মুখবন্ধ
মহাভারতের এক উপেক্ষিতা নারীচরিত্র হলেন মাদ্রী, যিনি নিজের সদ্যজাত শিশুসন্তানদের পরিত্যাগ করে স্বামীর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমনকি মহারাজ পাণ্ডুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছিল তাঁকেই। মদ্ররাজকুমারীর স্বল্পজীবনে যে বঞ্চনাগাথা লেখা হয়েছিল তাকেই বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে এই গল্পে। সময় বদলেছে, বদলেছে সামাজিক নিয়মকানুন ও সম্পর্কের প্রেক্ষাপট। তবুও কি বদলে গিয়েছে নারীর অবস্থান! তবে আজও কেন স্বামীর পরিচয় বাধ্যতামূলক তার কাছে? কুলরক্ষা কেনো আজও তার প্রধান কর্তব্য! এইসব প্রশ্নের উত্তরই খোঁজা হয়েছে গল্পে। দেখা যাক পাঠক একাত্ম হতে পারেন কিনা পৌরাণিক নারীর আধুনিক রূপের সঙ্গে।
(১)
প্রবল বৃষ্টির পরে থমথমে হয়ে আসে আকাশখানা, যেন মনে হয় এক অসীম অবসাদ ছেয়ে আছে তার সমস্ত শরীরে। ঝাপসা ধোঁয়াশাজাল আচ্ছন্ন করে রাখে চাঁদের আলো, ভেজা মাটির গন্ধে লেখা হয় এক অনন্য এপিটাফ। কার্যহীনতা পেয়ে বসে অলস শরীরটাকে, বারান্দায় ফুলের টবে একলা মাথা দোলায় অনামী সুগন্ধী ফুল, যা দেখার মতো কেউ থাকে না।
একমুহূর্তে রায়চৌধুরী ভিলাও ঠিক ততটাই থমথমে যতোটা থমথমে হয়ে থাকে বৃষ্টিশেষে আকাশ। বাড়ির কর্তা সুন্দরনারায়ণ পায়চারী করছেন প্রশস্ত ড্রইংরুমে। মাথার ওপর বেলজিয়াম কাঁচের দামী ঝাড়বাতি টুংটাং শব্দে দুলছে, যেন এই অপার নৈঃশব্দ্য সহ্য হচ্ছেনা তার। দামী সোফার একধারে জড়সড় হয়ে বসে থাকা মানুষগুলো একটু পরপরই আড়চোখে দেখছে তাঁকে, চোখেমুখে খেলা করছে আশ্চর্য ভয়। তারা বুঝে উঠতে পারছেনা তাদের ঠিক কি বলা উচিত। একেকটা সময়ে শিক্ষা শব্দের জোগান দিতে ব্যর্থ হয়, তখন মৌনতাই একমাত্র স্বস্তি হয়ে ওঠে।
বিখ্যাত ব্যবসায়ী সুন্দরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র আদিত্যর মেডিকেল রিপোর্ট পড়ে রয়েছে টেবিলখানায়। আদিত্য সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। তার শুক্রাণু বিকশিত নয়। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্কুলের কৃতি ছাত্র ও নামকরা গিটারিস্ট আদিত্য সদ্য বিবাহ করেছে। তার স্ত্রী মানালী এই মুহূর্তে এখানে উপস্থিত নেই।
সুবিশাল রায়চৌধুরী ভিলার কোনো এক কোনে লুকিয়ে রয়েছে সে। বিবাহের পরেই সন্তানধারণের জন্য চাপ দেওয়া শুরু হয় তাকে। রায়চৌধুরীদের বংশপ্রদীপ জ্বালতে না পারার অপরাধে এর আগে আদিত্যর প্রথমা স্ত্রী পৃথা পরিত্যক্তা হয়েছে, এবার কি তার পালা! ভেবে পায়না মানালী। আদিত্যর মেডিকেল রিপোর্ট এখনো চোখে পড়েনি তার। সন্তানধারণ করতে না পারার জন্য নিজেকেই দোষী ভেবে চোখের জল ফেলছে সে। পৃথিবীটা এইমুহূর্তে তার কাছে গভীর খাদ, ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে সে। মুক্তি কই!
আদিত্য এইমুহূর্তে উপস্থিত নেই রায়চৌধুরী ভিলায়, কোথায় গিয়েছে সে জানা নেই কারো। নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে অবগত সে অনেক আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিবাহে রাজী ছিলো না সে, কিন্তু মানালীকে একবার দেখার পরেই মত বদলাতে বাধ্য হয় সে। “প্রথম দর্শনে প্রেম” কথাটা আধুনিক যুগে অতটা চলনসই না হলেও আদিত্য জানে, কথাটা সম্পূর্ণ বাস্তব। মানালীর গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের অক্ষমতা ভুলতে পারে সে, ভুলে যায় রায়চৌধুরীদের স্ট্যাটাস, ধনসম্পদ আর তাকে রক্ষার জন্য সুন্দরনারায়ণের বিভৎস প্রচেষ্টার কথা। সে শুধু মানালীকে নিয়ে ভালো থাকতে চায়। সন্তান নাই বা থাকলো তাদের, ক্ষতি কি! সবাই কি আর সন্তানসুখ লাভ করে!
কিন্তু রায়চৌধুরী ভিলার পরিস্থিতি বর্তমানে অন্যরকম। সুন্দরনারায়ণের কঠিন মুখে চিন্তার কালো ছায়া। কোনোমতে এই রিপোর্ট মানালীর চোখে পড়লে তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ভেবেই শঙ্কিত হচ্ছেন তিনি। পৃথার বেলায় যে ভুলটা হয়েছিল তা যাতে এইবার না হয় সেজন্য যা করার করবেন তিনি। পৃথার চলে যাওয়াটা রায়চৌধুরীদের সম্মান নষ্ট করেছে অনেকটাই। ব্যক্তিত্বময়ী এই মেয়েটির জেদের সামনে হেরে গিয়েছেন সুন্দরনারায়ণের মতো দাপুটে ব্যবসায়ী। এই ভুলটা মানালীর ক্ষেত্রে কিছুতেই করবেন না তিনি, কিছুতেই না!
” শোনো, এই রিপোর্ট নিজের আলমারীতে তুলে রাখো। মানালীকে কিচ্ছু বলার প্রয়োজন নেই। তোমার সুপুত্রকেও বলে দিও এটা। যা করার আমি করবো। কেউ যেন টের না পায়! “
সুন্দরনারায়ণের কঠিন স্বরে কেঁপে উঠলেন প্রভা দেবী। তিনি জানেন তাঁর স্বামীদেবতাটি নিজের ইচ্ছেপূরণের জন্য কোনো নীতি নৈতিকতার ধার ধারেন, সন্তানের ইচ্ছে – অনিচ্ছে তাঁর কাছে মূল্যহীন। আদিত্যও বড্ড বাবার ন্যাওটা, বাবার মুখের ওপরে কিছুই বলার স্পর্ধা রাখেনা সে। প্রভা দেবী জানেন কি হতে চলেছে এরপর, কিন্তু তা আটকাবার সাধ্য তাঁর নেই। তিনি সুন্দরনারায়ণের স্ত্রী হলেও তাঁর কথার কোনো মূল্য নেই এই সংসারে। তিনি হলেন এই সংসারের কর্তার শখ করে কিনে আনা দুর্মূল্য ফুলদানিটির মতো, যাতে ফুল সাজানো – না সাজানো পুরোটাই কর্তার ইচ্ছে। তিনি নীরবভাবে মাথা নাড়লেন।
” আর হ্যাঁ, অশ্বিনীকে খবর দাও। বলো আমি ডেকেছি। গতবার যে ভুলটা হয়েছিল তা যেন এবার কোনোমতে না হয়, সতর্ক থাকতে হবে। “
এবারও নীরবে মাথা নাড়েন প্রভা দেবী। অশ্বিনী তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, নামকরা স্ত্রী- রোগ বিশেষজ্ঞ। তার এখানে কি কাজ জানেন না প্রভাদেবী, কিন্তু কর্তা যখন বলেছেন তখন তো তাকে ডাকতে হবেই। অশ্বিনীর ডাক্তারি পড়ার খরচ বহন করেছিলেন সুন্দরনারায়ণ, আজ বোধহয় তার প্রতিদান দেওয়ার সময় এসেছে অশ্বিনীর। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যান প্রভা দেবী। তাঁর চলার পথের দিকে খরদৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন সুন্দরনারায়ণ। প্রভা দেবী আজ এতো খুঁড়িয়ে হাঁটছেন কেন!
(২)
” আমায় ক্ষমা করো পৃথা। জানি এই কথাটার আজ আর কোনো দাম নেই। তবুও বলতে এলাম। নয়ত আমার বিবেক ক্ষমা করবেনা আমায়। “
স্কুলবাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে এক শিক্ষিকার উদ্দেশ্যে কথাগুলি বলছিলো আদিত্য।
সৌম্যদর্শনা শিক্ষিকার ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো। স্কুলের মাঠে ক্রীড়ারত ছেলেপুলের ঝাঁকের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন তিনি,
” অক্ষমতা অন্যায় নয় আদিত্য, অন্যায় হলো সেই অক্ষমতাকে ঢাকবার জন্য অপরাধ করা। তোমরা যা করেছো তা অপরাধ, প্রমাণ হলে যার শাস্তি অবধারিত। কিন্তু তোমরা ধনী – প্রভাবশালী, যে কারণে আইনকেও হয়তো কিনতে পারো তোমরা৷ তবে আমার ব্যক্তিসত্ত্বাকে কেনার মতো ধনী তোমরা নও, আমার সন্তানরা তোমার নামে কখনোই পরিচিত হবে না আদিত্য৷ চলে যাও। “
” পৃথা, আমি জানি, আমি অন্যায় করেছি। বাবাকে রুখতে না পারাটা আমার অন্যায়। কিন্তু বিশ্বাস করো পৃথা, সন্তানদের আমি ভালোবাসি। তাই তো বারবার আড়াল থেকে দেখে যাই তাদের, নিষ্পাপ ফুলের মতো বেড়ে উঠছে তারা৷ তারা আদিত্যনারায়ণ রায়চৌধুরীর সন্তান, এটা কিকরে অস্বীকার করবে তুমি পৃথা!”
” আদিত্যনারায়ণ রায়চৌধুরীর সন্তান! হাসালে আদিত্য। তুমিও জানো তারা তোমার সন্তান নয়। আমার মতামত গ্রাহ্য না করেই আমার গর্ভে অন্যের বীজ রোপণ করেছিলে তোমরা, একবার নয়, তিন – তিনবার। তোমাদের এতো সন্তানের মোহ কেন আদিত্য! যদি তৃতীয়বারে সবকিছু আমি জানতে না পারতাম, যদি তোমাদের ত্যাগ না করতাম, তবে এই অন্যায় আর কতবার করতে তোমরা! তোমরা কি মানুষ আদিত্য! “
” বাবার সামনে আমি কুঁকড়ে যাই পৃথা। ছোটবেলা থেকেই আমার সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়ে এসেছেন, আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আসলে আমার ব্যাপারটা চাপা দিতে গিয়ে তোমার সঙ্গে অন্যায় করতে হয়েছে পৃথা। প্রথম সন্তান দুর্বল হওয়ায় বাবা বাধ্য হয়েছিলেন আবার… “
” আবার! তিন – তিনবার আদিত্য! তিন – তিনবার আমার অসম্মতিতে তোমরা আমার গর্ভে অন্যের বীজ রোপণ করিয়েছো। ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে ধর্ষণ করিয়েছো। আমি তোমাদের ঘৃণা করি আদিত্য, প্রচন্ড ঘৃণা করি। আমার সন্তানদের ওপরে আমি কিছুতেই রায়চৌধুরী পরিবারের ছায়া পড়তে দেবো না, তারা আমার পরিচয়েই বড়ো হবে৷ নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে নেবে। তোমার বা তোমার পরিবারের কোনো সাহায্য আমার চাই না। “
তিক্তস্বরে কথাকয়টি বলে আদিত্যনারায়ণের দিকে পেছন ফেরেন শিক্ষিকা। স্কুলপ্রাঙ্গণে খেলতে থাকা তিনটে ছোট্ট শিশু ” মা মা” বলে ছুটে আসে। শিক্ষিকা শুনতে পান বিড়বিড় করছেন আদিত্য,
” এই অন্যায় আবার হবে পৃথা… বাবা অশ্বিনীকে ডেকেছেন… এবার মানালী… আমি আটকাতে পারবো না… সব শেষ হয়ে যাবে!”
বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন শিক্ষিকা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক টলটলে মুখের উচ্ছ্বল তরুণী। আদিত্যর দ্বিতীয় বিবাহের খবর সংবাদপত্রে দেখেছিলেন পৃথা, মেয়েটিকে দেখে বড্ড মায়াময়ী মনে হয়েছিল তাঁর। সেই মেয়ের সঙ্গেও হতে চলেছে অন্যায়! হে ঈশ্বর! নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলেন তিনি৷
(৩)
শীততাপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের শীতলতা কম করতে পারছে না অন্তরের প্রদাহ, যেন ব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক কোনে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ছে উজ্জ্বল কোনো তারা।
দামী ডিভানের ওপরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে পূর্ণগর্ভা মানালী। দৃষ্টি সিলিং এর দিকে নিবদ্ধ। আদপেই কি সিলিং দেখছে সে! আসলে তা নয়। তার শূন্য দৃষ্টির সামনে সুদৃশ্য সিলিং যেন এক ধূসর পর্দা, যার ওদিক থেকে তার দিকে চেয়ে রয়েছে অনন্ত শূন্যতা। একদলা তমসাপিণ্ডের মতো।
এ বাড়িতে যত্ন আত্তির কমতি নেই মানালীর, সুন্দরনারায়ণের আদেশ। কিন্তু তার শান্তি কই! আদিত্য প্রায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার থেকে। আজকাল আর কাছে আসেনা, হাত রাখেনা তার হাতে৷ কেমন যেন দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছে সে, অধিকাংশ দিন বাড়ি ফেরেনা রাতে।
তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পেছনের তিক্ত সত্যটা কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছে সে, জানিয়েছে অশ্বিনীই। এক মায়াবতী মানুষের সামনে মিথ্যে বলতে হয়তো কুঁকড়ে গিয়েছিল তার অন্তরাত্মা, কিন্তু এই রায়চৌধুরী পরিবার! এদের কি আদপে আত্মা রয়েছে! নাকি সবটাই নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, এক ধনসম্পদে পূর্ণ অনন্ত কৃষ্ণগহ্বর…
আদিত্য! তাকে তো ভালোবেসেছিল মানালী। সে কিকরে করতে পারলো এমন! ভালোবাসা শব্দটির আদৌ কি কোনো ভিত্তি আছে এযুগে! নাকি সবই দুর্বলকে প্রবোধদানের মাধ্যম মাত্র!
শরীরের ভেতরে অদ্ভুত অস্বস্তি, দু’খানা কচিপ্রাণ নাড়াচাড়া করে বেড়াচ্ছে গর্ভে। মানালী কেঁপে উঠছে বারবার। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই, আদিত্য ফেরেনি।
কট করে দরজায় একটা শব্দ।
পরক্ষণে এক মদাসত্ত মানুষ টলোমলো পায়ে প্রবেশ করলো ঘরের ভেতর। ঘোলাটে চোখে তাকে একবার দেখে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো মানালী, বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার। অসংলগ্ন অবস্থায় ডিভানের পাশে এসে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো আদিত্য, তারপর অনেকদিন পরে হাত রাখলো তার মাথায়, স্খলিত স্বরে বললো,
” চলো”!
চমকে উঠলো মানালী। সে এখন পূর্ণগর্ভা, যেকোনো সময়ে প্রসববেদনা জেগে উঠবে তার৷ এইসময়ে এতরাতে কিভাবে যাবে সে! আর যাবেটাই বা কোথায়!
একরাশ প্রশ্নমাখা চোখে তাকে চেয়ে থাকতে দেখে চোখ নীচু করে বললো আদিত্য,
” আমি জানিনা কোথায় যেতে হবে৷ শুধু এটুকু জানি এই বাড়ি থেকে দূরে যেতে হবে। বাবার ছায়ার থেকে দূরে রাখতে হবে অনাগত শিশুদের। যাবে মানালী? এর আগে কখনো সাহস হয়নি আমার, আজ অনেককষ্টে স্থির করেছি নিজেকে। আমার তিনটি সন্তান বাবা বলে ডাকেনা আমায়, নিজের পরিচয়েই তাদের বড় করে তুলছে পৃথা৷ আমি এদের আর হারাতে চাইনা মানালী, কিছুতেই হারাতে চাইনা!”
এক অক্ষম মানুষের অসহায় কান্না ঘরের নীরবতাকে যেন ফালাফালা করে চিরে দেয়। ভারী শরীর নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে উঠে বসে মানালী, তার শীতল কঠিন স্বর শোনা যায়,
” চলো!”
দুটি ছায়ামূর্তি পা টিপে টিপে অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে রায়চৌধুরী ভিলা থেকে বের হয়ে যায়। তাদের গাড়িটা পথের বাঁকে মিলিয়ে যেতেই মেঘ ঢেকে ফেলে আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডল, অন্ধকারে পরিত্যক্ত কয়েদখানার মতো নির্জিব দাঁড়িয়ে থাকে রায়চৌধুরী ভিলা।
(৪)
আইসিইউ এর শীতলতা যেন হাড়ের ভেতর ছুরি চালাচ্ছে নিঃশব্দে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে মানালীর। চেতন – অবচেতনের মাঝখানে যেন বন্দী হয়ে গিয়েছে তার আত্মা। প্রাণদায়ী যন্ত্রের হাহাকার বারবার জানান দিচ্ছে তাকে, সময় বেশি নেই!
সে’রাতে হাইওয়েতে যখন অ্যাক্সিডেন্ট করলো গাড়িটা, অজ্ঞান হওয়ার আগে সে দেখেছিল আদিত্যর সুন্দর শরীরটা ভারী ট্রাকের চাকার তলায় পিষে যেতে। নিজের চেয়ে নিজের গর্ভের সন্তানদের চিন্তা বেশি পেয়ে বসে মানালীকে, চিৎকার করতে চায় সে, গলা চিরে একটি শব্দও প্রকাশ পায়না।
সে শুনতে পায় বিছানার পাশে কিছু মানুষের ফিসফিস, ভালো আছে তার সন্তান। দুর্ঘটনাগ্রস্ত রক্তাক্ত অবস্থাতেই সন্তানপ্রসব করেছে সে, সুস্থ রয়েছে তার সন্তানদ্বয়। সুন্দরনারায়ণের গলার স্বর তীক্ষ্ণ শলাকার মতো বিদ্ধ করে তাকে,
” আমার বংশপ্রদীপদের সুস্থ রাখুন ডাক্তার, এই মেয়ের জন্য এতো খরচ করার কোনো কারণ নেই। আমার ছেলেকে ফুসলিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিলো সেই রাতে, রায়চৌধুরী ভিলায় এর আর কোনো স্থান নেই। “
অতিকষ্টে চোখের পাতা তোলে সে, কেউ কোথাও নেই! হাসপাতালের কেবিনে শরীরে অজস্র নল বিদ্ধ করে পড়ে রয়েছে সে, দরজার পাশের সাদা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক সর্বংসহা নারী। তবে ওই যে কথাগুলি সে শুনতে পেলো, তবে কি স্বপ্ন ছিলো সেগুলি!
মানালীকে জেগে উঠতে দেখে এগিয়ে এলেন সেই নারী, ফ্লুরোসেন্ট বাতির আলোয় ঝলসে উঠলো তাঁর সাদা পোশাক। বেডের কাছে ঝুঁকে পড়ে মানালীর মাথায় করতল রাখলেন তিনি, কি অসীম স্নেহময় সেই স্পর্শ! চোখ বুজে আসে মানালীর। কোনোক্রমে কেটে কেটে বলে সে,
” পৃ…থা! “
” আমি আছি মানালী, ভয় পেওনা।”
নিবিড় কণ্ঠস্বরে জবাব দেন পৃথা।
” আদিত্য…!”
” সে নেই, তবে ভালো আছে তোমার সন্তানরা। যমজ পুত্র, বড়ো সুন্দর তারা। “
চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মানালীর, অস্ফুটে বলে,
” ওদের দেখো। “
চোখ বন্ধ হয়ে যায় তার, জীবনদায়ী যন্ত্রের মনিটর সরলরেখা এঁকে দেয় তার স্বল্পজীবনের ভবিষ্যতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ান পৃথা। আজ থেকে পঞ্চপুত্রের জননী তিনি। দুই সদ্যোজাত মুখ চেয়ে রয়েছে তাঁর, তাঁকে যে তাদের বাঁচাতেই হবে। লিখতে হবে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে মানালী নয়, তিনিই হয়ে উঠবেন মুখ্য চরিত্র। এক একক মা হিসেবে।।
কলমে রিয়া ভট্টাচার্য