শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়। গোলবাড়ির শেডটার নীচে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ। গায়ে গা লাগিয়ে পায়ের উপর পা দিয়ে। পাঁচজনের জায়গায় বিশজন দাঁড়ালে যা হয় ! অসময়ের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে এমন সহাবস্থান। একটু আগেই মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়ে গ্যাছে। তারই আফটার শক চলছে এখন। শরতের বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটায় বরফের ছোঁয়া। ভরসন্ধ্যেয় অফিসফেরতা মানুষজন যে যেখানে পারে , একটা আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। রাস্তায় এখন গোড়ালি ডোবা জল। জল ছিটিয়ে ছুটে চলেছে ট্র্যাফিকের স্রোত। সিগনালের লাল সবুজ আলো আর গাড়ির হেডলাইটের তীব্র সার্চলাইট কেমন একটা মোহময় করে তুলেছে বৃষ্টিস্নাত তিলোত্তমাকে। সামনে নেতাজীর দিল্লি চলোর আহ্বান। আর জি কর রোডের দিকে নেতাজীর বাড়ানো হাত। বিশাল ঘোড়াটার লেজ ভূপেন বোস এ্যভিনিউর দিকে ছড়ানো। জড়সড় অনির্বাণ এ সব তারিয়ে তারিয়ে দেখছে। অনির্বাণের মনে হল নেতাজী ভুল দিকে হাত বাড়িয়ে আছেন। দিল্লিতো পশ্চিমদিকে ! বিশাল ঘোড়াটা কেমন গিলে নিয়েছে মহানায়ককে !ময়দান থেকে টিউবে এসে শ্যামবাজার নামে অনির্বাণ। এখান থেকে ডানলপের বাস ধরে সে। শিউলিঝরা বৃষ্টি এখন ইলশেগুড়ি। মানুষের জটলা ভাঙতে শুরু করেছে। বাড়িফেরার তাড়ায় চতু্র্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে লোকজন। এখন মেঘভাঙা বৃষ্টির জায়গায় বাঁধভাঙা মানুষের প্লাবন। অনির্বাণ পা বাড়িয়েও থমকে গেল। এখন ঘরমুখো মানুষের ঢল। বাসে চিড়েচ্যাপ্টা হতে হবে। একটু দেরি করে বোরোনোই ভাল। বুকপকেটের সেলোফোনটা বেজে উঠল। “অনিকেত কলিং” । –“হ্যাঁ বল।” –“তুই কোথায় ?” –“শামবাজারে আটকে আছি।” –“ও মাই গড, দ্যাটস্ মিরাকেল্ !” ফোনের ওপার থেকে অনিকেত লাফিয়ে উঠল যেন ! অনিকেত বরাবরই এমন। ব্যাঙ্ক মার্জিংয়ের অর্ডার এসেছে। তাদের ব্রাঞ্চটা হয়তো এসবিআইয়ের কোনো এক ব্রাঞ্চের সঙ্গে মিশে যাবে। কোথায় কতদূর পোস্টিং হবে– আদৌ চাকরিটা থাকবে কিনা, সকলের ঘুম ছুটে গ্যাছে। অফিসে কান পাতলে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় চাপা ভারী বুকের শব্দ শোনা যায়। অনিকেত এ সব থেকে অনেক দূরে। রসিকতা ওর মজ্জায়। ভিনগ্ৰহে পোস্টিং হলেও ওর কিছু যায় আসে না ! এমন ক্রাইসিস মোমেন্টে এমন বিন্দাস কী করে থাকা যায় ! অনির্বাণের এসব মাথায় ঢোকে না।
–“আর ইউ লিসেনিং–” অনিকেতের রহস্যকন্ঠ ভেসে এলো।–“শুনছি, বল।” –“তোর মোনালিসা আর্সেনালের সামনে দাঁড়িয়ে।” ধক্ করে হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল যেন ! এক ঝলক রক্ত উজলে পড়ল অনির্বাণের বুক থেকে। —“সিওর !”
–“সেন্ট পারসেন্ট, শিগগীর আয়।”
বছর পাঁচেক আগে, ময়দানের পিএনবির ব্রাঞ্চটায় পিও হয়ে জয়েন করেছিল মধুমিতা। এমবিএ করা অফিসার। অনির্বাণ তখন লোন ডিপার্টমেন্টের ফিল্ড অফিসার। চমকে দেওয়ার মত সুন্দরী মধুমিতা। শিক্ষা আর আভিজাত্য সে সৌন্দর্যকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে। অনেকটা সময় নিয়ে বিধাতা সৃষ্টি করেছেন তার মানস পুত্রীকে। মধুমিতার উপস্থিতি– সম্ভ্রম আর মোহ দুটোই আদায় করে নিত অনায়াসেই। ব্রাঞ্চের সবাই আড়ালে আবডালে তাকে মক্ষিরানী বলত। গভীর আয়তাকার মায়াবী চোখ আর গজদন্তের মধুঝরা হাসি দেখে অনির্বাণ তাকে একদিন সবার সামনে ‘মোনালিসা’ বলে ডেকেছিল। অফিসসুদ্ধ সবাই উদগ্ৰীব হয়ে তাকিয়েছিল মধুমিতার দিকে। হয়তো এক্ষুনি একটা ভয়ংকর এক্সপ্লোশন্ হবে! হয়তো একটা ভয়ংকর টর্নেডো সবকিছু গুঁড়িয়ে তছনছ করে দেবে ! নাঃ, মধুমিতা তার মধুঝরা হাসি ছড়িয়ে নামটা উপভোগ করেছিল সেদিন। ঝড় বা বিস্ফোরণের বদলে শিউলি ঝরা হাসি ঝরে ছিল অফিসময়। প্রেম আর প্রত্যাশার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। অনির্বাণ প্রেমে পড়েগেল মধুমিতার।
ময়দান, পাকস্ট্রিট, এসপ্লানেডের নামি অনামি কোনো রেস্টুরেন্টই বাদ যায়নি তাদের তালিকা থেকে। প্রায়ই ডিনার সেরে তারা বাড়ি ফিরত। ময়দানের পিএনবি ব্রাঞ্চটায় তখন অনির্বাণ- মোনালিসা একটা আলোচনার বিষয়বস্তু।
বন্ধুত্ব ভালোলাগা থেকে আসে। ভাললাগা থেকে ভালবাসা। এই ভালোবাসা কতটা জড়িয়ে আছে তাদের মেলমেশায়, সে ব্যাপারে সন্দিহান ছিল অনির্বাণ ! গভীর দৃষ্টির অনুচ্চ জিজ্ঞাসা সে কত কত বার ছুঁড়ে দিয়েছে তার মোনালিসার দিকে। নিষ্ফল নিরুত্তর আছড়ে পড়েছে তার বুকে। প্রতিবারই। অনির্বাণ প্রদীপ জ্বালিয়েছে। প্রদীপের তেলের কথা তার মনে আসেনি। মধুমিতার সারল্য, সৌন্দর্য, সাবলীলতায় অনির্বাণ মুগ্ধ হয়েছে কিন্তু মাধবিলতার মত জড়িয়ে যেতে পারনি।
প্রায় তিনবছর আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে পুড়তে অনির্বাণ এক ফুৎকারে একদিন নিভে গেল !
মধুমিতা তার বিয়ের ইনভিটিশনকার্ড অফিসে সবার হাতে হাতে দিচ্ছে। মুখে সেই মোনালিসার রহস্যময় হাসি। পাত্র এফআরসিএস ডক্টর। কার্ড হাতে সবার মুখ তখন শুকিয়ে কাঠ ! অনির্বাণ অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই। এমন অপ্রত্যাশিত দৃশ্যের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। মধুমিতার বিয়ের ইনভিটিশন কার্ড তার আর নেওয়া হয়নি।
বিয়ের পর উত্তরবঙ্গে পোস্টিং নিয়ে চলে যায় মধুমিতা। অনির্বাণ আর যোগাযোগ করেনি। মধুমিতাও করেনি। “আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড” কথাটা অনির্বাণ বিশ্বাস করে না। মোনালিসা ঝড়টা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে।
অনির্বাণ ঝট করে একটা হিসেব করে নেয়। মেট্রোতে শোভাবাজার নেমে অটো ধরলে, আর্সেনাল পৌঁউছাতে কম করে পনেরো মিনিট লাগবে। পা চালিয়ে এখান থেকে হেঁটে গেলে মিনিট দশেকের পথ। সে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয় মনে করল। আজ কতদিন পর মোনালিসাকে দেখবে অনির্বাণ। বুকের ভেতর চলা ঝড়টাকে আজ সে নামিয়ে দেবে। আজ সে হাল্কা হতে চায়। রাস্তায় নেমে প্রায় পাগলের মত ছুটতে লাগল সে। ট্রাফিক জ্যাম, মানুষের জটলা, বিপরীতমুখো স্রোতে ভাসা মানুষের ঢল– – সব– সবকিছু উপেক্ষা করে সে এগিয়ে চলেছে। ঝড়ের গতিতে। বৃষ্টিটা হঠাৎ করে একটু বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইলশেগুড়ি এখন পাথরকুচি। কাকভেজা হয়ে অনির্বাণ এগিয়ে চলেছে। কেসিদাশ, টাউনহল–মৃণালিনী– ট্রাম-বাসের রক্তচক্ষু—সবকিছু উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছে সে। সর্বাঙ্গে জল কাদার চুনকাম !
আজ মোনালিসার মুখোমুখি হবে সে। যে কথা বলা হয়ে ওঠেনি, যে কথা ঝড় হয়ে প্রতিনিয়ত তাকে ঢেউয়ের মাথায় আছড়ে মারছে, আজ সে সেকথাই বলবে। সযত্নে লালিত না বলা কথা।
যে উত্তর সে কোনোদিনই পায়নি আজ সে সেই উত্তর খুঁজবে ।
মিনিট পনেরো পর অনির্বাণ আর্সেনালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেজাহাতে মোবাইলটা বের করতে যাচ্ছিল, অনিকেত সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। –” ভেতরে চল, এতক্ষণে খাবার টেবলে বোধহয়। সঙ্গে দু’জন ভদ্রমহিলা আছেন।” পাঁচতলা বিশাল রেস্টুরেন্ট। পাগলের মত অনির্বাণ আর অনিকেত খুঁজে চলেছে মোনালিসাকে। প্রত্যেকটা ফ্লোর, প্রতিটা রুম, সমস্ত হলঘর–করিডোর– তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছে দু’জোড়া চোখ। অনির্বাণের আগ্ৰাসী চোখে দুনিয়া তোলপাড় করা মোনালিসার চোখ। বুকের হাপরের ওঠাপড়ার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে সময়। অনির্বাণ মহাকালের তালে তাল মিলিয়ে ছুটে চলেছে—
কলমে বিকাশ বর, সিঁথি – দমদম, কলকাতা
ষাটের দশকের শেষভাগে, সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্ৰামে জন্ম। স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখি। অসংখ্য পত্রপত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে।
“জাদুকাঠি” নামে একটি শিশুসাহিত্য পত্রিকার সহসম্পাদক। বর্তমানে একজন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী।