পর্ব -১
নিজো, নামটা ছোটবেলা থেকেই আমার বেশ অন্যরকম লাগতো।কেন কি , অনেক নাম শুনতাম, কোনোটা মিষ্টি, কোনটা ভারী মিষ্টি , কিন্তু এরকম আনকোরা নাম ওই ছোটবেলায় প্রথমই শোনা। আমার বাড়িতে আমাকে সবাই টুসাই বলেই ডাকতো , কখনো বা আদর করে বুলবুলি। বড্ডো কথা বলি কিনা। নিজো আমার পাশের বাড়ির একটি মেয়ে , যে আমার থেকে বয়েসে বড় এটুকু জানা ছিল , তবে ঠিক কতটা , তা কোনোদিনও মেপে দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। কারণ ছোটবেলা তে আমাদের দেখা হবার সময়ক্ষণ খুবই সীমিত ছিল।সেই স্বল্প সময়ে বয়েস নিয়ে গবেষণা না করে আমরা একটু মনভরে খেলেই নিতাম।
আমি যে ক্লাস এ পড়তাম , তার থেকে উঁচু ক্লাস এ পড়লেও , বয়েস বাড়ার সাথে সাথে ও আমার নিচের ক্লাস–ই চলে যায়। তবে সেই ব্যাপারটা ওদের পরিবারকে কতটুকু প্রভাবিত করেছিল জানিনা, আমার মা কে খুব বেশি প্রভাবিত করে। ওদের বাড়িতে যেমন পড়া ব্যাপারটা সব থেকে নগন্য আমার বাড়িতে ওটার–ই প্রাধান্য। তাই ছোটবেলার সেই বন্ধুত্ব, ক্রমশ বজায় রাখা চাপ হতে থাকে। মা ওদের ভাষা একদমই পছন্দ করতেন না , ওদের পরিবারে নিয়মিত লেগে থাকতো ঝগড়া আর অশান্তি। ছোট হলেও এটুকু বুঝতাম , যে ভাষায় ওরা ঝগড়া করছে, সে ভাষা আমার বাড়িতে কেউ কোনোদিন মুখে নেয়ার সাহস করবেনা। এরকমই একটা কথা ওর কাছ থেকে শুনে একবার নিজের দাদার ওপর প্রয়োগ করি , আর তারপর আগা –পাস্তলা মা আমাকে মেরে মেরে প্রায় ধুয়ে দিয়েছিলো। তাই তারপর থেকে আজ অবধি দু–একটা জন্তু জানোয়ারের নাম রেগে গেলে মুখে আসলেও ওই কথাটা আজও মুখে আসেনা।
একবার মা ওকে জিগেস করেছিল কিরে অঙ্কে কত পেলি নিজো। নিজো বলেছিলো ১৯ এ ২০। তখন আমরা না হলেও চতুর্থ শ্রেণী, তো পড়িই হবে। ওর পর থেকে বাড়িতে আলোচনা হলেই ওর এই অঙ্কের নম্বর নিয়ে কথাটা কেউ এড়াতে পারতো না। হা হা। আমাদের দোতলা পাকা বাড়ির পাশে ওদের মাটির বাড়ি।প্রায় ওর মা মাটির প্রলেপ জড়াতো ঘর গুলোতে। মাঝে মাঝে মনে হতো, ইসস আমিও যদি ওই বাড়িতে গিয়ে থাকতাম , নিশ্চয়ই নিজোরও একই কথা কখনোও মনে হয়েছে। ও কি সুন্দর সারাদিন খেলে বেড়াতো , যখন ইচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতো , আমিও যে পারতাম না তা নয় , তবে ওর মতো অতটাও স্বাধীনতা আমাকে আমার মা দিতো না, আর দিতো না বলে আজ বেশ বুঝতে পারি ,মা ও ভাবে আমাকে বেঁধে, অনুশাসনে না রাখলে , আমিও হয়তো। …
একটা সময় আসে যখন আমাদের সাথে ওদের একদমই কথা ছিল না , এমনকি মা যদি জানতো যে আমি নিজো র সাথে কথা বলেছি ,মা খুব রাগ করতো। তাই অনেক গুলো বছর লুকিয়ে চুরিয়ে নিচের তলার দাদার ঘরের জানলা দিয়ে খেলার পর্ব চলতো।ওদের বাড়ি আর আমার বাড়ির মাঝে তোলা ছিল উঁচু দেওয়াল যা আজও দাঁড়িয়ে আছে নানা স্মৃতি বুকে নিয়ে। ও গাছ বেয়ে ওই পাঁচিলে উঠে বসতো আর আমি দাদার অলক্ষ্যে , বা অনুপস্থিতিতে দাদার বিছানায় দাঁড়িয়ে। দুজনে হাত বাড়িয়ে জিনিসের আদান প্রদান করে রান্না বাটি খেলতাম। আর যেই পেছনে কোনো ডাক শুনতাম ,অমনি জালনা বন্ধ করে একা খেলার ভান করতাম।
এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলো দিন। দুটো একদম ভিন্ন মেরুর পরিবারের দুই মেয়ে বেশ বন্ধু ছিল , অন্তত আমি মনে মনে তাকে বন্ধু ভাবতাম। মাঠে দেখা হলেও খেলতাম, গল্প করতাম তবে পরিবারের সামনা–সামনি কোনো দিনও কথা বলার সাহস হয়নি ছোটবেলায়। দিন যাচ্ছিলো –বড় হচ্ছিলাম। ঠিক মনে নেই কিসে পড়ি , মনে হয় অষ্টম শ্রেণী। আমাদের পিছনের দিকে একটি বাড়িতে একটি ছোট বাচ্চার অন্নপ্রাশন হচ্ছিলো , আমাদেরও নেমন্তন্ন ছিল , নিজো–দের ও। নিজো–দের সাথে ওই পরিবারের খুব বেশি ভাব–ভালোবাসা ছিল। ওই বাড়িতে যে মহিলার বাচ্চার অন্নপ্রাশন ছিল, তার বোন মানে বাচ্চাটির মাসি এসেছিলো তার হবু বর বা বলা যাই বর্তমান প্রেমিককে নিয়ে ওই অনুষ্ঠানে সামিল হতে। তাদের আশীর্বাদ হয়ে গেছে, আগামী মাসেই নাকি তাদের বিয়ে , এসব কথা আমাকে নিজো–য় বলেছিলো। একদিন ছাদ থেকে দেখলাম ,ওরা তিনজন মানে ওই দুই প্রেমিক প্রেমিকা সাথে নিজো , খুব হাসি ঠাট্টা করছে। কয়েকদিন পর দেখলাম নিজো আর ছেলেটিকে একা ওদের বাড়িরই সামনের রাস্তায় কথা বলতে। মনে কিছু হয়নি , একারণেই , কারণ আমার মন তখন বই ছেড়ে অন্য পার্থিব বিষয়ে অতো পরিপক্ত হয়নি। তবে আশ্চর্য লেগেছিলো এটা ভেবে , যে অন্নপ্রাশন তো অনেক দিন হলো শেষ , তবে এখনো কেন ছেলেটি এখানে। এর পরেও ছেলেটিকে নিজোর সাথে দেখেছিলাম কয়েকবার।
ঠিক মনে নেই কত দিন পর হঠাৎ খবর আসে। কারণ মাথা থেকে নিজো আর ছেলেটির বিষয় প্রায় নেমেই গেছিলো , একদিন স্কুল থেকে ফিরে এলে , মা বলে জানিস আজ কি হয়েছে ? আমি বললাম কি!!!! আরে “নিজো , আমাদের পাশের বাড়ির নিজো, ওই কোন একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে। সে নাকি কদিন আগে এখানে এসেছিলো অন্নপ্রাশন এর নেমন্তন্ন খেতে। “
সে কি , নিজো পালিয়েছে !!!
©মৌসুমী ©মন ও মৌসুমী
বিঃ দ্রঃ : এই গল্পের সব চরিত্র এমনকি স্থান -কাল-পাত্র সব ই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া , নিতান্ত ব্যর্থ প্রচেষ্টা। গল্পের মধ্য দিয়ে কারোর কোনো অনুভূতিতে আঘাত লাগুক , তা লেখিকার উদ্দ্যেশ নয়। তাই পাঠকের কাছে আবেদন , লেখাটিকে শুধু মাত্র লেখা বা ছোট গল্প হিসাবে পড়তে ।
[…] <<প্রথম পর্ব […]