বের হওয়ার আগে আয়নায় আর এক ঝলক নিজেকে দেখে নিলাম। নতুন শহরের নতুন আবহাওয়ায় শীতের ভারী ওভারকোট আর মাথায় স্কার্ফ জড়ানো এই নতুন বেশে আয়নায় নিজেকে একটু একটু অচেনা লাগলো।
অফিসে পৌঁছতে খানিক দেরী হল। ঢুকতেই পাশের কিউব থেকে উঁকি দিয়ে বস বলল ‘হ্যাপি ফ্রাইডৈ’! তার চেহারায় একটু আলগা হাসি দেখে সন্দেহ হল, মনে হল তার মনে ‘হ্যাপি ফ্রাইডে’ ছাড়া আরো কিছু রয়ে গেছে। কোট-গ্লাভ-স্কার্ফ খুলে কেবিনেটে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে আমিও বললাম ‘হ্যাপি ফ্রাইডে’!
রাতভর তুষারপাত হওয়াতে রাস্তার অবস্থা ভালো না, স্নো ট্রাক্টরগুলো রাস্তায় জমে থাকা তুষার সরিয়ে লবন ছিটিয়ে যাচ্ছে বরফ গলিয়ে রাস্তার পিচ্ছিলতা কমানোর জন্য, তবু বেশ কয়েকটা গাড়ী নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে থাকতে দেখলাম। সবাই বলে গত দশ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৫ -এর পর থেকে এই শহরে এত তুষারপাত আর হয়নি। রাস্তায় ট্রাফিক চলছে ধীর গতিতে, আরো অনেকের মত আমারও তাই অফিসে পৌঁছতে বেশ দেরীই হয়ে গেল। অবশ্য বস এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। সময় মত কাজ শেষ করলেই হল। তাছাড়া সামনে ক্রিসমাসের লম্বা ছুটি, তার ওপর আজ শুক্রবার, সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। সবাই ফুরফুরে মেজাজে আছে বটে, শুধু আমি বাদে।
আমি বরং কিছুটা চাপের মধ্যে আছি। ছুটির আগে অনেকগুলো জমে থাকা কাজ শেষ করতে হবে। তারমধ্যে বেশীরভাগ কাজই আমি বুঝিনা কিংবা পারিনা, সোজা সাপ্টা কাজ না যে নিজে নিজে করে ফেলতে পারি, অন্যদের সাহায্য লাগবে এরকম কাজ। পাশ করে সবেমাত্র নতুন চাকরি পেয়েছি, সবকিছু বেশ চ্যালেন্জিং মনে হয়। কফি মেশিন চালু করা থেকে কম্পিউটার চালানো সবকিছুই চ্যালেন্জিং।
সকাল বেলা বাচ্চাদের রেডী করে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে সময় মত অফিসে পৌঁছানোর চ্যালেন্জ, ক্লাসরুমে পড়া বইয়ের থিওরিগুলোর সাথে বাস্তবের কাজের যোগসাজস করার চ্যালেন্জ, প্রতিদিন নতুন নতুন কাজ শেখার চ্যালেন্জ, গুবলেট না পাকিয়ে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে রিপোর্ট জমা দেয়ার চ্যালেন্জ, অফিসের হালচাল আর কোম্পানীর ব্যাবসার অবস্থা বোঝার চ্যালেন্জ, আর সদ্য ভিন দেশে আসা আমার মত মানুষের জন্য নতুন পরিবেশে সহকর্মীদের নাম-চেহারা মনে রাখাটাও বাড়তী চ্যালেন্জ বৈকি।
আমাদের টিমের পনেরো-ষোল জন ইন্জিনিয়ারের মধ্যে যারা আমেরিকান তারা বেশীরভাগই দেখতে আমার কাছে একই রকম মনে হয়। তাদের উচ্চতা, গড়ন, চুলের স্টাইল, হাঁটার ভঙ্গি, কন্ঠস্বর, একসেন্ট, সবকিছুই যেন এক রকম। নামও প্রায় এক রকম। জিনকে জিম বলে ভুল করি, ডেভিডকে ডেরেক বলে সম্বোধন করি, যে প্রশ্ন নিককে করার কথা সেটা যেয়ে রিককে জিজ্ঞেস করাতে সে চোখ কপালে তুলে তাকায়, যে জিনিষ টমকে দেয়ার কথা সেটা যেয়ে টিমকে দিয়ে আসি। তার ওপর চলতিভাষার ইংরেজী বোঝার চ্যালেন্জ তো রয়েছেই। প্রথম সপ্তাহে একদিন লান্চের সময় বস এসে যখন জিজ্ঞেস করলো ‘what’s on your plate today?’ আমি তখন কেবলমাত্র ক্যাফেটিরিয়া থেকে সালাদ নিয়ে এসে ডেস্কে বসেছি, স্টাইরোফোমের বাক্সের সালাদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে বললাম ‘on my plate? Umm..lettuce..tomato..cucumber’ তখন বসের হাসি দেখে বুঝতে পারিনি সে আসলে খাবারের প্লেটের কথা জিজ্ঞেস করেনি, সেদিন আমার লিস্টে কি কি কাজ করার কথা তা জিজ্ঞেস করেছে।
তবে চেহারার মত তাদের সবার সৌজন্যবোধও একরকম। ধৈর্য ধরে আমার ভাঙ্গা ইংরেজী বোঝার চেষ্টা করে, কথা বলার সময় ধীরে বলে যেন আমি বুঝতে পারি। কোন সাহায্য চাইলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
সবার সহযোগীতায় আমিও প্রথম ধাক্কা কিছুটা সামলে নিয়ে আমেরিকান কালচারে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে সহকর্মীদের সবার কার ক’টা বাচ্চা, কার কি পোষা প্রানী, কার স্ত্রীর হবি কি, কে কি গাড়ী চালায়, সামনের ভেকেশনে কে কোথায় যাচ্ছে, ইত্যাদি জেনেছি। সবারটা, শুধু হেনরি বাদে।
হেনরির কিউব আমার কিউবের মুখোমুখি। সেই সুবাদে উঠতে বসতে তার সাথে চোখাচোখি হয়। কম্পিউটার স্ক্রীন থেকে চোখ সরালেই তাকে দেখি, রিভলভিং চেয়ারে আরমোরা ভাংতে গেলে তাকে দেখি, কফি আনতে গেলেও তাকে দেখি। মাঝেমাঝে নিতান্তই চোখে চোখ পড়ে গেলে সে সংক্ষেপে ‘হাই’ বলে। ব্যাস, আর কিছু না।
শুধু আমি না, হেনরির সাথে অন্য কারোও তেমন মেলামেশা নেই। লান্চের সময় বাইরে আবহাওয়া ভাল থাকলে আমরা পেছনের লনে ফোয়ারার সামনের পিকনিক টেবিলগুলোতে বসে খাই, মাঝেমাঝে বসও যোগ দেয় আমাদের সাথে। কিন্তু হেনরি কখনো আসেনা, সে একা একা তার ডেস্কে বসে কাজ করতে করতে খায়। কফি রুমের আড্ডায়ও কখনো তাকে দেখিনা। তার কিউবটাও বেশ এলোমেলো। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোলা পড়ে আছে ভারি ভারি সব ডিজাইন ম্যানুয়ালগুলো। লাল কালি দিয়ে দাগ দেয়া বড় বড় ডিজাইনের প্রিন্টগুলো ডেস্কে বিছানো। চেয়ারের ওপর একাধিক সোয়েটার ঝুলছে। তার নাম ছাপানো বেশ কিছু প্যাটেন্ট আর সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সারি সারি সার্টিফিকেট ফ্রেমে ধুলো কুড়াচ্ছে। আর তার সাথে ঝুলছে কতগুলো কাঠের পুতির মালা।
হেনরি গত তিরিশ বছর ধরে এই কোম্পানীর সাথে কাজ করছে, তার অভিজ্ঞতা অনেক, তবে সে আপন মনে কাজ করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে, টিম-ওয়ার্ক করা তার কাজ নয়। তার এই অবন্ধুসুলভ স্বভাব এখন অন্যরাও মেনে নিয়েছে। বসও দেখি পারত পক্ষে হেনরিকে বিরক্ত করেনা।
শুরুর দিকে তখনও সবার সাথে তেমন পরিচয় হয়নি সেসময় একদিন হেনরির কাছে কিছু জিনিষ বোঝার জন্য কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম। সে বেশ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘are you sure you can’t solve this on your own?’ আমি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলাম ‘নিজে নিজে সমাধান করতে পারলে বুঝি তোমার মত বেরসিকের কাছে আসতাম?’ তারপর থেকে আমিও আর তার কাছে যাইনি।
তবে আজ সকাল থেকে দেখছি বস ব্যাস্তভাবে বেশ কয়েকবার হেনরির কিউবে আসা যাওয়া করছে। সকালে বসের মুখে আলগা হাসির রহস্য এতক্ষনে উন্মোচন হল।
আমাদের এই কোম্পানী অটোমটিভ সাপ্লাইয়ার কোম্পানী, আরো অনেক সাপ্লাইয়ার কোম্পানীর মত আমরাও গাড়ীর কিছু বিশেষ পার্ট বানিয়ে বড় কোম্পানীগুলোকে সাপ্লাই দেই। তারপর বড় কোম্পানীগুলো সেগুলোকে একসাথে এসেম্বল করে পুরো গাড়ী বানায়। আমরা কাজ করি আমেরিকায় অবস্থিত কোম্পানীর হেডকোয়ার্টারে। তবে ম্যানুফ্যাক্যারিংয়ের খরচ কম পড়ে বলে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গাড়ীর কোম্পানীর প্ল্যান্ট রয়েছে বলে তাদেরকে পার্ট সাপ্লাই দেয়ার সুবিধার জন্য আমাদের কোম্পানীও পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে প্ল্যান্ট তৈরী করেছে। তারমধ্যে একটি বড় প্ল্যান্ট হচ্ছে থাইল্যান্ডে।
থাইল্যান্ডের প্ল্যান্টে কয়েকদিন ধরে কিছু ম্যানুফ্যাকচারিং সমস্যা চলছে। সেখানে যে পার্টগুলো তৈরী হচ্ছে তার rejection rate খুব বেশী হচ্ছে। আমাদের কাস্টমাররা নাখোশ, তাদের অভিযোগ করা সমস্যাগুলোর কারন বা উৎস এখনো সনাক্ত করা যায়নি। প্ল্যান্টের প্রোডাকশন বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। প্ল্যান্ট ম্যানেজার আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছে, হেড কোয়ার্টার থেকে এক্সপার্ট কাউকে পাঠিয়ে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার অনুরোধ জানিয়ে।
এক্সপার্ট হিসাবে হেনরিকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হচ্ছে। আর তার সাথে সহকারী হিসাবে আমাকেও। হেনরির সাথে আমাকে পাঠানোর এই খবরটি দিতে বসকে বেশ কসরত করতে হচ্ছে মনে হয়। আর সেজন্যেই সকাল থেকে এত ভনিতা চলছে।
গাড়ীর পার্টগুলোর সত্যিকার প্রটোটাইপ বানানোর আগে সেগুলো কম্পিউটারে মডেল বানিয়ে সেগুলোর পারফরমেন্স যাচাই করে দেখা হয়। আমার কাজ হল পার্টগুলো কম্পিউটারে মডেল বানিয়ে সেগুলোর noise & vibration এর দিকগুলো দেখা। হাতে কলমে ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টের সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু সামনে ক্রিসমাসের ছুটি, অনেকেই এই সময় লম্বা ছুটি নিয়ে ইতিমধ্যেই চলে গেছে। যারা আছে তারাও ক্রিসমাসের সময় পরিবারেরে সবাইকে ছেড়ে থাইল্যান্ডে যেতে উৎসাহ দেখাচ্ছেনা। হেনরি একাই হয়তো সমস্যা সমাধান করতে পারবে তবে সাথে একজন সাহায্যকারী থাকলে কাজ দ্রুত হবে। সেজন্যই আমাকে তার সাথে পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে। তাছাড়া নতুন হিসাবে আমার জন্যেও এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে ভেবে আমাকেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
থাইল্যান্ড যেতে আমার কোন আপত্তি নেই বরং নতুন জায়গা দেখতে আমি সবসময় পছন্দ করি। কিন্তু আর কেউনা, হেনরির সাথে? এক আধ দিন নয় পুরো এক সপ্তাহ! এ যেন রীতিমত দন্ড। যাহোক মনকে শান্তনা দিলাম, হেনরি কাজ-পাগোল মানুষ, সে একাই সব সামাল দিবে আর আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে নতুন দেশে নতুন সব জায়গায় ঘুরে বেড়াবো।
ব্যাগ গোছালাম। যাবার আগে বাচ্চাদের সাতদিনের জন্য বাড়তী ‘bed time story’ পড়ে শোনালাম। এই প্রথম তাদের রেখে মা দূরে কোথােও যাচ্ছে। তাদেরকে বাড়তী ‘good night kiss’ আর ‘hug’ দিলাম গুনে গুনে আগাম সাতদিনের জন্য। তারপর বাচ্চাদের আর তাদের বাবার পুরো সপ্তাহের খাবার আর পোশাক গুছিয়ে রেখে সংসার থেকে ছুটি নিয়ে ক্যাথে প্যাসিফিকের ইকনমি ক্লাসে হেনরির পাশের সিটে চড়ে বসলাম।
হেনরি বসেছে উইন্ডো সিটে। আমি মাঝের সিটে, আমার অন্যপাশে আইল সিটে একটা চাইনিজ মেয়ে। প্লেন ওড়ার আগেই হেনরি তার ল্যাপ্টপের ব্যাগ থেকে একটা চটি বই বের করে পড়া শুরু করেছে। আমাকে যেন সে চেনেই না এমন ভাব। আমি আগ বাড়িয়ে দুই একটা হালকা কথা বলার চেষ্টা করলাম, yes no ছাড়া তেমন কোন সাড়া পেলাম না। আড় চোখে দেখলাম তার হাতের বইটার নাম ‘Compation’। মনে ভাবলাম যার যেটার অভাব …। চোখে পড়লো হেনরি তার কাঠের মালাগুলো গলায় পড়ে এসেছে। সবুজ চোখের আইরিশ বংশোদভূত এই অদ্ভুত মানুষটি কেন বুদ্ধর মালা পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছি। আমার কৌতুহলী দৃষ্টিতে মোটেই কর্নপাত না করে সে নিবিষ্ট মনে বই পড়তে থাকলো। মাঝে একটি ট্রানজিটসহ দীর্ঘ পঁচিশ ঘন্টার পুরো পথ আমি তার কাছে অদৃশ্য হয়েই রইলাম।
পৃথিবীর সবরকম ভ্রমনের মধ্যে প্লেন ভ্রমন সম্ভবত সবচেয়ে কম জনপ্রিয়। নৌকা ভ্রমন, জাহাজে চড়ে সমুদ্র ভ্রমন, রেলগাড়ির ভ্রমন নিয়ে কতো সব রোমান্টিক গল্প-কাহিনী-কবিতা লেখা হয়েছে কিন্তু প্লেনে ভ্রমন নিয়ে সেরকম কিছু চোখে পড়েনি। আমার কাছেও প্লেন ভ্রমন তেমন আকর্ষনীয় কিছু মনে হয়না। প্লেনে চড়ার পর কিছুই করতে ইচ্ছে হয়না; বই পড়লে ঘার ব্যাথা করে, গান শুনলে কান ব্যাথা করে, মুভি দেখলে চোখ ব্যাথা করে। চা খেলে গা গুলিয়ে ওঠে আর পাশের সিটে যদি থাকে হেনরির মত সহযাত্রী তাহলেই হয়েছে।
হেনরিকে ভুলে আমি অন্যপাশের যাত্রীর দিকে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। প্লেনে ওঠার পর থেকে আমার পাশের চাইনিজ মেয়েটি তার ল্যাপটপ বের করে ঝড়ের গতিতে টাইপ করছে, পাতার পর পাতা লিখে চলেছে। ব্যাংককে নামার সময় মেয়েটি যদি বলে প্লেনের সময়টা কাজে লাগিয়ে সে তার পি এইচ ডি ডিসার্টেশন লিখে ফেলেছে তাহলে অবাক হবোনা।
হেনরি বেশ কয়েকবার এয়ারহোস্টেসের কাছ থেকে কফি নিয়ে খেল। খুক খুক করে কাশছে একটু পর পর। শেষের দিকে দেখলাম সে মাফলার দিয়ে মাথা আর কান পেচিয়ে চোখ বন্ধ করে জড়সড় হয়ে বসে আছে।
স্থানীয় সময় সন্ধার দিকে আমরা ব্যাংকক নামলাম। হোটেলের শাটল এসে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নিয়ে গেল। পরদিন সকালে প্ল্যান্টের ইন্জিনিয়ার এসে আমাদের প্ল্যান্টে নিয়ে যাবে, সকালে সেখানে প্ল্যান্ট ম্যানেজারসহ অন্যদের সাথে মিটিং হবে, তারপর কাজ শুরু।
এসব নিয়ে আমাকে ভাবতে হবেনা। হেনরি নিশ্চয়ই সব কিছুর নীল নক্সা বানিয়ে এনেছে। আমি শুধু তার নির্দেশনা অনুসরন করবো। সে যেভাবে বলবে, যা বলবে তা-ই করবো।
বাচ্চাদের ছেড়ে আসার অভিজ্ঞতা আমার নতুন, ওদের জন্য একটু মন খারাপ হল। এখন আমেরিকাতে ভোর হবে, একটু পরে তারা স্কুলের জন্য তৈরী হবে। বাবা ঠিক মত লান্চ প্যাক করে দিতে পারবে তো? সময় মত বাস ধরতে পারবে তো? বিকেলে ফেরার সময় বাবা বাসস্ট্যান্ডে সময় মত আসতে পারবে তো? হোমওয়ার্ক করতে ভুলে যাবে না তো?
রাতের খাবারের পর একা একা হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে হাটতে বের হলাম। ওহাইওর ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা থেকে রাতারাতি থাইল্যান্ডের উষ্ণ বসন্তের আবহাওয়ায় এসে মন কিছুটা ফুরফুরে হয়ে গেল। রাস্তার পাশে আলো ঝলমলে অনেক রকমের দোকান, চেনা-অচেনা ট্রপিকাল ফল সাজানো, রঙিন অর্কিডসহ বিভিন্ন রকম ফুলের সমাহার, বরফের কুচিতে সাজানো কাঁচা মাছ আর সি-ফুডের দোকান, পোশাকের দোকান, সুভেনিরের দোকান, গরম স্ন্যাকের দোকান, ফ্যান্সি রেঁস্তোরা। পথের দুইপাশে ব্যাস্ত গতিতে মানুষরা হাঁটছে, অনেক টুরিস্টও আছে। আমিও হারিয়ে গেলাম তাদের ভীড়ে। হেনরির কথা, কাজের কথা পুরোপুরিই ভুলে গেলাম।
পরদিন ভোরবেলা সময় মত তৈরী হয়ে নিলাম। সারাদিন প্ল্যান্টে থাকার জন্য জিন্স আর গাড় রংয়ের টিশার্ট পড়লাম, পায়ে স্নিকার জুতো। তারপর পাশের রুমে হেনরিকে ডাকতে গেলাম। কোন আওয়াজ নেই। কিছুক্ষন দরজায় কড়া নাড়ার পর হেনরি এসে দরজা খুলল। বিছানার কম্বল গায়ে জড়িয়েই উঠে এসে দরজা খুলেছে সে, নাক-চোখ লাল, চুল উস্কো খুস্কো। কাশি আরো বেড়েছে অনেক। দরজা খুলে দিয়ে আমাকে দরজায় দাড় করিয়ে রেখেই সে আবার বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ল। মুখে কোন কথা নেই, ভালো সময়েই ঠিক মত কথা বলতে চায়না সে, আর এখন তো মনে হচ্ছে কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছে। কিন্তু একি দশা, অসুস্থ নাকি! অসুস্থ হওয়ার আর সময় পেলনা!
আমার মাথায় হোটেলের ছাদ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। একটু পরে মিটিং, আমি তো কিছুই জানিনা! থাইল্যান্ডের প্ল্যান্টে ঠিক কি ধরনের সমস্যা হয়েছে সে সম্পর্কেও আমার পরিষ্কার ধারনা নেই, পুরোটা ভাসাভাসা। অবশ্য কোন অযুহাত নেই না জানার। চাইলেই জেনে বুঝে তৈরি হয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। নিজের পরনির্ভরশীল স্বভাবকেই দোষারোপ করতে হবে। পুরোটা সময় হেনরির ভরসায় বসে না থেকে নিজে উদ্দোগ নিয়ে কিছু জানার চেষ্টা তো করতে পারতাম। কিন্তু নিজেকেই বা পুরো দোষ দেই কেন, আমি তো এক্সপার্ট নই, এসবের কিছুই তো আমি পারিনা, হাতে কলমে কাজ করার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই আমার, আর অন্যদের মত নতুন জিনিষ চটপট শেখার ক্ষমতাও নেই, আমি স্লো-লার্নার। তাছাড়া কারো নির্দেশ ছাড়া স্বয়ংসম্পুর্নভাবে কাজ করার অভ্যাস বা সাহস কোনটাই আমার নেই। পাছে ভুল করি সেই ভয়ে নতুন সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় নিজেকে না জড়িয়ে নিরাপদ থাকি। হেনরির অসুস্থতা নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা হলনা, বরং নিজের চিন্তায় দিশেহারা হয়ে গেলাম। ছোটবেলার সাঁতার শেখার সময়কার স্মৃতি মনে পড়লো, যেন বড়দের কেউ হঠাৎ পুকুরের গভীর পানিতে ঠেলে দিয়েছে, প্রানের মায়া থাকে তো নিজে সাতরে পার হয়ে এসো।
কিন্তু এখন এসব ভাবনার সময় নেই। একটু পরেই প্ল্যান্ট থেকে কেউ আসবে আমাকে নিতে। হেনরির যে অবস্থা তাতে মনে হয়না সে আজ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে। হেনরির কথা ভুলে নিজের রুমে ফিরে গেলাম। ল্যাপ্টপে লোড করা পুরনো সব ইমেইল খুঁজে পড়া শুরু করলাম। প্ল্যান্টে কি সমস্যা হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করলাম। কিছু কিছু জিনিষ নোট করলাম। কয়েকজন কি-পার্সনের নাম মনে রাখলাম। ইতিমধ্যে রুমের ফোন বেজে উঠলো, ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা জানালো মারিও এসেছে।
স্থানীয় প্ল্যান্ট ইন্জিনিয়ার মারিও, দেখে মনে হল অল্প বয়েস, হাসিখুশী চেহারা। পথে যেতে তার সাথে আলাপ পরিচয় হল। শেভির জানালা দিয়ে রাস্তায় নতুন শহরের দালান কোঠা দেখিয়ে মারিও এটা সেটা বলছিল, দৃষ্টি বাইরে থাকলেও আমি কিছুই দেখতে পেলাম না, মাথায় ভেতরে সবকিছু এলোমেলো ঘূর্নির মত ঘুরছে।
প্ল্যান্টে যেয়ে দেখলাম সেখানে কারোই হেনরিকে নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। তারা শুধু জানে আমেরিকার হেড কোয়ার্টার থেকে দুজন এক্সপার্ট এসেছে, এক্সপার্টের কাজ হল সমস্যা সমাধান করা। আমাকে পেয়ে তারা সবাই আমাকেই এক্সপার্ট ঠাহর করে সবকিছু বর্ননা করতে লাগলো। মনে ভাবলাম, ‘তোমরা অযথাই সময় নষ্ট করছো, আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই, বরং বিশেষ ভাবে অজ্ঞ একজন মানুষ। আমি এই কোম্পানীতে সদ্য চাকরী পেয়েছি। তাছাড়া আমি একা একা নিজের বুদ্ধিতে কোন সমস্যা সমাধান করতে পারিনা, আমি শুধু অন্যের নির্দেশ অনুসরন করি।’ কিন্তু আমার মনের কথাগুলো কন্ঠ থেকে শব্দ হয়ে বের হলনা।
মিটিং শেষে ওরা আমাকে প্রোডাকশন লাইনের কাছে নিয়ে গেল। আমাদের পার্টের রিজেকশন রেট শতকরা তিরিশ ভাগ। দ্রুত ঠিক না করা গেলে আমাদের কাস্টমার বড় গাড়ীর কোম্পানীগুলোর প্রোডাকশনও বন্ধ হয়ে যাবে, ব্যাবসা আর গুডউইলের বিরাট ক্ষতি।
অনেকগুলো মানুষের চোখ আমার দিকে তবু অস্বস্তি ভুলে যেয়ে সমস্যা বুঝতে মনযোগ দিলাম। এই প্রথম সমস্যাগুলোকে নিজের হিসাবে গ্রহন করলাম। এটা এখন আমার সমস্যা। ঠাঁই বিহীন পানিতে যেভাবে হোক পড়েছি, সাঁতার কেটে কোন উপায়ে ঘাটে পৌঁছতেই হবে।
অন্তত সমস্যার উৎস যদি সনাক্ত করা যায় তাহলে সমাধান বের করার মত মানুষ হয়তো এখানেই আছে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাষ নিয়ে নিজের ওপর অসীম ভরসা নিয়ে কাজে মন দিলাম। সংকোচ কাটিয়ে সবাইকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। সাধারন সব প্রশ্ন, কবে শুরু হল, কিভাবে হল, এই পার্টগুলোর লাইফ সাইকেল কি, কোথায় শুরু কোথায় শেষ, কি কি প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যায়, কি কি ভ্যারিয়েবল আছে, ইদানিং নতুন কি করা হচ্ছে যার ফলে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে ইত্যাদি কিছুটা ব্যাকগ্রাউন্ড জানার চেষ্টা করলাম। সমস্যা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ইন্জিনিয়ারদের মতামত আলাদা, এক টিমের ইঞ্জিনিয়াররা অন্য টিমের ইন্জিনিয়ারদের দিকে দোষারোপ করার প্রবনতা লক্ষ করলাম। আবার প্রোডাকশন কর্মীদের কথার সুরে মনে হল তারা ঠিকই জানে সমস্যা কিভাবে সমাধান করতে হবে কিন্তু ইন্জিনিয়াররা তাদের কথায় গুরুত্ব দেয়না। মারিওর সাথে আলাপ কিছুটা ঘনিষ্ট হলে জানলাম এখানে তাদের কাজের চাপ অনেক বেশী, কখনো কোন সমস্যা দেখা দিলে ভেবে চিন্তে তা সমাধান করার মত সময় কারো থাকেনা বরং জোড়াতালি দিয়ে সাময়িকভাবে তা সমাধান করে কাজ চালিয়ে নেয়া হয়। সমস্যার মূল কারন অর্থাৎ root cause সনাক্ত না করে তাৎক্ষনিকভাবে ‘আগুন নেভানো হয়’ বটে তবে একই কারনে পরবর্তীতে আবারো আগুন লাগার সম্ভবনাগুলো রয়েই যায়। সবার সাথে কথা বলে প্ল্যান্টের গ্রীস মাখা টেবিলে বসেই কাগজ কলম নিয়ে সেগুলো নোট করলাম। এভাবেই সারাদিন পার হয়ে গেল।
রাতে হোটেলে ফিরে চিন্তা করছিলাম কোথা থেকে শুরু করবো। কোথাও পড়েছিলাম ‘a problem clearly stated is a problem half solved’, প্ল্যান্টের প্রোডাকশনজনিত সমস্যাটিকে পরিষ্কার করে লেখার চেষ্টা করলাম। Toyota Motor Company – র ‘5 why methodology’ নামে একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি আছে, এই পদ্ধতিতে বার বার, অন্তত পাঁচ বার ‘why’ প্রশ্ন করা হয় যতক্ষন পর্যন্ত সমস্যাটির একটি পরিষ্কার সংগা দাড় করানো হয়। যেমন সমস্যা হল কলে পানি নেই, প্রশ্ন করা হবে কেন কলে পানি নেই? উত্তর হবে কলে পানি নেই কারন ছাদের ট্যাংকে পানি নেই। তারপরে আবার প্রশ্ন করা হবে, ছাদের ট্যাংকে কেন পানি নেই? তার উত্তর হয়তো হবে ট্যাংকে পানি নেই কারন পানি তোলার পাম্প কাজ করছেনা। আবার প্রশ্ন, পাম্প কেন কাজ করছেনা? উত্তর হবে পাম্পের মোটর চলছেনা। তারপর প্রশ্ন হবে কেন মোটর চলছেনা? তার উত্তরে হয়তো জানা যাবে মোটর পুড়ে গেছে। ইত্যাদি। এবার বোঝা যাচ্ছে সমস্যার গোড়ায় রয়েছে মোটর পুড়ে যাওয়ার ঘটনা। অতএব মটর সারালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
অবশেষে সমস্যাটির শুধুমাত্র একটি শিরোনাম দিতেই গভীর রাত নাগাদ বসে ভাবলাম। প্রথম দিনে অন্তত কিছুটা অগ্রগতি হল। হেনরি সুস্থ হয়ে উঠলে কাল থেকে সে-ই বাকিটা সামাল দিতে পারবে।
পরের দিন সকালে হেনরির খোঁজ নিতে যেয়ে তাকে প্ল্যান্টের আপডেট দিলাম। ভাবলাম, আমি ‘অর্ধেক’ কাজ করেছি, সমস্যার শিরোনাম দিয়েছি, এবার হেনরির সমাধানের পালা। কিন্তু তার অসুখ আরো বেড়েছে মনে হল, জ্বর-কাশি-হাঁচি মিলে কাবু হয়ে পড়েছে সে। আমার কথা তার মাথায় কতটা পৌছলো কি জানি তবে তার ঘোর-লাগা চাহনী দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম ‘are you sure you can’t solve this by yourself?’ তারপর কিছুটা অনিশ্চিত মনে একাই প্ল্যান্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সমস্যা সনাক্ত করার পর এবার তথ্য প্রমান সংগ্রহের পালা, সমস্যা যে আসলেই রয়েছে তার প্রমান কি? সেজন্য কিছু ডাটা সংগ্রহ করতে হবে। প্ল্যান্টের কিছু ইন্জিনিয়ার আর প্রোডাকশন কর্মীকে সাথে নিয়ে সবার পরামর্শ সাপেক্ষে টেস্ট প্ল্যান তৈরী করলাম। ডজন ডজন পার্ট নিয়ে সেগুলোতে কিছু ফ্যাক্টর অপরিবর্তিত রেখে কিছু কিছু ফ্যাক্টর পরিবর্তন করা হবে। ভিন্ন ভিন্ন ভেরিয়েবল সেট করে এক এক টিম সেগুলো টেস্ট করবে তারপর সেই টেস্টগুলোর ফলাফলের ডাটা অ্যানালাইসিস করে দেখা হবে ফ্যাক্টরগুলো পরিবর্তন করার ফলে ডিপেন্ডেন্ট ভেরিয়েবলগুলো অনুমান অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে কিনা। তারপর সেই তথ্য থেকে সমস্যার উৎস সনাক্ত করা হবে। তারপর কিভাবে সেই কারনগুলোকে দূর করে সমস্যা সমাধান করা যায় সেই ব্যাবস্থা করা হবে।
রাতে হোটেলে ফিরে সারাদিনের সংগ্রহ করা ডাটাগুলো প্রসেস করে ক্লু খুঁজলাম। কোন ভেরিয়েবল পরিবর্তন করলে কোন ডাটা পরিবর্তন হয় তা পর্যবেক্ষন করে অনুমান অনুযায়ী কিছু ক্লু পাওয়া গেল। ফোনে আমেরিকায় দু একজন সহকর্মীর সাথে পরামর্শ করলাম। প্ল্যান্টের সবার সহযোগিতায় পরের দুদিনও কাজের আশানুরূপ অগ্রগতি হল।
অনিশ্চিত পরিনাম আর সম্ভাব্য ব্যার্থতার সংকা ভুলে পুরোপুরি মনোনিবেশ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। কোনরকম জটিলতা ছাড়াই ছোট ছোট ধাপে সহজ পদ্ধতিতে এগিয়ে ক্রমশ সমস্যার গোড়ায় পৌছাতে পেরেছি। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি এখনো তবু কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা আমেরিকায় ফিরে গেলে এখানকার ইন্জিনিয়াররা নিজেরাই আরো কিছু অনুসন্ধানের পর হয়তো সমাধান করতে পারবে বাকিটা।
সবচেয়ে বড় কথা হঠাৎ লক্ষ করলাম নিজের মাথার ওপরে চেপে থাকা পাহাড়ের বোঝা কিছুটা কমেছে। নিজের পরনির্ভরশীলতার গ্লানি নিয়ে অন্তত ফিরে যেতে হবেনা। এই সমস্যাটির পুরোপুরি সমাধান করতে না পারলেও নিজের মনে ভরসা পেলাম, প্রয়োজন হলে আমিও পারি, চাইলে আমি একাই পারি।
কয়েকদিনের টানা কাজের পর বাড়ী ফেরার জন্য মন উচাটন হয়ে পড়েছে। কাল সন্ধায় আমাদের ফেরার ফ্লাইট।
শেষদিন ভোরবেলা আমার রুমের দরজায় খট খট শব্দ, হেনরি দাড়িয়ে আছে। গত কয়েকদিন শেইভ না করাতে তার মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি। কদিন তার ওপর বেশ ধকল গেছে। তবে চেহারায় তরতাজা ভাব দেখে মনে হল তার ফ্লু সেরে গেছে। হেনরির পাশে মারিও দাড়িয়ে। সে এসেছে আমাদেরকে শহর ঘুরে দেখাতে। হেনরির সাইট-সিইং লিস্টে কিছু গন্তব্য ছিল, আমরা বাড়ী ফেরার আগে সেগুলো দেখে যাবো। তিনজন মিলে সেই উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
শহর ছাড়িয়ে মাঝারি আকারের একটি বৌদ্ধ মন্দির, তার ভেতরে বিশাল আকারের এক মূর্তি। নিরেট সোনার তৈরী বৌদ্ধ মূর্তি! শান্ত, সৌম্য, আবেদনময় চাহনী, সরাসরি যেন আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু রহস্যময় হাসি হাসছে বৌদ্ধ।
মূর্তির সামনে কাচের বাক্সে এক টুকরো কাদামাটি সাজিয়ে রাখা, তার সাথে কাগজে লেখা মূর্তির ইতিহাস। ইতিহাস পড়ে খানিকটা আশ্চর্য হয়ে গেলাম, মূর্তির সাথে নিজের মিল খুঁজে পেলাম।
আধুনিক ব্যাংকক শহর তৈরীর সময় শহরের বিভিন্ন জায়গায় হাইওয়ে তৈরীর প্রকল্প শুরু হয়। সেটা ছিল ১৯৫৭ সাল। হাইওয়ে তৈরীর পথে পড়াতে একটি বৌদ্ধ মন্দির তখন স্থানান্তর করার প্রয়োজন হয়। সেই মন্দিরে ছিল বিশাল এক বৌদ্ধ মূর্তি, তবে মাটির মূর্তি। সেই বিশাল মাটির মূর্তি সরানোর জন্য বিশাল ক্রেইন আনা হয়েছে। কিন্তু মূর্তিটি এতই ভারি যে ক্রেইন দিয়ে তোলার সময় তাতে ফাটল তৈরী হয়। সেই সময় শুরু হয় মুষল ধারে বৃষ্টি। পবিত্র মূর্তিটি সংরক্ষনের জন্য মন্দিরের শীর্ষ স্থানীয় মংক বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত মূর্তিটি নামিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বৃষ্টির পানিতে ভিজে মূর্তিটি যেন নষ্ট না হয় সেজন্য সাময়িকভাবে ক্যানভাসের তাঁবুর নিচে ঢেকে রাখা হয়।
রাতে মূর্তির অবস্থা পর্যবেক্ষন করার জন্য টর্চ লাইট নিয়ে হেড মংক তাঁবুর নিচে যায়, টর্চের আলো মূর্তির ফাটলের ভেতরে পড়লে মংক লক্ষ করে দেখে ফাটলের নিচে কিছু একটা চকচক করছে। কৌতূহলবশত সে হাতুরি বাটালি দিয়ে মূর্তিটি খুড়তে শুরু করে। একটু একটু করে বাইরের কাদার পুরু আবরন খুড়ে ফেলার পর ভেতর থেকে পরিপূর্ন সোনার মূর্তিটি বের হয়ে আসে।
প্রচলিত গল্প আছে কয়েক শত বছর আগে বার্মিজ সৈন্যরা একবার থাইল্যান্ড দখল করার প্রয়াস চালায়। থাইল্যান্ডের সিয়ামিজ মংকরা এই বার্মিজ আক্রমণের খবর জানতে পেরে তাদের মূল্যবান এই স্বর্নমূর্তিটিকে পুরু কাদার আবরনে ঢেকে রাখে যেন বার্মিজরা মূর্তিটি সনাক্ত করতে না পারে এবং লুট করে না নিতে পারে। সেই আক্রমণে বার্মিজরা সব মংকদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তবে মাটির আবরনের আড়ালে লুকানো এই স্বর্নমূর্তির কথা সবার কাছে অজানা রয়ে যায়। তারপর কয়েকশো বছর পর ১৯৫৭ সালে সেই মংক হাতুরি বাটালি দিয়ে কাদার আবরন সরিয়ে সোনার মূর্তিটি আবিষ্কার করার পর সবাই পুরনো ইতিহাস জানতে পারে।
মূর্তি দর্শন শেষে বিস্ময় নিয়ে আমরা পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
রাতের ব্যাংকক নগরীর সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের প্লেন ক্রমশ আকাশে উড়ছে। বিমানবালা ফ্লাইট সেইফটির ডেমো দেখাচ্ছে। এবারও হেনরি আমার পাশের সিটে। এবার আমি জানালার পাশে। শেভ করাতে এখন তাকে ঝরঝরে দেখাচ্ছে। গলায় কাঠের পুতির মালাগুলো রয়েছে এখনো, মুখে সামান্য হাসির আভাস। পরনে ব্যাংককের ফুটপাত থেকে কেনা গেরুয়া পোশাক। কিছুটা বৌদ্ধ মংকের মত দেখাচ্ছে তাকে। ল্যাপ্টপের ঢাকনা খুলে কি যেন ভাবছে। ওর দিকে কিছুটা হেলে আমি ওর অন্ধকার স্ক্রিনে আড়চোখে নিজেকে এক ঝলক দেখে নিলাম। আঙ্গুল দিয়ে চুল ঠিক করলাম।
ল্যাপ্টপের স্ক্রিনে দেখা নিজের চেহারায় কিছু একটা মিসিং মনে হল। ঠিক মিসিং নয় বরং একটা ফাটলের আভাস, তার আড়ালে ঝাপসা কিছু একটা চকচক করছে মনে হল। আবার তাকালাম। ভয়, সংকোচ আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজের চারদিকে যে আবরন নিয়ে সারা জীবন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তাতে কিছুটা ফাটল ধরেছে মনে হল। কোন সবুজ চোখের আইরিশ ‘মংক’ সেই পুরু আবরনে ফাটল তৈরি করে দিয়েছে নিজের অজান্তেই।
আমাকে তার ল্যাপ্টপের স্ক্রিন আয়না হিসাবে ব্যাবহার করতে দেখে এবার সে ঘার ঘুরিয়ে সরাসরি আমার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনীতে তাকালো। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ!’ হেনরি কিছু না বুঝতে পেরে চোখ কুচকে আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি আবার হাসলাম।