নীড় হারা পাখি

1
1879

ফুলমনি বেলচায় করে তপ্ত পিচ নিয়ে ঢেলে দিচ্ছে রাস্তার ওপর।বুধি টেনে সমান করছে।বৈশাখের দুপুরে তপ্ত পিচ থেকে যত না তাপ লাগছে তার থেকে বেশি রোদের হলকা তাদের পুড়িয়ে দিচ্ছে।ফুলমনির কালো পিচের মত মসৃন পিঠ বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।গায়ের সাথে চিটিয়ে থাকা টেরিকটের ব্লাউজ বেয়ে ঘামের স্রোত বয়ে এসে উন্মুক্ত কোমরের ভাঁজে আটকে পড়ছে।পিচ ফেলতে গিয়ে বারবার ঝোঁকার ফলে বুকের আঁচল আলগা হয়ে ঝুলে পড়েছে,স্পষ্ট হচ্ছে বক্ষ বিভাজিকা।ঘর্মাক্ত বক্ষ আর কোমরের ভাঁজে  আটকা পড়ছ একজোড়া পুরুষ চোখ।

ফুলমনি সদ্য যুবতী, শরীর জুড়ে তার ভরন্ত যৌবন।হরেন এসে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় তাকে পুকুর পাড়ের দিকে।বেশ কয়েকটা জারুল আর কৃষ্ণচূড়া গাছ আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে।হরেন ঠেসে ধরে তাকে কৃষ্ণচূড়া গাছটার গুঁড়ির সাথে।বামহাতে তার চওড়া চোয়াল টিপে ধরে ডানহাতে তার বুকের কাপড় ঠিক করে দিতে দিতে বলে –
“ডবকা গতর কি না দেখায়ে রইতে পারিস নাই।কতবার কইছি তোকে সমঝে কাজ কর,ভাগাড়ের শকুন গুলা ঘুরতে থাকে তোর আগুপিছু।মাগীর তোয়াক্কা নেই তাতে। ”

ফুলমনি এক ধাক্কায় ঠেলে সরিয়ে দেয় হরেনকে।তারপর আঁচল ঠিক করে নিয়ে নিজের কাজে যোগ দেয় সে। বুধি চোখের অশ্লীল ইশারা ছুঁড়ে মুচকি হাসে। পান্নালাল ব্যাপারখানা দেখেও না দেখার আছিলায় একই ভাবে গিলতে থাকে ফুলমনির উচ্ছ্বলে পড়া যৌবন।

দুপুরে সারে সারে পান্তাভাত আর শুশনি শাকের ভাজা,কাঁচা পিঁয়াজ লঙ্কা ডলে খেতে বসে মজুরের দল।
পান্নালাল তাড়া লাগায় -“ভোট আসছে,জলদি জলদি কাজ শেষ করতে হবে গো,তাড়াতাড়ি খেয়ে হাত লাগাও কাজে।”

একটা বড় এলুমিনিয়ামের জামে পান্তা নিয়ে বসেছে হরেন আর ফুলমনি,সাথে বছর তিনেকের একটা ছেলে,জামের ভিতর হাত চালিয়ে মুঠো মুঠো পান্তা তার ছোট্ট হাতের তালুতে নিয়ে নিচড়ে সে মুখে চালান দিচ্ছে।সাথে ঝাল ঝাল লঙ্কা দলা নুনে পিঁয়াজ ডুবিয়ে কচকচ করে কামড় লাগাচ্ছে।সে দৃশ্য দেখে পান্নালাল শিউরে ওঠে। বাপের মতই রাক্ষস ছানাটা।
আহার শেষে আবার যে যার কাজে লেগে পড়ে।হরেনের ছেলেটা দূরে পড়ে থাকা ছাই এর ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে,হয়ত মায়ের কোলের নরম সান্নিধ্য পাচ্ছে তা থেকে।ফুলমনি একবার সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

ভোট এলে পরে কাজ বাড়ে।পিচের গন্ধ মহুয়ার মতই নেশা ধরায়।ঘর ছেড়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।তপ্ত গ্রীষ্মের দুপুরে ধোঁয়া ওঠা গরম পিচ ঢেলে চলে উন্নয়নের ধ্বজা টানা।

হরেন এখন একটু অনুতপ্ত। সারাদিন তেতে-নেয়ে কাজ করে বউটা।এতটা রুক্ষ্ম না হলেও হত।পান্নালালের চোখ জোড়া যেন নেকড়ের মত লকলকে।মনে হয় খালি চোখ দিয়ে চেটে নেয় সে তার ফুলমনিকে।

এই আঙরাভাসি গায়ের রাস্তা হতে হতে ভোট এসে যাবে।তারপর বেশ কিছুদিন ছুটি।হাতে কাজ নাই।পরেরবার থেকে ঠিকাদার পান্নালালের কাজ সে করবে না ঠিক করেছে।

আঙরাভাসির সড়ক ধারে বিশাল ফাঁকা প্রান্তর।এক স্বচ্ছ দীঘি।দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল এক বটগাছ।চারদিকে ঝুরি নেমে তার বিপুল শাখাপ্রশাখার ভার বইছে।দীঘির একপ্রান্তে তাবু গেড়ে চলছে রাতের খাবারের যোগাড়।এবেলা দুটো গরম ভাত যে যার নিজের মত ফুটিয়ে নিচ্ছে।

হরেন সন্ধের আগেই আশপাশে থেকে গুড়িয়ে এনেছে শুকনো পাতা,ডালপালা।মাটি খুঁড়ে অস্থায়ী উনুন গড়েছে ফুলমনি।প্রায় একমাস হল এখানে তাদের সংসার পাতা।আর দিন সাতেকের কাজ বাকি।তারপর ফিরে যাবে তারা লাল মাটির দেশে।পটলা বটের ঝুরি ধরে টনাটানি করছে কখন থেকে।
হরেন গিয়ে বাধা দেয় তাকে।
-“বাপ মোর,রাতের বেলা গাছ ঠাকুরে  ঘুম দেয়।জ্বালাস নি তেনাকে।”

-“কেনে কি হয় বাপ?”
-“গাছ ঠাকুরে রেগে গেলে শাপ দিবেক।”
পটলা অতিব বটগাছটার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায়।শাপ কি জিনিস সে জানে না।শুধু এটুকু বোঝে- সে এক ভয়ঙ্কর কিছু, ঠিক যেমন ভুত,পেত আর একানুড়ি।হরেনের গা ঘেঁসে দাঁড়ায় সে। হরেন কোলে তুলে নেয় তাকে পরম মমতায়, চুমু খায় তার নরম চিবুকে।
হাওয়ার দমকে বারবার নিভে যায় আগুন।ফুলমনি ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া তোলে।ধোঁয়ার জ্বালায় তার চোখের সাদা জমিনে ফুলে ওঠে লাল শিরা।হরেন এসে বসে পাশে।পটলা মায়ের পিঠে উপুড় হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে দোল খায়। হরেন উনুনে ফুঁ দিতে যায়,ঠোকা লাগে ফুলমনির মাথায়।দুজনেই হাত বোলায় ঠোকা লাগা স্থানে।ফুলমনি মৃদু হাসে,হরেনের মনে গুমোট কেটে দক্ষিনা বাতাস বয়ে যায়।ফুলমনি আবার মাথা ঠুকতে উদ্যত হয়, হরেন মাথা সরিয়ে নেয়।
-“শিং উঠবেক,ওরে ঠুকাইতেদে মাথা।”
আবার লাগে মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি, এবার পটলাও তার ছোট্ট মাথা দিয়ে গুঁতিয়ে দেয় বাপ মাকে।

চুনোমাছের বাটিচচ্চড়ি আর আলুপোড়া দিয়ে একথালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তোলে হরেন।ফুলমতির খাবারে অনিহা।তিন মাস হল মাসিক বন্ধ,খুশিতে ডগমগ হরেন।আসছে পটলার ভাইবোন। এবারের মত কাজ শেষ হলে ফুলমতিকে সে বিয়ানোর আগে পর্যন্ত কাজে যেতে দেবে না ঠিক করে নেয়।
তাবুর ভিতরে দম হাঁসফাস করা গরম।বাইরে চাটাই পেতে শোওয়ার ব্যবস্থা করেছে তারা। পটলা পড়ে রয়েছে চাটাই-এর মাঝে হাতপা ছুঁড়ে।

ফুলমনি এঁটো বাসন নিয়ে দীঘির পাড়ে যায়।হরেন যায় লন্ঠন নিয়ে। হাতে হাতে লেগে দেয় সে ফুলমনির।ফুলমনির কালো শরীরে লেপ্টে রয়েছে লাল সুতার শাড়ি,আলো আঁধারিতে বড় মোহময় লাগে তাকে।
হরেন বলে-” বউ এই লাল শাড়িতে তোকে বহুত মানায় বটে।”
-“তাই বুঝি তোর অত সন্দ জাগে মনে!!”অভিমানী শোনায় ফুলমনির গলা।-“তবে কি সাফা কাপড় পড়ব কাল থিকে?”

-“রাগ করিসনি ফুলি।ঠিকাদারের দৃষ্টি মোকে ঠিক লাগছেক নাই।তাই তুকে বলা।”

-“এইসুব তোর মনের ভুল বটেক।ঠিকাদার ভদরনোক।আমাদের মত ছোট নোকের দিকে নজর দিবেক নাই।ভদর ঘরের বউঝি হলে আলাদা কথা।”

-“তোর রুপের কাছে ভদর ঘরের বউঝিরা ফিকা পড়ি যায় রে ফুলি।এমন ঢোলকের মত গতরখানি কাহার আছে আশেপাশে দেখ দিকিনি।”

লাজে রাঙা হয় ফুলমনি।বলে -“আ মরন, মিনসে তো দেখি সব বউঝিদের দেখে পটর পটর।”

ফুলমনিকে কাছে টেনে এনে তার অন্তর্বাসহীন বুকে মুখ ডোবায় হরেন।ফুলমতির ঘামে ভেজা বুকের মাতাল করা গন্ধ শুকতে শুকতে ধরা গলায় বলে -“দেখি রে ভদরলোকের বউদের।বড় বাসনা হয় মনে তোকেও যদি রাখতে পারতি এমন করে,স্নো পাউডার মেখে সোন্দর কাপড় পরে রইতি তুই ঘরে!!আমি খাটতে যেতাম।পটলাটা খিচড়ি ইস্কুলে যেত।”
ফুলমতি হরেনের মাথায় হাত রেখে বলে-” দুর…,মোর এই ভাল বটে।খেটে মরি মরদের সাথে তাল ঠুকে।তুই যেথায় যাস তোর পিছু পিছু গিয়ে ঘর বাঁধি। সারাদিন তোকে ছেড়ে থাকতে নাই পারব বটে।”
গলা খাঁকারি দিয়ে মদন আসে দীঘি পাড়ে।ধোয়া বাসন হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায় ফুলমনি।

দুই- তিন হাত দূরে দূরে এক একটা তাবু গেড়ে শ্রমিকের দল রাত কাটায়।রাতেই রাঁধে বাড়ে। সকাল, দুপুর সেই বাসি ভাতে জল ঢেলেই আহার সারে।গ্রামের সীমায় নিধিরামের চা জলখাবারের দোকান আছে ।সেখানে ঘুগনি মুড়ি,ডিমটোস্ট, তেলেভাজা রমরমিয়ে বিকোচ্ছে। কিন্তু তাতে পেটের জ্বালা মেটে না তাদের।মাঝে সাঝে মুখ বদলের খাবার ওসব।

এখন মধ্যরাত,চারিদিকে ঝিঝির আওয়াজ, বাদুড়ের ডানা ঝাটপটানি।দম হাঁসফাস করা গুমোট গরম। দীঘির পাড়ে লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া সব বৃক্ষরাজি-বট,শিরীষ,জাম এক পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হালকা তালে দোল খায়।শিরীষ গাছের ফাঁক গলে বাঁকা চাঁদ মাঝ আকাশে হানা দেয়।বিন্দু বিন্দু নক্ষত্রের ঝলমলে আলো লক্ষ যোজন দূরেই হারিয়ে ফেলেছে পথ।
ক্লান্ত মজুরের দল যে যার তাবুর বাইরে পড়ে রয়েছে গাদাগাদি করে। গরম নিঃশ্বাসে ভারী হয় চারিধার।দূরে তাল গাছের মগডালে বসে হুতুম পেঁচা ডেকে ওঠে। ফুলমনি সদ্য পোয়াতি, সারাদিনের ধকলে ঘুমে বিভর।পাশে পটলাটা শুয়ে রয়েছে মায়ের গায়ে ঠ্যাং তুলে।হরেনে চোখে আজ ঘুম নেই।কি যেন অশনি সংকেত দিচ্ছে তার মন।নিধিরামের দোকানে আলোচনা হচ্ছিল সে শুনেছে সেদিন।আঙরাভাসির আকাশে বাতাসে চাপা গুঞ্জন। নতুন দল মাথা চাড়া দিতে চায়,তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে খুব। তার মন বলে খুব তাড়াতাড়ি কোন গোলমাল হবে এখানে।ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে হরেন।তাতে তাদের কি! মানে মানে কাজ শেষ করে কেটে পড়তে পারলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।
পান্নালালকেও তার বড় সন্দেহ জাগে। লোকটা ঠিক সুবিধার নয়।একে তো মাগীখোর তার ওপর নেতাদের সাথে ওঠাবসা। ঘুমের ঘোরে ফুলমনি পাশ ফিরে ঠ্যাং তোলে হরেনের ওপর।চিন্তার মোড় ঘুরে যায়।আর কদিন পরে ফুলমনি বিয়োবে,এবার নিশ্চয় মাইয়াছেনা হবে! মা মুখী, বাপ সোহাগী মাইয়াছেনা।পটলা তো হল বাপমুখী আর মা সোহাগী। ভাবতে ভাবতে ছেঁড়া ছেঁড়া  সুখের আমেজে তন্দ্রা জড়িয়ে ধরে চোখের পাতায়।

হঠাৎ চমকে ঘুম ভাঙে। ‘দুম…. দুম….’ প্রবল বোমা পড়ার শব্দ।ভোটের আগে আঙরাভাসি গ্রামে দুচারটা বোমা পড়ার শব্দ নতুন কিছু না।কিন্তু আজ যেন একটু কাছ থেকেই আসছে আওয়াজটা।হরেন ও কিছু শ্রমিক ছুটে যায় সেদিকে।ওদিকটাতেই তো রাস্তা তৈরির কাজ চলছে কদিন থেকে।পড়ে রয়েছে মেসিন পাতি সব ওখানেই।
কিছু লোক শাবল,কোদাল,কুঠার, নিয়ে সদ্য হওয়া রাস্তা খুঁড়ে ফেলছে। পিচ গলা মেসিন আর জি পি এস টাতেও তারা হামলা করেছে।হরেন,বিধু,কানাই,জগা সব ছুটে গেল সেখানে।
-“তোমাদের গ্যারামের রাস্তা হইছে,কেন নষ্ট কর গো।”বিধু ভয়ে ভয়ে বলে।
-“এই তোদের কাজের ছিরি! এমন ভেজাল জিনিস দিয়ে রাস্তা বানাস!শুধু টাকা মেরে খাওয়ার ধান্দা।”একজন নেতা গোছের লোক এগিয়ে এসে বলে তাদের।
হরেন মৃদু গলায় অনুনয়ের সুরে বলে -“আমরা তো মজুর বটেক,এসব বাবুরা জানে।”
-“আর তোমরা কিছু জাননা না! জান না তোমরা কেমন মালমশলা দিয়ে রাস্তা হয়! পিচের স্তর এত পাতলা কেন?”
একজন চেচিয়ে বলে ওঠে -“বেঁধে রাখ সব মজুর গুলাকে।কান টানলেই মাথা আসবে।”
আর একজন বলে -“সব মজুর এখানে আসেনি।ধানঘরা দীঘির ধারে তাবু দিয়েছে সব। সেখান থেকে বাকিদের তুলে আন।শালা কাজে ফাঁকি,আজ ফাঁকি ঢুকিয়ে দিব গ্যাড়ে।”

চমকে ওঠে হরেন।ফুলমনির পেট ভারী,পটলা তো ছেনামানুষ।হাতে পায়ে ধরে উদ্ধত জনতার সে।-“ছেড়ে দাও বাবারা।বউ ছেনা লয়ে কাজে আসছি।মোরা গরিব মানুষ বটেক।কুথায় কি ভেজাল মিশছে তাতে মোদের কি লেনদেন! ঠিকাদার বাবু জানে উসব।”

-“আর তোরা কিছু জানিস না, ন্যাকা সব।পাশের গাঁ ফিরোজা গঞ্জে রাস্তা হল আগের বছর, তখন তো তোরাই ছিলি,ছিলি কিনা বল?”ফুঁসে ওঠে একজন ভিড়ের মধ্য থেকে।

কানাই বলে-” মু ছিলি বাবারা, কিন্তু আমাদের সকলে ছিল নাই।”
-“কারা কারা ছিল হাত তোল।”
কানাই আর বিধু হাত তোলে।
-“সেখানে কি এই ভাবে রাস্তা হয়েছিল, সত্যি কথা বল তো।”
বিধু মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বা না -কি বোঝাতে চাইল বোঝা মুশকিল।

তার মাথা নাড়াকে সম্মতিসূচক চিহ্ণ ধরে নিয়ে নেতা গোছের লোকটি বলল -“তবে এখানে যখন ভেজাল মিশিয়ে রাস্তা হল তোরা প্রতিবাদ করিস নি কেন? আবার বলিস আমরা গরিব মানুষ কিছু বুঝি না! ডাক তোদের বাপকে।সেই এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।”
দলের কয়েকজন যুবকের উদ্দেশ্যে বলে সে –  “বাঁধ তো ব্যাটাদের।যা কয়েকজন ধানঘরা দীঘির পাড় থেকে চুলের মুঠি ধরে টেনে আন মাগীগুলা কে।তাদের ছাড় দিতে হবে কেন ,তারা কি এই রাস্তার কাজ করেনি!”

-“খবরদার বাবুরা,পরিবারের দিকে হাত বাড়াবি নাই,আমাদের সাথে যা পারিস কর।”গর্জে ওঠে হরেন।

উত্তেজিত জনতার কয়েকজন ছোটে দিঘীর দিকে।হরেন হঠাৎ একজনের হাত থেকে কুঠার কাড়িয়ে ধেয়ে যায় তাদের দিকে।ছুটে গিয়ে সামনে রাস্তা ঘিরে দাঁড়াল সে।
-“খবরদার, উদিকে আর একপাও এগাবি নাই।নইলে কুপিয়ে দু-টুকরা করব সব ব্যাটাকে।” ওপরের দিকে হাত তুলে কুঠারটাকে শূন্যে ঘোরাতে লাগল সে।উত্তেজিত জনতা ভয়ে পিছিয়ে এল কয়েকপা।

তারপর ‘দুম.. ‘ করে আকাশ কাঁঁপানো এক শব্দ হল।চারিদিকে কালো ধোঁয়া আর চিৎকার।রাতজাগা পাখিরা ডানা ফড়ফড় করে কর্কশ আওয়াজে বিপদের সংকেত দিতে দিতে উড়ে গেল। কিছুক্ষণ সবাই স্তম্ভিত।ধোঁয়ার রেশ কাটতে দেখা গেল বুনো শুয়োরের মত মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছা হরেন।হাঁটু থেকে একখানা পা আলগা হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে ধুলোয়।সামান্য একটু মাংস চামড়া যুক্ত করে রেখেছে সেটাকে হরেনের শরীরের সাথে। রক্তের বন্যা বয়ে যেতে লাগল।
সাথে সাথে পুলিশের গাড়ি ঢুকল চার পাঁচ খানা।পিছনে পান্নালালের গাড়ি।দারোগা বাবু শূন্যে দু রাউন্ড গুলি ছুঁড়তেই জনতার ভিড় ছত্রভঙ্গ হল। যে যেদিকে পারল ছুটতে লাগল।বিরোধী পার্টির দু – এক জন, যারা জনতাকে একত্রিত করেছিল তারা দাঁড়িয়ে ছিল তখনও।
পুলিশ তাদের এরেস্ট করতে যাচ্ছিল। পান্নালাল বাঁধা দিয়ে বলল -“আরে মশায়, থাক থাক আর ওদের ধরা কেন! আমারই দোষ, লেবাররা সব ফাঁকি দিয়ে গেছে কাজে।আমিই ব্যস্ততার জন্য এদিকে নজর দিতে পারিনি।এবার থেকে সরে জমিনে কাজ কর্ম আমিই সব খুঁটিয়ে দেখব।”

আড়ালে দুইপক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া সমাপ্ত হতে হতে পূবের আকাশ রক্তিম হল।হরেনকে ঘিরে ধরেছিল সব মজুরের দল।ফুলমনি ও দলের বাকি বউ বাচ্চা ছুটে এসেছে অনেকক্ষন। ফুলমনি নিজের পরনের কাপড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেঁধে চলেছে ক্ষতস্থান।রক্তের ধারা বইতে বইতে শুকিয়ে গেছে  ।হরেনের গোঙানি এখন কমে এসেছে।খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে সে। ফুলমনি বারবার ছুটে গেছে আলুথালু কাপড়ে পান্নালালের কাছে।
-“ওই বাবু মরদটা মোর মরে যাবে গো।নিয়ে চল না হাঁসপিতালে।নিয়ে চল না রে বাবু।”
পান্নালাল এগিয়ে এসে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয় তাকে।
-“দাঁড়া চারপাশটা একটু পরিস্কার হোক।হাসপাতাল এখান থেকে কুড়ি কিমি হবে।এত রাত্রিরে সেখানে ডাক্তার নার্স কেউ থাকেনা।ভোর হলেই নিয়ে যাব তাকে।কিছু হবে নি মরদের তোর।যা কাছে গিয়ে বস গে যা।”
মন মানেনি ফুলমনির।কেঁদে গেছে সে হরেনের গোঙানির সাথে তালে তাল মিলিয়ে। একটু দুরে বসে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে রয়েছে পটলা বাপ মা এর দিকে।বাকি মজুরের দল লতাপাতা জড়িবুটি যে যা ঔষধির খবর জানে তাই খুঁজে এনে রস চিপে চিপে হরেনের ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করছে।

পান্নালাল গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে গেল হরেন আর ফুলমনিকে হাসপাতালে।শরীর তার রক্তশূন্য। ডাক্তার মৃত ঘোষনা করল। হরেনের মৃতদেহ আঁকড়ে নিয়ে ফুলমনি ফিরে গেল আঙরাভাসি গাঁয়ে।গ্রামের অনতি দূরে পোড়ানো হল তার দেহ।

PHoto :SimpleSite

ফুলমনি বসে রয়েছে চিতার একটু দূরে আনমনে।গায়ে লেপ্টে রয়েছে তার আগের রাতের পরে থাকা ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাল সুতার শাড়ি।বাতাস বইছে শনশনিয়ে।কেঁপে কেঁপে উঠছে চিতার আগুন।গ্রীষ্মের দুপুরে তপ্ত বাতাস ফুলমনির কানে ধাক্কা মারে।যেন বলে যায় চুপি চুপি আগের রাতের মতই
-“বউ এই লাল শাড়িতে তোকে বহুত মানায় বটে। ”

বাবার চিতায় আগুন দিয়ে নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে পটলা অনেক আগেই।এখন সে ব্যস্ত রাস্তার ধারে পড়ে থাকা স্টোন চিপস, আর বড় বড় পাথর খন্ড একে একে তুলে এনে তাদের তাবুর এককোনে জড়ো করতে।পরে সময় করে সেও একখানা বানিয়ে ফেলবে পিচরাস্তা। তাবু থেকে দিঘির পাড় অবধি।সেই রাস্তা বেয়ে তার মা যাবে দিঘির পাড়ে বাসন ধুতে আর বাপ যাবে লন্ঠন নিয়ে আলো দিতে।মনে মনে ভেবে সে পুলকিত হয় মা বাপে তার কত খুশি হবে পটলার কেরামতি দেখে।

জরা, শোক,মৃত্যু কোন কিছুই পেটের থেকে বড় নয়।আগের থেকেও দ্রুত বেগে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে কাজ।হাতে আর পাঁচদিন সময়।রাস্তার কিছু অংশ ঘুরে মেরামত করতে হবে।দলে লোকও কমেছে।ফুলমনি রয়ে গেছে তাবুতেই।পোড়ামুখীর চোখের জলটুকুও যেন কেড়ে নিয়ে গেছে কেউ! দুদিন ধরে শতছিন্ন লাল কাপড়খানি গায়ে জড়িয়ে রয়েছে সে।কে সান্ত্বনা দেয় তাকে! কে বোঝায় নিয়ম নীতি! বিধবার যে লাল পরতে মানা!খেটে খাওয়া মজুরের দলের কাছে এখন নিশ্বাস ফেলার টাইম নেই।

সন্ধ্যা হতে চলেছে  তবু কাজের বিরাম নাই।আজ রাত দশটা অবধি কাজ হবে ঠিকাদার বলে গেছে।ফুলমনি বসে রয়েছে তাবুর দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।পাশেই ধুলায় পড়ে ঘুমাছে পটলা।পান্নালাল এসে দাঁড়ায় তাবুর সামনে। দু-চারবার হাঁকডাক দেয় সে।কোন সাড়া নেই।মাথা ঝুঁকিয়ে ঢুকে পড়ে তাবুর ভিতর।ফুলমনি বসে থাকে একই ভাবে।বুক থেকে আঁচল খসে পড়েছে তার।উস্কোখুস্কো চুলের রাশি কোমর পর্যন্ত লুটিয়ে রয়েছে,চোখের দৃষ্টি ফ্যাকাসে। অন্তর্বাসহীন ব্লাউজ তার যৌবন লুকিয়ে রাখতে অক্ষম।পান্নালাল লোলুপ চোখে চেটে নেয় তার যৌবন।

হরেন মরায় ফুলমতি এখন চাবিহীন সিন্ধুকে পড়ে থাকা রত্ন সম্ভারের মতই।যত ইচ্ছা লুটে নাও।কেউ বাধা দেওয়ার নেই।পান্নালাল এগিয়ে এসে গা ঘেঁসে বসে ফুলমনির।মাথায় হাত রেখে বলে -“তোর চিন্তা নেই রে ফুলমনি।মরদ তোর আমার কাছে কাজ করতে গিয়ে মরেছে।আমি খেয়াল রাখব তোর।আমার কাছে থাকবি তুই।মরদের কোন অভাব তোকে বুঝতে দিব না।” বলতে বলতে হাত দুটো নেমে আসে বুক, পেট হয়ে উরুর ভাঁজে।হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে ফুলমতির।চমকে উঠে ধাক্কা দেয় সে পান্নালালকে।হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে ফুলমতির পায়ের কাছে।
খিঁচিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ফুলমনির ওপর -“ছিনাল শালী, মরদ মরেছে তাও তেজ কমেনি।বসে বসে আমার খাবি আর আমাকে ধাক্কা দিবি! বেশ্যামাগী আজ তোর মরদানি বার করছি দাঁড়া।”

ফুলমনিকে মাটিতে শুইয়ে তার ওপর চেপে বসে সে।একটানে ছিঁড়ে ফেলে কদিনের পরে থাকা মলিন ব্লাউজ।কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে সে  তার পুরুষ্টু স্তন যুগল।দুদিনের শোকে অনাহারে ক্লান্তিতে দুর্বল শরীর ফুলমতির। সমস্ত বল প্রয়োগ করেও পারেনা সে পান্নালালকে রুখতে।একসময় পান্নালাল সম্পূর্ণ নগ্ন করে তার শরীরের নেশায় বুদ হতে শুরু করেছে।শূন্যে দুটি হাতে তুলে নিজেকে বাঁচানোর জন্য মাটি হাতড়াতে হাতড়াতে একসময়ে নাগালে পেয়ে যায় পটলার জড়ো করে রাখা একটা ধারালো পাথর টুকরো ।তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে সে তার অপর শুয়ে থাকা অসুরটাকে।প্রবল আক্রোশে পান্নালালও গলা চেপে ধরে তার।একসময়ে মাথার পিছনে পাথরের এক মক্ষম আঘাতে ফুলমনির গলায় চেপে ধরা হাত শিথিল হয়।ফুলমনি পান্নালালের শরীরটাকে লাথি মেরে ঠেলে দিয়ে চেপে বসে তার বুকে।রক্তাক্ত ধারালো পাথর  দিয়ে তার মাথায়, মুখে আর বুকে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে আর এক বিকট ভারী আসুরিক গলায় চিৎকার করতে থাকে সে –
“মরে নাই, মরে নাই মোর মরদ,মরে নাই।এইখানে, এইখানে আছে সে ” বলে নিজের পেটের দিকে ইশারা করে।”এই দেখ, তাকায়ে দেখ”- বলে ঘুমন্ত পটলের মুখের দিকে আঙুল নিক্ষেপ করে বলে      -” এই, এই তো মোর মরদের অবিকল মুখ। মোর মরদ বেঁচে আছে ইহার মধ্যে।”বলতে বলতে ছিঁচতে থাকে সে পান্নালালের মাথা পাথরের ঘায়ে। রক্তের সাথে গলগল করে ঘিলু বেরিয়ে আসে। পান্নালালের প্রান বায়ু উড়ে যায় সেই আঘাতে।শুধু মৃত চোখ দুটি মেলে সে চেয়ে থাকে ফুলমনির রুদ্র মূর্তির দিকে।ফুলমনি মেরে চলেছে তখনও,পটলার ঘুম ভেঙে গেছে ।মায়ের সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে কেঁদে ওঠে সে চিৎকার করে।ছেলের কান্না শুনে হঠাৎ শান্ত হয় ফুলমনি।হাত থেকে খসে পড়ে তার পাথর খন্ড। তাড়াতাড়ি উঠে কাপড় জড়িয়ে নেয় গায়ে।ছেলেকে কোলে তুলে কান্না থামায়।

অন্ধকার নেমে এসেছে আঙরাভাসি গ্রামে।গুমোট বাতাসে ভেসে আসে শিয়ালের সমবেত হুক্কাহুয়া রব।মজুরেরা ফিরবে এবার তাবুতে।বেঁধে নেয় সে প্রয়োজনীয়  জিনিসপত্র পুঁটলিতে। তারপর ছেলের হাত ধরে দীঘির পশ্চিম দিকের ঝোপঝাড় আর আগাছা ভরা বিল পথ ধরে ছুটে চলে সে আঙরাভাসি থেকে দূরে বহু দূরে।

লেখিকা পরিচিতি : প্রীতি দাস,মেদিনীপুর

বিঃ দ্রঃ লেখাটি Quaterly Creative Writing Competition, June 2019 এ  দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।                                                      

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here