অপেদমান্তরং জ্ঞানং সূক্ষ্মবাগাত্মন স্থিতম্।

ব্যক্তয়ে স্বস্বরূপস্ত শব্দম্বেন নিবৰ্ত্ততে ॥

“স্হান ও কালের সৃষ্টি মুহূর্তে উদ্ভূত মহাধ্বনি, আপাতভাবে অনন্ত বিস্তার লাভ করে হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়৷ কিন্তু শক্তির তো বিনাশ সম্ভব নয়—তাই, পরিবর্তিত রূপে, মহাবিশ্বের অনন্তব্যপী অতলান্ত চেতনায় মিশে থাকে সেই শব্দব্রহ্ম৷ দেখবার মত চোখ থাকলে যেমন অসুন্দরের মাঝেও সৌন্দর্য্যের অন্বেষণ সম্ভব, তেমনভাবেই সম্ভব লুপ্তপ্রায় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন৷ আপাতভাবে যা কিছু সমান্তরাল, তা অসীম বিস্তারে গিয়ে অভিকেন্দ্রিক হতে চায়৷ উদাহরণস্বরূপ, আপেক্ষিকভাবে সমান্তরাল সূর্যালোকের উৎপত্তিস্হল কিন্তু এক এবং অভিন্ন…”

*******

বিরামহীনভাবে একটার পর একটা সাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বালুকাবেলায়৷ সোঁ সোঁ শব্দে আস্ফালন করে ফেনিল জলরাশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে—যেমন করে বাঁধনভাঙা উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আসছে অনন্তকাল ধরে৷ ঈষৎ নোনতা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছে প্রফেসর হিমাংশু দত্তগুপ্তর চোখেমুখে৷ চশমার কাচটা কখন যে অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে—খেয়াল করেননি তিনি৷ কাচ ঝাপসা হওয়ার কারণ দুটো; নোনা হাওয়ার ঝাপটার সাথেই আর একটা কারণ এই যে, চশমার ভিতরেও অতীতচারী মনের দর্পণ— দুইচোখে বাষ্প জমে উঠেছে৷ উদাস দৃষ্টিতে অনন্ত বিস্তৃত মহাসাগরের দিকে চেয়ে রয়েছেন৷ সময়ের কোন হিসেব নেই৷ অজানা অনিশ্চয়ের পথে পা দেওয়ার আগে, শেষবারের মত নিজের সাথে কথা বলে নিচ্ছেন হয়ত৷ মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি৷

    হিমাংশু দত্তগুপ্ত সারাজীবন বিজ্ঞানসাধনায় একনিষ্ঠ থেকেছেন৷ দেশবিদেশের অজস্র সম্মানে সম্মানিত হয়েছে তাঁর কাজ৷ অথচ বছর বিশেক আগে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে যে, এই সবকিছু নিতান্তই অর্থহীন বালখিল্য বিষয় ব্যতিরেকে আর কিছুই নয়! অকিঞ্চিৎকর ক্ষমতার অধিকারী মানুষ, তার পরিণতি পরিবর্তনে কতটা অক্ষম! জিনঘটিত দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, প্রিয়তমা পত্নী সম্পূর্ণা’কে, চোখের সামনে তিলতিল করে ভীষণ কষ্ট পেয়ে মারা যেতে দেখেছেন তিনি৷ মানসিক যন্ত্রণায় নিজেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, কিন্তু, কিছুই করতে পারেননি৷ বহুবছরের বিজ্ঞানসাধনার অহং চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অশ্রুকণায় পরিণত হয়েছে৷

প্রিয়জন বিয়োগের শোকে জীবন বড়ই অর্থহীন মনে হয়েছিল তাঁর কাছে৷ এই বিফল জীবন রেখে কী লাভ—এ’কথাও ভেবেছিলেন তিনি৷ কিন্তু তাঁর বন্ধু, ইতিহাসের অধ্যাপক, প্রফেসর অভিষেক বর্মন একটা প্রাচীন পুঁথি তাঁর নজরে আনেন৷ সেখানে লেখা কিছু কথা তাঁকে একটা নতুন গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে৷ একটা সম্ভাবনা অতীতকে ফিরে পাওয়ার… একটা সম্ভাবনা অতীতের সুখস্মৃতি’কে আরো কিছুক্ষণ উপভোগ করার…

সেই সম্ভাবনার পিছু নিয়ে তিনি অতিবাহিত করেছেন জীবনের কুড়িটা বছর৷ হয়ত কেবল সোনার হরিণ তাড়া করে ফেরা হয়েছে—হয়ত সব পরিশ্রম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে আর তাই অদৃষ্ট অন্তরালে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে! যা হবে হোক৷ তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন৷ আজ তাঁর অগ্নিপরীক্ষা৷

  সৃষ্টির আদি মুহূর্তের কিছু অশ্রুত অনুরণন আজও ছড়িয়ে রয়েছে আকাশে বাতাসে—প্রকৃতির বুকে৷ তার সাথে সংস্পন্দন করতে পারলেই খুলে যাবে সমান্তরাল জগতের দ্বার—এমনটাই বলা ছিল পুঁথিটিতে৷ দেওয়া ছিল আপাত সমান্তরাল মাত্রাগুলির অভিকেন্দ্রিক হওয়ার রহস্যের আভাস৷ দীর্ঘ কুড়ি বছরের গবেষণায় নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি সংস্পন্দন সম্পাদনকারী যন্ত্র ও একটি কমাঙ্ক সংবেদী যন্ত্র তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন হিমাংশু৷ প্রাথমিক পরীক্ষা সফলও হয়েছে৷ বাকী পদ্ধতি চেতনা নিয়ন্ত্রিত… তার জন্যও নিয়মিত অনুশীলনে প্রস্তুত করেছেন নিজেকে৷ সুগভীর মেডিটেশনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে দুই ভ্রু এর মাঝে সুসংবদ্ধ করেছেন সমস্ত চেতনাকে৷ অব্যবহারে কর্মক্ষমতা হারাতে বসা পিনিয়াল গ্ল্যান্ড সুচর্চিত হয়ে কর্মক্ষম হয়ে উঠেছে৷ ক্ষুদ্রচেতনার সাথে মহাজাগতিক চেতনার সমন্বয় সাধনের সেই পথ বড় কঠিন ছিল৷ শরীর কখনো কখনো বিদ্রোহ করেছে৷ কিন্তু পরিশেষে অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে হিমাংশু কাটিয়ে উঠেছেন সমস্ত প্রতিকূলতা৷

প্রযুক্তিগতভাবে এবং মানসিক সক্ষমতার দিক থেকে আজ তিনি প্রস্তুত৷ বহুমাত্রিক জটিল হিসেবনিকেশের গণনায় যা ফলাফল ধরা পড়েছে, সেই অনুযায়ী মহাজাগতিক সন্ধিক্ষণ উপস্হিত৷ সমান্তরাল মাত্রাগুলোর আজ অভিকেন্দ্রিক সংযোগের সম্ভাবনা প্রবল, তাই তাঁর অন্তিম পরীক্ষার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় আজ৷ কয়েকটি গভীর শ্বাস নিয়ে মনকে সুসংবদ্ধ করেনিলেন হিমাংশু তারপর তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলিকে বিশেষ বিন্যাসে সংযুক্ত করে মেইন সুইচ অন করলেন৷

—ক্লিক ক্লিক…

অস্ফুট একটা যান্ত্রিক শব্দ করে  যন্ত্রের সমবায়টা চালু হয়ে গেল৷ পদ্মাসনে বসে কানে বিশেষভাবে নির্মিত হেডফোনটা পরে নিলেন হিমাংশু৷ একটা নয়েস তাঁর মনসংযোগকে বারবার ব্যহত করতে লাগল বেশ কিছুটা সময় ধরে৷ তারপর ধীরে ধীরে সে’টাও মুছে গেল৷ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিঃসীম নৈঃশব্দ্য!

তারপর হঠাৎ অত্যন্ত দ্রুতগামী যানে সওয়ার হওয়ার মত অনুভূতি… কিন্তু রৈখিক নয়, বহুমাত্রিক! কোন দৃশ্যপটই স্পষ্ট হচ্ছে না৷ ক্রমশ গতিময়তার তাড়নায় ইন্দ্রিয়গুলো কর্মক্ষমতা হারাতে লাগল তাঁর৷ পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের আধারটা বড় অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হল৷ তাঁর ব্যক্তিচেতনা যেন সীমার বাঁধন অতিক্রম করে অসীমে ধাবমান! ষষ্ঠ একটি অনুভবের গ্রাহক সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হয়ে উঠল৷ সেই অনুভূতি-গ্রাহকটি বাকী পাঁচটি জাগতিক ইন্দ্রিয়ের সামগ্রিক গুণের অধিকারী!

 ধীরে ধীরে অভূতপূর্ব একটা অনুভূতি গ্রাস করতে লাগল হিমাংশু দত্তগুপ্তের ষষ্ঠতম অনুভবটিকেও৷ একটা স্নিগ্ধ শীতলতার স্পর্শানুভূতি… হালকা মিষ্টি একটা নাম না জানা ফুলের সুবাস… মোহন বাঁশীর মায়াময় সুর ভেসে আসছে কোথা থেকে…? সমস্ত কিছু যেন সাতরঙা মায়াবী আলোর অনন্ত বিস্তৃত সাগরে নিমজ্জিত৷ অনির্বচনীয় ভাললাগা ও একরাশ মুগ্ধতা সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে৷ কিন্তু যাকে আর একটি বার দেখতে পাওয়ার জন্য বিশ বছরের সাধনা—সে কোথায়?

 ঐ… ঐতো সম্পূর্ণা! সম্পূর্ণা আর তিনি বসে আসেন সেই সাগরের কিনারায়…

 কিন্তু একী! অনন্ত বিস্তৃত বালুকাবেলায় অগণিত হিমাংশু আর সম্পূর্ণা বসে রয়েছে! তাদের মুখে স্বর্গীয় হাসি৷

মোহনবেণুর স্বর্গীয় সুর-মূর্ছনায় কী এক অনির্বচনীয় আনন্দধারার আবেশ জেগে উঠেছে৷ সমস্ত আলো-অন্ধকার আর স্মৃতি-বিস্মৃতির বৈপরিত্যকে ধারণ করে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা পরিমাপহীন ময়ূরপুচ্ছ৷

কলমে উৎস ভট্টাচার্য, কাঁকিনাড়া, পশ্চিমবঙ্গ

IIT Bombay থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর৷ IISc তে গবেষণার কাজ এবং বাসুদেবামূর্তি সুন্দরারাজন পুরস্কার প্রাপ্তি৷ বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রপত্রিকা ও সংকলনে নিয়মিত লেখালেখি৷ সহসম্পাদনায়  “আতঙ্কের অমানিশা” শীর্ষক বহুল সমাদৃৃৃৃত সংকলনটি  তুহিনা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে৷

3 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here