অঙ্কন : পারমিতা কর

পূজোর গন্ধ ভাসছে শহরের বাতাসে। শরতের আসমানী নীলে সাদা মেঘের ভেলা, পুজোর গান, মহালয়ার সুর শোনা যাচ্ছে পাড়াতে। এসবের মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সোমলতা। সকালে শিউলির মালা গেঁথে রেখেছে ঠাকুর ঘরে, কিন্তু মনটা এখনও বিছিন্ন। গতরাতে ইন্দ্রর সঙ্গে আবার একদফা হয়ে গেছে। বদ্ধ ঘরের দাবানলের আঁচ বাইরে আসেনি বটে, তবে তার রেশ রয়ে গেছে, সকাল থেকে একটাও কথা হয়নি দুজনের। মা, বাবা হয়ত টের পেয়ে থাকবেন, কাজের থেকে ফিরে বোঝা যাবে, ভাবতে ভাবতে বের হল সোমলতা। গলির মোড়ের মাথায় আজ একটাও টোটো নেই। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, সোমলতা হাঁটা লাগালো। কিছুদূর এগোতেই পেছন থেকে চেনা গলা। রত্নাদি অটো থেকে ডাকছিল, কাছে যেতেই বলল, ‘তাড়াতাড়ি উঠে আয়।’
‘তুমি আজ বাঁচালে রত্নাদি।’ অটোতে উঠতে উঠতে বলল সোমা।
‘আরে, আমার এদিকে আসার কথা ছিল না। মেয়েটার জন্য একটা স্কুলের খোঁজ পেয়েছিলাম এদিকে। বিশেষ বাচ্চাদের স্কুল পাওয়া যে কি দুষ্কর, তিয়াষা না থাকলে জানতাম নারে। তুই তো সবই জানিস।’
নানান কথার মাঝেই ব্যাঙ্কে পৌঁছল সময়ের আগেই। ঢুকতেই মাইতিদা হাসিমুখে ঘোষণা করলেন, ‘তলব হয়েছে তোমাদের দুজনের। এবারের অফিস ট্যুরে আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমাদের।’ রত্নাদি গজ গজ করতে করতে এগোল, সোমলতা সঙ্গ নিল।
সোমলতা বরাবরই শান্ত স্বভাবের। ছোটবেলাতেই মা বাবা দুজনকে হারাতে হয়েছিল এক পথ দূর্ঘটনায়। তারপর থেকে মামার সংসারেই বড় হওয়া। ইন্দ্রর সঙ্গে বিয়েটা মামার জন্যই হয়েছিল। ইন্দ্র মামার অফিসেই ছিল তখন। শিলিগুড়ির নামকরা কাপড়ের ব্যবসায়ী বাবা ও শিক্ষক মায়ের একমাত্র ছেলে। বাড়ির লোকজন বেশ ভদ্র। এক কথায় ভালো পরিবার বলতে যা বোঝায়। শ্বশুর বাড়ি এসে প্রথম বছর গুলো বেশ চলছিল। ইন্দ্রর সঙ্গে সুন্দর মুহূর্ত গুলো উপভোগ করা, একে অপরের ভালোবাসায় মেতে থাকা।
ইন্দ্রের ব্যবসা পছন্দ ছিল না, তাই বাবার অনেক বলা সত্বেও দোকানে বসেনি। বাবাকে বুঝিয়ে শান্ত করতে হয়েছিল সোমলতাকেই। কিন্তু সাত সাতটা বছর বাদেও যখন নতুন অতিথি এলো না, তখন অতি যত্নে গোছান সংসারটা অগোছাল হতে থাকল। ইন্দ্র অফিসের শেষে নেশা করে বাড়ি ফেরা শুরু করলো। এসবের জন্য একসময় চাকরিটাও হারাতে হয়েছিল। বাবা মা ভেবেছিলেন, বাড়িতে নতুন কেউ এলে ছেলেটা ঠিক হয়ে যাবে। অপত্য স্নেহ অনেকসময় সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সোমলতার কথা কেউ ভাবে নি তখন। মা না হওয়ার যন্ত্রনা, ওকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল। অথচ এই বাড়ির তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন কোন রকম ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই ওকেই দায়ী করল। এখন তো কোন পূজোতেও জোগাড়ের কাজ করলে মা পছন্দ করেন না। কিন্তু না করলেও হয় না, নাতি নাতনীর আশায় দিন দিন পূজো বেড়েই চলেছে, যেগুলো আবার একা হাতে সামলাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মাঝে মধ্যেই।
….বাগচী স্যারের কেবিন থেকে বেরিয়ে, কিশোরকে চা দিতে বলে যে যার জায়গায় বসল। রত্নাদির মাথা এখনও গরম, পরের বুধবার ওদেরকে সিকিম যেতে হবে, তিন দিনের জন্য। রত্নাদির চিন্তা তিয়াষাকে নিয়ে। বারো বছর যদিও হয়ে গেছে, তবুও রত্নাদিকে ছাড়া কিছুই বোঝে না।
ছুটির পরে রত্নাদি বলল, ‘ভাবছি মাকে কিছুদিন এসে থাকতে বলি। আজই একবার ওবাড়ি ঘুরে যাবো।’
সোমলতা বলল, ‘আরে আমিও তো ওদিকেই যাচ্ছি। মামার শরীরটা ভালো নেই। বয়সও হচ্ছে। তোমার বাপের বাড়ির পাড়াতেই তো। চল, একসঙ্গেই যাওয়া যাক।’
ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল, এসে দেখল, ইন্দ্র তখনও ফেরেনি। এখন রাত করে প্রায়ই। গতকালও তো এই নিয়ে ঝামেলা হল। শাশুড়ি সন্ধ্যা পূজো করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ফ্রেশ হয়ে নিজের জন্য চা আর বাবা, মার জন্য হরলিক্স বানিয়ে নিয়ে এল। বাবা খবর দেখছিলেন, মাকে দিয়ে, তারপর বাবার কাছে এসে বসলো। চা শেষ করে রাতের রান্না করতে হবে। এই সময় বাবার সঙ্গে সারাদিনের কথা হয়, রজত বাবুও অপেক্ষা করে থাকেন তার বৌমার জন্য । কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সোমলতা গেল রান্নাঘরে।
রান্না করতে করতে ভাবছিল সোমলতা, ইন্দ্র প্রায়ই রাতে খায় না আজকাল। বললে বলে খিদে নেই। মামার অফিসের পরে এই নিয়ে তিন নম্বর অফিস হল। বাবা কতবার বলেছেন বাবার সঙ্গে দোকানে বসতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! যখন চাকরি থাকে না তখন কিছুদিন যায়।
বাড়িতে রাতে খেতে বসে সোমলতা জানাল, সিকিমে যাওয়ার কথা।
শাশুড়িমা শুনেই রেগে গেলেন, ‘পূজোর আগেই যেতে হবে! ঘরের কত কাজ আছে, আমি এখন তো অত কিছু পেরে উঠব না। তাও আবার চার দিনের জন্য যাবে বলছ। দেখো পরের দিন কথা বলে, যদি এখন না যেতে হয় তবেই ভালো।’
সোমলতা বোঝাতে চাইল, ‘আচ্ছা সোমবার বলে দেখব। তবে এবার যেতেই হবে মনে হয়, তুমি ভেবো না মা, আমি ফিরে এলে পরের রবিবার সব করে দেব। আর যদি শুক্রবার ফিরতে পারি তাহলে শনিবারটাও পাবো, পরের শনিবার তো ব্যাঙ্ক ছুটি।’
বাবা সামাল দিলেন, ‘ও যাক রমা, দরকারী কাজ মনে হচ্ছে।’
রমা দেবী বাকি খাবার চুপচাপ খেয়ে উঠলেন। ইন্দ্র তখনই ঘরে ঢুকল। পা টলছিল। অটোর চালক বাড়িতে দিয়ে গেল।
বৌমার ট্যুরের কথা শুনে তখন মাথা গরম ছিল, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ইন্দ্রর উপর, ‘তুই প্রতিদিনই কি যে সব ছাইপাশ খেয়ে আসিস! তোকে নিয়ে এমন দিন দেখব ভাবি নি কখনও।’
সোমলতার কাঁধে ভর দিয়ে নিজেদের ঘরে গেল ইন্দ্র। বিড় বিড় করছিল, ‘সব আমার দোষই দেখলে মা জননী। বংশ রক্ষা হল না, মনে কি চলছে সেটা বুঝলে না!’
সোমলতার চোখ থেকে জল গড়িয়ে এল। মেয়ে হয়ে মা হতে না পারাটা যে কত বড় শাস্তি সেটা ওর চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে! এখন তো অনেক রকম উপায় আছে। সে সবের কথা এই বাড়িতে তোলাও যাবে না। সোমলতা নিজের বেশ কিছু টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয়ে, ইন্দ্রকে অনেক বার টেস্ট করাতে বলেছিল, সম্মত হয়নি সে, বদলে বেড়েছিল অশান্তি। তারপরেও কতবার চেয়েছিল, কোনও শিশুকে দত্তক নিতে। ইন্দ্রও রাজি হয়ে গিয়েছিল একবার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাস্তবায়িত হয়নি। মা, বাবা কেউ অনুমতি দেন নি। সোমলতা নানাভাবে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিল। একটা সন্তান ঘর পেত, আপন জন পেত। না, হল না, কিছুই। ভাবতে ভাবতে রাতের সব কাজ সারতে দেরি হয়ে গেল। শোবার ঘরে যাওয়ার পথে মা’র চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল।
বাবা মনে হল বোঝাচ্ছেন মাকে, তাও খুব আস্তে আস্তে। সোমলতা আজ নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করলো, বাবা, মা’র ঘরে আড়ি পাতল।
বাবা বলছেন, ‘কি কুলাঙ্গার ছেলে হয়েছে আমাদের। সব আমাদের ভুল বুঝলে গিন্নি। আমাদের অন্ধ পুত্রস্নেহের জন্য ওর আজ এই অবস্থা। এখন কেঁদে কি হবে গিন্নি, আমরা তো কোনদিন ওর ভুলটাকে শুধরে দেই নি। খারাপ লাগে বউমার জন্য। ও কি পেলো! আগে তাও ইন্দ্র রাতে একসঙ্গে খেত, গল্পও হতো কতরকম। বউমার মুখটা দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে, সেটা কি দেখেছ? কিছুদিন ধরে ভাবছি কথা বলব ইন্দ্রর সঙ্গে, একটু বোঝাবো। কাল রবিবার, সবাই ঘরেই থাকবে। ইন্দ্রকে এই বাজে স্বভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। চল না, সবাই মিলে কিছুদিন কোথাও ঘুরে আসি। এই সবের থেকে দূরে।’
‘হ্যাঁ, তুমি ওই ভাব, আমার গোপালকে কে দেখবে? তুমি বউমাকেই দেখো, আমি ছেলেটার কথা ভেবে ভেবে মরছি!’ কেঁদে কেঁদেই বললেন রমা দেবী।
রজত বাবু বললেন, ‘এখন মনে হয়, তখন আমরা অহেতুক জেদ করেছিলাম, মেয়েটা একটা শিশুকে মানুষ করতে চেয়েছিল, সেদিন সেটা করতে দিলে, আজ হয়ত সংসারের অবস্থা এমন হত না!’
রমা দেবীর কান্নার প্রকোপ বেড়ে গেল।
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সোমলতা, চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে এল। চোখ গুলো জ্বালা করছিলো। চোখেমুখে জল দিয়ে একটা বই নিয়ে বসলো। বইয়ের পাতা উলটোতেও পারলো না, সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে এল। কিসের আশায় এই বাড়িতে এখনও পড়ে আছে, নিজে উপার্জন ভালোই করে, তবুও সংসারের এই দুটো বুড়ো মানুষের মুখের দিকে চেয়েই কি এই মায়ার বাঁধন থেকে বের হতে পাড়ছে না? নাকি ইন্দ্রর ভালোবাসা? ভালোবাসা কি আর আছে? অনেক প্রশ্ন মনের কোণে জমাট বাঁধছে। ইন্দ্র কি আবার আগের মত কখনই হতে পাড়বে না! বিয়ের পর হানিমুনে যাওয়া হয়নি, কিন্তু তখন ইন্দ্র ওকে নিয়ে প্রতি রবিবার ঘুরতে যেত। কালও তো রবিবার, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আজ আর কিছু পড়া হবে না, সোমলতা এবার ঘুমোবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা শুরু করলো।
শাশুড়ির মুখ ভার সত্বেও সোমলতার অফিস ট্যুরে যেতে হল। সব কিছু পরিকল্পনা মাফিকই হয়ে গেল, কাজেই শুক্রবার বিকেলের মধ্যেই সোমলতা বাড়িতে। দরজার বেল বাজাতেই অবাক হওয়ার পালা, দরজা খুলল ইন্দ্র। আজ ঘরে আছে! সোমলতা অবাক হলেও কিছু বুঝতে দিলো না। পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। পোশাক পরিবর্তন করতে গিয়ে নজর পড়লো, পড়ার টেবিলের উপর একগাদা কাগজপত্র। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখা শুরু করতেই ইন্দ্র ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, ‘কি হল কি ভাবছ? খুব অবাক হয়েছো তো! সব বলব, কিন্তু তার আগে তুমি পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই কয়েক বছর অনেক দুঃখ দিয়েছি। তবে কথা দিচ্ছি আর হবে না।’ সোমলতা কি বলবে বুঝতে পারল না।
ইন্দ্র বলতে থাকলো, ‘কালকের দিনটা ফাঁকা রেখ। একটা অনাথ আশ্রমে যাবো, বাবা কথা বলে রেখেছে, তোমাকে আর আমাকে যেতে হবে একসঙ্গে ।’
সোমলতা আরও অবাক! বলল, ‘মা জানে? মা রাজী হবে তো?’
ইন্দ্র বলল, ‘বাবা রাজী করিয়েছে মাকে। এখন বিশ্রাম নাও, অনেক ধকল গেছে তোমার।’
সোমলতার খুব ইচ্ছে করছিলো ইন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে, এই আনন্দ দুজনে ভাগ করে নিতে। ইন্দ্র বলল, ‘কিছু বলবে লতা?’
‘আজ আমার ঘুম আসবে না ইন্দ্র, এই দিনটার জন্য কতবছর অপেক্ষায় ছিলাম, চল, আমরা এখুনি বেরিয়ে যাই।’ ইন্দ্র হাসল, অনেকদিন বাদে ইন্দ্রর মুখে হাসি দেখে খুব ভালো লাগলো।
পরের দিন ওরা যখন বের হচ্ছে, তখন সামনের ঘরে মা, বাবা দুজনেই ছিলেন। বাবা বললেন, ‘কাকে আনবে, কিছু ভেবেছ বউমা?’
মা বললেন, ‘পুজোর আগে তো দেবীকেই আনতে হবে, তাই না বউমা?’
সোমলতা হেসে বলল, ‘তাকেই আনতে যাচ্ছি, মা।’
দুগ্গা দুগ্গা বলে ওদের যাওয়ার পথ করে দিলেন রমা দেবী।
সব কিছু ঠিক করে ফিরল ওরা। আজ আর ইন্দ্র বাইরে যায় নি। একসঙ্গেই ঘরে ফিরেছে দুজন। একটা ফুটফুটে পরী দেখে এসেছে, কিছু নিয়মমাফিক কাজ বাকি আছে। দু একদিনের মধ্যে সব মিটিয়ে ওরা সবাই মিলে শাম্ভবীকে ঘরে আনবে। এর মধ্যে দুজনে নতুন সদস্যের নামও ঠিক করে নিয়েছে। শাম্ভবীর ঘর ঠিক করতে হবে। কত কাজ এখন সবার। সব থেকে উত্তেজিত রমা দেবী, আগের থেকেই বলেছেন, নাতনি তাদের সঙ্গে থাকবে সারাদিন।
সোমলতার চোখে আজ আগমনীর আনন্দাশ্রু।

কলমে পারমিতা কর, মুম্বাই

 সাহিত্যপ্রেমী, গল্পকার। পত্রিকা ও ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে ‘লাবণ্য’ পত্রিকার সম্পাদকীয় গ্ৰুপের একজন সক্রিয় সদস্য।



2 COMMENTS

  1. খুব ভালো লাগল।অর্থবহ শিরোনামে ঝরঝরে, স্বতঃস্ফূর্ত নির্মাণ। শেষটাও বেশ ভালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here