচীনে বুদ্ধরূপী জনার্দনের কাছে যাওয়ার কথা বলা হয়।বশিষ্ট সেই মতো মহাচীনে বুদ্ধ রূপী জনার্দনের কাছে উপস্থিত হয়ে সমস্ত ঘটনা পূর্বাপর বললে তিনি বশিষ্ট কে জানান :বক্রেশ্বরের ঈশান কোণে বৈদ‍্যনাথ ধামের পূর্ব দিকে দ্বারকা-নদীর পূর্বতীরে শ্বেতশিমূলবৃক্ষ তলে বশিষ্টের আরাধ‍্যা তারা দেবী আছেন।সেই তারা শিলামূর্তি।দেবী দ্বিভুজা,সর্পময় যজ্ঞোপবীতভূষিতা,বাম ক্রোড়ে পুত্ররূপে স্বয়ং মহাদেব শায়িত—এই রূপ চিন্তা করে সাধনা করো।
অবশেষে বশিষ্ট দ্বারকা নদীর তীরে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসে তারা মায়ের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন।মা তারা তাকে দর্শন দিলে তিনি মায়ের কাছে বুদ্ধরূপী জর্নাদন মায়ের যে রূপ বলেছিলেন সেই রূপ দেখতে চান।মা তাকে সেই রূপেই দেখা দেন।বশিষ্ট মায়ের কাছে প্রার্থনা করে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে মায়ের দেখা পাওয়ার জন‍্য।আর কাউকে যাতে তা না পেতে হয় মা যেন সেই ব‍্যবস্থা করেন‌।বশিষ্টের কথা মতো মা তারা জানান,যে এই মঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে ভক্তি ভরে তিন লক্ষ জপ করতে পারবে সেই মা তারার দর্শন পাবে আর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারবে। এই ঘটনার দিন ভোরে দ্বারকার বালুচরে বশিষ্ট তারা মাকে যে রূপে কল্পনা করে সাধনা করেছিল ঠিক সেইরূপের মায়ের শিলা মূর্তিটি লাভ করে।

একান্নপীঠের কিংবদন্তি:-অনেকের মতে সতীর দেহত‍্যাগের পর ভগবান বিষ্ণু সতীর দেহকে ৫১টি খন্ডে ছিন্ন করলে বক্রেশ্বরের ঈশান কোণে বৈদ‍্যনাথ ধামের পূর্বদিকে উত্তরবাহিনী দ্বারকা নদীর পূর্বতীরে মহাশ্মশানে শ্বেত শিমূলবৃক্ষ মূলে সতীর ঊর্ধ্ব নয়ন তারা পতিত হয়।এই স্থানকে ‘শিলাময়ী দেবী চণ্ডী ভগবতী উগ্রতারা’বলা হয়।
অনেকে তারাপীঠ কে সতীর একান্নপীঠের একপীঠ বললেও অনেক এই মত অস্বীকার করেন।কারণ ‘মহাপীঠ পুরাণ’এ তারাপীঠ পীঠস্থান তালিকা ভুক্ত নয়।পুরাণাদি গ্রন্থে এই স্থানে দেবী সতীর নয়নের তারা পড়ার মতকে কোনোরূপ সমর্থন করে না।

কিংবদন্তির প্রমাণ:- সপ্তম শতাব্দীতে বাংলায় বীরাচারী সাধনা বৃদ্ধি পায়।এই সময় নাগার্জুনের হাত ধরে তিব্বতের বৌদ্ধ দেবী তারার সাধন পদ্ধতি ভারতে প্রবেশ করে বলে অনুমান করা হয়।ক্রমে বৌদ্ধদেবী তারা, বাংলার ঘরের মা বা মেয়ে তারায় পরিণত হয়। ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষের মতানুসারে বাংলায় পালযুগে বৌদ্ধধর্ম বিকাশিত হলে বাংলাতে বৌদ্ধদেবী তারার সাধনা বৃদ্ধি পায়। সেই সময় বাংলায় হিন্দু ধর্মের উত্থানে বৌদ্ধদেবী তারা হিন্দুদের মা-তারায় পরিণত হন এবং নাগার্জুন ক্রমে লোককথায় বশিষ্টে মুনিতে রূপান্তরিত হন।

মহাশ্মশান:-‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির’ ঠিকানা তারাপীঠ মহাশ্মশান নানা জাতীয় বড়ো-ছোটো গাছে ভর্তি। সূর্যের কৃপণ আলোয় মহাশ্মশানে এক মায়াবী রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। তারাপীঠ মহাশ্মশানে আছে সাধক বামাক্ষ‍্যাপার সমাধি। ঠিক তার পাশেই মাতারা দুটি প্রস্তরীভূত পায়ের ছাপ। এছাড়া বহু সাধু সন্ন‍্যাসীর ছোটো ছোটো কুটির। আর আছে তিনটি চুল্লি। এই মহাশ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যৌবন হারানো মুমূর্ষু দ্বারকা নদী।  মরা নদীর বাঁকে গজিয়ে উঠেছে নানা আগাছা। বর্ষাকালে নদী কিছুটা হলেও সুস্থ হয়ে উঠে ।তখন নদীতে জল দেখা যায়।

নিকটবর্তী দর্শনীয় স্থান:-তারাপীঠ থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে সতীর একান্ন পীঠের একপীঠ নলহাটি তে মা নলাটেশ্বরী আছে।এছাড়া তারাপীঠ থেকে ১০কিলোমিটার দূরে বীরচন্দ্রপুর অবস্থিত।এখানে আছে বাঁকারায় অর্থাৎ কৃষ্ণ।এখানে একটি  জঙ্গল আছে ।কথিত আছে যে এই জঙ্গলে পান্ডবরা অজ্ঞাত বাসের সময় এসেছিলেন। তারাপীঠ থেকে অনতিদূরে অবস্থিত বামাক্ষ‍্যাপার জন্মভিটে আটলা গ্রাম।
এছাড়া রামপুরহাট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে আছে ঝাড়খণ্ড রাজ‍্যের দুমকা জেলার শিকারীপাড়া থানার অন্তর্ভুক্ত মলুটি গ্রাম।এটি প্রাচীন ঐতিহ‍্যবাহী মন্দিরময় গ্রাম।পূর্বে ১০৮টি মন্দির থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন ৭২টি মন্দির আছে।বাংলার স্থাপত‍্যের অনন‍্য নজির ছড়িয়ে আছে এই গ্রামের প্রাচীন মন্দির গুলিতে।এখানে আছে মা মৌলিক্ষার মন্দির।এই মা মৌলিক্ষাকে মা তারার বোন মনে করা হয়।এখান থেকেই বামাক্ষ‍্যাপা পায়ে হেঁটে তারাপীঠ যেতেন।এখন ও মলুটিতে গেলে বামাক্ষ‍্যাপার ব‍্যবহৃত শঙ্খ,ত্রিশূল,চিমটে দেখতে পাওয়া যাবে।

বিশেষ পূজা:-প্রায় প্রতিদিনই তারাপীঠ মন্দিরে মা তারার পুজো হয়।বহু ভক্তের সমাগম ঘটে।তবে রথের দিন এখানে মা তারার রথ বের করা হয়।এছাড়া প্রতিবছর আশ্বিন মাসের কোজাগরি শুক্লাচতুর্দশী তিথিতে মন্দির থেকে মাকে বের করে মন্দিরে পশ্চিমদিকে অর্থাৎ মলুটির দিকে মুখ করে বসানো হয় ও মায়ের মূর্তির স্নান,পূজা ইত‍্যাদি অনুষ্ঠান হয়।

যোগাযোগ:- কলকাতা থেকে তারাপীঠের দূরত্ব মাত্র ২১৯.৪ কিলোমিটার।কলকাতা থেকে সরাসরি বাস পাওয়া যায়।আবার হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে ট্রেনেও আসা যায়। “মা তারা এক্সপ্রেস “নামে একটি ট্রেন চলে। ট্রেনে তারাপীঠ স্টেশনে নামা যায়।আবার রামপুরহাট স্টেশনে নেমে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বা অটো, টোটো তে রামপুরহাট বাসট‍্যান্ডে এসে বাস ধরে বা অটো, টোটো বা যেকোনো ছোটো যানে করে তারাপীঠ মন্দির যাওয়া যায়।
এখানে থাকা খাওয়ার জন‍্য অনেক বড়ো-ছোটৌ হোটেল আছে।

উপসংহার:-মা তারার লীলাভূমি ও সাধক বামাক্ষ‍্যাপার সাধন পীঠ হিসেবে এই তারাপীঠ হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।কালক্রমে এই মহাপীঠের পরিচয় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।তারাপীঠ এখন আন্তর্জাতিক তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে‌। বর্তমানে ‘তারাপীঠ উন্নয়ন পর্ষদ’ গঠন করা হয়েছে মন্দিরের উন্নয়নের স্বার্থে। মন্দির এলাকা সর্বদা ‘জয় তারা’  ও ‘জয় বাম’ ধ্বনিতে  মুখরিত থাকে।রাঢ় বাংলার স্থাপত‍্য,ভাস্কর্য  পোড়ামাটি(টেরাকোটা)র শিল্প, পৌরাণিক, অলৌকিকত্ব, কিংবদন্তির মিশেলে এই মহাপীঠ তারাপীঠের মন্দির ও মূর্তি নির্মিত হয়েছে। এয়োদশ শতাব্দীর বাংলার স্থাপত‍্যের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন এই তারাপীঠ মন্দির।

কলমে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

6 COMMENTS

  1. খুব ভালো লিখেছেন স্যার।এই প্রবন্ধটি পড়ে মহাপীঠ তারাপীঠের অনেক ইতিহাস জানতে পারলাম। খুব সুন্দর স্যার🙏🏻🙏🏻🙏🏻🙏🏻👏🏻👏🏻👏🏻👌🏻👌🏻👌🏻👌🏻👌🏻👍🏻👍🏻👍🏻👍🏻❤️❤️

  2. […] বাংলার স্থাপত‍্য তারাপীঠ মন্দির Previous articleফিরে পাওয়া “মন ও মৌসুমী”https://monomousumi.com/bengaliDisclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব – কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত……………… […]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here