নিজো – একটি মেয়ের গল্প (পর্ব -৩)

4
1249

<<দ্বিতীয় পর্ব                                                                                            শেষ পর্ব >>

গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি আসা। বোজো ও দেখলাম বাড়ি এসেছে। মা বললো , এখন নাকি প্রায় দিন ওর বর
ফোন করে আমাদের টেলিফোনে , খোঁজ খবর নেয়। ছেলেটা ছোট্ট একদম,মাঝে সাঝে ওপরের ছাদ থেকে দেখি ওকে ছেলে কে নিয়ে ওদের বাড়ির সামনের গেট এ দাঁড়িয়ে থাকতে , গল্প করতে। একদিন চোখে চোখ পরে যায় , কিছুক্ষন পরে ওর গলার আওয়াজ শুনি , বাড়ির নিচে , ছেলে কে নিয়ে এসেছে আমাকে দেখাবে বলে। ভারী মিষ্টি ছেলেটি। নাম নাকি শান্তনু। দেখার সাথে সাথে বুঝলাম খুব শান্ত বাচ্চা। কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেছিলো সেদিন। মা এখন আর আগের মতো বকে না , আমাকে আর নিজো কে কথা বলতে দেখলে , হয়তো আমার ওপর ভরসা বেড়েছে , নয়তো বা…

এরকম ভাবে জীবন এগোতে থাকে , প্রথম বছর থেকে দ্বিতীয় বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাঝামাঝি। এর মধ্যে অনেক বার নিজো বাড়ি এসেছে , সে ভাবে আজকাল আর কথা হয়না। ওর সেই সেজে দি , দুটি বড় বড় ছেলে মেয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেছে সেই লাল কালো বাইকের লোকটির সাথে ,আবার নতুন সংসার পেতেছে। ওদের পরিবার সম্পর্কে , শুধু আমাদের না পাড়ার সবারই প্রায় একই ধারণা , এই কান্ড গুলো ওদের মতো বাড়িতে তেমন কোনো ব্যাপার না। সেজে দির বর , মাঝে অসুস্থ হয়ে মারা যান। সে অসুস্থ হয়েছিল না অন্য কিছু , অনেক কথা কানে আসলেও , কেউ সে বিষয়ে মাথা ব্যাথা দেখায়নি।শুনেছিলাম খাবারে কোনো বিষক্রিয়া ঘটেছে। এক দুবার পুলিশ আসতেও দেখেছিলাম , কিন্তু ওই , সব ই দেখা আর শোনার মাঝে রয়ে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হতো আচ্ছা , এই একই কাজ আমাদের পরিবারে হলে কেউ কি ছেড়ে দিতো !!!নাকি ওরা “ওরকম” পরিবারের মানুষ বলে লোকে ঠিক গণ্য করলো না , একটা মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিলো , সেটাকেও।

আমি পৌনে দুবছর কলেজ হোস্টেলে থাকতে পেরেছিলাম , বরাবরই আমায় মা আর বাড়ি ঘ্যাঁসা , তাই দুবছর শেষ না হতে হতেই লোটাকম্বল গুটিয়ে মা-বাবা কে মানিয়ে দৈনন্দিন রেল যাত্রা শুরু করি বাড়ি থেকে ,প্রায় ২ ঘটে ৩০ মিনিট যেতে আবার ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট আসতে। সারাটা দিন প্রায় রাস্তা আর কলেজে এ কাটতে থাকে।
এরকম ই এক সন্ধ্যেতে টেলিফোনে বেজে ওঠে আরো একবার , যা ছিল একটু অন্যরকম। ফোনের ওপারে অসীম , প্রায় কাঁদো কাঁদো অস্থির কণ্ঠস্বরে ” কে, টুসাই , আমি নিজোর বর , অসীম। আছে একটু জানলা দিয়ে দেখবে , নিজো ওর বাড়িতে এসেছে নাকি ? মানে তুমি কি সকাল থেকে ওর গলা শুনেছ ?”
আমি বললাম ” কই , না তো , অতো খেয়াল করিনি এ, আচ্ছা আমি জিগেস করে বলছি নয়। ”
অমনি অসীম বলে উঠলো ” না না , থাক, আমি ওর বোন কে ফোন করেছিলাম সকাল থেকে অনেক বার , বললো আসেনি , আর এখন তো ফোন করলেও ধরছে না। ”
আমি বললাম ” আসেনি হবে , আসলে তো শান্তনু র গলা শুনতাম। ”
অসীম ভারী গলায় বললো ” কি করে শুনবে , শান্তনু তো আমার কাছে। তোমাকে একটা কথা বলি , গোপন কথা , আরও একবার তোমার সাহায্য চায় ”
“আমার সাহায্য !!” বলে উঠলাম আমি।
“হ্যাঁ , তোমার ” , অসীম বলতে থাকলো , ” তুমি শুধু কিছু ভাবে সত্যি খবর এনে দাও নিজো আদৌ ওর বাড়িতে এসেছে নাকি , আমার ছেলে মা মা করে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি ওকে নিয়ে আর রাখতে পারছিনা। যদি সত্যি ও ওখানে থাকে , আমার হয়ে ওর হাত ধরে বোলো , ও যেন ছেলের মুখ চেয়ে বাড়ি ফিরে আসে।”
আমি আশ্বাস দিলাম , আর বললাম কাল ফোন করতে।

সেই সন্ধ্যে কেমন যেন ঘোরে চলে গেলো , ওপরের ঘর থেকে অনেক বার চেষ্টা করলাম নিজোর গলা শোনার বা কিছু শোনার , যা থেকে কিছু খবর আমি অসীম কে দিতে পারি। মা কে সব কথা জানালাম। মা বললো “আজ থাক, কাল সকালে নয়, জিগেস করিস”।

সকল না হতেই খবর নিলাম নিজো বাড়ি এসেছে নাকি। ওর বোন বললো ‘না’ আসেনি। কি মুশকিল ,বড় বলছে বৌ নেই , এদিকে বৌ এর বাড়ির লোক বলছে ও বাড়ি আসেনি। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগলো। বাড়িতে সবাই কে বললাম। আর অপেক্ষা করতে থাকলাম , বিকেলের ফোনের জন্য। বিকেলে ফোন এলো , অসীমের। আমি বললাম না নিজো তো আসেনি বাড়িতে।

অসীম বললো “নিজো পালিয়েছে “. কান কে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। মানে টা কি !!আগে কারোর প্রেমিক কে নিয়ে পালিয়েছিলো , কয়েক বছর ও ঘুরলো না , আবার পালালো। এটা কি সিনেমা নাকি সত্যি !!! তাও একটা দুধের বাচ্চাকে ছেড়ে। আমি সব সময় ভাবতাম ও ওর বাড়ির অন্য সবার থেকে একটু হলেও আলাদা। কিন্তু না , জীন বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে , প্রমান পেলাম সেদিন।

অসীম বলে চললো ” অনেক দিন সন্দেহ হচ্ছিলো , কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি , নিজো আমার সাথে এরকম করবে ! কিছুর তো অভাব রাখেনি , সুখের সংসার , আমার ছেলে- মা কে নিয়ে বেশ তো সুখেই ছিল। আছে করে আমার সাথে ঝগড়া করতো , তখন ই আমার বোঝা উচিত ছিল ,কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে , কিন্তু আমি ভেবেছি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এরকম হয়েই থাকে। কিন্তু তা বলে !! লজ্জায় কাল বলতে পারিনি , মনে একটু আশা ছিল , হয়তো , হয়তো , ছেলের মুখ চেয়ে ও একাজ করবে না। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। যে মেয়ে অন্যের সংসার ভেঙে আমাকে বিয়ে করতে পারে , সে একদিন যে আমাকেও ছেড়ে যাবে , তা তো আশ্চর্য্য নয়। কিন্তু কি করে এই ছেলেকে নিয়ে , কে ওকে বোঝাবে ওর মা কোথায় !”

আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি , আর মনে মনে কেমন যেন বিশ্বাস ভঙ্গ এর নিঃশব্দ ভাঙ্গনের আওয়াজ শুনতে পারছি। ছিঃ। হ্যাঁ , ছিঃ , ঠিক এরকম ই বলছিলো মন আর মস্তিস্ক। ওর ওই দুধের শিশুতে তো আমারই কত মায়া , আর ও কি করে পারলো , এক বারো ভাবলো না , ছেলের কথা।

অসীম বলে উঠলো ” যেন ও কার সাথে পালিয়েছে ? আমার ভাগ্নের সাথে !!ভাবতে পারছো ?”
আমি চুপ।
অসীম বললো ” আমি তাও চাই , ও ফিরে আসুক , আমি ওকে আবার মেনে নেবো , আমার ছেলের জন্য। ”

এর পর অনেক বার অসীমের ফোন এসেছিলো , শুধু জানতে নিজো কি বাড়ি এসেছে ! কারণ অসীমের স্থির ধারণা এবারের সব কর্মকান্ডে ঠিক আগের বারের মতো ওর পরিবার সব জানে , ওরা জেনে শুনেও কিছু বলছে না।

আমার কিন্তু শুধু মনে হয়েছিল , পাপ কাউকে ছাড়েনা। যে যা কর্ম করবে তার ফল তো এই জীবনে পেতেই হবে। মনে পড়লো সেই কালো মেয়েটির কথা , কি কষ্ট , কি বাজ ই না পড়েছিল তার বুকে যেদিন তোমরা সুখের ঘর বেঁধেছিলে।

এর পর প্রায় ৮-৯ মাস চলে যাওয়ার পর নিজো কে দেখতে পায় ওর বাপের বাড়িতে ।বেশ আছে , দিব্যি হাসছে , কথা বলছে , যেন সব কিছু স্বাভাবিক। বিশ্বাস করুন , আমি যেন বুঝে পাচ্ছিলাম না , এই কি সেই আমার ছোট বেলার বান্ধবী , যার সাথে বন্ধুত্ব রাখতে “মা” কে লুকিয়ে কত কিছু করেছি , মা কে মিথ্যে বলেছি। সব যেন বৃথা লাগছিলো। আমার কিছুই স্বাভাবিক লাগছিলো না। যদি এর নাম মানুষ জীবন হয় , ধিক সেই মানব জীবন , ধিক সেই ভালোবাসা , যে ভালোবাসা এক শিশুসন্তান এর থেকে তার সমস্ত জীবনে আশা আল্হাদ কেড়ে নিলো। যে মা কে আমি পুজো করি , সেই মা এর যে এই রকম ও রূপ থাকতে পারে , ভাবলেই দেহে কাটা দেয়।

আমার কলেজ জীবন প্রায় শেষ শেষ। এখন কখনো কখনো নিজো র সাথে দেখা হয় , তবে আমি চোখ সরিয়ে নি , ইচ্ছে হয়না আর কথা বলার। ওকে দেখলেই শান্তনু র কথা মনে পরে। মাথায় বড় করে কাজলের টিপ্ আর মন কেরে নেওয়া হাসি। অসীমের ফোন আর আসেনি , শুনেছি সেও নাকি আবার বিয়ে করেছে। সে করুক , কিন্তু শান্তনু , তার কি হলো , কি হবে। নিশ্চয় সে বড় হয়ে নিজের আসলো মা কে কাছ থেকে দেখলেও চিনবে না , আর না চেনায় ভালো।

আমি নতুন কাজে যোগদান করে ,বেশ কয়েক মাস কি বলবো , প্রায় বছর গড়িয়েছে , কয়েক বছর এগিয়ে গেছে জীবন এখন।

 

 

Mousumi Kundu Paul

©মৌসুমী

©মন ও মৌসুমী

 

 

 

 

<<দ্বিতীয় পর্ব                                                                                           শেষ পর্ব >>

 

বিঃ দ্রঃ : এই গল্পের সব চরিত্র এমনকি স্থান -কাল-পাত্র সব ই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া , নিতান্ত ব্যর্থ প্রচেষ্টা। গল্পের মধ্য দিয়ে কারোর কোনো অনুভূতিতে আঘাত লাগুক , তা লেখিকার উদ্দ্যেশ নয়। তাই পাঠকের কাছে আবেদন , লেখাটিকে শুধু মাত্র লেখা বা ছোট গল্প হিসাবে পড়তে ।

4 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here