শিশু-কিশোর ও বড়দের অতি প্রিয় শিল্পী ১৮ জানুয়ারি ২০২২ প্রয়াত হয়েছেন। তার আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই শোকাহত।

নারায়ণ দেবনাথ (২৫ নভেম্বর ১৯২৫ ― ১৮ জানুয়ারি ২০২২)। একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কমিক্স শিল্পী। তিনি হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, কৌশিক রায় প্রভৃতি বিখ্যাত কার্টুন চরিত্রের স্রষ্টা। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার লেখা ও আঁকা কমিকস ছোট-বড় বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। কমিক-স্ট্রিপ ছাড়াও তিনি শিশু-কিশোরদের উপন্যাস অলঙ্করণ করেছেন। শুকতারা, কিশোর ভারতী প্রভৃতি কলকাতা ভিত্তিক শিশু-কিশোরদের পত্রিকায় কমিকসগুলোকো ছোট ছোট খণ্ডে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন।
নারায়ণ দেবনাথের জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯২৫
শিবপুর, হাওড়া, বেঙ্গল, ব্রিটিশ ভারত।
প্রেসিডেন্ট বিশেষ স্বীকৃতি পুরস্কার (২০০৭), সাহিত্য অকাদেমী (২০১৩) , বঙ্গবিভূষণ (২০১৩), পদ্মশ্রী পুরস্কার (২০২১)
নারায়ন দেবনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলার শিবপুরে। পারিবারিক আদি বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে হলেও তার জন্মের আগেই পরিবার শিবপুরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করে। অল্প বয়স থেকেই শিল্পের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। পারিবারিক পেশা স্বর্ণকার হওয়ায় অলঙ্কার প্রভৃতির নক্সা করার সুযোগ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আর্ট কলেজে পাঁচ বছরের ডিগ্রীর জন্য লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাননি, শেষ বর্ষে এসে পড়া ছেড়ে দেন। এরপরে কিছু বছর বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য কাজ করেন।
নিজের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে – কলকাতা বইমেলা ২০১৪
বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ন দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদক মন্ডলীর উৎসাহে। তার প্রথম কমিকস হাঁদা ভোঁদা নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সেসময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ’র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা তখন যুগান্তরে প্রকাশিত হত। হাঁদা ভোঁদা প্রকাশের সাথে সাথেই পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে দেবনাথ নিজেই হাঁদা ভোঁদায় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। হাঁদাভোদা ৫৩ সপ্তাহ ধরে শুকতারা পত্রিকায় চলেছিল।

নারায়ণ দেবনাথের প্রথম রঙীন কমিক স্ট্রিপ ছিল বাঁটুল দি গ্রেট। ১৯৬৫ সালে বাঁটুল দি গ্রেটের সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নারায়ণবাবুর কথায়, কলকাতার কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি (figure) এঁকে ফেলেন। যদিও তিনি শুরুতে বাঁটুলকে কোনো অলৌকিক শক্তি (superpower) দেন নি।

পরবর্তীকালে কিশোর ভারতী পত্রিকা দল নারায়ণবাবুর কাছে বিশেষ পুজোসংখ্যার ব্যাপারে এসে পৌঁছয়। তখন সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। পরে দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক হিসেবে নারায়নবাবুকে গোয়েন্দা-গল্প (স্ট্রিপের) প্রস্তাব দেন যা পরে পরিণত হয় ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়’ চরিত্রে। ১৯৬৯ সালে নন্টে-ফন্টের সৃষ্টি করেন নারায়ণ দেবনাথ। কিশোর ভারতীতে তার আঁকা প্রথম ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হলো ‘ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ’, যার একটি সংখ্যা বেরোয়। ২০১১ সালে লালমাটি প্রকাশন তার বিরল কাজগুলি পুনরায় প্রকাশ করে নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র ১ম ও ২ খন্ড হিসেবে। ২০১২ সালে বাঁটুল প্রথমবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।

নারায়ণ দেবনাথ
বাঁটুল দি গ্রেট (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৫)
হাঁদা ভোঁদা (প্রথম প্রকাশ ১৯৬২)
নন্টে ফন্টে (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৯)
বাহাদুর বেড়াল (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২)
ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়
ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ
ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু
গোয়েন্দা কৌশিক র১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় ‘নন্টে-ফন্টে’-র আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ইতিমধ্যেই সবার মন জিতে নেওয়া দুই চরিত্র হাঁদা এবং ভোঁদার আদলেই নন্টে এবং ফন্টেকে গড়ে তুলেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। তিনি ১৯৭২ সালে ‘পরিবর্তন’ নামের একটি বই অলংকরণ করেছিলেন। মনোরঞ্জন ঘোষের লেখা এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। সেটির থেকে বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। বইটি পুনর্মুদ্রণের সময়ে অলংকরণ করতে গিয়ে তিনি সেখানে পান কয়েকটি ছেলের হোস্টেল জীবনের গল্প। এরপর থেকে তাঁর কমিকসেও নন্টে আর ফন্টের হোস্টেলবাস শুরু হয়, এসে যায় সুপারিনটেনডেন্ট স্যার হাতিরাম পাতি, দুষ্টু ছাত্র কেল্টুরাম, রাঁধুনির মতো চরিত্ররা।

‘নন্টে-ফন্টে’ সিরিজের কমিকসে দেখা যায়, নন্টে আর ফন্টে কোনো এক মফস্ব
লের স্কুল হোস্টেলে থাকে। দু’জনে সহপাঠী এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কেল্টুরাম এই দু’জনের থেকে বয়সে বড়ো। অন্য ছাত্রদের মতো সে হাফ প্যান্ট পরে না, ফুল প্যান্ট পরিধান করে। অল্পবয়সী ছাত্রদের দিয়ে নিজের কাজকর্ম করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কখনও ভয় দেখয়, কখনও বা অন্যভাবে কাজ হাসিলের পরিকল্পনা করে। তবে, নন্টে আর ফন্টের কাছে বারবার জব্দ হয়। কেল্টু সব সময়ে বিশালবপু, খাদ্যরসিক সুপারিনটেনডেন্ট স্যারের সুনজরে থাকার চেষ্টা করে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই স্যারের প্রহারই তার ভাগ্যে জোটে। কমিকস স্ট্রিপে ল্যাংচা, বোঁচার মতো আরও বেশ কিছু চরিত্রের নাম পাওয়া যায়।

১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বই হয়ে পাঠকের হাতে আসে ‘নন্টে-ফন্টে’-র কমিকস। প্রথম দিকে সাদাকালো কমিকস থাকত, পরে কম্পিউটারের জাদুতে রঙিন কমিকস প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি অ্যানিমেটেড ভিডিও সিরিজ। পঞ্চাশ বছরও পেরিয়ে গেলেও, একইভাবে কচিকাঁচাদের মনোরঞ্জন করছে ‘নন্টে-ফন্টে’। শুধু কঁচিকাচা বললে ভুল হবে, বড়োরাও এই কমিকস পড়ে একই রকম মজা পান, উপভোগ করেন। ফেলে আসা শৈশবকে তাঁরা খুঁজে পান এই কমিকসে। এমন এক নির্মল ছাত্রজীবনের গল্প বলা থাকে এই সিরিজে, যেখানে মোবাইল ফোন নেই, কেরিয়ারের জন্য ইঁদুর দৌড় নেই – নন্টে-ফন্টের হোস্টেল যেন এক রূপকথা। তেমন মিষ্টি কৈশোর এখনকার ছেলেমেয়েরা আর পাবে না, ‘নন্টে-ফন্টে’-র কমিকস তাই চিরকালীন হয়ে থাকবে বাঙালির জীবন।
বাঁটুল দ্য গ্রেট বাঙালি কমিকস শিল্পী নারায়ন দেবনাথের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক কমিকস চরিত্রইংরেজি কার্টুন চরিত্র ডেসপারেট ড্যান-এর আদলে তৈরি বাঁটুলের কমিকস গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে (১৯৬৫ থেকে) প্রকাশিত হয়ে আসছে শুকতারা পত্রিকায়। বাঁটুল দি গ্রেটকে একমাত্র বাঙালি সুপারহীরো (অতিমানব) বলা যায়। নারায়ান দেবনাথ অসাধারণ সৃজনশীলতায় বাটুল দি গ্রেট চরিত্র সৃষ্টি করেছেন।

বাঁটুল দি গ্রেট প্রচন্ড শক্তিশালী এক মানুষ। বাঁটুলের গায়ে গুলি লেগে গুলি ছিটকে যায়। মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় মাথায় একফোঁটা জল পড়ল। কিন্তু তার পোশাক আশাক মোটেও সুপারহীরোর মত নয়। গোলাপী বা কমলা স্যান্ডো গেঞ্জী, কালো হাফপ্যান্ট তার একমাত্র পোশাক। বাঁটুল সবসময়ে খালি পায়েই থাকে। কারণ জুতো পরলেই নাকি ছিঁড়ে যায়। তার আছে দুই স্যাঙাত যাদের নাম বিচ্ছু ও বাচ্ছু, কখনো কখনো তাদের নাম গজা ও ভজা বলেও বর্ণিত হয়েছে। তারা সবসমকে কিভাবে বাঁটুলকে জব্দ করবে, কিন্তু শেষে তারাই জব্দ হয়। বাঁটুলের প্রতিবেশী হলেন বটব্যাল বাবু ও তার চাকর। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গেও বাঁটুলের বন্ধুত্ব। বাঁটুলের আরেক অনুগত স্যাঙাত আছে যার নাম লম্বকর্ণ। লম্বকর্ণের শ্রবণশক্তি প্রখর। বাঁটুলের পো্ষা কুকুরের নাম ভেদো আর পোষা উটপাখির নাম উটো। মাঝে মাঝেই সমসাময়িক বাস্তব ঘটনায় বাঁটুলকে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। বাঁটুলকে দেখা গেছে অলিম্পিকে ভারতের জন্য সোনার মেডেল জিততে। বাঁটুল বেড়াতে ভালবাসে। একবার মিশর বেড়াতে গিয়ে সে একটি যান্ত্রিক স্ফিংসকে জব্দ করেছিল। বাঁটুল সৎ ও দেশপ্রেমিক।
হাঁদা ভোঁদা , নন্টে ফন্টে, বাটুল দি গ্রেট ইত্যাদি কমিক সিরিজ গুলি জি বাংলা সহ বিভিন্ন টিভি সিরিয়াল হয়ে আসছে যার দর্শকপ্রিয়তা ছোট-বড় সব মানুষের কাছেই মনমুগ্ধকর।

অসাধারণ প্রতিভাধর কার্টুনিস্ট হট ও কমিক গল্পের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের সামান্য কথায় প্রকাশ করা যয় না। তিনি তার অমর সৃষ্টি মাঝে চিরভাস্বর থাকবেন।তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

কলমে মনোজিৎকুমার দাস ( প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক ও কবি)। লাঙ্গলবাধ, মাগুরা, বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here