কবিদের চিন্তার জগৎ আর সাধারণ পাঠকের বোধের গভীরতা এক নয়, সমান নয়। সে কারণেই সমকালের পাঠক সমাজ অপবাদ দেন,’আমাদের কবিতা দুর্বোধ্য’। পঠিত কবিতার সিংহ ভাগই বুঝতে পারেন না। আছে আড়ালতা, প্রচ্ছন্নতা। এই আড়ালতা বা প্রচ্ছন্নতা কবিতার শত্রু নয়, কবিতার শত্রু দুর্বোধ্যতা। কবিদের চিন্তার ক্ষুরধারতা, প্রখরতা, দৃঢ়তা বা উত্তরাধুনিক মননতা পাঠকের জন্য অদৃশ্য এক দেয়ালের সৃষ্টি করছে, নতুবা সমকাল পাঠক কেনো কবিকে প্রত্যাখ্যান করবে? বোধের সাথে বিষয় না থাকলে কিংবা বোধ যদি নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনা না পায় কবিতা তো দুর্বোধ্য হবেই। কবির অন্তর্লোকের সৌন্দর্য এবং উপস্থাপন অভিনবত্ব প্রথমত পাঠক মনে এনে দেবে অজানা সুখানুভব আর সুখানুভবই উদ্বুদ্ধ করবে কবিতার অন্তর্লোকের আবিষ্কার। দুর্বোধ্যতা তখন জয় করা যাবে।
দুর্বোধ্যতার বেড়াজালে আটকা পড়ার কারণে কিংবা গভীর ব্যঞ্জনায় সরল পাঠ না থাকার দরুন বা নিষ্ঠ পাঠকের অন্তর্লোক আলোকিত না করতে পারার কারণে কবিদের সীমার মাঝের অসীম সৃষ্টির এক তিল কণাও কুড়িয়ে নিতে পারছেন না, তাই কবিরাও ব্যর্থ, পাঠকরা তো বটেই। কবিরা কথা বলেন দূরের মানুষদের সাথে, দূরের কোন সীমাহীনতার সাথে। তাঁরা জলের গভীরতা না মেপে সমুদ্রের গভীর থেকে মণি মাণিক্য তুলতে যান না। একজন যোগ্য পাঠক হতে হলে কবির কাব্য সমুদ্রে ডুব দিলেই হবে না, কেবল ডুব সাঁতার দিলেই শেষ নয়, ব্যস্ততা বা উৎকণ্ঠার ফাঁকে হৃদয়ের আবেগে এক মিনিট চোখ বুলালেই হবে না, দরকার একনিষ্ঠতা, ভাবালুতা, মগ্নতা, যা পাঠক প্রাণে এনে দেবে কবির সম্বন্ধে, কবিতার সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা, ব্যাখ্যা।
সমকালীন কবিরা কবিতা সৃষ্টি করছেন মগজের সবটুকু চিন্তা ঢেলে। কবিতার বিষয়বস্তু এলোপাতাড়ি। দূরদর্শিতাহীন। চিন্তার গভীরতা কম। পঙক্তিগুলো কাব্যময়তাহীন। ব্যঞ্জনাহীন। কাব্যাকাশে উড়ার শখ প্রবল, সেই অনুপাতে শ্রম দিতে নারাজ। পড়েন না৷ না পড়ে লেখেন। সৃষ্টি হয় নতুন ফসল কিন্তু সে ফসলের স্বাদ যেন অন্য। অন্য জিনিস মন্দও নয় বটে। কিন্তু এভাবে সেই কবি টিকছেন না দর কষাকষির বাজারে। হারিয়ে যাচ্ছেন প্রতিযোগিতার বাজারে নতুন কবির আগমনে। পিছিয়ে যাচ্ছেন সৃষ্টির ভেতর বিভিন্নতা কিংবা অনন্যতা না থাকায়। পাঠক চান মনোরঞ্জন, জ্ঞান বৃক্ষের ফল আসলে কেউ নিতে চান না। সেই সুযোগ নিয়েছেন কিছু কবি। রাতারাতি উঠে আসছেন। সুনামের ঝুঁড়িতে সুনাম ধরছে না। পাচ্ছেন উপাধি। কিন্তু আসল কবি হতে পারলেন না। পাঠকরাই তাঁকে আসল কবি হতে দিলেন না৷ হাজার অসুন্দর সৃষ্টির চেয়ে একটি সুন্দর সৃষ্টি কি শ্রেয় নয়? তাই তো কবিদের শুনতে হচ্ছে,’শ্রেষ্ঠ কবিতাটি যেন কোন ভাবেই লেখা হচ্ছে না’। এ অপবাদ, এ জ্বালা, এ যন্ত্রণা কোনো কবিকে কি পোড়ায়, ভাবায়?
সেই শব্দগুলো কি হাত ছাড়া হয়ে গেলো? কেনো শব্দ সৈনিকগণ উত্তম শব্দ চয়ন করতে পারছেন না? কেনো শব্দরা পাশাপাশি বসে একটি অনন্য সুন্দর বাক্য সৃষ্টি হচ্ছে না? বাস্তুশিল্প কখনো টিকবে না যদি না ভিত না হয় মজবুত। তেমনি কাব্যশিল্পও টিকবে না যদি কবিতার কাঠামো, ছন্দ না জানা যায়। কাব্যের ভেতর ছন্দের অবস্থান সবার উপরে। বর্তমানের কবি বাবুরা ছন্দজ্ঞানহীন। বলেন,’ছন্দ ছাড়াই শিল্প হবে, এটি নতুন ধারা’। তাঁদের এ ধারণা ভুল, তাঁদের এ উচ্চারণ ভ্রান্ত। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে তাঁরা কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, লিখুন দোষ কিসের? কিন্তু ছন্দ তো জানতেই হবে- না লিখুন ছন্দময় কবিতা। আজীবনই কি কবি অক্ষরবৃত্তে লিখে যাবেন? কোনদিনও কি স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তে লিখবেন না? সমকালীন কবি বাবুদের জানতে হবে অন্তমিলই, ছন্দই কবিতার মূল বিষয়। কবিতায় ছন্দ ছাড়া গতি নেই। তাই আজকাল কবিতা ছন্দনির্ভর নয় এই বাক্য উচ্চারণ করে নিজের অক্ষমতা ঢাকার চেষ্টা করেন না। ছন্দ না জানার যন্ত্রণায় চার দেয়ালের মাঝে আত্মপীড়ন অনুভব করেন তো বটে। ছন্দ জানেন না – আত্মসম্মানে আঘাত লাগে কিন্তু বর্ণচোরা কবিরা, কত দিন নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে থাকবেন? কবি জীবন অগোচরে যে আপনার অসস্পূর্ণ থেকে যাবে। অর্বাচীন, আর উচ্চারণ করেন না ছন্দ ছাড়া শিল্প হয়, কবিতা হয়। আপনারা যে মৃদু ঝড়ও সহ্য করতে পারবেন না।
কবিতা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নিকষকৃষ্ণ আঁধারের মাঝে থেকেও অমৃত রূপকল্প। আমি প্রেরণাতে বিশ্বাসী। কবিতা আমাকে প্রেরণা দেয়। কবিতা চিন্তার গভীরতা বাড়ায়। বিশ্লেষণে তীক্ষ্ণতা আনে। মনোজলোকে কামনা বাসনার জটিল আবর্ত সৃষ্টি করে। কবিরা উত্তম শব্দ চয়নের মাধ্যমে আমার হৃদয়ের কথা বলেন, বিহ্বলিত হই। কবিরা শব্দের সমুদ্রে স্নান করেন, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকেন। মালা গাঁথেন। সুষম পাঠক না হলে কবিতায় জন্ম নেয়া ফসলের স্বাদ আস্বাদন করা যাবে না। অবশ্য কবির প্রাণে কবিতা আসে বিশেষ ক্ষণে, কবিতা মৌহূর্তিক, তাৎক্ষণিক, হঠাৎ আলোর ঝলকানি। কবির কবিতা শক্তি শূন্যতা থেকে পূর্ণতা দেয়। কবিতা কবির বিশুদ্ধ সৃষ্টি, আশ্চর্য সৃষ্টি। কবিতা শব্দ নির্ভর, ছন্দ নির্ভর, ইমেজ নির্ভর। কিন্তু নির্ভরই। সবচেয়ে বড় অন্তমিল নির্ভর। কবিতা কখনো কখনো শ্লোগানও। সঞ্জিবনী শক্তি দেয়। প্রাণ পায় প্রাণ। কবিতা প্রতিভাকে বিকশিত করে। কল্পনা প্রবণতাকে বৃদ্ধি করে। ভাবুক করে, দূরদর্শী করে। তাই যান্ত্রিক যুগেও কিছু কিছু মানুষ হয়নি যন্ত্র। কবিতা ভালোবাসি বলেই স্বপ্নচারী কবির প্রয়োজন ফুরাবে না। কবিহীন জাতি মাটির স্তূপ। আত্মাহীন দেহর মতো। তাই চাই, আরো কবি চাই। নতুন কবি চাই। ক্ষুরধার কবি চাই। যার কলম নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উৎপাদনশীল নয়। যে কবির কলম থামবে না অনন্তকাল, তেমন কবি চাই। আধুনিক কবিদের নিয়ে আশার শেষ নেই। তাঁরা রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দকে আরো নতুন ভাবে আবিষ্কার করবেন। এক পথে হাটুক, পূর্ণতা আসবে। ছন্দ ফিরে আসুক কবিতায়। ছন্দ কবিতার হয়ে উঠুক ভূষণ। ছন্দপতন কিংবা ছন্দহীনতা লাঘব হোক। কবিরা ছন্দ সচেতন হোক, ছন্দকে বাহুল্য মনে করে নিরেট গদ্য ভাষায় কবিতা লেখা কমিয়ে দিক।
আধুনিক কবিদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কতটুকু তাঁদের কবিতা পড়ে বোঝা দুষ্কর। আবার বুঝে পাই না, নিজের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবার কি আকুতি আছে সেই কবিতায়? সত্যশীল ভাষায় অনুভবের প্রকাশ কি আদৌ আছে? যাপিত জীবনবোধের সত্য উন্মোচন কি আছে? আকাশ সংস্কৃতির দাপটে খ্যাতির মোহে কবিতায় শুদ্ধতার চেয়ে চাতুর্য চর্চা হচ্ছে বেশি। পরিশীলিতবোধের চেয়ে বিভ্রান্তবোধ হচ্ছে কবিতায়। যতি চিহ্নের ব্যবহার যথাযথ হচ্ছে না। সম্পাদকেরা কি কোন স্বজন-প্রীতির মাধ্যমে অর্থহীন, অযৌক্তিক কবিতা (কবিতা কি?) ছাপছেন? নাকি ফর্মা না পূরণের কারণে অকবিতা শেষের দিকে জুড়ে দিয়ে হাত ঝাড়ছেন? এমন অকবিতা নতুন কবিদের যেমন উঠতে দেবে না, তেমনি প্রেরণাও দেবে, একনিষ্ঠ পাঠককে হতাশ করবে, অকবিরা বলবেন, ‘এমন তো আমিও লিখতে পারবো’! সেই হবেন কবি (কবি?)!
কবিতায় দুর্বোধ্যতা এবং বর্তমানের কবিদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য আলোচনা হলো। এখন যে কাব্য সাহিত্য হচ্ছে তার আঙ্গিক, শব্দচয়ন, আবেগ, মেজাজ, মনোরম উপস্থাপনা, দার্শনিকতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। সমসাময়িক কবিরা গতানুগতিক ধারার বাইরের কবি। সহজ সরল শব্দ চয়নের মাধ্যমে লেখেন। কবিতায় আছে স্বপ্নের ছড়াছড়ি। সাহিত্যের চৌকাঠে দাঁড়াতে যে অনুভূতি শক্তি লাগে তা তাঁদের কবিতার ভেতর আসছে কি? স্বপ্নবিলাসী কবিদের অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্নরা চোখে আহ্লাদি মেয়ের মতো খেলা করে। স্বপ্নীল ভাবনাগুলো রঙিন পাখনায় ভর করে নীল আকাশে উড়ে যায়। শোক, তাপ, ক্ষুধা, ব্যর্থতা ভুলে নতুন করে স্বপ্নের নকশি কাঁথায় বুনন তোলেন পরম মমতায়। কবি জেগে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পটু, ঘুমের স্বপ্নে বিশ্বাসী নয়। ঘুমের স্বপ্নে আছে হৃদয়কে ক্ষত করার মতো অতর্কিত হানা। স্বপ্ন না দেখলে মনের বয়স বেড়ে যায়। কবিতায় মানুষের বহুরূপিতার প্রকাশ দেখা যায়। মুহূর্তের মাঝে চেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে যায়, অচেনার মতো আচরণ করে, আঘাত করে। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না। মানবতার ভিত্তি ভূমি মূল্যবোধ। মূল্যবোধের প্রথম সোপান বিশ্বাস। বিশ্বাসকে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। বিশ্বাস ছাড়া ধার্মিক হওয়া যায় না। বিশ্বাস ছাড়া সামাজিক জীব হওয়া যায় না। বিশ্বাস ছাড়া মানুষও হওয়া যায় না। যে মানুষকে বিশ্বাস করে না সে নিজে বিশ্বাসী নয়, সে মানুষও নয়। সুষম শব্দচয়ন করে রিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরি করে কাব্য উঠানে সত্যকে উপস্থাপন পূর্বক কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য পাঠককে বিশ্বস্ত করে তুলবে তেমন কবিতা লেখা হচ্ছে না।
নারীর মন মানসিকতার উন্নয়ন, নারীর বিপদে পড়ার আখ্যান-উপাখ্যান কিংবা নারী কি নিজেই নিজের বিপদের রচয়িতা? সমকালীন কবিদের কবিতা জুড়ে এ সংক্রান্ত চিন্তা চেতনা বড় অংশ জুড়ে। নারীর প্রতি বৈষম্য, অনাচার, অত্যাচার প্রতিবাদস্বরূপ কবিতায় নিপূণভাবে চিত্রিত হচ্ছে। নারী মুক্তি পেতে চায়, শৃঙ্খল ভাঙতে চায়, নিজ পায়ে দাঁড়াতে চায়। কন্যা নামক স্টিকার কপালে এটে আর থাকতে চায় না। অদৃশ্য মোহিনী শক্তির সাথে মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে তারাও দেশ ও দশের জন্য কিছু করতে চায়। সবাই নারী মুক্তিতে বিশ্বাসী, কিন্তু কেউ মুক্তি দিতে চান না। কবিদের কবিতায় বিষয়টি বহুমাত্রিকতায় প্রকাশমান।
বিশ্বায়ন যখন দ্বারপ্রান্তে কড়া মেরে মেরে অস্থির তখনই তো এক শ্রেণির পুঁজিবাদেরা স্বার্থ হাসিল কল্পে টোপ ফেলে উন্নয়নশীল দেশের সর্বস্ব লুট করে চলে যাচ্ছে অস্ত্র ছাড়া, জোর-দবস্তি ছাড়া, বুদ্ধি দিয়ে। সাহায্যের নামে ঢুকে সম্পদ লুটে ভাগছে। গণ্ডার তো তারাই। পুঁজিবাদীদের তাণ্ডব নৃত্যে তৃতীয় বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভুক্তভোগী। তাঁদের উত্তরণের কোন পথ খোলা নেই। বেঁচে থাকার জন্য ধার-দেনা, সাহায্য গ্রহণ। দিনে দিনে দেনা বাড়ে, কপালে ভাজ পড়ে। কবিরা বিষয়টি কলম দিয়ে ছত্রে লিখে প্রতিবাদ করছেন। বহুমাত্রিক উপমায়, প্রতীকি চিন্তন দিয়ে অসংগতির প্রতিবাদ করে চলেছেন এই কবিরাই।
জীবন এখন যন্ত্রের চেয়েও অন্য কিছু। কম্পিউটারাইজড হয়ে যাচ্ছে সব। মোবাইলের বাটন টিপে সব কর্ম সম্পাদন করছেন। উচ্চ আকাঙ্ক্ষা, চায় সাকসেস, বেগবান জীবন, আল্ট্রা মডার্ন, রুচিহীন পোশাক-আশাক, অবাধ বিচরণ, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, জাংক ফুড, ফাস্ট ফুড, অতিভোগে অজীর্ণ, মাত্রাছাড়া অ্যাম্বিশন, প্রাণপাত খাটুনি, নজর উর্ধ্বমুখী, ক্যারিয়ার বিল্ডআফ -সবাই তার জন্য দৌঁড়াচ্ছেন। লাগামছাড়া জীবন। এক একটি যন্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছেন সকলে। মন হৃদয় নেই। কবিদের এই ইঁদুর দৌঁড়ের জীবন অপছন্দের। এ যান্ত্রিকতা চান না। তার চেয়ে বরং নৈঃশব্দ্য জীবন চান যেখানে কৃত্রিম আলোর ঝলকানি থাকবে না, যেখানে যান্ত্রিকতা থাকবে না। কবিদের কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে মুক্তোর দানার মতো সাজানো থাকে শব্দের পরে শব্দের যোগে অমূল্য প্রতিবাদস্বত্তা এই যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, সজীবতার পক্ষে।
অন্ধকার অন্ধকারই। অন্ধকারকে সবাই ডরাই। শিহরে উঠেন সকলে। এখন আর ভূত নেই। ভূতগুলো রূপ নিয়েছে সন্ত্রাসে। কাজের সামনে আসে নানান বাঁধা। নানান প্রতিকূলতা। কিন্তু এই প্রতিকূলতা জয়ের মধ্য দিয়ে আসে জীবনের স্বার্থকতা। জীবন হেরে যাওয়ার নয়। অসাধ্য সাধনের নামই জীবন। পৃথিবীতে অসাধ্য কোন কর্ম নেই। একনিষ্ঠ সাধনা বলে জয় সম্ভব। কবিগণ তারই জয়স্তুতি কবিতার ফ্রেমে গাঁথেন। নিখুঁত অনুভূতিকে কাব্যকথায় গেঁথে দৃশ্যমান করেন পাঠকের সম্মুখে। পাঠকের হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ।
জীবন অনেক বড় দৌঁড়। জীবন চলার পথ মোটেও সহজ সরল নয়। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ শ্বাপদ সংকুল পথ কণ্টকাকীর্ণ। পথ চলতে চলতে পথ ভুল হয়ে যায়। অনেকে অর্থ লোভে বিপথে পা বাড়ায়। আদর্শিক মানুষের পথ কখনো ভুল হবে না। পথ ভুল হয়ে গেলেই কবির লেখা পথ প্রদর্শক হয় সম্মুখে। পথভ্রষ্ট নিষ্ঠপাঠক হলে চিত্তের পরিবর্তন হতে বাধ্য। চিত্তের মৌনতায় দ্রোহ আসবে, ব্যক্তিমনের অন্তর্লোকের উদঘাটন হবে, ফিরে পাবে দিশা।
অনেক কবি আছেন প্রচারের ডামাডোলের বাইরে নিভৃতচারী। উদার মানবতাবাদী, কাল ও সমাজ সচেতন, প্রগতিপন্থী। যারা কবিতাকে উপস্থাপন করেন অস্তিত্বের মর্মমূলে। প্রকৃতির সাথে মিশে থাকে কবিস্বত্তা। কাব্যভাষায় নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্যতা দিয়ে ভাব প্রকাশ করেন, যে কবিতায় প্রকৃতির ছোঁয়া মোটেও কম না। নগর জীবনের যান্ত্রিক কোলাহল, দ্বন্দ্ব, জটিলতামুক্ত কবি কবিতা লেখেন প্রকৃতির এক স্বজনী হয়ে। কবিতায় একদিকে নিঃসঙ্গতার অন্তর্দ্বন্দ্বের নান্দনিক চিত্রায়ণ, অন্যদিকে নেই নেই সর্বস্ব মানুষের অস্তিত্ব ভাবনার প্রাঞ্জ চিন্তার প্রকাশ যার বিষয়াংশ, ভাব পরিমণ্ডল এবং প্রকরণ প্রকৌশলের বিবেচনায় বাংলা সাহিত্য ধারায় নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্রের পরিচয়বাহী। মানুষ অনবরত অন্যায় করে চলেছে। তবুও নিজের কাছে নিজের আত্ম-জিজ্ঞাসা নেই কেনো অন্যায় করছি! কেনো সমাজের একজন কীটে পরিণত হচ্ছি। কবিগণ সেই মানুষদের বিরুদ্ধে কলম ধরছেন। উষ্মা প্রকাশ করছেন।
বাস্তববাদী কবিরা কবিতাকে জীবন অস্তিত্বের সংরাগ আর অভীপ্সার আগ্নেয় উদ্ভাসন বলেই উপস্থাপন করছেন। জীবনের টানাপোড়েনকে কাব্য ভাবনায় দাঁড় করাচ্ছেন। শব্দ কুড়িয়ে কবিতায় ভাস্বর্য তৈরি করছেন। যে কবিতার অবয়ব জুড়ে রয়েছে বজ্র-বারুদ, কখনো বা রয়েছে নৈর্ব্যক্তিক মানসিকতা, কখনো বা জাতিস্বত্তা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রয়েছে ব্যক্তি জীবনের সংঘাত, সংগ্রাম, সমস্যা, সংকট, গ্লানি ঘৃণা, দহন-পীড়নের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা।
সমকালের কবিতায় যে দৃশ্যমান সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করা যায় না। কবিতা বাস্তব নয় (!) আবার তাকে অবাস্তব বলাও ঠিক হবে না। সে হিম্মত কারো নেই। কবিতা সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত বটে কিন্তু একবার, দু বার পড়ে আবিষ্কার করা দুরুহ বটে। বিস্ময়কর অনুভূতি সিক্ত শিল্প কবিতা পড়ে মুগ্ধ হই। হাতের মুঠোয় থেকেও কবিতা কেনো যেনো অধরা থেকে যায়। দৃষ্টিগ্রাহ্য বটে কিন্তু যেনো অদৃশ্যের অন্ধকারে। এজন্য পাঠক প্রাণে এক প্রকার সত্যিকার হাহাকার। অনেক খেয়েও ক্ষুধার্ত থাকার মতো। নিরবিচ্ছিন্ন মগ্নতা, এক ধরনের নিবিড় সাধনা এবং ধ্যান না থাকলে তা বোধগম্য হয় না।
কেউ কখনো তাঁর নিজের স্থান ছাড়তে চান না। কেউ পদস্খলন চান না, চান ক্রমোন্নতি। তেমনি কেউ এ ধরাধাম ছেড়ে যেতে চান না। যদি সেশনজটে পড়ে আরো দুটো দিন থাকা যায় এমন আক্ষেপ থাকে। প্রত্যেক কবিই কবিতার মধ্য দিয়ে এ বিশ্ব মাঝে অমর হওয়ার বাসনা লিপ্ত থাকে, থাকে কীর্তি লাভের আশা ও আক্ষেপ।
কবিতা কুড়িয়ে পাওয়া সোনা। সোনা অবশ্য সকলে চেনেন না। সোনা চিনতে হলে জহুরির চোখ চায়। তাই যত কবিতার গভীরে প্রবেশ করা যাবে ততই পাওয়া যাবে অমূল্যখনি। আর সেখান থেকে অমূল্য নিয়ে পালাতে দোষ নেই।
কবিরাই তো সাহিত্য আকাশের ধ্রব-পুরুষ। অনেকে সাহিত্যের সকল শাখায় স্বাচ্ছন্দ্যে পদচারণা করছেন। সব দিকে হাটাচলা করলে পূর্ণতা পাওয়া কষ্টকর হয় বটে। অধিকাংশ কবি স্বপ্নবিলাসী রোম্যান্টিক অর্থাৎ তুমি ভিত্তিক কবি, প্রেমের স্পর্শে কবিদের সংবেদনশীল হৃদয় অনায়াসে সাড়া দেয়। প্রেম এবং নারী কবিতায় ব্যাপক এলাকাজুড়ে আছে। বিরহের মাধুর্য কবিতায় অন্যতম শিল্পিত সৌরভ ছড়ায়।
প্রত্যেক কবিই বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সৃষ্টি করছেন। গুণীজন বলছেন তাঁদের এ কবিতা টিকবে না। টিকবে কি টিকবে না এ বিতর্ক করা অমূলক। তাঁদের দার্শনিকতা, উপলব্ধি ক্ষমতা, চিন্তা চেতনা ও ধীশক্তিতে যা সৃষ্টি হচ্ছে তাকে নমস্য ও সাধুবাদ জানানো দরকার। তাঁদের কলমের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে দেশপ্রেম, রাজনীতি, প্রেম ভালোবাসা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, কলহ, হতাশা, দারিদ্র্যতা, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা। আঙ্গিক কল্পনায় অভিনবত্ব ও নজর কাড়া ভাষা প্রতিভা। যদিও দুর্বোধ্যতা থাকছেই।
ভালো লাগছে সমকালীন কবিরা লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটলেও তাঁদের কাব্য চর্চার বিরাট স্থান জুড়ে রয়েছে বিশ্বায়ন নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, নগর জীবনের প্রেম-যৌনতা, জীবনের ব্যর্থতা, হাহাকার, সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিকার, স্থূলতা, নৈরাজ্য, আত্মগ্লানি, ব্যক্তিক দ্বিধা, সর্বোপরি দেশ ও ঐতিহ্য। অত্যাধুনিক যুগের কবিরা মূলত উত্তর অাধুনিকতার কবি। ছন্দবিমুখ সংগত কারণেই তাঁরা। পুরাতন প্লাটফর্ম ভেঙে নতুন করে তাঁরা যা গড়ছেন মন্দ তো না। ছন্দ বিশেষজ্ঞ নাক সিটকাবেনই সংগত কারণে। কারণ কবিতা শৈল্পিক হয়ে উঠে ছন্দ শর্ত অনুসরণের মধ্য দিয়ে। একে প্রথা ভেবে বর্জনের চেষ্টা করা ঠিক নয় বটে। তবে বর্জন করলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। তবুও সব শেষে বলবো ছন্দময় কবিতার জয় হোক।