পরীক্ষা! নাম শুনলেই গা শিউরে ওঠে, তাইনা! পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শব্দের যদি তালিকা থাকত তবে সবার প্রথমে থাকত পরীক্ষা শব্দটি। নামটাই যেন কেমন! অদ্ভুত রকমের ভয়ঙ্কর। যেন এক রাশ ভয় সঞ্চিত হয়ে আছে উক্ত শব্দে! পরীক্ষা কেন আবিষ্কৃত হল, সে এক অপার বিস্ময়! কিন্তু অনুভব করলে বোঝা যাবে আমাদের শিক্ষা কিন্তু আসলে পরীক্ষা তে গিয়েই থামে! নদী যেমন সাগরে গিয়ে পড়ে, তেমনি পড়াশোনা পরীক্ষায় গিয়ে শেষ হয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু পরীক্ষাই হয়ে গেছে। জ্ঞানার্জনের কোনো আর আগ্রহই যেন গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেই নেই। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধু তাই ছিলো? কে দেবে এই উত্তর!
পরীক্ষার আবিষ্কারকের নাম হচ্ছে হেনরি মাইকেল। তিনিই পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলক। পরীক্ষা যতই খারাপ জিনিস হোক, পরীক্ষার মাধ্যমেই কিন্তু ভালো আর মন্দ শিক্ষার্থীদের আলাদা করা হয়। আর ভালো শিক্ষার্থীদের তো কদরই আলাদা! দেশে -বিদেশে সবখানে। তাই হেনরি মাইকেলের উপর যতই ক্ষোভ থাকুক তিনি মোটেই মন্দ নন, বরং অত্যন্ত বিবেচক মানুষ। মেধার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানে তার ভূমিকাই মূখ্য।
কত রকমের পরীক্ষা তো দিয়েই থাকি। কিন্তু কিছু কিছু পরীক্ষা একেবারে হৃদয়ের গভীরে গেঁথে থাকে। যেমন: ম্যাট্রিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষা বিশেষ কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমেই মানুষ দীর্ঘ দশ বছরের স্কুল জীবনকে বিদায় জানিয়ে ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়। শুরু হয় মেধা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। সেই সফল হয় যে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগায়। মেধা দিয়ে স্থান করে নেয় বিশ্বের বুকে। নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরিচয়:
একজন শিশু যখন শিক্ষা জীবনে প্রবেশ করে তখন শুরুতেই স্কুলে ভর্তি হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা অসীম যত্ন ও ধৈর্য্যের সাথে শিশুদের পড়ান। শিক্ষাজীবনের দীর্ঘ দশটি বছরের পরিক্রমায় যখন একজন দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয় তখন সময় হয় সুদীর্ঘ দশ বছরের স্কুল জীবনকে বিদায় বলার। শিক্ষার্থীদের মনে ধ্বনিত হয়,
“ ছেড়ে দিতে নাহি মনে চায়,
তবু ছেড়ে যেতে হয়,
তবু চলে যায়।”
এই এত বড় সময়কে তো আর এমনি এমনি বিদায় দেয়া যায় না, তাই সারা দেশ ব্যাপী নেয়া হয় এই পরীক্ষা। নবম-দশম শ্রেণীর বইয়ের উপর ভিত্তি করে নেয়া হয় এই পরীক্ষা। সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে A+, A, A-, B, C, D, F গ্রেড নির্ধারণ করা হয়। ৮০-১০০ A+, ৭০-৭৯ A, ৬৯-৬০A-, ৫৯-৫০ B, ৪৯-৪০ C, ৩৯-৩৩ D এবং ০-৩২ F। গ্রেডিংয়ের ফলে একজনের যোগ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। প্রতি বছর প্রায় ৫০-৫৫ লাখ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে এই পরীক্ষা দেয়। এই পরীক্ষার ৫০% নম্বর নির্ভর করে ভবিষ্যতে কোথায় পড়তে পারবে। ব্রিটিশ আমলে লর্ড ক্লাইভ এই ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রচলন করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর শুরু হয়ে যায় ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার যুদ্ধ।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিলেবাস এবং মানবন্টন :
নবম-দশম শ্রেণীর উপর ভিত্তি করেই মূলত ম্যাট্রিক পরীক্ষা নেয়া হয়, তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জে.এস.সি.- এর মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণী পাশের পরেই ছাত্র-ছাত্রীরা ৩ শাখায় ভাগ হয়ে যায়। যথা:
(১)বিজ্ঞান বিভাগ
(২)কলা বিভাগ
(৩)ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ।
ভিন্ন তিন শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের মোট ১৪ টি বিষয় রয়েছে। পূর্ণমান ১৩৫০। ৪ টি ভিন্ন বিষয় ছাড়া সব বিষয়ই প্রায় একই। কিছু সংক্ষিপ্ত বর্ণনার মাধ্যমে সেটা উল্লেখ করা যায়, যেমন:
(১) বিজ্ঞান বিভাগ: বিষয় মোট ১৪ টি। বাংলা ২ টি (২০০), ইংরেজী ২ টি(২০০), সাধারণ গণিত(১০০), জীববিজ্ঞান(১০০), রসায়ন(১০০), পদার্থবিজ্ঞান(১০০), উচ্চতর গণিত(১০০), বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়(১০০), ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা(১০০), ক্যারিয়ার শিক্ষা(১০০), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি(৫০)।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক দেয়া বইয়ের প্রতিটি অংশ হতেই পরীক্ষা নেয়া হয়।
(২) কলা বিভাগ: বিজ্ঞান বিভাগের মতো এই বিভাগেও বিষয় ১৪ টি। জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং উচ্চতর গণিতের পরিবর্তে রয়েছে, ভূগোল(১০০), অর্থনীতি(১০০), পৌরনীতি(১০০), রাষ্ট্রনীতি(১০০)। এছাড়া বাকি সকল বিষয়ই রয়েছে।
(৩) ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ: এই বিভাগেও আলোচ্য চারটি বিষযের পরিবর্তে রয়েছে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং(১০০), একাউন্টিং(১০০), ম্যানেজনেন্ট(১০০), বিজ্ঞান(১০০)। এছাড়া বাকি সব বিষয় একই।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি :
দীর্ঘ দুই বছরের সাধনার পর ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় ম্যাট্রিক পরীক্ষা। প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু সমান গুরুত্বের সাথে পড়তে হয়। টেস্ট পেপারস্ সমাধান করতে হয়। বিগত বছরগুলোর পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র করতে হয়। মূলত বই সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলেই এ পরীক্ষায় সফল হওয়া যায়।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বই:
ম্যাট্রিক পরীক্ষা জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। তাই এই পরীক্ষার যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া একান্ত দরকারি। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক পড়া অনেক জরুরী। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য টেস্টে পেপারস্ও সমাধান করকে হয়। বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন সমাধানের মাধ্যমও প্রস্তুতি যাচাই করা সম্ভব হয়। তবে প্রথমেই প্রয়োজন বই সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান ও পারদর্শিতা।
পরীক্ষার প্রশ্নের ধারা:
মূলত সৃজনশীল ধারার প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হয়। ৭ টি সৃজনশীল ও ৩০ টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা হয়। ইংরেজী পরীক্ষায় অবশ্য গ্রামার এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং নির্মিতি লেখা হয়।
*সৃজনশীল প্রশ্নের গঠন: সৃজনশীল প্রশ্নের ৪ টি অংশ থাকে। “ ক” “খ” “ গ” “ ঘ”।
ক নং প্রশ্ন হচ্ছে জ্ঞানমূলক প্রশ্ন। এই প্রশ্নে বইয়ের মধ্যে থেকে একটি এক কথায় উত্তর আসে। এই প্রশ্নের মান ০১
খ নং প্রশ্ন হলো অনুধাবন মূলক প্রশ্ন। এতে বইয়ের কোনো একটি বিষয় উপলব্ধি করে লেখতে হয়। এ প্রশ্নের মান ০২
গ নং প্রশ্ন প্রয়োগ মূলক। এতে নির্ধারিত পাঠ থেকে কী শেখা গেল তা লেখতে হয়। এ প্রশ্নের মান ০৩
ঘ নং প্রশ্ন উচ্চতর দক্ষতা মূলক। এতে দুটি বিষয়ের আলোচনা লেখা হয়। এর মান ০৪
একটি সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য বরাদ্দ ১০ নম্বর।
বাংলা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, গণিত – এগুলোতে ৭ টি সৃজনশীল লেখতে হয়। উচ্চতর গণিত, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানে ৫ টি লিখতে হয়।
*বহুনির্বচনী প্রশ্নের গঠন: ৩০ টি প্রশ্ন বই থেকে আসে প্রত্যেকটির উত্তর দিতে হয়। প্রতিটি প্রশ্নের মান ০১
*ব্যবহারিক: রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান , উচ্চতর গণিত, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ও ক্যারিয়ার শিক্ষার জন্য ব্যবহারিক করতে হয়। ব্যবহারিকের মান ২৫
ফলাফল প্রকাশ:
সাধারনত মে মাসে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। আর বৃত্তির ফল প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে। ম্যাট্রিকে পাশের হার ৯৭.৬৫ %
জীবন ছন্দময় গতিতে এগিয়ে চলে। কখনো উথ্থান-কখনো পতন। কিন্তু জীবন চরম পর্যায়ে আরোহন করে সার্থকতার মাধ্যমে। সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করার জন্য যোগত্যা একান্ত প্রয়োজন। তার একমাত্র উপায় হলো পরীক্ষা। তাই ভীতিকে উপেক্ষা করে সফলতার সাধনায় ব্রতী হতে হবে।কোনো কাজে হাত দিলে পূর্ণ করতে হবে।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন,
“ কোনো কাজ ধরে যে উত্তম,
হোক সে সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন।”
আমাদের তাই সফলতার সাধনা নিরবিছিন্ন ভাবে চালিয়ে যেতে হবে।