তান্ত্রিক হরিচরণ

কলমে-বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

1
342

ছোটো থেকেই ডাক্তার হয়ে গ্রামের লোকের সেবা করব এই স্বপ্ন ছিল। তাই ডাক্তারি পাস করেই প্র‍্যাকটিস করতে চলে এলাম আমার বাব-ঠাকুরদার গ্রামের বাড়ি তাবাডুংরা। বীরভূম জেলার বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে অবস্থিত এই গ্রাম। এই একবিংশ শতাব্দীতেও সেই গ্রাম-গ্রামই রয়ে গেছে । সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও স্পর্শ করেনি ওকে। বৈদ্যুতিক খুঁটি-তার বাড়ি বাড়ি বিদ্যুতের কানেকশন সবই আছে, কিন্তু আসল জিনিসটার দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে তাও দিনের বেলা। রাতে সেই লন্ঠনের আলো। আদিবাসী প্রধান গ্রাম।জন মজুরের কাজ করা এদের জীবিকা। গ্রামে প্রাইমারি-হাইস্কুল আছে,কিন্তু স্কুলে যাচ্ছে কে! মাস্টার মশাইরা বাড়ি থেকে খেলার মাঠ থেকে ছেলে-মেয়েদের ডেকে মানে একপ্রকার ধরে বেঁধে নিয়ে যায় মিড-মিলটুকু খাওয়ানোর জন্য। শিক্ষাদীক্ষার বড়োই অভাব এখানকার অধিবাসীদের।আদিবাসীদের গ্রাম হলেও দু-একটা তথাকথিত ভদ্রলোকের  বাড়ি আছে বইকি। ওই দু-একটা চাষা,এক দু-ঘর ব্রাহ্মণ,গোয়ালা এই নিয়ে গ্রাম। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সমস্ত কাজের জন্য তাদের বেশ কিছু দূরে শহরে আসতে হয়। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ওই দুটি বাস। তাও মাঝে মাঝে একটা চলে,মাঝে মাঝে চলেই না।   শহরের সঙ্গে যুক্তকারী প্রধান রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। কোনো এককালে পিচের চাদর দিয়ে ঢাকা হয়েছিল। কোথাও কোথাও সেই চাদরের শেষ চিহ্ন বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।
আপনারা ভাবতেই পারেন এই অজো গ্রামে আমি কোন্ সুখে ডাক্তারি করতে গেলাম। তার কারণ আছে।বাবার মুখে শুনেছি আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা সহ গ্রামের অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। সেই তখন থেকেই আমি ঠিক করি ডাক্তার হয়ে এসে এখানের মানুষের চিকিৎসা করব। ঠাকুরদা ঠাকুরমার মৃত্যুর পর বাবা কাজে বদলি নিয়ে শহরে চলে আসে সে আমার জন্মের বহু আগে। ফলে গ্রামের পূর্ব পুরুষের মাটির বাড়ি দেখ ভালের অভাবে কালের হাতে আত্মসমর্পণ করে। বাড়ির অস্তিত্বের শেষ চিহ্ন টুকুও ক্রমে মেদিনী গ্রাস করে। এখন ওখানে ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করে। গ্রামের মানুষ ছাগল গরু বেঁধে রাখে।
বাবার কাছে ফোনে আমার উদ্দেশ্যের কথা শুনে গ্রামে বাবার বাল‍্যকালের বন্ধু গ্রামপ্রধান হরিচরণ মুখোপাধ্যায় অত‍্যন্ত খুশি হয়ে তার বাড়িতে থেকেই আমাকে প্র‍্যাকটিস করার কথা বলেন। বাবার বন্ধু হওয়ায় হরিচরণ মুখোপাধ্যায় কে আমি কাকু বলি। হরিচরণ কাকু বাবার সঙ্গেই আবগারি দফতরে চাকরি করতেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর গ্রামের পৈত্রিক মাটির বাড়ি ভেঙে পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন। তিনি অকৃতদ্বার মানুষ। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তন্ত্র সাধনা করে তিনি এখন আগাগোড়া তান্ত্রিক। বাড়িতে পৈত্রিক কালী মন্দির আছে। সব সময় লাল পোশাক পড়ে থাকেন।গলায় রুদ্রাক্ষির মালা।মুখ ঢেকেছে সাদা পাকা গোঁফ দাঁড়িতে। তান্ত্রিক হিসাবে তার যথেষ্ট নাম-ডাক আছে। শোনা যায় তিনি কামাখ্যায় এক সন্ন্যাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তন্ত্রসাধনা শিখেছেন।
গ্রামের মানুষের আমার চিকিৎসার থেকে হরিচরণ কাকুর মন্ত্র-তন্ত্র মাদুলি কবচ তাবিজ জলপড়া তেল পড়ায় বেশি ভরসা। হরিচরণ কাকুর ও চিকিৎসা ব‍্যবস্থায় ভরসা কম।
প্রত‍্যেক দিন আমাদের সান্ধ্য আড্ডা বসে কালীমন্দিরের চাতালে। সেখানে আমি ও হরিচরণ কাকু ছাড়াও উপস্থিত থাকেন শ‍্যামল ঘোষ,উৎপল মোড়ল সহ গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। এরা সবাই বাবার পরিচিত বা বন্ধু হওয়ায় কাউকে কাকু জ‍্যেঠু প্রভৃতি সম্বোধন করি।
আজ তিনদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টির কারণে  সান্ধ্য আড্ডায় কেউ আসতে পারে না।আমি আর হরি কাকু ঘরে বসে বসে গল্প করি–কখনও আমার ডাক্তারি বিষয়ে তো কখনও হরি কাকুর তান্ত্রিক হওয়ার বা তন্ত্র সাধনার জোড়ের কথা গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। আজ আড্ডাটা ঠিক জমছে না। হরি কাকুর পাশে পড়ে থাকা  দু’দিন আগের খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে পড়তে লাগলাম।এখানে প্রতিদিন খবরের কাগজ পাওয়া যায় না।কেউ শহরে যাচ্ছে জানতে পারলে কখনও হরি কাকু বা কখনও আমি টাকা দিয়ে আনা করায়। ওদিকে হরি কাকু কানের কাছে রেডিওটা নিয়ে চ‍্যানেল ধরানোর চেষ্টা করছেন।আর রেডিওটা থেকে খ‍্যাড় খ‍্যাড় সোঁ সোঁ আওয়াজ হচ্ছে চ‍্যানেল পালটানো।আমি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ আমাকে হাসতে দেখে হরিকাকু জিজ্ঞাসা করলেন –‘কী হলো হে ছোকড়া হাসছ কেন?কী এমন খরব পড়লে যা দেখে মন পুলকিত হয়ে উঠল? বত্রিশ পাটি বের করে হাসছ?’
–‘আরে দেখুন না এই খবরটা, বর্ধমানের খবর।একজনের বাড়িতে তিনটি আত্মা মানে ভূত আছে।ভূতের উৎপাত থেকে বাঁচতে ওরা বাড়িতে তালা লাগিয়ে পালিয়েছে। যাগ-যজ্ঞ ,তন্ত্র-মন্ত্র করেও নাকি কিছু করতে পারেনি–‘ হাসির বেগ সামলে খবরের কাগজে চোখ রেখে এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে আবার হেসে উঠলাম।
–‘তা খবরটাতে হাসির মতো তুমি কী পেলে ,যে এতো হাসছ।’
–‘কী বলছেন কাকু,হাসব না। এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন মানুষ মঙ্গলে যাচ্ছে –চাঁদে যাচ্ছে– তখনও মানুষ ভূত-প্রেত-ডাইনি–ওঝা এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করছে। ভাবতেই অবাক লাগে!’ কথাটা বলার পরেই আমার মনে পড়ল,আরে কাকু  নিজেই তো একজন তান্ত্রিক।ওনার সামনে আমি এ কী বেফাঁস মন্তব্য করে ফেললাম!

এর মধ‍্যে রান্নার দিদি কাজে এসেছে।রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল
–‘চা করব নাকি?’
আমি বললাম “হ‍্যাঁ এক কাপ চা করে দাও তো।”
অবশ‍্য এখানে বলে রাখি রান্নার দিদি কেবল আমার জন্যই রান্না করতে আসে।কারণ হরি কাকু নিজের রান্না নিজে করে নেন।উনি দিনে একবার এক পাকে সিদ্ধ আতপ চালের ভাত খান। তড়িতড়কারি কিছু খান না।ওই ভাতেই একটা আলুসিদ্ধ দিয়ে দেন। আর রাত্রে বাতাসা মুড়ি খান।কারো হাতে খাবার তিনি খান না।
আমার কথার জের টেনে কাকু বেশ ভারী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আচ্ছা,তোমার কি মনে হয় খবরটা বুজরুকি?’
আমি বললাম–‘হালবাত, বুজরুকি।ভূত বলে কিছু হয় নাকি?আচ্ছা, আপনি আজ না হয় তান্ত্রিক হয়েছেন।কিন্তু আপনি তো বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন বলে বাবার কাছে শুনেছি।বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আপনিই বলুন এই খবর কি সত‍্য হতে পারে?’
আমার কথা শেষ হতেই কাকু জিজ্ঞাসা করলেন –‘তাহলে খবরটা কেন দিয়েছে বলে মনে হয় তোমার?’
–‘দেখুন গা এটা স্থানীয় অসৎ কোনো মানুষের চক্রান্ত হতে পারে। লোকটিকে তাড়াবার জন্য ভূতের ভয় দেখাচ্ছে–বা বাড়ির মালিক নিজে কোনো অপকর্ম করেছে ওই বাড়িতে , যা চাপা দিতে এই সব গল্প ফাঁদছে ; যাতে এলাকার কেউ ঘরের কাছাকাছি না যায়–যাতে তার অপকর্ম চাপা থাকে।’
–‘তোমার কথা ফেলে দেওয়া যায় না।হতেই পারে তুমি ঠিক।আবার এও হতে পারে তুমি ভুল, ওই সাংবাদিক ঠিক, তার খবরটা সত‍্য।’
–‘বলেন কি! ভূত!এই একুশ শতকে ভূত!এটা কখনও হয়!’
–‘আচ্ছা তার মানে তুমি ভূত-আত্মা এগুলো মান না ,তাই তো?’
—‘না আমি মানি না। একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমি এগুলো বিশ্বাস করি না।কারণ এগুলো হয় না।’
–‘তাহলে প্ল‍্যানচেট?’
–‘হ‍্যাঁ,প্ল‍্যানচেট জানি কিন্তু…’
–‘কিন্তু মান না। তাইতো?এটা জান তো রবীন্দ্রনাথ নিজে প্ল‍্যানচেট করেছেন।’
–‘হ‍্যাঁ,জানি’ বলেই এই বিষয়ে চুপ করে গেলাম।

আমার মাথাটাও বেশ গরম হয়ে গেছে।তাই বেশ কঠিন সুরেই জিজ্ঞাসা করলাম “আপনি একজন বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র হয়েও কেন এই তন্ত্র সাধনার পথ বাছলেন?এছাড়া আপনার ভূতে বিশ্বাস হলো কী করে ?একটু বললেন।”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হরি কাকু বেশ মেজাজের সঙ্গে বিরক্তির সুরে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,”তার মানে তুমি একজন হিন্দু হয়ে প্রাচীন তন্ত্র সাধনাকে অস্বীকার করছ?ভূত কে অস্বীকার করছ? মানে বলতে চাইছ ঠাকুর রামকৃষ্ণ,বামাক্ষ‍্যাপার মতো তন্ত্র সাধকদের জীবনের কাহিনী গুলো মিথ্যা? ভূত বলে কিছু নেই?”
–”ভূত আমি মানতে পারলাম না।আর তন্ত্র সাধনার বিষয়ে আমি জানি না।তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি।আপনিই বলুন আপনি কেন বিশ্বাস করেন?”

আমাদের ভূত নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক শুনে রান্না ঘর থেকে মালতিদি বলে–‘হ‍্যাঁ গো দাদা,ভূত আছে।’
–‘তাই নাকি?তুমি ভূত দেখেছ মালতিদি।’
মালতিদি রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমারা যে ঘরে আছি সেখানে এসে একটু তফাতে বসে বলল–‘আমি দেখিনি গো কিন্তু আমার মামা দেখেছে মানে বুঝেছে।’
আমি বললাম ‘সে কী!বলো বলো, ঘটনাটা বলো!’
মালতিদি শুরু করল– ‘আমার মামা বাড়ি তাপাসপুর  গ্রামে। সেখানে বড়ো ডাঙাল বলে একটা মাঠ আছে। সেখানে নদীর পাড়ে মরা পোড়ানো হয়। তাই সেই মাঠের পাশ দিয়ে সন্ধ্যায় কেউ সচরাচর যায় না। মামা ভূতটুত মানত না। একদিন রাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ওই বড়ো ডাঙালের রাস্তা ধরে। মাঠের মাঝামাঝি রাস্তায় আসতেই মামার  সাইকেলের পিছনটা ভারি মনে হয়, ঠিক সাইকেলের পিছনে কেউ চাপলে যেমন মনে হয়। মামা তাও সাইকেল চালাতে থাকে।একটু এগোতেই কেউ যেন মামাকে সাইকেল থেকে ঠিলে ফেলে দেয়। মামা ভয়ে ভয়ে উঠে সাইকেলটা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই গালে কেউ যেন একটা থাপ্পড় মারে। মামা তারপর সাইকেল ফেলে চিৎকার করতে করতে  দৌড়াতে লাগে। গ্রামে যখন ঢুকে তখন সবাই চিৎকার শুনে বাইরে এসে মামাকে ধরে। মামা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তারপর সবাই জল-টল দিলে মামার জ্ঞান ফিরে। তারপর মামা গ্রামের লোক কে সব কথা জানায়।মামার গোটা গায়ে নখের আঁকড়ের দাগ আর গালে চড় মারলে যেমন আঙুলের ছাপ থাকে সেরকম দেখা যায়। ‘
মালতিদির কথা শেষ হতেই কাকু বললেন,–‘নাও বল ,এর কী ব‍্যাখ‍্যা আছে তোমার কাছে।’
আমি বললাম,’না তা নেই। তবে…’
–”এখনো বিশ্বাস হলো না তোমার?”
আমি কাকুকে শুধালাম,–‘আচ্ছা, এবার আপনি বলুন আপনি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও কেন মানেন?”
কাকু বললেন,অবশ‍্যই বিজ্ঞানের ছাত্র যখন তখন পর্যবেক্ষণ,পরীক্ষণ ছাড়া তো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনা ।’
”তাহলে তো শুনতেই হয়। বলুন  বলুন”–আমি অত‍্যন্ত উৎসুক হয়ে বললাম।
কাকু শুরু করলেন,” আমার মাসতুতো ভাগ্নি একদিন স্কুল থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে যায়। সারা গায়ে কেমন লাল চাকা চাকা দাগ আর শরীরটা কেমন ভারি ভারি লাগে। ডাক্তার দেখিয়েও সুস্থ হয় না।ডাক্তারের নির্দেশ মতো বিভিন্ন টেস্ট করান হয় কিন্তু কোনো রোগ ধরা পড়ে না। এদিকে খেতে না পেরে মেয়ে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যায়। এমন অবস্থা হয় যে কেউ দেখে বলবে না ওর বয়স 15-16বছর। এভাবেই আজ এ ডাক্তার তো কাল সে ডাক্তার চলতে থাকে।মাসতুতো বোনের শাশুড়ি একদিন ওকে এক ওঝার কাছে নিয়ে যায়। ওকে দেখেই ওঝা বলে– ‘ওকে ভূতে ধরেছে’। ওঝা কিছু জিনিস বেঁধে দেয়,একটু ঝাড়ফুঁক করে দেয়। ওখান থেকে ফিরে এসে মেয়ে একটু ঠিক হয়। খাওয়া দাওয়া করে সবার সঙ্গে গল্প হাসাহাসি করে। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই মেয়েকে আর রাখা যায় না। সেই দেওয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে। ওঝা হাতে কোমরে যে গুলো বেঁধে দিয়েছিল সব টেনে খুলে ফেলে দেয়। আর ঠাকুরের ছবি দেখলেই চিৎকার করতে লাগে এক বিদঘুটে আওয়াজ করে। সবাই আবার দুশ্চিন্তায় পড়ল। পরদিন ওই ওঝাকে সব জানানো হলো। ওঝা জানাল তার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। এরপর থেকে ভাগ্নির সাথে বিভিন্ন অদ্ভুদ ঘটনা ঘটতে থাকে–এই ধরো বসে আছে হঠাৎ ওর জামায় আগুন লেগে গেল। অথচ কোথাও কিছু নেই ।ঘরের মধ‍্যে খাটে বসে আছে।জল ঢেলে আগুন নিভানোর পর দেখা গেল ওর জামা যেমন কার তেমন আছে কোথাও কিছু হয়নি। আবার একদিন দেখা গেল ওর চুলে হঠাৎ করে আগুন জ্বলে উঠল। নিভানোর পর আবার যেমন কার তেমন। ডাক্তার ওঝা বদ‍্যি কিছু বাদ রাখা হলো না।কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।’
আমি বললাম ‘তারপর’।
—বলছি বলছি একটু দম নিতে দাও।
দম নিয়ে কাকু আবার শুরু করলন–”কামাখ‍্যার সন্ন্যাসীদের কথা জানিস?শুনেছিস কখনও?”
আমি বললাম –‘না’।
কামাখ‍্যার এক সন্ন‍্যাসীর খব‍র দিল তারাপীঠে আসা এক তান্ত্রিক।সেই মতো মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হলো কামাখ‍্যায়। মেয়ে তো কোনো মতে মন্দিরের ধারে কাছে যাবে না। ওরা ওখানে একটা হোটেলে উঠলো। মাসতুতো বোনের জামাই বিভিন্ন জায়গায় ওই সন্ন‍্যাসীর খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু কেউ তার ঠিকানা বলতে পারেনা । তারাপীঠের সেই তান্ত্রিক একটা কথা বলে দিয়েছিল ”তোরা খুঁজবি। মনে মনে তার দর্শনের জন‍্য প্রার্থনা করবি  যদি ওনার ইচ্ছা হয় তবে উনি ঠিক তোদের দেখা দিয়ে সাহায্য করবেন।” বোনের জামাই দু-তিন দিন ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু কোনো মতেই তার হদিস না পেয়ে অসহায় অবস্থায় শ্মশানে একটা গাছের নীচে হাঁটুতে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে ভাবে– আর বোধহয় মেয়েকে বাঁচতে পারবে না।অনেক আশা নিয়ে তারা এসেছিল। কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হবে না—এইসব সাতপাঁচ যখন ভাবছে আর অঝোরে কাঁদছে ঠিক তখনই হঠাৎ এক সন্ন‍্যাসী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে বলেন,” কাঁদছিস কেনে বেটা ?আমি এসেছি। তুর মেয়ের কিছু হবে না।চল আমি যাব তোর সঙ্গে।”  জামাই অলোক মুখ তুলে সন্ন‍্যাসীর পায়ে প্রণাম করে জানতে চাই সে যাকে খুঁজছিল তিনিই সেই সন্ন্যাসী কিনা।সন্ন্যাসী জানালেন তিনিই সেই,যাকে সে কয়েকদিন ধরে খুঁজছে। সন্ন্যাসীকে সঙ্গে করে হোটেলের রুমে নিয়ে আসে অলোক। সন্ন্যাসী হোটেলের রুমের দরজায় পা দিয়েই বলেন ‘আমি ভিতরে যাব না।আমি গেলে যে তোর মেয়ের শরীরে আছে সে তোর মেয়ের ক্ষতি ক‍রবে। আমি বাইরে থেকেই ওর ব‍্যবস্থা করব।’ আর সত‍্যিই সন্ন‍্যাসী রুমে পা দিতেই ভাগ্নি বিদঘুটে আওয়াজ করে চিৎকার করতে শুরু করে। সন্ন্যাসী অলোক কে ডেকে নিয়ে আবার শ্মশানে ওই গাছের তলায় চলে যান। সেখানে গিয়ে বলেন,– ‘দেখ তোর মেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে তে-মাথার মোড়ে একটা লাল পুঁটুলিতে হাত দেয়। ওই পুঁটুলিতে আত্মহত্যা করা এক অবিবাহিত মেয়ের দোষ কাটিয়ে রাখা ছিল। এখন সেই মেয়ে তোর মেয়ের দেহ অধিকার করে আছে। ওই মেয়েকে একজন বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে ঠকিয়ে ছিল তাই সে আত্মহত্যা করে। তাই তোর মেয়ের বিয়ে হলেই ওই অতৃপ্ত আত্মা ওকে ছেড়ে যাবে’-হিন্দি বাংলা মিশিয়ে বাবাজি কথা গুলো বলে গেলেন। জামাই অলোক জানতে চায় ‘এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে?ওর এরকম অবস্থা’।অলোকের কথা শুনে সন্ন্যাসী বলেন– ‘মেয়ের বিয়ে হবে।’ তিনি সব ঠিক করে দেবেন। অলোক যেন এখনই মেয়ের মাথার একটু চুল,হাতের আঙুলের একটু নখ আর এখন যে পোশাক পড়ে আছে তার সামান্য অংশ কেটে এনে এই গাছ তলায় রেখে উলটো মুখে চলে যায়‌। পিছন ফিরে না দেখে। সঙ্গে এও জানিয়ে দেন আজকের পরে আর তিনি দেখা দেবেন না। আর আগামীকাল যেন অলোকরা কামাখ‍্যা থেকে চলে যায়। সন্ন‍্যাসীর কথা মতো অলোক নিষ্ঠা ভরে সমস্ত কাজ করে। কামাখ‍্যা থেকে ফিরে মেয়ে মোটামুটি ঠিকই থাকে। শুরু হয় বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা। অনেক খুঁজে একটা ছেলে পাওয়া গেল যদিও বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশি তবুও অলোকরা আপত্তি না করে বিয়ে দিয়ে দিল ।এখন মেয়ে একদম ঠিক।”
কাকুর মুখ থেকে এই ঘটনা শুনে আমি একদম চুপ।

এরপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হরি কাকু যা বললেন তা শুনে আমি ভারি আশ্চর্য হলাম। তিনি বললেন, — “আমি মৃতদেহের ভিতর আত্মাকে আটকে রাখতে পরি। অবশ‍্য সেটা করতে হবে মৃত্যুর মিনিট দশকের মধ‍্যে।”
কথাটা শেষ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ লক্ষ করে বেশ গম্ভীর সুরে বললেন,–“কথাটা বিশ্বাস হলো না বোধহয়!”
–“না,তা নয়,আসলে এরকম কখনও শুনিনি তো। “
আমার কথা শুনে গলার সুর চড়িয়ে বললেন,— “যদি কখনও সুযোগ হয় তো চাক্ষুষ দেখিয়ে দেব।আসলে তোমাদের মতো শিক্ষিত ছেলে ছোকরাদের এই এক দোষ। তোমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের অধীত বিদ‍্যাকে মানতে চাও না।”
আমাদের আলোচনার মাঝেই– কটা হবে এই আটটা কি সোওয়া আটটার দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এমন সময় হঠাৎ দেখি ছাতা মাথায় টর্চ হাতে উঠেনে দাঁড়িয়ে” ঠাকুর মশাই…ও… ঠাকুর মশাই” বলে কেউ ডাকছে।হরি কাকুকে গ্রামের লোক “ঠাকুর মশাই” বলে ডাকে। ডাক শুনে হরি কাকু–“কে রে ভোলা নাকি ?”বলতে বলতে হ‍্যারিকেনটা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়ালেন। আমিও পিছন পিছন উঠে এলাম।
–“হ‍্যাঁ,গো ঠাকুর মশাই,আমি ভোলা।”
–“কী হয়েছে রে ভোলা?” হরিকাকু জিজ্ঞাসা করলেন।
–“কর্তা কেমন করছে ঠাকুর মশাই।খুব ছটফট করছে।আপনি এখুনি একবার চলুন।”
–“আচ্ছা তুই যা আমি আর ডাক্তার দাদা এক্ষুনি যাচ্ছি।”
ভোলা উৎপল মোড়লের বাড়ির চাকর। উৎপল কাকুর স্ত্রী গতবছর তিনদিনের জ্বরে মারা গেছেন।ছেলে আধাসামরিক বাহিনীতে চাকরি করে।বাবা কে বহুবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু উৎপল কাকু বাবার ভিটে ছেড়ে যেতে রাজি হননি।তাই তিনি গ্রামেই থেকে যান। উৎপল কাকুর ছেলে  অসুস্থ বাবাকে সর্বক্ষণ দেখাশোনা করা স্নান করানো রান্না করে খাওয়ানো টাইমে ওষুধ দেওয়া প্রভৃতি সমস্ত কাজের জন‍্য গ্রামেরই মাঝবয়সী চাষাদের ছেলে ভোলাকে রেখে গিয়েছে মোটা টাকা বেতনে।
আমি চিকিৎসার জিনিসপত্র ভরা ব‍্যাগটা এক হাতে আর একহাতে ছাতাটা নিলাম। আর হরিকাকু অন‍্য একটা ছাতা আর টর্চ নিয়ে রাস্তা দেখিয়ে চললেন।
উৎপল কাকুর বাড়িতে ঢুকে তার শোওয়ার ঘরে গিয়ে আমি প্রথমে তার পালস চেক করলাম তারপর যা যা আমাদের ডাক্তাররা করে থাকে সে সব করলাম–মানে প্রেসার মাপলাম,বুকে স্টেথো দিয়ে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করে যেটুকু বুঝলাম অবস্থা খুব খারাপ।তাই চিকিৎসার সমস্ত প্রাথমিক পর্ব সেরে হরিকাকুকে বললাম–“অবস্থা ভালো না। শহরে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে । যে কোনো সময় কোলাপ্স করবে।”
–“কিছু ওষুধ দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না হাসপাতাল।”–হরিকাকু জিজ্ঞাসা করলেন।
–“এতো দূর,তারপর রাস্তার যা অবস্থা তাতে রাস্তাতেই শেষ হয়ে যাবে মনে হয়।আর হাসপাতালে ভর্তি করেও কিছু হবে বলে মনে হয় না।বরং ওনার ছেলেকে খবর দিয়ে দেন।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি আসুক।” কথা গুলো বলেই আমি আবার পালস মাপতে উৎপল কাকুর হাতটা নিয়ে দেখলাম– শেষ। সেকথা বলতেই হরিকাকু বললেন,” আজ তোমাকে যে বিদ‍্যার কথা বলছিলাম তুমি বিশ্বাস করোনি আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ তোমাকে দেখাব।যা তোমাদের বিজ্ঞান পারে না।”
আমি বললাম “ও ওই দেহে প্রাণ আটকে রাখা।”
“হ‍্যাঁ”বলেই হরি কাকু ঘর থেকে দ্রুত গতিতে বেরয়ি ছাতা মাথায় চলে গেলেন। আবার মিনিট দুই-তিনের মধ‍্যে ফিরেও এলেন। হাতে কয়েকটা বই ও কিছু জিনিস নিয়ে।
সদ‍্য মৃত উৎপল বাবুর ঘরে ঢুকে আমাকে দরজা জানলা সব লাগিয়ে দিতে বললেন ও দূরে দাঁড়িয়ে দেখার নির্দেশ দিলেন । তারপর মেঝেতে আসন পেতে বসে কী সব আঁকিবুকি আঁকতে লাগলেন। তারপর “ওঁ হিং টিং সট ছট শৃণু” মন্ত্র বলতে বলতে উৎপল বাবুর খাটের চারকোণে চারটি পেরেক পুঁতে লাল সুতো জড়াতে লাগলেন। সুতো জড়ানো শেষে মন্ত্র বলতে বলতে একটা পাত্র থেকে হাতে করে জল ছিটাতে লাগলেন উৎপল কাকুর গায়ে। তারপর একদম উৎপল কাকুর মুখের উপর ঝুঁকে তার কপালে একটা লালা টিপ পড়িয়ে দিয়ে বুকের মাঝে হাত রেখে উৎপল কাকুর নাম ধরে ডাকতে লাগলেন ।বেশ কয়েকবার ডাকার পর একটা অর্ধস্ফুট ও অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম।কেউ যেন সাড়া দিল।কিন্তু কী অদ্ভুত আওয়াজ।ঠিক যেন অনেক দূর থেকে বা কোনো খালি পাত্রের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে কথা বললে যেমন হয় তেমন শব্দটা।
সাড়া দেওয়ার সাথে সাথে হরি কাকু বললেন–কী হয়েছে তোমার উৎপল?
–“আমি মরে গেছি।আমাকে আবার ডাকছ কেন?আমাকে যেতে দাও।বিরক্ত করো না।”
সেই অদ্ভুত ভাবে শব্দ করে হরিকাকুর কথার উত্তরে কেউ এ কথা গুলো বলল?তাহলে কী উৎপল কাকু!কারণ ঘরের ভিতর আমি আর হরিকাকু ছাড়া কেউ নেই।আশ্চর্য হয়ে গেলাম।গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।নিজের চোখ আর কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। এমন সময় হরিকাকু গলা মোটা করে বললেন,” আমি না ছাড়া পর্যন্ত তুমি কোথাও যাতে পারবে না।তুমি এখন আমার হাতে বন্দি।মনে রাখবে আমি তোমাকে তোমার দেহের ভিতর আটকে রাখলাম।যখন ডাকব তখন সাড়া দেবে–বুঝেছ।”
আবার সেই দূর থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় কেউ যেন অর্ধস্ফুটভাবে বলল “আচ্ছা! জ্বালাতন তো।আমাকে ছেড়ে দাও”
–“না, এখন তোমার ছাড়া নেই। তুমি মনে কর তুমি ঘুমাচ্ছো—ঘুমিয়ে যাও—গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাও—আবার পরে তোমাকে ডাকব।” উৎপল কাকুর বুকের মধ‍্যে একটা হাত ও অর্ধেক খোলা চোখে চোখ রেখে হরিকাকু গম্ভীর ভাবে কথা গুলো বললেন।
এই দৃশ‍্য দেখে আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম।সব শেষ করে হরিকাকু আমাকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে বলে নিজেও বেরিয়ে এসে দরজায় বাইরের ছিটকিনি লাগিয়ে “ওঁ স্থানু বন্দি ইহো দেহে ইহো ঘটে শৃং শং শৃণু ছট্ কট্” মন্ত্র বলতে বলতে লাল কাপড় আর লাল সুতো বেঁধে দিলেন। ভোলাকে ডেকে বলে দিলেন ঘরের দরজা যেন কেউ না খুলে। তিনি আবার কাল সন্ধ্যায় এসে খুলবেন।
এরপর বাড়ি ফিরে উৎপল কাকুর ছেলেকে ফোনে সব জানান হলো। এমনকি এই আত্মা ধরে রাখার বিষয়টাও। ছেলে জানাল সে ছুটির ব‍্যবস্থা করছে।আশা করছে দু-তিনদিনের মধ‍্যেই বাড়ি চলে আসবে।
এই সমস্ত কিছুর মধ‍্যে হঠাৎ করে হরিকাকুকে কেমন অদ্ভুত লাগতে লাগল।তাকে দেখে যেন খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।সদা হাস‍্য মানুষটি কেমন যেন ঝুম মেরে গেল। উৎপল কাকুর বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে হরিকাকু আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।রাত্রে খাবারও কিছু খেলেন না।আমিও আর বিরক্ত করলাম না। আমি কোনো রকমে একটু খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম কিন্তু একফোঁটা ঘুম এলো না। এখনও পর্যন্ত গোটা ঘটনাটাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কে সাড়া দিল—এরকম হয় কিনা বিবিধ চিন্তা তখনও আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

পরদিন সকালেও দেখি, যে হরিকাকু ভোরে উঠে স্নান সেরে পুজোর আয়োজন করেন তিনি আজ এখনও বিছানা থেকে উঠেননি। আজ পর্যন্ত যে কটা দিন আমি এখানে এসেছি এমন কখনও দেখিনি। তাই কাকুর ঘরের ভিতর ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম–“আপনার কি শরীর খারাপ।” বিছানায় শুয়েই কাকু উত্তর দিলেন “প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধ কাজ করেছি সে কি আমাকে ছেড়ে দেবে ভাবছ।যতদিন না আমি উৎপলের আত্মাকে মুক্তি দিচ্ছি ততদিন আমার শরীরের উপর অত‍্যাচার চলবে।বেশি দিন ধরে রাখলে আমার মৃত্যুও হবে।” কাকুর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম বললাম –“তাহলে আজ রাতেই মুক্ত করে দিন।” কাকু বললেন –“থাক  ছেলেটা তো চলে আসবে বলেছে।”
কাকুকে জোড় করে দুপুরে একটু খাওয়ালাম।খাওয়ার সাথে সাথে বমি করে সব বের করে দিলেন।সন্ধ্যা নামতেই কাকুর চোখ মুখের আকৃতি বদলে গেল।আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেল উৎপল কাকুর বাড়ি।ঘরের দরজা খুলে আগের দিনের পেতে রাখা আসনে বসে বেশ কিছুক্ষণ মন্ত্র পাঠ করে উঠে আগের দিনের মতো উৎপল কাকুর মুখের উপর ঝুঁকে লাল টিপ পড়িয়ে বুকের মাঝে হাত রেখে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ ডাকার পর সাড়া পাওয়া গেল।
হরি কাকু জিজ্ঞাসা করলেন–“উৎপল তুমি কোথায় আছো?কেমন আছো?”
সেই খোনা খোনা গলায় নাকি সুরে উত্তর শুনতে পেলাম।আজকের আওয়াজটা যেন আরও দূর থেকে আরও গভীর থেকে আসছে বলে মনে হল।
–“আমাকে ছেড়ে দাও।খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি ভালো নেই। আমাকে আমার দেহ থেকে মুক্তি দাও।”
এই কয়েকটা কথা অনেকক্ষণ ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন মৃত উৎপল কাকু।
সত‍্যি আশ্চর্য চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও মৃতদেহের কোনো ক্ষতি হয়নি একটু গন্ধ ছাড়েননি–কিচ্ছু হয়নি।শরীরটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে।নিজের চোখ কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না।ডাক্তারি জ্ঞান কে ভ্রান্ত মনে হচ্ছে।
হরিকাকু বললেন,–“খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে ছেড়ে দেব।এখন তুমি ঘুমাও।মনে করো তুমি জল খেয়েছ।তোমার তেষ্টা মিটে গেছে।তুমি আরামে ঘুমাচ্ছো।আবার কাল জাগাব।” এই বলে আবার আগের দিনের মতো আমাকে ঘর থেকে বের করে হরি কাকু কিছুক্ষণ  পরে ঘর থেকে বেরলেন।তারপর আগের দিনের মতোই মন্ত্র বলে দরজা বন্ধ করে লাল কাপড় আর লাল সুতো বেঁধে দিলেন।তারপর আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।বাড়ি এসে উৎপল কাকুর ছেলেকে ফোন করে জানালাম যে আত্মা ধরে রাখায় হরিকাকুর শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।তাই তাড়াতাড়ি আত্মার মুক্তি দিতে হবে।ছেলে জানাল সে ছুটির দরখাস্ত করেছে।ছুটি মঞ্জুর হলেই সে বেরিয়ে যাবে।
আজ তিনদিনে পড়ল।হরিকাকুর শরীর আগের থেকে আরও খারাপ হয়েছে।সকাল থেকে রক্ত বমি শুরু হয়েছে।তাকে দেখে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না ।তাই উৎপল কাকুর ছেলেকে ফোন করে ছুটি হয়েছে কিনা জানতে চাইলাম।সে জানাল তার ছুটি মঞ্জুর হয়নি।তাই আমরাই যেন তার বাবার মৃতদেহ সৎকার করে দিই।সে পরে এসে সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়া করবে।
হরিকাকুকে সব জানালাম সেই সঙ্গে বললাম আজ রাত্রে উৎপল কাকুকে মুক্তি দিয়ে দিতে। কাকু রাজি হলেন।কিন্তু সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হরি কাকুর সঙ্গে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগল।হঠাৎ করে তার চোখ মুখ থেকে গড়গড় করে রক্ত পড়তে লাগল।হরিকাকু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কেমন একটা চিৎকার করতে লাগল।এইসব দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম।হরিকাকুর গায়ে হাত দিয়ে জোড়ে ডাকতেই কাকু একটু প্রকৃতস্থ হলেন।তখন রক্ত পড়াটাও বন্ধ।কাকুর আর হেঁটে উৎপল কাকুর বাড়ি যাওয়ার মতো শক্তি নেই।আমি আর ভোলা কোনো রকমে কাঁধে তুলে নিয়ে গেলাম।সেখানে পৌঁছানো মাত্র আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।যে ঘরে উৎপল কাকুর মৃতদেহ আছে সেই ঘরের ভিতরের জিনিস পত্র কেউ যেন ছুড়ে ছুড়ে মেঝেতে ফেলছে –দরজাটা ধরে খুব জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিচ্ছে–আর সেই অদ্ভুত বিদঘুটে গলায় চিৎকার করছে।হরি কাকু বাইরে থেকে মন্ত্র পড়তে আরম্ভ করলেন। মন্ত্র পড়া শেষ করে বললেন –“আজ  তোমাকে ছেড়ে দেব।তুমি শান্ত হও।আর শান্ত না হলে আজও ছাড়ব না। “
হরিকাকুর বার কয় এই কথা বললে জিনিস পত্র ভাঙার আওয়াজ ও বিদঘুটে চিৎকার করাটা বন্ধ হয়। আজ আমাকে ঘরের ভিতর ঢোকার আগে গলায় একটা মাদুলি পড়িয়ে দিলেন। তারপর কাকু আস্তে আস্তে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। আমিও তার পিছন পিছন ঢুকলাম। বারান্দায় রাখা লন্ঠনের আলোয় ঘরের ভিতরের যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে দেখলাম গোটা মেঝেতে ঘরের জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো।এমনকি কাকুর পুজোর জিনিস গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।অথচ উৎপল কাকুর দেহ খাটে আগের মতোই শোয়া অবস্থায়।তাহলে কে?আমি কোনো হিসাব মেলাতে পারছি না।আজ তিনদিন হয়ে গেলেও দেহে কোনো পচন ধরেনি,গন্ধ ছাড়েননি।
হরি কাকু সেই আলো-অন্ধকারে অসুস্থ শরীরে আসন পেতে বসে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। আসন থেকে উঠে কাকু মৃত দেহের উপর জল ছিটাতে ছিটাতে আমাকে ইশারায় সব জানলা দরজা খুলে দিতে বললেন।তার নির্দেশ মতো আমি দরজা জানলা সব খুলে দিয়ে প্রথম দিনের মতো দূর দাঁড়িয়ে কাকুর কান্ডকারখানা দেখতে লাগলাম ।
দেখলাম কাকু মৃতদেহের উপর ঝুঁকে কপালের তিলকটা মুছে দিলেন।তারপর বুকের মাঝে হাত দিয়ে আবার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।আজ অনেক দেরিতে সাড়া পাওয়া গেল। হরি কাকু বললেন,–“আজ তোমাকে ছেড়ে দেব।তার আগে তুমি কথা দাও আর কখনও এই বাড়িতে এই গ্রামে আসবে না। কাউকে জ্বালাবে না। তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে চলে যাবে। এখন থেকে তুমি মনে করবে তুমি মরে গেছ। ” —কাকুর এই কথা শুনে  ভাঙা ভাঙা খোনা গলায় ঠিক হাঁড়ির ভিতর থেকে আওয়াজের মতো করে কেউ যেন সাড়া দিয়ে বলল—“না আমি আসব না।কাউকে জ্বালাব না।আমাকে ছেড়ে দাও খুব কষ্ট আমার।”
একথা শেষ হতেই কাকু বললেন,–“যাও আজ থেকে তুমি মুক্ত।এই শরীরে আর তোমাকে বন্দি থাকতে হবে না।যাও তোমাকে মুক্তি দিলাম।”
এই বলেই কাকু মৃতদেহের কপালের সব সিঁদুর মুছে দিলেন।তারপর”শৃনু শানু ছিং টিং মুক্তং চক্রং বন্দিং দশাং ভো ভো মুক্তিং” মন্ত্র বলতে বলতে পেরেকে বাঁধা সুতো গুলো সব একে একে খুলে দিলেন।সুতো খোলা শেষ করে একটা একটা করে পেরেক মন্ত্র বলতে বলতে তুলতে লাগলেন।শেষ পেরেকটা যখন তুললেন তখন স্পষ্ট দেখলাম মৃত দেহটা নড়ে উঠল।আর সমস্ত ঘর পচা গন্ধে ভরে গেল।  মৃতদেহে পচন শুরু হয়ে গেছে। এতক্ষণ হরিকাকুর দিকে নজর ছিল না। এখন তাকিয়ে দেখি তিনি মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।আমি ও ভোলা ধরাধরি করে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে জল পাখা করাতে তার জ্ঞান ফিরল। পরে কাকুকে বাড়িতে শুয়ে রেখে আসি। তারপর গ্রামের সকলে মিলে মৃতদেহ সৎকারের ব‍্যবস্থা করলাম।
সৎকার করে ফিরতে ফিরতে সকাল হয়ে গেল।নদীতে স্নান সেরে বাড়িতে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম হরিকাকু বিছানা থেকে নীচে পড়ে আছেন।আর তার চারদিকে তাজা রক্ত।এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কাকুর গলায় কিছু একটা কামড়ের দাগ সেখান থেকে তখনও রক্ত বেরচ্ছে।গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম কাকু আর নেই।হঠাৎ চোখে পড়ল খাটে রাখা একটা কাগজ।তাতে আমার নামে লেখা–
স্নেহের সন্তু,
ফিরে এসে  তোমাদের আবার শ্মশান যেতে হবে আমার নশ্বর দেহটা নিয়ে। কারণ তোমাকে যে বিদ‍্যার প্রয়োগ দেখিয়েছি তাতে শেষে যে তান্ত্রিক এই বিদ‍্যা প্রয়োগ করে মৃতদেহের আত্মার মুক্তির কিছু পরেই তার মৃত্যু হয়।তাই ফিরে এসে তুমি আর আমাকে দেখতে পাবে না। তবে শুধু তোমাকে বিষয়টা চাক্ষুষ দেখানোর জন্য নয় নিজের অধীত বিদ‍্যার পরীক্ষার জন‍্য আমি এটা করেছিলাম। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করার শাস্তি আমাকে পেতে হবে। আশাকরি এবার নিশ্চয় তোমার ভূত ও তন্ত্র সাধনার শক্তিতে বিশ্বাস জন্মেছে। আমার সেদিনের বলা কথায় এখন নিশ্চয় তোমার আর কোনো সন্দেহ নেই।আমার…
এরপর হয়তো কিছু লিখতে গিয়েছিলেন কিন্তু সেই সময় ও সুযোগ পাননি বলে মনে হল। আজও পর্যন্ত এই ঘটনাটা আমার কাছে রহস্য হয়ে রয়ে গেছে।

কলমে-বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here