এক

   “  ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না  লক্ষ্মী  এতো দেরীতে কাজে এলে তোকে ছাঁটাই করে দেব । কতজন বসে আছে আমাদের বাড়ীতে কাজ করার জন্য !”

   “ কি করব   গিন্নিমা রোহণের  জন্য  টাকা তুলতে পার্টী অফিসে গিয়েছিলাম  ওর কষ্ট যে আর সহ্য না !” 

   “ ভিক্ষে করে কি আর এতো টাকা তুলতে পারবি ছেলের চিকিৎসার জন্য ! নে আমার পানটা সেজে দে । তারপর আমি রোদে বসব আমাকে ভালো করে তেল মালিশ করে দিবি  ।“

  “ দিচ্ছি   গিন্নিমা ।“  

    এ ধরনের কথা রোজই শুনতে হয় লক্ষ্মীকে । সে কোন উত্তর দেয় না এসব কথার । রোহণের  জন্য এমনিতেই তার মন সবসময় খারাপ থাকে। আর কিছু বলে হবেই বা কি তাকে তো এখানেই কাজ করতে হবে। 

    আসানসোলের বনেদি বাড়ীতে কয়েক পুরুষ ধরে  কাজ করে আসছে লক্ষ্মীর বাড়ীর লোকেরা । পুরুষেরা এই বাড়ীর ব্যবসায় মজুরী খাটে আর মহিলারা ওদের বাড়ীতে কাজ করে । এই এলাকায় এটা সবচেয়ে পুরানো বনেদি পরিবার রায়চৌধুরী  পরিবার । ওরা দেশভাগের অনেক আগে বাংলাদেশ ছেড়ে এ দেশে আসেন। বাংলাদেশের বরিশালে ওরা জমিদার ছিলেন ।  বাংলাদেশ  ছেড়ে আসার সময় ওদের কিছু প্রজাও তাদের সঙ্গে আসানসোলে আসে । গৌরসুন্দর  রায়চৌধুরী ওদের এখানে থাকার জায়গা  সেইসঙ্গে কাজের ব্যবস্থা করে দেন । তাদের মধ্যে লক্ষ্মীর শ্বশুর বাড়ীর পূর্ব পুরুষেরাও ছিল ।  রায়চৌধুরীরা অন্য জমিদার বাড়ীর মতো   এদেশে এসে তলিয়ে  যায়নি ।বরং  তারা এখানে এসেও নানা ধরনের ব্যবসা শুরু করেছে , প্রচুর সম্পত্তিও হয়েছে  ওদের । বলতে গেলে ওদের নামডাক অনেক বেশী বেড়েছে , এখন এই বাড়ীর পুরুষেরা রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত । এ বাড়ীর বর্তমান কর্তা বিপিনচন্দ্র রায়চৌধুরী পরপর তিনবার এম ,এ ,লে হয়েছেন । আগামী নির্বাচনে জিতলে হয়ত মন্ত্রী হয়ে যাবেন । 

    লক্ষ্মীর শ্বশুর বাড়ীর পূর্ব পুরুষেরা সবাই এখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এ প্রজন্মের লক্ষ্মীর দুই দেওর  মুম্বাইতে  কোম্পানিতে চাকরী করে । শুধু লক্ষ্মীর বর রাজন দাস ওদের কারখানায় কাজ করে আর লক্ষ্মী ওদের বাড়ীতে কাজ করে । তার কাজ মূলত গিন্নিমা মানে বিপিনবাবুর   স্ত্রী যোগমায়া দেবীর সঙ্গে সঙ্গে থাকা তার যত্ন করা , তার কাজ করা । রাজন চাইত না লক্ষ্মী এখানে কাজে আসুক । কিন্তু লক্ষ্মী নিজেই এখানে কাজে এসেছে । তার এক ছেলে এক মেয়ে , দুজনেই পড়াশোনায় ভালো । লক্ষ্মী ,রাজন দুজনেই চায় ছেলে মেয়ে রোহণ আর লতা  অনেক লেখাপড়া শিখে ভালভাবে বাঁচুক । তাদের মতো লোকের বাড়ীতে কাজ করতে যেন না হয় ।  কিন্তু একজনের রোজগারে খুব কষ্টে সংসার চলে তাই লক্ষ্মী  একটু আয় বাড়ানোর জন্য এই বাড়ীতে কাজ নিয়েছে ।  

   বিপিনবাবুর দুই ছেলে বিজয় আর বিনয়  । দুজনেই বিবাহিত ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । বিজয় বাবুর এক ছেলে বেদ আর অজয় বাবুর এক মেয়ে বন্যা । বেদ আবার রোহণের সমবয়সী একই ক্লাসে পড়ে কিন্তু আলাদা স্কুলে । বেদ নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করে আর রোহণ সরকারী স্কুলে পড়ে । বেদ ছোট থেকেই বড্ড জেদি আর একরোখা । পড়াশোনায় একটুও মন নেই সারাক্ষণ বন্ধুদের নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতেই ভালোবাসে , ওর যখন যা মন চায় তাই করে ।বনেদি বাড়ীর ছেলে হিসেবে সেও খুব অহংকারী হয়েছে ।  তাকে অনুসরণ করে বন্যাও তার মতো জেদি , অহংকারী হয়েছে। তাদের কেউ কক্ষনও শাসন করেনি বেদের মা বিপাশা দেবী একটু অন্য ধারার মানুষ  কখনও ছেলেকে শাসন করতে গেলে গর্জে উঠতেন যোগমায়া দেবী ।  বলতেন , “ রায়চৌধুরী বাড়ীর উত্তরসূরি আমার দাদুভাই । আমাদের এত সম্পত্তি কার জন্য দাদুভাই সবকিছু  পাবে ।  ওর যা খুশী তাই করবে তুমি তাকে কিছু বলবে না ।“ 

    “ কিন্তু মা বেদ দিন দিন কেমন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে ! ওকে যদি একটুও শাসন না করি তাহলে ওর স্বভাব চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে , লেখাপড়া একটুও হবে না । “ 

   “ কে বলেছে তোমাকে এসব কথা বৌমা । তুমি বনেদি বাড়ীর মেয়ে হয়ে কেন যে মিডিল ক্লাসদের মতো কেন কথা বুঝি না !  আমি আমার ছেলেদের কখনও শাসন করিনি কিন্তু তার পরেও ওরা কি দাপটের সঙ্গে ব্যবসা সামলাচ্ছে ,রাজনীতিতেও বাবাকে সাহায্য করছে । আমার নাতিও তেমনই হবে । আর লেখাপড়া নিয়ে এতো  শিখে কি হবে ব্যবসা রাজনীতি করতে এতো লেখাপড়া লাগে না ! আমি চাই না আমার নাতি দুপাতা পড়ে স্কুলে মাস্টারী  করুক !” 

   “ কিন্তু মা ব্যবসা ,রাজনীতি করতেও  লেখাপড়া শিখতে হয় । এখন আর আগের মতো চলে না ।“  

   “ সে যাই হোক সময় এলে দেখা যাবে !”

    ব্যস যোগমায়া দেবী নাতি – নাতনীকে কোন শাসন করতে দিতেন না। বন্যার মা বিনীতা  দেবীও শাশুড়ির ভয়ে মেয়েকে শাসন করতে পারতেন না ।  রোহণ ছোট থেকেই বাবা – মায়ের সঙ্গে কোন অ্নুষ্টানে বা এমনিই রায়চৌধুরী বাড়ি আসত । বেদ ওর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত , সামান্য কারণেই ওর গায়ে হাত তুলত । আর নিজে দোষ করে সব দোষ চাপিয়ে দিত রোহণের উপর । বেচারা শান্ত স্বভাবের রোহণ কিছু বলতে পারত না শুধু কাঁদত । কখনও একটা চকলেট দিয়ে নানা কাজ করাত তাকে দিয়ে যেমন ওর স্কুলের খাতা কমপ্লিট করা ,ওর হাত পা টিপানো আরও কত কিছু করাত সে । বন্যাও কম যায় না রোহণের বোন লতাকে দিয়ে সুযোগ পেলেই নানা কাজ করাত সে । রোহণকে বেদ চামচা বলে ডাকত ।  লক্ষ্মী সবই বুঝত কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস তার নেই । কিছু বলতে গেলে হয়ত ওদের কাজ হারাতে হবে ।

                                           দুই 

      শীতের দুপুর । যোগমায়া দেবীকে তেল মাখিয়ে স্নান করাল লক্ষ্মী। তারপর উনার ঘরদোর পরিষ্কার করে  কাপড় চোপড় ধুয়ে ছাদে মেলতে গেল । যোগমায়া দেবীর কিছুদিন আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এমনিতেই তিনি খুব রাগী ,অহংকারী মহিলা এখন তিনি আরও খিটখিটে হয়ে গেছেন ।পান থেকে চুন খসলেই রেগে যান তবে বিপিনবাবুর শরীর সত্তর বছর বয়সেও ভালো আছে । দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। 

     লক্ষ্মী অন্য মনস্কভাবে কাপড় মেলতে গিয়ে একটা কাপড় নীচে পড়ে যায় । ছাদে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে কমলা খেয়ে গল্প করছিলেন বিপাশা দেবী , বিনীতা দেবী । কাপড়টা নীচে পড়ে যাওয়াতে বিপাশা দেবী বললেন ,” একটু সাবধানে কাজ করবি  লক্ষ্মী, মা যদি বুঝেন তার কাপড় নীচে পড়ে গেছে তাহলে খুব রেগে যাবেন ।“ 

    “ না গো বড় বৌদি খেয়াল ছিল না । আসলে রোহণের জন্য মনটা সবসময় খারাপ থাকে কি যে হবে ছেলেটার ! আমি কাপড়টা  ভাল করে ধুয়ে দেব । “  

    “ সত্যি রে লক্ষ্মী আমারই খেয়াল ছিল না । ছেলেটা এত অসুস্থ তবুও তোকে কাজে আসতে হচ্ছে । কেমন আছে এখন রোহণ ?”

     “ কেমন আর থাকবে গো বড় বৌদি মনে হচ্ছে ছেলেটাকে আর বাঁচাতে পারব না । কোথায় পাব আমরা দশ লাখ টাকা । গিন্নিমা ঠিকই বলেছেন ভিক্ষে  করে কি আর এতো টাকা আমরা জোগাড় করতে পারব মনে হয় পারব না ।  পেটের দায়ে অসুস্থ  ছেলেকে ঘরে রেখে কাজে আসতে হচ্ছে । “

    “ রোহণের জন্য আমাদেরও খুব খারাপ লাগে !  আমাদের ক্ষমতা থাকলে তোকে সাহায্য করতাম । কিন্তু তুই তো সবই জানিস আমাদের এতো অবস্থা থাকলে ও নিজের প্রয়োজন ছাড়া বেশী টাকা আমরা কাউকে দিতে পারি না । আমি আজও ভূলিনি একদিন তুই রক্ত দিয়ে আমার বেদের জীবন বাঁচিয়েছিলি । আজ যদি কিছু করতে পারতাম তাহলে আমারই ভালো লাগত । কিন্তু এতো মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া সম্ভব নয় রে । আমাদের বাড়ীর ছেলেরা টাকা ছাড়া কিছু  বুঝে না ওরা নিজেদের আনন্দের জন্য অনেক টাকা খরচ করতে পারে কিন্তু এমন কাজে হয়ত কিছু দেবে না ।“ – বিপাশা দেবী বললেন ।  

   “ না বড় বৌদি আমরা বড় কর্তার কাছে অনুরোধ  করেছিলাম তিনি বলেছেন রোহণের চিকিৎসার কিছু সাহায্য  করবেন কিন্তু এতো টাকা তো আর কেউ দেবে না । আমাদেরই যেমন করে  যোগাড় করতে হবে । আর না করতে পারলে যদি কপালে থাকে তাহলে  ছেলেটা আমার মরবে। সবই আমাদের নিয়তি গো  ! “  

   “  দিদিভাই সেদিন লক্ষ্মী যদি রক্ত দিয়ে বেদকে না বাঁচাত তাহলে আমাদের বেদ হয়ত বাঁচত না । কি কঠিন অসুখ  হয়েছিল বেদের  । তার রক্তের গ্রুপ ‘O’  পজিটিভ  । এই গ্রুপের রক্ত পাওয়াই যাচ্ছিল না শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীর রক্তের গ্রুপ মিলল বেদের সঙ্গে । আর লক্ষ্মী রক্ত দিয়ে বেদকে বাঁচাল ।“ – বিনীতা  দেবী বললেন । 

   “ সত্যি বলছিস ছোট সেদিন লক্ষ্মী না থাকলে যে কি হত কে জানে !  কিন্তু বেদের শরীরে তো এ বাড়ীর রক্ত বইছে । আমি কতবার বেদকে বলেছি এই কথাটা যে লক্ষ্মী রক্ত দিয়ে তোর জীবন বাঁচিয়েছে ।  কিন্তু তারপরও সে রোহণ , লক্ষ্মী ,লতা  এদের সঙ্গে কত খারাপ ব্যবহার করে।  কি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন ওকে নিয়ে আর পারি না । রোহণের কথা ভাবলে আমার খুব কষ্ট হয় । কিন্তু তুই চিন্তা করিস না লক্ষ্মী তোদের টাকা পয়সা কম থাকতে পারে কিন্তু তোরা ভালো মানুষ দেখিস ভগবান একটা না একটা ব্যবস্থা করবেন রোহণ নিশ্চয়ই বাঁচবে !”- বিপাশা দেবী বললেন । 

  “ তোমার কথা যেন সত্যি হয় বড় বৌদি !”

   “  দিদিভাই রোহণ পড়াশোনায় কত ভালো বাবা মায়ের কষ্ট দেখে টিউশিনি করে নিজের পড়ার খরচ যোগাচ্ছে , বোনটাকেও পড়াচ্ছে । ছোট থেকেই বাবা মায়ের কষ্ট বুঝে  । আমাদের দুটোকে দেখ সারাক্ষণ  যেন উড়ে বেড়াচ্ছে ।  শুধু টাকা চাই ওদের যদি বড়লোক বাড়ীর ছেলে মেয়ে ওরা না হত  তাহলে যে ওদের কি দশা হত কে জানে !”

   “ থাক ছোট বৌদি এসব কথা ওরা বড়লোকের ছেলেমেয়ে যেমন খুশী চলার ওদের অধিকার আছে । আমি এখন যাই দেরী হলে গিন্নিমা চেঁচামেচি করবেন ।“

     সময় চলে যায় রোহণ সরকারী স্কুলে ভালো রেজাল্ট করে পড়াশোনা করতে থাকে আর বেদ ভালো স্কুলে কোনমতে পাশ করে । দু একবার ফেলও করেছে বিপিন  বাবুর অনুরোধে  ওকে  পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।  সারাক্ষণ ফ্যাশন , বন্ধু বান্ধবী , পার্টী এসব নিয়েই মেতে থাকে বেদ ,বন্যা।  । আর শুধু বায়না আজ এতো টাকা চাই , কাল নূতন মডেলের বাইক চাই   শুধু এসবই নিয়ে মেতে থাকে ভাইবোন দুজনে । আর সরকারী স্কুলে পড়েই রোহণ খুব ভালো রেজাল্ট করে সায়েন্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয় , উচ্চ মাধ্যমিকেও ভালো রেজাল্ট করে ফিজিক্স অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয় । লতাও আর্টস নিয়ে ওই কলেজেই ভর্তি হয় ।  একই কলেজে ভর্তি হয় বেদ আর বন্যা ।তার পড়াশোনাতে একটুও মন নেই দলবল নিয়ে যা খুশী করে বেড়ায় সে । কলেজে যাওয়ার পর তার  নিত্য  নূতন গাড়ীর শখ বেরেছে । কিছুদিন  পর  পরই তার নূতন মডেলের গাড়ী চাই । তার ব্যবসায়ী বাবা ,কাকা ,দাদু তাদের ভাইবোনের সব বায়না মিটিয়ে দেন । 

    কিন্তু রোহণের দুর্ভাগ্য কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে । পড়াশোনা করতে তার বেশ কষ্ট  হচ্ছিল । লক্ষ্মী , রাজন যথা সম্ভব তার চিকিৎসা করাতে থাকে কিন্তু রোহণ কিছুতেই সুস্থ হচ্ছিল না । শেষে পরীক্ষায় ধরা পড়ে রোহণের দুটো কিডনি দুটো নষ্ট হয়ে গেছে । কিডনি ট্রান্সফার করতে  গেলে দশ লাখ টাকার প্রয়োজন । কোথায় পাবে তারা এত টাকা বিপিনবাবু কিছু সাহায্য করবেন বলেছেন আর বাকী টাকা জোগাড় করতে নানা জায়গায় যেতে হচ্ছে লক্ষ্মী রাজনকে । লতা লেখাপড়া প্রায় বাদ দিয়ে টিউশিনি করছে যা পাচ্ছে তাই করছে কিন্তু এত টাকা জোগাড় করা কি সম্ভব !  দিন দিন রোহণের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে ! 

    নূতন গাড়ী নিয়ে  বন্ধুদের নিয়ে পিকনিকে গেছে বেদ সঙ্গে বন্যাও গেছে । ফেরার পথে খুব মাতাল হয়ে বেদ নিজেই গাড়ী চালাচ্ছিল । এক ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে আর বেদ ঘটনাস্থলেই মারা যায় । বন্যা বাকীদের অবস্থা খুব খারাপ তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ।

     রায়চৌধুরী বাড়ীতে শোকের ছায়া নেমে আসে । তাদের  বংশের উত্তরাধিকারী আর রইল না । বেদের লাশ যখন  এল  চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেছে শুধু বিপাশা দেবীর চোখে জল নেই । তিনি চুপচাপ পাথরের মতো বসে আছেন । অনেকে ভাবছে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি শোকে কেমন যেন হয়ে গেছেন । কিন্তু হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন “বেদকে আমি এভাবে হারিয়ে যেতে দেব না । ওকে আমি রোহণের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব ! “

   “ কি আবোল তাবোল বলছ বড় বৌমা তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে !” – বিপিনবাবু বললেন । 

  “ আমার মাথা ঠিকই আছে বাবা । আমি চাই বেদের কিডনি দুটো রোহণকে দেওয়া হোক । একদিন লক্ষ্মী রক্ত দিয়ে বেদের জীবন বাঁচিয়েছিল এখন আমি তার প্রতিদান দিতে চাই । “

  “ তুমি কি  আমার নাতির শরীরটাকে  কাঁটা ছেড়া  করাবে বউমা ? “ – যোগমায়া দেবী বললেন । 

   “ বেদের  শরীরটা মাংসের দলার মতো হয়ে আছে । সারা শরীর থেকে কত রক্ত বেড়িয়েছে   তারপরও  আপনাদের কাঁটা ছেড়ার ভয় রয়েছে নাকি !  বেদ যদি এভাবে হারিয়ে না গিয়ে অন্যের মাঝে বেচে থাকে তাহলে কি আপনাদের ভালো লাগবে না ! বেচে থাকতে ছেলেটা কোন ভালো কাজ করেনি মরার পর তাকে কিছু ভালো করতে দিন !“ 

    বিপিনবাবু একটু চিন্তা করে বললেন ,” বড় বৌমা ঠিকই বলেছে । রোহণের কিডনির দরকার আর বেদের কিডনি দিয়ে যদি তাকে দেওয়া যায় ক্ষতি কি ! বেদ মরে গিয়েও  রোহণকে বাঁচিয়ে গেল এর চেয়ে ভালো কাজ আর কি হতে পারে ! “ 

   লক্ষ্মী ,রাজন ,লতা খুব খুশী হয় বিপাশা দেবী প্রস্তাব আর বিপিনবাবুর তার প্রস্তাবে সম্মতি দেখে । ভগবান তাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন !  

   শেষ পর্যন্ত বিপাশা দেবীর জেদ আর যুক্তির কাছে হার মেনেছিলেন রায়চৌধুরী বাড়ীর সবাই । বেদের কিডনি দুটো রোহণের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়  আর ওর লিভার ,হার্ট , চোখ ও দান করা হয়েছিল । বেদ বেঁচে আছে রোহণ আরও তিনজন মানুষের মাঝে !  

 কলমে সংঘমিত্রা রায়

 পেশা – স্কুল শিক্ষিকা , নেশা ছোট গল্প  লেখা । এ পর্যন্ত কিছু সংকলন ও পত্রিকাতে লেখা প্রকাশিত হয়ে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here