আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই পর্দা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সে জানলার পর্দাই হোক বা দরজার পর্দা অথবা স্রেফ কাপড়ের পর্দাই হোক বা ডিজাইনার পর্দা। জানলার পর্দা দেখে যেমন রাস্তার পথচলতি মানুষ ঘরের ভেতরের মানুষগুলোর সৌখিনতা সম্বন্ধে ধারণা করে, তেমনি ঘরের ভেতরের মানুষগুলোর মধ্যে ঘটে চলা রাগ, দুঃখ, কান্না, প্রেমের আঁচও বাইরের সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখে। নবদম্পতির ছোট্ট, মিষ্টি প্রেম কাহিনী বা ঠোঁটের উষ্ণ আলিঙ্গন সবই ঢাকা পড়ে যায় পর্দার আড়ালে । পাশের বাড়ির কাকীমা-মাসিমাদের গোয়েন্দা চোখকে ফাঁকি দিতেও পর্দার জুড়ি মেলা ভার। বছর বাহান্নর অলোকেশবাবুর গিন্নী চন্দ্রিমাদেবীও এই পর্দার ব্যাপারে বেশ সৌখিন। তিনি নিজেই দোকান থেকে বেছে বেছে পর্দা কিনে আনেন। ইদানীং অবশ্য চন্দ্রিমা দেবী নিজেই কাপড় কেটে সেলাই করে পর্দা তৈরি করা শুরু করেছেন। ছোটোবেলায় মায়ের কাছে শেখা সেলাই এখন এই বয়সে এসে বেশ কাজে লাগছে। রান্না করা আর টিভি দেখা ছাড়া বছর পঁয়তাল্লিশের চন্দ্রিমা দেবীর সারাদিন আর সেরকম কিছুই করার থাকে না। হাতে যথেষ্ট সময়, তাই চন্দ্রিমা দেবী নিজের খেয়ালেই সময় কাটাতে নানা ডিজাইনের পর্দা বানাতে শুরু করলেন। নতুন নতুন প্ল্যান মাথায় ঘুরতে থাকলো। সর্বশেষ যে প্ল্যানে তার চিন্তা ভাবনা গিয়ে ঠেকলো, তা হলো তার পরম পূজনীয় স্বামী অলোকেশবাবুর বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের লুঙ্গি । একটা ইউনিক কনসেপ্ট তিনি ভেবেছেন, এটা চিন্তা করেই চন্দ্রিমা দেবী নিজেই নিজের প্রশংসা করলেন। চৈত্র সেলে বেশ কিছু লুঙ্গি কিনলেন। এক প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হওয়ায় সে তো বলেই বসলো, -“চন্দ্রিমাদি তুমি তো দাদার খুব খেয়াল রাখো। দাদার সারা বছরের লুঙ্গি কিনে নিচ্ছো।”চন্দ্রিমা দেবীও একটা রহস্যময় মুচকি হাসি দিয়ে চলে এলেন। সেই মুচকি হাসির রহস্য প্রতিবেশী আজও উদ্ধার করতে পেরেছে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে । চন্দ্রিমা দেবী অবশ্য নিজের লক্ষ্যে অবিচল, সেই লুঙ্গিগুলো দিয়ে একটা নতুন পর্দা বানিয়ে ফেললেন। কিন্তু শুধু বানালেই তো হবে না, প্রশংসা করার লোক চাই । তাই নিজের স্বামীর কাছেই প্রথম গেলেন প্রশংসা পাবার আশায়, কিন্তু অলোকেশবাবুর মুখ দিয়ে একটা দুঃখমিশ্রিত প্রশংসা বেরোলো। সত্যিই তো ওনার আর কি দোষ, চোখের সামনে নিজের নতুন লুঙ্গির এই হাল দেখে কে আর খুশি মনে প্রশংসা করতে পারে? তাই তিনিও অনেক কষ্টে প্রশংসা করলেন। কিন্তু গিন্নীর কাছে সে প্রশংসা যথেষ্ট মনে হলো না, অগত্যা প্রশংসা জোগাড়ের শেষ ভরসা ফেসবুক। গিন্নী পটাপট করে লুঙ্গি কেটে তৈরি করা পর্দার কয়েক খানা ফটো তুলে ফেসবুকে নিজের টাইমলাইন আর বেশ কয়েকটা গ্রুপে পোস্ট করে দিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই লাইক আর কমেন্টের বন্যায় উপচে পড়লো। প্রশংসায় ভেসে অলোকেশবাবুর গিন্নী তো খুশিতে ডগমগ। বিকেলবেলা আবার কয়েকটা লুঙ্গি কিনে এনে পর্দা বানানো শুরু করলেন। অলোকেশবাবু গিন্নীকে আর বোঝাতে পারছেন না, ফেসবুকে পাওয়া প্রশংসার বেশিরভাগটাই লোক দেখানো, সম্পর্ক ভালো রাখার তাগিদে  অনেকেই প্রশংসা করেন, যেটা সত্যি নয় । এই কথা বোঝাতে গিয়ে অলোকেশবাবু গিন্নীর মুখ ঝামটা খেলেন,-“থামো তো, তুমি ফেসবুকের কি বোঝো? যেটা জানো না, সেটা বোলো না। জানো আমার এই কাজটা কত লাইক আর কমেন্টস পেয়েছে?” অলোকেশবাবু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না, এই লাইক আর কমেন্টসের জীবনটা যে বাস্তব থেকে বহু দূরে।  অগত্যা বোঝানো পর্বের সেখানেই ইতি। গিন্নী তো যে কটা লুঙ্গি ছিলো, সেই কটা লুঙ্গি দিয়েই পর্দা বানানোর চেষ্টায় মগ্ন। রাত বেড়েই চলেছে, অলোকেশবাবু গিন্নীকে বললেন, -“কই, এসো, শোবে তো।” গিন্নীর দায়সারা উত্তর, -“তুমি শোও, আমি পরে শোবো।” অলোকেশবাবু শুয়ে পড়লেন। পরেরদিন রবিবার, একটু দেরীতেই ঘুম ভাঙলো অলোকেশবাবুর। প্রায় নʼটা বাজে। আধো ভাঙা ঘুমে খেয়াল করলেন, গিন্নী ফোনে কাকে বলছে, -“না রে, আর কিছু উপায় ছিল না, আজ সকাল দশটার মধ্যে গ্রুপে পোস্ট করতে হবে, না হলে প্রতিযোগিতার বাইরে হয়ে যাবে । তবে প্রায় হয়ে এসেছে। রাখলাম।”  এত কিছুর মধ্যেও অলোকেশবাবু দেখলেন, গিন্নী তার গায়ে একটা চাদর চাপা দিয়ে দিয়েছে। মনে মনে খুশী হলেন, গিন্নীর এই ব্যবহারে, এত কাজের মধ্যেও তার দিকে গিন্নী কত খেয়াল রাখে। গিন্নীর তার প্রতি যে ভালোবাসা অটুট রয়েছে, সেটাও অনুভব করলেন । এরপরেই তিনি অনুভব করলেন চাদরের নিচে তার আর কোনো কাপড়ের আবরণ নেই, মানে তার পরনের শেষ লুঙ্গিও গিন্নীর পর্দা তৈরিতে অংশগ্রহণ করেছে। এতক্ষণে তিনি বুঝলেন, তার গায়ে চাদরের রহস্য এবং গিন্নীর এত ভালোবাসার কারণ।

কলমে দেবাজীব সরকার, কলকাতা

আমি প্রধানত হাস্যরস, রম্যরচনা এই ধারার লেখা লিখি। আমার নিজের হাস্যরসের গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে এবং নিজের পেজে বহু মানুষকে হাস্যরসের মাধ্যমে উদ্বেগময় জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করি ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here