পরিচিতি:– লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন একজন হিন্দু সিদ্ধগুরু। বাংলা ১১৩৭ বঙ্গাব্দের (ইং ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ) ১৮ ই ভাদ্র মঙ্গলবার, জন্মাষ্টমীর দিন ২৪ পরগণা জেলার চাকলা গ্রামে (মতান্তরে কচুয়া গ্রাম) এক ব্রাহ্মণ পরিবারে লোকনাথ ব্রহ্মচারী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম লোকনাথ ঘোষাল। তাঁর পিতা রামকানাই ঘোষাল ছিলেন একজন গুপ্ত সাধক ও ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। তাঁর মাতার নাম কমলা দেবী। লোকনাথ ছিলেন তাঁর পিতা মাতার চতুর্থ সন্তান।
শৈশব জীবন:– ছোটোবেলা থেকেই লোকনাথ ছিলেন খুবই দুষ্টু। তিনি লেখাপড়ার সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্র এসব পাঠ করতেন। লোকনাথের বয়স যখন এগারো বছর, তখন বাবার আদেশ অনুযায়ী তিনি ভগবান গাঙ্গুলীর কাছে সন্ন্যাসের দীক্ষা নিলেন। ভগবান গাঙ্গুলী ছিলেন নিষ্ঠাবান সর্বশাস্ত্রজ্ঞ এক পন্ডিত। তিনি লোকনাথ ও তাঁর সঙ্গী বেণীমাধব বন্দোপাধ্যায়ের উপনয়ন কার্য সম্পন্ন করে তাঁদের নিয়ে গৃহত্যাগ করেন।
লোকনাথের সিদ্ধিলাভ:– বাংলা ১১৪৮ বঙ্গাব্দে ভগবান গাঙ্গুলী তাঁদের নিয়ে আসেন কলকাতার কালীঘাটে। তখন গভীর অরণ্যে ঢাকা কালীঘাটে তাঁরা অনেক জটাধারী সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখা পেলেন। কিছুদিন পর তাঁরা কালীঘাট ছেড়ে চলে গেলেন। ভগবান গাঙ্গুলী নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের “নক্তব্রত”শুরু করান। নক্তব্রত অর্থাৎ সারাদিন উপোস থেকে পরদিন হবিষ্যান্ন গ্রহণ করা। এভাবে বিভিন্ন ব্রত করে তিনি লোকনাথ ও বেণীমাধবকে ধ্যান ও যোগ শিক্ষা দেন। যথা– একান্তরা অর্থাৎ সারাদিন-রাত্রি উপবাস থেকে পরদিন হবিষ্যান্ন গ্রহণ করা, পঞ্চাহ অর্থাৎ পাঁচদিন উপবাস থাকা। এভাবে সমস্ত ব্রত পালনের ফলে মহাসিদ্ধি লাভ করলেন লোকনাথ বাবা। রোজ ভিক্ষা করে গুরুদেব যা খাবার পেতেন তাই তাঁরা ভাগ করে খেতেন। তাঁদেরকে বিভিন্ন রকমের কীট পতঙ্গের কামড় সহ্য করার অভ্যাস করা হয়েছে। এভাবে ৩৫ বছর ধরে চলে তাঁদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের শিক্ষা। এরপর গুরুদেব তাঁর শিষ্যের কাছ থেকে হঠযোগের কঠিন পরীক্ষা নিলেন এবং সেই পরীক্ষায় লোকনাথ উত্তীর্ণ হয়। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ লোকনাথের পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। তখন তিনি ছিলেন বর্ধমান জেলার বেড়ুগ্রামের সীতানাথ বন্দোপাধ্যায়।
ভারতবর্ষের বহু তীর্থস্থান ও হিমালয় পর্বত পরিক্রমা করে লোকনাথ, বেণীমাধব ও ভগবান গাঙ্গুলী এসে পৌঁছোলেন কাশীধামে। সেখানে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হিতলাল মিশ্র নামে এক মহাপুরুষের,যিনি পরে হয়েছিলেন ত্রৈলঙ্গ্যস্বামী। তাঁর হাতে শিষ্যদের তুলে দিয়ে ভগবান গাঙ্গুলী সেই স্থান থেকে চলে এলেন। এর কয়েকমাস পরে ভগবান গাঙ্গুলী কাশীর মণিকর্ণিকার ঘাটে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেহত্যাগ করেন। এরপর হিতলাল মিশ্র, লোকনাথ ও বেণীমাধব হিমালয়ের দুর্গম বরফাবৃত অঞ্চলে প্রবেশ করেন। সেখানে পঞ্চাশ বছর কঠিন তপস্যা করে লোকনাথ পরমব্রহ্ম লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স ৯০ বছর।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ:– ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে লোকনাথ বাবা পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন আরবের মক্কা শহরে। যাত্রাপথে মরুভূমি প্রান্তরে “আব্দুল গফুর” নামে প্রায় ৪০০ বছর বয়সী এক মুসলমান ফকিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। লোকনাথকে দেখে তার ধ্যানভঙ্গ হয় এবং তিনি তাকে আলিঙ্গন করেন।
আরবের কাবুলে “মোল্লা সাদি” নামে একজন শাস্ত্রজ্ঞ ধার্মিক মুসলমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কাবুলে থাকার সময় লোকনাথ বাবা কোরাণ-শরীফ পাঠ করতেন।
এরপর লোকনাথ বাবা,বেণীমাধব ও ত্রৈলঙ্গ্যস্বামী আফগানিস্তান,পারস্য, ইসরায়েল ইত্যাদি দেশ অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে পৌঁছেছিলেন। এরপর তাঁরা ভারতে ফিরে বদ্রীনাথ মন্দিরে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে তাঁরা পায়ে হেঁটে সাইবেরিয়া, চীন দেশ ভ্রমণ করতে থাকেন। সেখান থেকে ত্রৈলঙ্গস্বামী উদয়াচলে ও বেণীমাধব কামাক্ষ্যার উদ্দেশ্য যাত্রা করেন এবং লোকনাথ বাবা চলে এলেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে।
লোকনাথ বাবার কাহিনী:– চন্দ্রনাথ পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকনাথ বাবা ত্রিপুরা রাজ্যের দাউদকান্দি গ্রামে এসে পৌঁছেছিলেন। সেখানকার এক নিবাসী ডেঙ্গু কর্মকার ফৌজদারি মামলার দোষী হয়ে কার্যালয়ে যাবার পথে এক গাছের নীচে লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে দেখতে পান এবং তাঁকে প্রণাম করে মামলায় জয়লাভের জন্য প্রার্থনা করেন। জয়ী হয়ে ফেরার পথে তিনি লোকনাথ বাবাকে নিজের গ্রামে নিয়ে যাবার জন্য বললেন। লোকনাথ রাজি হলো এবং তাঁরা নৌকা করে দাউদকান্দি গ্রামে আসেন। তারপর সেখান থেকে তিনি চলে যান বাংলাদেশের ঢাকার গজারিয়া গ্রামে এবং তারপর তিনি হাজির হলেন সোনা ডাঙ্গার বারদী নামক গ্রামে। বারদী গ্রামের ছোটো ছোটো ছোকরারা দল বেঁধে তাঁকে তাড়া করতো। সেখানকার মানুষরা মনে করতেন, লোকটি পাগল ও নীচুঁ জাতের মানুষ।
একদিন গ্রামের কয়েকজন ব্রাহ্মণ পৈতায় গ্রন্থি দিচ্ছিল। সেখান দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলেন লোকনাথ বাবা। পৈতায় গ্রন্থি করতে দেখে তিনি সেদিকে এগিয়ে এলেন এবং তাঁকে দেখে ব্রাহ্মণরা বলে উঠলেন– “ওরে পাগল এটা ছুঁস না”। ব্রহ্মচারী জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন”যে তাঁরা কাশ্যপ গোত্র। তখন ব্রহ্মচারী বললেন– “তোদের তিন প্রবর। কাশ্যপ, অপসরা,নৈধ্রুব”। পাগলের মুখে এসব কথা শুনে ব্রাহ্মণরা বিস্মিত হলেন এবং মনে মনে ভাবলেন– “ইনি কোনো সাধারণ মানুষ নন”। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে লোকনাথ বাবাজী সাধারণ মানুষের কাছে আত্মপ্রকাশ করলেন।
লোকনাথ বাবার বাণী:– লোকনাথ বাবার কিছু বাণী হল– ১) রণে,বনে, জঙ্গলে যখন বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও আমি রক্ষা করবো। ২) যেকারণে মোহ আসে,তাকে ত্যাগ করাই ভালো। ৩) যারা আমার আশ্রিত, আমার সন্তান, তাদের অনিষ্ট করে এমন শক্তি পৃথিবীতে কারোর নেই।
লোকনাথ বাবার মহাপ্রয়াণ:– বাংলা ১২৯৭ বঙ্গাব্দের (ইং ১৮৯০ খ্রিঃ) ১৯ জৈষ্ঠ্য ১৬০ বছর বয়সে লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করেন।
কলমে হিরন্ময় চক্রবর্তী
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.