“এতদিন যার অপেক্ষায় বসে থেকে আশা প্রায় শেষ হয়ে গেছিল, সে এলো কিন্তু ধরা দিল না”
পাঁচদিন পর অফিস ট্রিপ থেকে ফিরে ধপ করে বসে পড়ে কুহু। আর কতবার যে এমন হবে তার সাথে। প্রথমবার কুমড়ো গাছ লাগিয়েছিল কুহু। কিন্তু গাছ তরতরিয়ে বাড়লেও ফুলের দেখা পায় না কুহু। কেটে যায় দু’মাস। আর আজ ফিরে কুহু দেখল প্রায় সাতটা কুমড়োফুল মৃত শুকনো কয়েকটা পাতার মতন আটকে আছে গাছে। এ আর নতুন কি! শেষ অব্দি সবাই মাঝরাস্তায় এসে ফিরিয়ে দেয় কুহুকে।
নতুন বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে অস্তমিত সূর্য যখন শেষ রশ্মিতে আলতো স্পর্শ করে যায় পাঁচ ফুট লম্বা সূর্যমুখীগুলোকে তখন হঠাৎ করেই কুহুর মনে হয় পাঁচবছর হয়ে গেল সে ঘরছাড়া।
কেমন অদ্ভুত এই জীবন। দু নৌকোয় পা দিয়ে কেটে যাচ্ছে রোজ, তবুও বৈতরণী পার করা হয়না তার। হাতলওয়ালা দুটো সাদা চেয়ার, তুলসী, জবা, গোলাপ, গাঁদায় সাজানো কুহুর সাধের বাগান। ঠিক যেমন ছিল কলকাতার বাড়ির ছাতে। কুহুর বাগানে বিদেশী ফুলের প্রবেশ নিষেধ। বাগানটা আসলে নিমিত্ত মাত্র। সেখানের সমস্ত কিছু আসলে ফেলে আসা দিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। তবুও কুহু অনুভব করে কিছু যেন একটা নেই সেখানে। এত যত্ন করে কুহু ওদের তবুও সেই চেনা গন্ধটা পায়না কুহু।
শীতকালে বরফে ঢেকে যায় সবটা। ছোটবেলা যে দৃশ্য সে অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে দেখত সিনেমায় আর মনে হত এক ছুটে চলে যায় সে সেই “ওয়ান্ডারল্যান্ডে” এখন তার জানলার বাইরে সবটাই খুব বিরক্তিকর। সব পাতা ঝড়ে যায় বড় গাছগুলোর। সাদা চাদরে মুড়ে যায় চারিদিক। ঠিক যেমন মুড়ে রেখেছিল নিলাঞ্জনকে দু’ বছর আগে। এমনই বরফঠান্ডা রাতে গাড়ির চাকাটা স্কিট করে যায় নিলাঞ্জনের। মেয়ে রিনির জন্যই বেরোতে হয়েছিল তাকে। পরেরদিন “কনসুলেট জেনারেল ওফ ইন্ডিয়া”তে তার নাচের অনুষ্ঠান। শেষ মুহুর্তে তারা জানিয়েছে নাচের জন্য সাদা ফুল চাই। যে বাগানে সাদা ডালিয়া হয়ে থাকে অন্যসময় সেই বাগান এই ঠান্ডায় রুগ্ন, হাড়গোর বার করে তখন ধুঁকছে ভয়ংকর বরফঠান্ডায়। কুহু না চাইলেও মেয়ের বাবা ছুটল ফুল আনতে। আর ফিরতে পারেনি নিলাঞ্জন। কুড়ি ইঞ্চি সাদা বরফের কামড়ে স্থির হয়ে গেছিল সময়টা। ব্ল্যাক আইসে গাড়ি উল্টে গেলেও নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল নিলাঞ্জন কিন্তু দরজাটা খুলে অর্ধেক শরীর বাইরে নিয়ে গেলেও কুড়ি ইঞ্চি বরফে লাশ হয়ে যায় সবটা। কুহু সাদা চাদরে মোড়া নীল হয়ে যাওয়া মানুষটাকে দেখে কাঁদেনি একবারও। এই দেশে এমন আ্যক্সিডেন্ট হওয়াটা তো নর্মাল!
বসন্তের ঊষ্ণ আবেদনে বাগানটাকে নতুন বউয়ের জরি পাড় বেনারসির মতন লাগে কুহুর। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের দিকে তাকাতেই পড়ন্ত ছায়ায় মায়ের শাড়ীটা দেখতে পায় কুহু। লাল পাড় সাদা আঁচলটা লোটাতো তাদের কলকাতার বাড়ির ছাতে আর মা ব্যস্ত তখন গাছগুলোর যত্ন নিতে। কুহু দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেই মা তাকে শেখাতো মাটির যত্ন। মাটির সঠিক যত্নেই ফুল হয়। মাটি যদি ঠিক না পড়ে, খাবার যদি ঠিক না দেওয়া হয় তাহলে সুন্দর হবেই না গাছের বড়ো হয়ে ওঠা। সব গাছের খাওয়ার উপাদানও এক না। কারোর চাই পটেসিয়াম, কারোর নাইট্রোজেন, কারোর জল কম রোদ বেশী, কারোর প্রয়োজন ছায়া। ছোট্ট চারা থাকার সময়টাই আসল, তার ওপরই নির্ভর করে বড় হয়ে ওঠা। চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে কুহুর। রিনি চলে গেছে তাকে ছেড়ে একবছর হয়ে গেছে। কলকাতায় জন্ম হলেও আমেরিকায় বড় হওয়া রিনির “নিজের স্পেস” খুব প্রয়োজন। তাই গ্র্যাজুয়েশনের পর নিজে এক ছোট চাকরি নিয়ে সে এখন নিউইয়র্কের একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকে। শাষণে যে আদর থাকে তা এ দেশে বেমানান। বাঁধা দেয়নি কুহু। রিনির ছোট ঘরটায় ফুল রাখার কোনও জায়গা নেই। রিনিদের তাই কোনও অনুশোচনা অভিমান হয় না। কুহুর হয় মায়ের ওপর। মা ভুল শিখিয়েছিল, মাটির সঠিক পরিচর্যাতেও সবসময় ভাল ফল হয় না। রিনির তাই আর মনেই পড়ে না কলকাতার লাল বারান্দা, বাগানের দোলনা, ছোটবেলার রান্নাবাটি। এখন তাই অফিসের পর বাগানবিলাসিতায় একা কুহু। তবে নিঃস্বঙ্গ নয়। কয়েকটা সবুজ কথা না রাখলেও বেশিরভাগেরাই রাখে। রোজ সকালে বাড়ির চারপাশটা ভরিয়ে দেয় ফুলে।
ফোনটা বেজে ওঠে কুহুর। “মম আই কান্ট কাম দিস সামার। আওয়ার ফ্রেন্ডস আর প্ল্যানিং ফর এ ট্রিপ টু ইজিপ্ট।” ইতিহাসের ঝোঁকটা দাদুর থেকে পেয়েছে রিনি। কুহুর সম্মতির অপেক্ষা যদিও রিনি করে না। তবে এবার রিনি উল্লেখ করে দাদুর কথা। দাদুর কাছে গল্প শুনেছিল ইজিপ্টের। তাই এবার চাক্ষুষ দেখবে সে মিশরীয় সভ্যতা।
কুহু ফিরে তাকায় বাগানটার দিকে। আলগা হয় অনেকদিনের একটা তীব্র অভিমান। কুহু-নিলাঞ্জনের বাইরে থেকে যাওয়াটা কোনওদিন মেনে নেননি অখিলেশ চ্যাটার্জি, কুহুর বাবা। তাই যে মানুষ মেয়েকে ছাড়া একদন্ড থাকতে পারত না, সে একবারও আসেনি এখানে। নিলাঞ্জনের মৃত্যুর সময়েও না। মা এলেও চলে যেতে হয়েছে তাঁকে তাড়াতাড়ি। কুহু চায়না তাঁরা আলাদা থাকুক। তাই জোর করেনি সেও। রিনিরা ফেরেনা কিন্তু কুহু ফিরবে। আসলে একটা ভয়, অসহায়ত্ব, অনিশ্চয়তা কাজ করে এই দেশটায় সব ভালোর মধ্যেও। বাবা হয়ত জানত সেটা।
ল্যাপটপ খুলে এমিরেটস্-এর ওয়েবসাইটে ঢোকে কুহু। এবার গ্রীষ্মে সে বাড়ি ফিরবে, সেই গন্ধটাকে ফিরিয়ে আনতে তার বাগানে। মায়ের রজনীগন্ধায় আবার নতুন করে সাজবে বাগানবিলাসীতা। যা নিজের, যেখানে ছড়িয়ে আছে অস্তিত্বের শিঁকড়, তা শেষ পর্যন্ত থেকে যায় আপণ হয়েই। ওরা অপেক্ষা করে কুহুর জন্য….. চিরন্তন, চিরদিন।।
কলমে সুষ্মিতা রায়চৌধুরী, নিউজার্সি
একজন ব্লগার, বাচিকশিল্পী এবং লেখিকা।সানন্দা, ভ্রমণ, আনন্দবাজার, প্রতিদিন, দি ওয়ালে ফিচার লেখা ছাড়াও উনি নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন দেশ-বিদেশের ই-ম্যাগাজিনে গল্প, ধারাবাহিক, অণুগল্প, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, নাটক লিখে থাকেন।