দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ বলা হয়, অথবা সবচেয়ে পরিচিত নাম হলো তিনশ ষাট আউলিয়ার দেশ; দুটোই বাংলাদেশের সিলেট জেলার নাম। চায়ের বাগানে ঘেরা জেলার একদম শেষ প্রান্তে আমাদের সিলেট ক্যাডেট কলেজ,তিনদিকে পাহাড় আর সামনে বিস্তীর্ণ চা বাগানের মমতায় ঘেরা এই কলেজ ১৯৭৯ সালে যাত্রা শুরু করে।১৯৭৯ এর পূর্বে এই কলেজ ছিল “সিলেট রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ”। এই কলেজের প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
কলেজের হাউস ৩টি। তিতুমীর, সুরমা আর শাহজালাল হাউস। এখানে ছাত্রদের বলা হয় “ক্যাডেট”, কেননা এই দেশে পাকিস্তানি আমলে ক্যাডেট কলেজ গড়ে তোলা হয়েছিল সেনাবাহিনীর জন্য যোগ্য ছাত্র তৈরির জন্য, এবং এখনো সেই একই আদর্শ নিয়ে এই কলেজের শিক্ষাক্রম চলে আসছে।
- মূল কাঠামোঃ কলেজের মূল কাঠামো ৫৩.৫৪একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। কলেজের চারপাশ দেয়াল ও বৃক্ষরাজি দিয়ে ঘেরা। বিদ্যুতের ব্যবস্থার জন্য রয়েছে নিজস্ব জেনারেটর। কলেজ আবাসিক হওয়ায় এখানে শিক্ষকদের থাকার জন্যও রয়েছে আলাদা কোয়ার্টার। পাশাপাশি দপ্তরি, মালি, ঝাড়ুদারদেরও নিজস্ব কোয়ার্টার, ক্লাব রয়েছে। ডাইনিং হল আয়তন ৩০০জনের বসার জন্য। অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষের জন্য বাংলো আছে।
- প্রাত্যহিক কার্যক্রমঃ এই কলেজের প্রতিদিনের রুটিন চলে ঘড়ির কাঁটা ধরে। সংক্ষিপ্তভাবে যদি কলেজের প্রতিদিনের কাজ তুলে ধরা হয় তা হবে এমনঃ
১. সকাল ৫ঃ২৫ এ ঘুম থেকে উঠে আধাঘণ্টা শরীর চর্চা, তারপর গোসল–আহার, জুতো পলিশ, কাপড় পরিপাটি করা, সকালের খাবার গ্রহণ।
২. ৭ঃ৫০ থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান , ১০ঃ৫০ থেকে ১১ঃ২০ পর্যন্ত নাস্তার বিরতি।
৩. ১ঃ৩৫ এ ক্লাস সমাপ্তি, দুপুরের খাবার, বিশ্রাম।
৪. ৪ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত খেলাধুলা।
৫. ( যেহেতু বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ, তাই) ৬ঃ১৫ পর্যন্ত নামায।
৬. হালকা নাস্তা, শ্রেণিকক্ষে নিজস্ব পাঠ প্রস্তুতি, ৮ঃ১৫ থেকে ৯ঃ১০ পর্যন্ত রাতের খাবার, আবার শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ।
৭. সারাদিনের কাজ শেষে রাত ১০ টায় হাউসে আসা।
- স্বদেশে অবদান ও অভ্যন্তরীন কার্যক্রমঃ এভাবে সুশৃঙ্খলভাবে শিক্ষাগ্রহণ করে ক্যাডেটরা দেশের অমূল্য রত্নে পরিণত হয়, চিকিৎসা, প্রকৌশল খাত এবং বিশেষভাবে, সেনাবাহিনীতে ক্যাডেটদের যোগদান দেশের উন্নতির মানদণ্ডকে আরো উন্নত করছে।
ক্যাডেটদের পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য রয়েছে বিভিন্ন পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কাজ, যেমন ঃ দেয়াল পত্রিকা, মাসিক ও বাৎসরিক ম্যাগাজিন, সাপ্তাহিক খবর আলোচনা,সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা আরো অনেক কিছু। শারীরিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে, ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, এ্যাথলেটিক্স ও রয়েছে।
- শিক্ষকদের অবদান ও ফলাফলঃ অভিভাবকদের থেকে দূরে থাকা ক্যাডেটরা বছরে মোট তিনমাস বাসায় যেতে পারে, বাকি সময় কলেজের নিয়মে শিক্ষালাভ করে। অভিভাবক শূন্যতায় থাকা সত্ত্বেও কলেজের সুযোগ্য ও স্নেহপ্রবণ শিক্ষকদের পরম যত্নে ক্যাডেটদের মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণতা লাভ করে।
কলেজের শিক্ষার মান অনেক ভালো। বরাবরই এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষায় কলেজ গর্বের সাথে সিলেট বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে। কলেজের প্রতিটি ক্লাসরুমে রয়েছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির সাথে ক্যাডেটদের খাপ খাওয়ানোর সকল
উন্নত ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি কলেজের সব ক্লাসরুমে দেয়া হয়েছে ডিজিটাল বোর্ড।
- সাংস্কৃতিক বিনিময়ঃ এসবের পাশাপাশি কলেজ থেকে সাংস্কৃতিক আাদান–প্রদানের ব্যবস্থাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রতি বছর কোনো একজন যোগ্য ক্যাডেটকে কলেজ ব্যবস্থাপনায় Cultural exchange এর জন্য প্রেরণ করা হয়। এভাবে বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কেও ক্যাডেটদের সম্মুখ ধারণা দিতে সিলেট ক্যাডেট কলেজ তৎপর।
- অনুষ্ঠানাদিঃ কলেজে প্রতি বছরই বাৎসরিক কিছু অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে রয়েছেঃ শীতের পিঠা উৎসব , বার–বি–কিউ পার্টি, গ্রীষ্মে ফল উৎসব, বিভিন্ন সময় কনসার্টের আয়োজনও করা হয়। তাছাড়া রয়েছে কলেজ পিকনিকের ব্যবস্থা। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি জাতীয় দিবসেও বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠান ও নানা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয়ে থাকে। এছাড়া শূত বস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিও হয়ে থাকে।
- নিজস্ব সুযোগ–সুবিধাঃ ক্যাডেট কলেজ সুযোগ্যভাবে পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার থেকে প্রতি ক্যাডেটের পেছনে মাসে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়। ক্যাডেট কলেজে সকল কিছুর সুবিধা বিদ্যমান, রয়েছে ঃনিজস্ব খেলার ফুটবল মাঠ, ক্রিকেট পিচ ও মাঠ, বাস্কেটবল – ভলিবল–টেনিস–ব্যাডমিন্টন কোর্ট, মাঠ পরিষ্কার রাখার জন্য কর্মরত রয়েছে ২০জনেরও অধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কলেজের বিস্তৃত বাগান পরিচালনার জন্য রয়েছে ৫জনের অধিক মালি। রয়েছে চুল কাটার নিজস্ব সেলুন ও ধোপাখানা। সম্প্রতি সুইমিং পুলের কাজও চলছে।
- অন্যান্য সুবিধাঃ কলেজের রয়েছে নিজস্ব মুরগির ফার্ম ও গরুর গোয়াল, নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষ করা হয়।কলেজে রয়েছে ১৪০০০বই সমৃদ্ধ পাঠাগার।কলেজ থেকে ক্যাডেটরা রচনা প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞানমেলা, ভাষা প্রতিযোগিতা, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়।
- স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতাঃ ক্যডেটদের পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস বজায় রাখার জন্য মাসিক অধ্যক্ষের পরিদর্শন হয়। পাশাপাশি প্রত্যেক হাউস পরিচালনার জন্য রয়েছেন হাউস মাস্টার, কলেজের নিজস্ব হসপিটালে রয়েছে চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং আর্মি ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার। ক্যাডেটদের সুস্বাস্থ্যের জন্য সকল ওষুধ ও প্রয়োজনীয় মেডিকেল দ্রব্যাদি হসপিটালে পাওয়া যায় বিনামূল্যে।
- মহত্বঃ এই কলেজের সবচেয়ে বড়ো মহত্ব হলো, অভিভাবকের মাসিক আয় অনুযায়ী ক্যাডেটদের মাসিক বেতন নেয়া হয়। সকল ক্যাডেট প্রতি বেলা একই কাপড় পরে, এক সাথে খায়, পড়াশোনা করে, খেলাধুলো করে, অর্থের দম্ভ ক্যাডেট কলেজে কখনোই শেখানো হয় না।
এসবকিছু মিলিয়ে এই সিলেট ক্যাডেট কলেজ বাংলাদেশের সুনাগরিক ও যোগ্য নেতা গড়ে তোলার ব্রতে ব্রতী। পড়াশোনা, খেলাখুলা, নীতিশিক্ষা সকল কিছু নিয়ে সিলেট ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটরা প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়।দেশের যেকোনো দুর্যোগে যোগ্য আলোর দিশারী গড়ে তোলার জন্য কাজ করে চলছে সিলেট ক্যাডডেট কলেজ। তাই তো এই কলেজের নীতিবাক্য হলোঃ’’আলোকের অভিসারী”।
[…] শেখায়, মানবতা অর্জনে সহায়তা করে। বাংলাদেশের একটি ছোট্ট শহর নারায়ণগঞ্জে ডিএফএইচ […]