“কিরে লিফ্ট অব্দি যেতে পারবি তো মহি” হেসে জিজ্ঞেস করে মধুরাদি।
“মোনো চাহে যে ধরা দিতে,মধুমালতী ডাকে আয়।কিন্তু মধুদি দুনির মা যে ধরা পড়েনা।”-হেসে মুখ ঘোরায় মহি।পেন্সিল হিল পড়ে সোজা দৃঢ় পদক্ষেপে লিফ্টে উঠে পড়ে মহামায়া।
আজও স্বল্প লাল আলোতে ঘরে ঢুকে,প্রথমেই দুনির ঘরে যায় মহি।অঘোরে ঘুমোচ্ছে পাঁচ বছরের মেয়েটা মায়ের শাড়ি হাতে জড়িয়ে।পাশেই শুয়ে উল্কি,দুনির সারাদিনের সঙ্গী আর মহির একমাত্র সম্বল।হেসেল থেকে হকার সবকিছু সামলায় তিরিশের উল্কি।হেসে দরজা বন্ধ করে মহি।কাল শনিবার,সপ্তাহান্তের অপেক্ষায় থাকে মহি প্রত্যেক সপ্তাহ।সর্ব অর্থে প্রকৃত স্পা–টাইম তার এই দুদিন দুনির সাথে!
ঘড়িতে প্রায় তিনটে।স্নান করতেই ঘুমে চোখের পাতা জুড়ে আসে মহির।কিন্তু তাও গল্পের বই হাতে না নিলেই নয়।সেই কোন ছোটবেলার অভ্যেস বাবা শুরু করিয়েছিলো।আজ রাতের দোসর সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের “পূর্ব–পশ্চিম”।বিদ্রোহী বাংলার পার্টিশন,নক্সাল মুভমেন্ট,দেশের জন্য আত্মত্যাগ,বন্ধুত্ব আর সবার ঊর্ধ্বে নিজেকে ভালোবাসা,সমস্ত কিছু যেনো এক সুত্রে এক আশ্চর্য মাদকতায় তুলে ধরেছেন লেখক এখানে।কতো সহজ হয়ে যায় জীবন কঠিন পরিস্থিতিকে একটু সহজ ভাবে সামলে নিলে।দূর থেকে শোনা যায়,তৃপ্ত আমি সম্পূর্ণা আমি…….
“এই যে ওঠো,না উঠলে কিন্তু আমি লুচি করে নেবো,ওঠো”,মহির ঘুম ভাঙে উল্কির ডাকে।প্রত্যেক শনিবার এই হুমকিতে ঘুম ভাঙে তার।পড়িমড়ি দৌড়য় মহি দুনির কাছে।আদর করে,চটকে,চুমু খেয়ে তবে শান্তি মহির রোজ।দুনিও তাই।শুরু হয় দুজনের প্রাণচঞ্চল সকাল।”না না উল্কি,মা আজ বানাবে এগ এন্ড গ্রিট,নো লুচি”।উল্কি মুখ বেকাতেই মা–মেয়ে বলে ওঠে “উল্কি লেটস্ স্টার্ট আওয়ার ভেল্কি”।হেসে দেয় উল্কিও।সারা বাড়িতে মুখরিত হয় আনন্দের কলতান।
হেসেলে ঢোকার আগে,মোবাইলটা এবার দেখে মহি।দুটো মেসেজ স্ক্রিণে।মধুরাদির রাতের মেসেজ,”মহি রে তোর মতন হতে গেলে কি খেতে হয় জানাস তো,শুভরাত্রি,শুধু ভালোবাসা”।
দ্বিতীয়টি মহির উকিল পাঠিয়েছে।দ্বৈপায়নের উকিলের চিঠি ফরোয়ার্ড করা হয়েছে।দুনির কাস্টডি চায় দ্বৈপায়ন।
একবছর ধরে চলছে এই ঝামেলা।
“মা চলো আজ নাচ করি”,দুনির কথায় সম্বিৎ ফেরে মহির।দুজনেই আগে যায় রান্নাঘরে,নতুন রেসিপি বানাতে।আজ জমিয়ে নাচ করবে মেয়ের সাথে।তারপর দুপুরবেলা গল্পদিদির আসর।বিকেলে ঘুরতে চলে যাওয়া গাড়ি নিয়ে।কখনও আবার দুনির নেমন্তন্ন বাড়ি থাকে।পাঁচ বছরের মেয়ের কত রকম স্কুলফ্রেন্ডর্স পার্টি।সাজতে ভালোবাসে মা–মেয়ে দুজনেই।বরং উল্কি উল্টো।সেই তাড়া দেয় দুজনকে।উল্কির বয়স তখন দশ যখন মহির বাবার বাড়িতে আসে উল্কি,নিজের মায়ের হাত ধরে।মা মারা যাওয়ার পর থেকে মহির বোনের মতন বড়ো হয় সে।স্কুল ও কলেজের গন্ডি পার করে এখন সে ওনলাইন ব্যবসা করে,হাতের কাজের জিনিষের।যে বাড়িতে আশ্রিতাকে পড়াশুনা করানো হয়,সেখানে নিজের মেয়ের প্রথাহীন ইচ্ছেগুলোকে “অন্যায় অসভ্য আব্দার” বলে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হতো রোজ।মহির বাবার রক্ষনশীল শিক্ষিত বাড়িতে মেনে নেওয়া হয়নি তার বিজ্ঞাপন অফিসে কাজ করার ইচ্ছে।”এ্যাড এজেন্সিতে শরীর বেঁচা হয়”,বলেন সত্তর বয়সী নামকরা ডাক্তার,মহীর বাবা।কাকা ইন্জিনিয়ার,মা অঙ্কের প্রফেসর।না না চাকরী করতে বাঁধা নেই কিন্তু চাকরী হতে হবে সম্মানের থুড়ি সমাজবদ্ধ।
বিদ্রোহী মহি মানেনা অযথা ভদ্রতার মোড়ক।অতএব সবার অমতে চাকরী নেয় এক নামকরা বহুজাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থায়।পাল্টে যেতে থাকে শিক্ষার অর্থটা রোজ তার কাছে যখন রোজ মায়ের টিপ্পনীতে শুনতে হয়,”মডেল এলো শরীর দেখিয়ে”। পদমর্যাদায় মহি হেড ওফ সেল্স তখন।মাবাবা আর মহির বাড়তে থাকা দূরত্বর সুযোগটাই নেয় আত্মীয়রা(স্বজন বলতে আটকায় মুখে)।জোর করা হয় বিয়ের জন্য কিন্তু মহি তাতেও না বলায় শুরু হয় নোংরা কৌতুহল।
মহি সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ছাড়ার।পাশে পায় এই উল্কিকে।
“কিগো ওঠো আজ একটু উত্তর কলকাতা যাবো চলো,দুনিকে বালিগঞ্জের বাইরের ঘিঞ্জি কলকাতা দেখানোর আছে চলো”।
মহি ভাবে তাহলে হল্টার নেকের সাথে সাদাকালো শাড়িটা পড়বে আজ।মহি ভালো থাকতে ভালোবাসে।ইচ্ছেডানায় তালিম দিতে শেখাচ্ছে দুনিকেও শুধু রাশটা রাখতে হবে নিজের হাতে।কোনও আবেগপ্রবণ বাহুলতায় নিজেকে হারাণো বারণ মহির।তাতে সে স্বার্থপর হলেও ক্ষতি নেই।কিন্তু দিনের শেষে সে সুখী নাহলেও শান্তিতে থাকে।দুনিকে এই প্রশ্নর সম্মুখীন হতে হবে একদিন জানে মহি,যে তার বাবা কে বা কোথায়।আরেকটু বড়ো হলেই মহি কথা বলবে দুনির সাথে আর উল্কি তো এখন থেকেই দুনিকে শিখিয়ে রেখেছে কারোকে আদর করতে না দিতে।তাই দুনির টোল পড়া গালের হাসিতে সবার মন ভালো হলেও গাল টিপত গেলেই আদুরে উত্তর স্বয়ং দুনির থেকে,”লেটস্ শেক হ্যান্ডস”।কি কান্ড বাবা!ব্যতিক্রম হয়তো মাত্র চারজন,মহির বন্ধু।তারা দুনির চোখে “ফ্যামিলি”।বাস্তবে তাঁরাই পরিবার মহির।
প্রত্যেক শনিবার কাটে এভাবেই হৈ–হুল্লোড় করে,রাত আসে শান্তির নিদ্রায়।
আজকের মতন প্রত্যেক রবিবারগুলো নতুন জিনিষ শেখার দিন।কখনও ক্রাফ্টিং কখনও দুনির তুলিতে আকাশ লাল আবার কখনও গোলাপী।নাহ,শুধরে দেয়না মহি।কারণ দুনির লাল আকাশ মানে ঈশান কোণে ঝড় আবার গোলাপি আকাশ মানে ফুল ফোটার দিন।মেয়েটার মধ্যে নিজের ছোটবেলা দেখতে পায় মহি।বাবা শিখিয়েছিলো স্বপ্ন দেখতে কিন্তু বাস্তবায়িত করতে শেখায়নি।কিন্তু দুনি তা শিখবে।দুনি হওয়ার পরেও ওরা আসেনি তাতে মহির কোনও অভিমান নেই আবার কোনও রাগও নেই।এই নির্লিপ্ত মহিকেই অনেক মানুষ অহংকারী ভাবে।কিন্তু মহি বোঝেনা এতে দোষটা কোথায় যেমন বোঝেনা মাতৃত্বে একটি বাবার নাম প্রয়োজন কেন ?
বেশিরভাগ দিনই দুনি শোয় মহির কাছে।এই একটা বিষয় বরং উল্কি বলে”কিগো খুব তো বলেছিলে পাঁচ বছর হলে মেয়েকে আলাদা শোয়াবে,কি হলো”,বলেই মিটিমিটি হাসে উল্কি।আমতা আমতা করে হ্যাঁ বললেও,কিছুতেই দুনিকে কাছছাড়া করে না সে।নিস্তার নেই দুনির তার থেকে।একমাত্র যেদিন বন্ধুদের সাথে লেট নাইট থাকে বা অফিস পার্টি সেদিন দুনি শোয় উল্কির কাছে।মহি ভালোবাসে আড্ডা মারতে,বাইরে খেতে,পার্টি করতে আবার নিয়মিত শরীরচর্চায় কোনও ঘাটতি নেই তার।
দুনিকে তখন সবে বইপত্তর নিয়ে বসিয়েছে,এমন সময় মধুদির ফোন।”দ্বৈপায়ন তো বলছে তোকে বিয়ে করবেই,নাম দেবে সম্পর্কটাকে,এই বলে সবাইকে ফোন করছে রে।কালকেই তো সিদ্ধান্তের শেষ দিন,দেখিস মহি যা বলবি বুঝে বলিস”।কিছুক্ষন কথা বলে ফোন নামিয়ে রাখে মহি।
কি বুঝে বলতে হবে সেটা বোঝেনা সে।যা সত্যি তাই তো বলবে।মহির জীবনধারা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলে চিঠি পাঠিয়েছে দ্বৈপায়নের উকিল।সে নাকি উচ্ছৃঙ্খল,মদ্যপ,সন্তানের খেয়াল রাখতে অপারগ।বিয়ে করা উচিত কি শুধুমাত্র বংশের প্রদীপকে নিজের অধিকার বানাতে?
দুনি ঝপাং করে কোলে আসতেই হেসে ফেলে মহি।পড়াশুনো করে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে রাতে।কাল থেকে ওফিস,স্কুল সব শুরু।দুনি জানে ঘরে লাগানো ক্যামেরাগুলোয় নজরবন্দি সে সারাক্ষন।মাঝে মাঝে দুনি ঠানদি–বুড়ির মতন ফোন করে মাকে বলে,”আমায় না দেখে কাজ করো”।যদিও দুনি খুব লক্ষী মেয়ে,বাধ্য খুব কিন্তু উল্কিকে খুব নাকানিচোবানি খাওয়ায় মাঝে মাঝে তার অলিক প্রশ্নের ঝুরি খুলে।যার উত্তর শুধুমাত্র থাকে মহির কাছে।
সোম থেকে শুক্র পড়াশুনা আর একসাথে রাতের খাওয়দাওয়া।শুধু রাতে মহির পার্টি থাকলে অন্য ব্যবস্থা নাহলে এর অন্যথা নেই।শেষ হয় আরেকটা রবিবার মহি–দুনির ভালো–বাসায়!
সোমবারের ট্রাফিকে মহির গাড়ি ছুটে চলেছে পার্ক সার্কাসের দিকে।দ্বৈপায়ন,মহির ওফিসেই চাকরী করে।অন্য বিভাগে।মহির আত্মবিশ্বাসী মনোভাব আর দ্বৈপায়নের সম্ভ্রান্ত উপস্থিতি কাছে এনেছিলো দুজনকে।কিন্তু দুজনেই জানতো একসাথে মিল হওয়া অসম্ভব।তাই পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক বন্ধনে লিপ্ত হয় দুজনেই যে কোনওরকম কৈফিয়ৎ বা ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতি বা টানাপোড়েন থাকবে না এই সম্পর্কে।মহি প্রথমেই বলে দিয়েছিলো সে বিয়ে মানেনা।এরপর দ্বৈপায়ন অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসে এবং বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দেয় তাকে।মহির জীবনে এরকম অনেক পুরুষ আসে যায় কিন্তু মহি প্রথমেই বলে দেয় সে বিয়েতে নারাজ।অনেকেই কানাঘুষো করে এই নিয়ে কারণ ওফিসের ডিরেক্টরের তো আর সম্মুখে নিন্দা করা যায়না।অনেকের স্ত্রীয়ের চক্ষুশুল সে।অথচ আজ অব্দি কোনও বিবাহিত পুরুষের সাথে শারীরিক ভাবে লিপ্ত হয়নি সে।মহির বন্ধুদের সাথে এই নিয়ে খুব মজা করে।পয়ত্রিশের মহির উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ তীক্ষ্ণ মুখশ্রী,তন্বী চেহারা অনেকের কাছেই চক্ষুশুল।অথচ যে ছেলেদুটি ওর বন্ধু তাদের স্ত্রীরা মহি বলতে পাগল।
বছর পাঁচ আগে যখন মহি বোঝে সে সন্তানসম্ভবা সে জানায়নি দ্বৈপায়নকে।কোনও কারণ বা দায়বদ্ধতা ছিলো না এবং দ্বৈপায়ন তখন বাড়ির পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ের পাকা কথাও বলছে।খুব খুশী তখন মহি।অজানা আশঙ্কা,শরীর খারাপের মধ্যেও নতুন প্রাণের স্পন্দন তার ভেতরে যেনো এক নতুন পৃথিবীর আহ্বান।বন্ধুরা ছিলো পাশে।দ্বৈপায়ন পরে জানলেও খুব একটা আগ্রহী ছিলো না বিষয়টা নিয়ে।মহিও তাই চাইতো।কিন্তু দুনি জন্মানোর বছর তিন পর থেকে শুরু হয়েছে এই গন্ডগোল।যে মেয়েটির সাথে দ্বৈপায়নের বিয়ে ঠিক ছিলো সে নাকি সব কথা দিয়ে বেকে বসে,কানাঘুষো শোনা যায় পুরণো প্রেমিকের কাছে ফিরে যায় সে।এরপর থেকেই দ্বৈপায়নের বাড়ি জোর ফলাতে থাকে,মহিকে বিয়ে করার কারণ তাদের বংশের প্রদীপ সেখানে।আর মহীও নারাজ এসব অমুলক অন্যায় আব্দার মেনে নিতে।হঠাৎ নাকি দ্বৈপায়ন তাকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়।কোন শতাব্দীতে বাস করে এরা!
গাড়ি এসে থামে তার উকিলের ওফিসে।ওখানে উভয় পক্ষের উকিল আর দ্বৈপায়ন হাজির।শুরু হয় দগ্ধ উত্তপ্ত আলোচনা।
দ্বৈপায়নের উকিলের মতে – দ্বৈপায়ন একটি সুস্থ দায়িত্বপূর্ণ মানুষ হওয়ার নিদর্শন দিচ্ছে মহিকে বিয়ে করতে চেয়ে।কারণ সে তাকেই ভালোবাসতো তাই অন্য মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারেনি।এই সমাজে আজকালকার দিনে এমন মহৎ কজন হয় যে অন্য সুযোগ পেলেও উচ্ছৃঙ্খল মহিকে বিয়ে করতে চায ভালোবাসে বলে এবং নিজের সন্তানকে নিরাপদ ভবিষ্যত দেবে বলে।মহি নিজের জেদ এবং স্বার্থে দুনিকে তার জন্মদাতা তার বাবার থেকে দূরে রাখছে।অতএব মহি তাতে রাজি হোক নাহলে নোংরা জীবনযাপনের জন্য আদালত শেষ সিদ্ধান্ত শোনাবে!
মহির উকিল বলেছিলো ধর্ষণের অভিযোগ আনতে যেহেতু বিয়ে হয়নি কিন্তু মহির সবথেকে বড়ো শক্তি সত্যতা,মিথ্যে সে ভয় পায়,ঘেন্না করে।অতএব সে খারিজ করে দেয় এই মিথ্যে অভিযোগ করার প্ল্যান।হ্যাঁ এবং না এই দুটো বলার অধিকার একটি মানুষের আছে।আছে ব্যক্তিগত পছন্দের অধিকার কারোর ক্ষতি না করে।
অতএব সে সত্যের সাথে লড়বে।
মহির উকিল প্রত্যুত্তর দেয়– অভিযোগ সব মিথ্যে।তার ক্লায়েন্ট বিবাহ চায়না এবং সন্তান শুধুমাত্র তার একার।কারণ বিয়ে বা সংসার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা সেক্সুয়ালি রিলেটেড হয়নি কখনও।এবং আজ দ্বৈপায়ন শুধুমাত্র অন্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলেই পরিবারের সম্মান এবং পুরুষত্বের উগ্র জাতীয়তাবাদ বাঁচাতেই এই মিথ্যে ভালোবাসার গল্প সাজানো।
ঠিক হয় দুই উকিল যাবে জজ সাহেবের কাছে সিদ্ধান্তের তারিখ নিতে যেহেতু আদালতের বাইরে মিমাংসা হলো না।
গাড়িতে উঠতে যেতেই দ্বৈপায়ন বলে”ইউ বিচ,তুমি তো নিজেই পরিবার–ছাড়া।তুমি কিকরে জানবে সন্তান পালন”!
মহি হেসে উত্তর দেয়,”দেখা হবে আদালতে”।
আজ মহি বারবার আনমনা।প্রথমবার অজানা আশংকা।হেরে যাওয়ার ভয় নেই,ভয় একটি অর্ধ–প্রস্ফুটিত শৈশবকে হঠাৎ করে বড়ো হওয়ার তপ্ত পোড়খাওয়া প্রশ্নের সম্মুখীন করানোর।এ কিসের অশনি সংকেতে আজ বিহ্বল মহি।কোনওদিন হাসতে ভোলেনি মহি।জীবন তার কাছে জোয়ার ভাটায় খরস্রোতা নদী।সে ভালো কি মন্দ কোনওদিন নিজেকে প্রশ্ন করলে,তার অন্তরাত্মা সপ্রতিভ জবাব দিয়েছে সে তার নিজের মতন।ভীষণ এই বিশ্বে সে ক্ষুদ্র এক নিজস্ব পৃথিবী।সে নিরপেক্ষ,সে প্রথাহীন সামাজিক,তার পরিচয় সে মানুষ,নারী এবং মা।মাতৃত্ব তার অভিমত,তার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত,তার একমাত্র বেঁচে থাকার রসদ কিন্তু পরিপূর্ণতা তার মনুষ্যত্ব।সে বারবার ঋতুমতি নারী হয়ে জন্মাতে চায়।মাতৃত্ব কেড়ে নেয়না সখ–আহ্লাদ বরং আরও ক্ষুরধার করে দ্বায়িত্ববোধ।তার ইচ্ছেডানায় সে নারী,সে তীব্র,সে দাপুটে,সে ব্যক্তিত্বসম্পন্না।তার শরীর একমাত্র তার অনুগত।অন্তর আর শরীরের সন্ধিক্ষণে সে একটি মানুষ।তার কাউকে আঘাত করার অধিকার নেই কিন্তু তার অধিকার আছে “না” বলার।তার মধ্যে কামের বর্ণনা নিতান্ত এক শারীরিক চাহিদা আর ভালোবাসা সহৃদয় বন্ধুত্ব।হ্যাঁ এটাই মহি,সমাজের “ভালো মেয়ে” হওয়ার চেনা ছকের বাইরেও একটা অনেক বড়ো পৃথিবী আছে সেখানে লিঙ্গ নির্বির্শেষে,সততা একমাত্র ভালো হওয়ার মাপকাঠি।।
নাহ,দুনিকে কিচ্ছু শেখায়নি আজ আলাদা করে।দুনি শুধু জানে আজ একটা অচেনা জায়গায় তাকে মায়ের কাছে থাকতে কেনো ভালোলাগে বলতে হবে।
দুদিন আগে উকিল জানিয়েছিলো যেহেতু দুনির বয়স পাঁচ,তাই শেষ সিদ্ধান্ত নেবে দুনি।দুনির মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা দেখে জজ্ রায় দেবেন কাস্টডি কার কাছে থাকবে এবং বিয়ে আর পিতৃপরিচয় কতোটা আবশ্যিক সন্তানের সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য।উল্কি বলেছিলো দুনিকে শেখাতে কি বলতে হবে কিন্তু মাতৃত্বের তো কোনও সংজ্ঞা হয়না।মা পুরুষ–স্ত্রী উভয় হতে পারে।লিঙ্গ নির্বিশেষে “মা” সে যার শরীরের গন্ধে “সন্তান” নিজেকে খুঁজে পায়,বাঁধা থাকে স্বার্থহীন খুঁটি,সময়ের সাথে মতের অমিল হতেই পারে কিন্তু অমিলেও থাকে আশ্বাস ।
ফ্যামিলি কোর্টে ঢুকতেই দ্বৈপায়ন জড়িয়ে ধরে দুনিকে কিন্তু দুনির সপ্রতিভ উত্তর “ সরি আমি তোমায় চিনিনা,সরে যাও।”
শুরু হয় প্রশ্ন–উত্তর,জবার পাল্টা জবাব……দৃঢ়,ঋজু,মহির সামনে দ্বৈপায়নের ছকে বাঁধা সামাজিক আরোপ উড়ে যায় খড়কুটোর ন্যায়।
আবার অন্যদিকে অনেকেই “ভালো” চায় মহীর,তাই মহৎ আখ্যা দেয় দ্বৈপায়নকে।
“যাই হোক সামাজিক নামকরণ তো পাবে বেচারি ছোট মেয়েটা”।
কিন্তু এই শব্দটাতেই তো আপত্তি প্রথম থেকে।প্রথম থেকেই তো এই কারণে প্রথা ভাঙার জন্য সবার থেকে বিদ্রোহী তকমা পাওয়া।ভালো থাকাটা আজকাল বড্ড সমালোচিত।কেউ ভালো আছে মানেই সে বিরুদ্ধচারী।আর মাতৃত্ব?সেটাতে কষ্ট না থাকলে,ত্যাগ না থাকলে তা অপূর্ণ।
মহি খুশী।মহি নাচের তালিম নেয়,মহি চাকরি করে,মহি নিজের শরীরের যত্ন নেয়,মহি স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা দুনিকে প্রতিপালন করে আবার প্রয়োজনে ফর্মুলা।মহি রান্না করে আবার হাল্কা মদ্যপানে ডুবিয়ে দেয় নিজেকে ।
তার সন্তানের নামকরণ সে নিজে।বিয়ে করে সংসার যারা করে তারাও তার বন্ধু কিন্তু সেটা সামাজিক জোরজুলুম না ।ঠিক যেমন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাটা বয়সের মাপকাঠিতে হয়না,হয় একান্ত ভাবে শ্রদ্ধার নিরিখে তেমনই যৌনসহবাস বা সেক্স তার কাছে পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক মিলন।কিন্ত তা কখনই বিবাহীত কারোর সাথেনা।ঠিক না ভুল সেটার বিচার সমাজ করতে পারেনা।কারণ সমাজে ভদ্র হওয়ার গন্ডিতে রোজ কাঁদে অনেক লক্ষী।শোষিত অত্যাচারীত হয় অনেক স্তব্ধ অন্নপূর্ণারা রোজ।শুধু সেই আদালতে স্বাক্ষী থাকে কান্নাভেজা বালিশ আর রক্তক্ষরণে বিছানার চাদর।বিচার কে করবে তার? খুন হয় কন্যাভ্রুণ।ভবিষ্যত্বের মাতৃত্ব ধারণ করতে পারার যন্ত্রটাকেই তো পুরুষশোষিত ভদ্র সমাজ গর্ভাশয় শেষ করে দেয়।তাহলে মহি নাহলে অন্যরকম মাতৃত্বটাকেই আজ নিজের নামকরণ দিলো।জেগে ওঠে আজকের দশভুজা।সে অপ্রতিরোধ্য,সে তীব্র,সে সুন্দর,সে নবরুপে আবির্ভূত এই ফ্যাসিবাদের দাবানলকে হেলায় হারাতে।সে শান্তি,সে আনন্দ,সে অট্টহাসে অবিচল….সে এযুগের নারী,সেই মহামায়া।
জজ্ সাহেব শোনেন পুরোটা।রায় আসে সিঙ্গল মাদার হওয়ার সমস্ত যোগ্যতা আছে মহির।শুধুমাত্র দুনির ওপর নির্ভর করছে পুরোটা।কিন্তু দুনিকে যে কিচ্ছু শেখানো হয়নি।
দরজাটা খুলে যায় আদালতের।সুর্যের রশ্মির অভন্তরাল থেকে এগিয় আসে ছোট্ট একটি নিষ্পাপ মুখ।যে একবার ফাদার্স ডেতে মহিকে প্রশ্ন করেছিলো তার বাবা কে,উত্তরটা দেওয়া হয়নি।আজ কি তাহলে আদালত এই উত্তরটা বোঝাবে তাকে!!!
শুরু হয় প্রশ্নোত্তর।
–নাম কি তোমার?
–প্রিসাগ্নি মুখার্জি ।
–তোমার নামের মানে কি?
–ঠাকুরের উপহার আগুনের মতন ভালো।(ঈশ্বরের পবিত্র নৈবেদ্য মনুষ্যজাতিকে যে অগ্নির ন্যায় পবিত্র,মহি হেসে বলে দেয় পুরোটা)
–তোমার মায়ের নাম?
–মহামায়া মুখার্জি।
–বাবার নাম?
–মহামায়া মুখার্জি।
–তা কি করে হয়?বাবা তো সবার আলাদা।তোমার বন্ধুদের মতন বাবাকে পেতে ইচ্ছে করেনা?
–হ্যা করে তো।
উল্কি তাকায় মহির দিকে।এক হীমশিতল স্রোত বয়ে যায় চারদিকে যেখানে দ্বৈপায়ন এগিয়ে যায় অনেকটা।
আবার প্রশ্ন করে জজ্।
–তোমার বাবাকে পেতে ইচ্ছে করে?
–হ্যাঁ,করে তো।যখন সারাদিন মা ফোনে বলে এটা করবি না ওটা করবি না,যখন নাচ পড়াশুনা ছড়া গল্পের বই এইসব নিয়ে বসিয়ে রাখে আর নতুন নতুন রান্না করে খাওয়ার পরে বলে ঘুমোবি না কিন্তু,তখন বাবাকে চাই।তখনই তো বাবা আসে এসেই গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যায়,আইসক্রিমে খাওয়ায় চুপিচুপি রাত দুটোয়,যাতে উল্কি না জানতে পারে।বাবাই তো এমন ঘুমোয় যে আমায় ডেকে তুলতে হয়।বাবাই তো আদর করে আগলে রাখে যখন মা শাষণ করে।মা যখন লিপস্টিক লাগাতে বারণ করে বাবা চুপিচুপি লাগিয়ে দেয়।মা বিদ্যুৎ চমকালে ঘরবন্দী করে বাবা বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়।ওই তো আমার বাবা।
মহামায়া মুখার্জি।
প্রথমবার মহি বসে পড়ে কান্নাভেজা চোখে।
দুনি বলতে থাকে,-আঙ্কল ওই যে আমার বাবা–মা।উল্কিকে দেখিয়ে বলে–ওই যে আমার ফ্যমিলি।
আমি তো ঠাকুরের উপহার।ওই তো আমার ঠাকুর,আমার মহামায়া,সবার মহি।
স্তব্ধ সামাজিক নামকরণে সোচ্চার হয় এক নিষ্পাপ পবিত্র সরল ভালো থাকা।পাঁচ বছরের শৈশব জন্ম দেয় এক দেবীর।নিঃশ্বাস নিতে না পারা এক অন্ধ অশিক্ষিত ভীরু সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাড়ায় এক দেবী–সে সাধারণ মানুষ।সঠিক বিচার পায় নারীত্ব,আর তা ঊর্ধ্বে সঠিক ন্যায় পায় ভালো থাকা।আমরাই সমাজ,আমরা সমাজবদ্ধ নই।
আজ আরেকবার পরিপূর্ণা লাভ করে মাতৃত্ব–সিঙ্গল মাদারহুড ইস এ চয়েস।মাদারহুড ইস এ চয়েস।
এগিয়ে যাচ্ছে মহামায়া,প্রিসাগ্নি আর উল্কি।
এগিয়ে যাচ্ছে শহরের ক্যকাফোনের শঙ্খধ্বনিতে নতুন এক সমাজে,ভালো থাকা শিখতে।
দুরে শোনা যায়,আবার জন্মাবো আমি নারী হয়ে,
আমি একালের মহামায়া।।