এ বছরও পথিকৃৎ সংঘের দুর্গা পুজোয় পুরোহিতের কাজটা করবেন অমিয় চক্রবর্তী। এই নিয়ে কুড়ি বছর তিনি এই পুজো করে আসছেন। প্রতি বছরই পুজোর পরে টাকাপয়সা দেওয়ার সময় কর্মকর্তারা নানা রকম খুঁত বার করে তাকে কম টাকা দেয়।আবার তিনিও ভাবেন পরের বছর থেকে অন্য কোথাও পুজো করবেন, কিন্তু এ লাইনেও এখন খুব প্রতিযোগীতা। বস্তুতঃ পুজোর সবথেকে কম বাজেট ধরা হয় পুরোহিতের আর ঢাকির বেলায়।
বহুদিন আগে অমিয় তার দাদুর কাছে শুনেছিলেন পুজো শুরু করার আগে মায়ের কাছে পুজো গ্রহণের জন্য আবেদন করা উচিৎ। মা পুজো গ্রহণ করলে নাকি বিজয়ার দিন নীলকণ্ঠ পাখি ডেকে যায়।
আজ উনিশ-কুড়ি বছরে, তিনি কখনো ওই পাখির ডাক শোনেননি। ওনার ধারণা, ওনার পুজো মা গ্রহণ করেননি এখনও।
জেসপ কোম্পানী বন্ধ হওয়ার পর থেকে অমিয় এই জীবিকাকেই আশ্রয় করেছেন, অন্য সময় একটা কারখানার সিকিউরিটি গার্ড এর কাজ করেন। দুই মেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসার।
এ বছরও তিনি পুজো করতে এসে প্রতিমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, পুজো গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছেন। কর্মকর্তারা এটাকে ভড়ং বলে টিপ্পনী ও কেটেছে।
ওদিকে দুখে ঢাকীও বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে হাজির। ওর সঙ্গে এবার ওর ভাইঝিও এসেছে। অভাব মেয়েটার পোশাকে স্পষ্ট হলেও, মুখখানি বড়ো ভালো লাগলো অমিয় পুরুতের। টানাটানা চোখ, টিকালো নাক আর তাতে একটা ইমিটেশন এর নথ। বছর বারো তেরোর মেয়েটা খুব মিশুকে আর প্রাণশক্তিতে ভরা।
কথায় কথায় অমিয় দাদুর সাথে মিলেছে খুব। খালি দাদুকে বলেছিল, “দাদু এবার পুজোয় নতুন জামা হয় নি, কিনে দেবে একটা”!
শিশু মন, বোঝেনি এই দাদুর দুই মেয়েরও এবার পুজোয় কিছু হয়নি। গত বছর পা ভেঙে যাওয়ার পর কাজ ছিলোনা তিন মাস, ওই সময়কার ধার শোধ করা এখনো বাকি। তাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।
হেঁসে উত্তর দিয়েছিলেন ” মা রে ওই বড়োমা কে বল, ওনার অনেক শক্তি উনি নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা করবেন”।
পুজো চলছে, সপ্তমীর সন্ধ্যায় কর্মকর্তাদের পানাসরে তিনি গিয়ে বাচ্চাটার আবদারের কথা বললেন। সক্কলে ধমক দিয়ে বললো, জানেন পুজোর খরচ কত? ও সব খয়রাতি নিজের পয়সায় করুন। অনেক আবেদন করার পর, এক কর্মকর্তা বলে বসলেন- ঠিক আছে, কাল মহাঅষ্টমী। আপনি দুই ঘন্টা ধরে আরতি করুন, তারপর দেখা যাবে। এমনিতেই আপনি যা আরতি করেন তাতে আমার গিন্নীর মন ভরে না। আর হ্যাঁ, খোঁড়া পায়ে পড়ে গেলে কিন্তু আমরা দায় নেব না,বুঝলেন। এখন আসুন। আমাদের জ্বালাতন করবেন না।
অনেক রাত, মায়ের সামনে অমিয় বসে আছেন, কোথায় যেন মায়ের প্রতি বিশ্বাস চলে যাচ্ছে। পাশে মেয়েটা কাকুর সাথে ত্রিপল পেতে শুয়ে আছে। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অমিয়র। রাতে, পাড়ার সবথেকে নাস্তিক ছেলে রানা সাইকেল চালিয়ে ফিরছে। অমিয় কে দেখে বললো, কি ঠাকুর মশাই, বাড়ি ফিরবেন না, এত রাতেও কি পুজো করবেন নাকি! অমিয় বললেন, না রে বাবা, পুজো করতে আর ইচ্ছে করে না, মা কি সত্যি আছে?
রানা হেসে বললো, সে তো আমি আগেই জানি, তা আপনার এই কথা হঠাৎ কেন মনে হচ্ছে? অমিয় বললেন সব কথা, রানা শুনে বললো এত টাকা নেতাদের নিমন্ত্রণে খরচ হয়, আর ওই সামান্য বিষয়ে এত কঠিন শর্ত? আচ্ছা আজ বাড়ি যান, কাল দেখি কি করা যায়।
পরের দিন সকালে, রানা পূজামণ্ডপে এসে ঘোষণা করলো, যদি অনুমতি পায় তবে সে মায়ের আরতি করবে, কারণটাও সবাইকে জানালো। বললো তার আরতি দেখে কারও ইচ্ছে হলে কিছু দক্ষিনা দেবেন, কোনো জোর নেই। আর ঠাকুর মশাইকে বললো বাকি টাকা যা লাগবে তা সেই দেবে। প্রয়োজনে পুরোটাই।
অমিয়, ভাবছেন ছেলেটা পুরো ডোবাবে.. তবে হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেছে, আর কিছু করার নেই।
কর্মকর্তারা কিন্তু কিন্তু করে রাজী হলো, আর কোনো ভুল হলে, রানার গুস্টিউদ্ধার করবে বলে ভাবতে লাগলো। অষ্টমীর পুজো শেষ করে,অমিয় দেখলেন রানা কোথা থেকে দশজন কে জোগাড় করেছে, প্রত্যেকে আরতির সরঞ্জাম নিয়ে ধুতি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে তৈরি।
আরতি শুরু হলো, রানা বললো দুখেদা জোরে বাজাও, যেন তাল ঠিক থাকে।।
তারপর আরতি শুরু।। ঢাক,কাঁশি আর উলুধ্বনিতে মুখরিত সারাপাড়া, প্রচন্ড শক্তিতে রানার দলবল নেচে নেচে আরতি করে চললো। দর্শকদের মন দুললো, পরে শরীর দুললো, নিজেদের আবেগকে আটকাতে পারছেনা কেউ কেউ। সময় যেন থমকে গেল, বাড়ী যাচ্ছে না কেউ। সব্বাই হাতজোড় করে আবেগে ভাসছে।
টানা দুই ঘন্টা পর রানা আর তার দলবল থামলো, দক্ষিনার পাত্রও ভর্তি।
অমিয় রানার হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেললেন..বললেন “বুঝলাম মা আছেন”। তুমি বড়ো হও বাবা।
রানা হেসে বললো, সে পরে হবেখন, এখন দেখুন তো কত উঠলো।
সব মিলিয়ে প্রায় চার হাজার টাকার মতো উঠেছে, রানা টাকাটা নিয়ে দুখেদাকে বললো আমি তোমার ভাইঝি কে নিয়ে যাচ্ছি, ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরবো।
ওরা ফিরলো, দুটোজামা আর দুটো শাড়ি নিয়ে, মেয়েটা দৌড়ে এসে বললো, দেখো দাদু বড়মা আমার জন্য কি সুন্দর জামা দিয়েছে। আর এটা আমার বোনের জন্য। ওই শাড়িদুটো তোমার মেয়েদের জন্যও পাঠিয়েছে।
অষ্টমীর সন্ধ্যায়, ওরা তিনজন নতুন পোশাকে ঘুরছে, কর্মকর্তারা চুপ, তাদের একটি পয়সাও খরচ হয়নি, তবে আজ আর আসর বসেনি।
দশমীর পরেরদিন দুখে ফিরে যাবে, নতুন জামা গায় দিয়ে মেয়েটা দেখা করতে এসেছে। অমিয় একটা থালায় নারকেল নাড়ু, মিষ্টি সাজিয়ে মেয়েটার সামনে দিলেন, মেয়েটা নিয়ে কৌটায় ভরে বললো দাদু, যেতে যেতে খাবো। পরের বছর আবার আসবো কিন্তু। তুমি থাকবে তো? হাসতে হাসতে মেয়েটা চলে গেল, অমিয় আস্তে আস্তে বললো, থাকবো মা, আবার আসিস পরের বছর।
চোখ জলে ভরে আসছে, চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে।। মাথার ওপর দিয়ে কি একটা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল…. অমিয় নিশ্চিত এটা নীলকণ্ঠ পাখি।।
কলমে চিরঞ্জীব চক্রবর্তী
একটা ছোট্ট গ্রামের খুব সাধারণ মানের ছেলে। কবিতা বা যা কিছু লেখা শুরু, আর্য্যা(স্ত্রী) র কথায়,ওর পড়ার জন্যে।শখ:1. মানুষের সাথে মেশা, 2.বিজ্ঞান কে বিজ্ঞান হিসাবে শেখা, 3.রাতের নিঝুম রাস্তায় একা হেঁটে রাতের মিস্টি কথাশোনা।পেশা: স্কুল এ জীবন বিজ্ঞান শেখা,ও শেখানো। স্বপ্ন: পৃথিবী টা কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে রাখা(জেগে দেখা স্বপ্ন)।
বেশ ভালো লাগলো 👍🏻